গ্রামের স্কুলে পঞ্ছম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর আমাকে স্কুল বদলাতে হয় কারণ ওই স্কুলে পঞ্ছম শ্রেণীর পর আর উপরের কোন ক্লাস ছিল না। আব্বা বললেন, গ্রামেই আরেকটা স্কুলে ভর্তি করায়ে দেই। মা বললেন না! ছেলেকে শহরের স্কুলে ভর্তি করায়ে দিব। ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়ে ভর্তি হলাম বগুড়া জিলা স্কুলে। ক্লাস সিক্স। সেই তো শহরে আসা। এরপর শহর আর আমার পিছু ছাড়ল না। সেই শহর থেকে আরেক বড় শহর...। এভাবেই এতটি দিন...।
আমার নানা ছিলেন বগুড়া ইয়াকুবিয়া স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক। নানা উনার নাম সব সময় লিখতেন এভাবে, মোঃ ফজলার রহমান, বি এ, বি টি। এই বি টি ডিগ্রীটা উনি ব্রিটীশ পিরিয়ডে ঢাকা কলেজ থেকে নিয়েছিলেন বলে গর্বটা একটু বেশিই ছিল। চাকুরি জীবনে তিনি অনেক স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। এক স্কুলে বেশি দিন চাকরি করতে পারেন নি । আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার জন্য অনেক বার উনাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে, গিয়েছেন নতুন জায়গায়! যতদিন নিজের সম্মান বাঁচিয়ে রেখে কাজ করতে পেরেছেন, করেছেন; যখন পারেননি প্রতিবাদ করেছেন, শেষ পর্যন্ত চাকরিও ছেড়ে চলে এসেছেন এরকম উদাহরণ অনেক আছে। আমার ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় উনার বয়স ছিল ৭৫ এর মত। অবসর নিয়েছেন অনেক আগেই, কিন্তু তখনও অনেকটা তেজী ভাব শরীরে । জিলা স্কুলে পড়ার সময় নানা আমাকে ইংরেজি পড়াতেন। নানার বাড়ি ছিল গ্রামে। ওই বয়সে প্রতিদিন বিকালে আমাদের বাসায় আসতেন আর যেতেন সন্ধ্যায়। নানার কথার অনেকটা জুড়েই থাকতো দার্শনিক কথাবার্তা। আমি তখন তার অনেক কিছুই বুঝতাম না। হাসতাম। যেমন যে কথাটা উনি বেশি বলতেন, “বস্তু জগত ধ্বংস হবে। বস্তুর প্রতি মায়া বাড়ায়ে লাভ নাই।" মাঝে মধ্যেই আমাকে তার হাত- পায়ের জড়ানো চামড়া দেখিয়ে বলতেন, “তোর কি বিশ্বাস হয় একদিন আমি তোর মত ছিলাম”? আমি কিছু বলতাম না। নানার এসব কথার অর্থ ধরার মত জ্ঞান তখন আমার ছিল না। আমি শুধু হাসতাম।
এই লোকটি, আমার পরীক্ষা হলে বাসায় এসে বসে থাকতেন প্রশ্ন দেখার জন্য, রেজাল্ট অথবা পরীক্ষার খাতা দিলে সেদিন রোদ-বৃষ্টির মধ্যে স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে থাকতেন। মোটা ফ্রেমের চশমায় স্কুলের অনেক ছাত্রের মধ্যে তিনি ঠিকি আমাকে খুঁজে নিয়ে বলতেন “ভাই! কি খবর তোর?”
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বয়সের ভারে নানা একেবার অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন। বাসা থেকে বেরুতেন না। গ্রামের বাসায় একটা খাটের উপর সারাদিন শুয়ে থাকতেন আর বই পড়তেন। হঠাৎ কোনদিন আমি যদি যেতাম, নানা লাফ দিয়ে উঠতেন বিছানা থেকে। উচ্ছৃসিত কন্ঠে বলে উঠতেন “ কি রে ভাই......!” দেখা করে আসার সময় আমার দিকে চেয়ে এই কথাটা প্রতিবারি বলতেন, “কোন দিন এসে দেখবি চলে গেছি রে ভাই !" আমি হাসতাম। নানা, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে কেন!
বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষে আমার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোন করে মা কান্নাকাটি করে বললেন বাবা, “তোর নানা আর...।" আমার সেদিন সাথে সাথে বগুড়ায় রওনা দেবার কথা ছিল ।আমি দিতে পারিনি, পরদিন সকালে টার্ম ফাইনালের পরীক্ষায় অংশগ্রহন সন্ধ্যায় বগুড়ায় যাবার চাইতে আমার কাছে তখন যে বেশী গুরুত্বপূর্ণ................!!
এই বস্তুজগতের মায়া ছাড়া কী এত সহজ......................................!!!!!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





