সাংবাদিকতায় তখন আমি শিশু। ভালো কলেজে পড়াশুনো করার সুবাদে কিছু প্রফেসরের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। যেমন আমার মাস্টার মসাই ড. অলোক রায়। তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলার প্রধান ছিলেন। এটা ওনার ক্ষুদ্র পরিচয়, বৃহৎ পরিচয় পাঠক তাঁর নিজের স্বার্থে জেনে নেবেন। ওটা আমি গোপন রাখছি। বলতে পারেন ইচ্ছে করে। উনি আমার জীবনের দিশা এখনো পর্যন্ত। স্যার যখন এম.এ পরেন তাঁর বন্ধু ছিলেন সুনীল (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়), শীর্ষেন্দু (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়), শক্তি (শক্তি চট্টোপাধ্যায়), শ্যামল (শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়), বরেন (বরেন গঙ্গোপাধ্যায়), অতীন (অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়) আরো কতো জন। নাম বলে শেষ করা যাবে না। নিঃসন্তান স্যারের কাছ আমি পুত্রবৎ। ফলে আমার অবাধ বিচরণ সবার কাছে।
স্যারের হাত ধরেই সাংবাদিকতায় আসা। এখানে আমার দেখা কিছু ব্যাক্তিত্বের কথা আপনাদের জানাবো। বলতে পারেন জীবনের বাইরে জীবন।
যেকোন ক্রিয়েটারের মধ্যে একটা পাগলামো থাকে। আপাত দৃষ্টিতে আমরা বলি পাগল, কিন্তু তা নয়। ওটা তাঁর অন্তরের সৃষ্টির যন্ত্রণা। কেউ যদি কোনো সন্তান ধারণকারী কোনো মহিলাকে মা হতে দেখেন, দেখবেন সৃষ্টির আনন্দে তিনি কতোটা পাগল (সেই প্রচন্ড গর্ভযন্ত্রণা)। সৃষ্টি করার পর তাঁর আনন্দটাও পাগলামীর মধ্যে পরে।
আমি এমনি কিছু ব্যক্তিত্বের কথা আপনাদের জানাবো। বলতে পারেন আপনাদের সঙ্গে নিজের ভালোলাগাটাকে শেয়ার করবো।
অফিসে বসে লিখছিলাম। হঠাৎ ফোন।
অনি তুই কোথায় রে।
অফিসে।
কেনো।
এখুনি একবার হাওড়া স্টেশনে চলে আয়।
কেনো। আপনার কিছু হয়েছে।
না। আমি সোমনাথ (শিল্পী সোমনাথ হোড়) আছি। তুই এখুনি চলে আয়।
বুঝলাম শক্তিদা (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) কোথাও যাবেন, আমি চেলা। জলটা এনে দে, পেঁয়াজ এনে দে, লঙ্কা এনে দে। শঁসাটা একটু কুঁচিয়ে দে।
আমার পকেটে একটিও পয়সা নেই।
আমারও নেই, তাতে কি হয়েছে।
আমি তখন সবে মাত্র গ্র্যাজুয়েসন কমপ্লিট করেছি। কাঁচা মন। এদের সান্নিধ্যে এসে সব কিছু যেনো গিলে খাচ্ছি। আমার অবস্থা অনেকটা অপুর মতো। লোভও হচ্ছে তারপর ভাবলাম দুর যাবো না।
গেলাম।
স্টেশনের বড়ো ঘরির তলায় সোমনাথদা শক্তিদা। আমায় দেখে সেমনাথদা হেসে ফেললেন।
আমিতো ভাবলাম তুই আসবিনা।
দাদা ডাকলেন।
ওঃ সোমনাথ বেশি বকিস না। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই আয়।
আমি পেছন পেছন, সামনের সিগারেটের দোকানে গিয়ে বললেন ভাই একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট দাও তো। ভদ্রলোক দিলেন।
একটা পেন হবে।
না।
পেন্সিল।
আছে।
দাও।
উনি কট কট করে শক্তিদার দিকে তাকালেন, পেন্সিলটা দিলেন। শক্তিদা খশ খশ করে লিখলেন,---
সেমনাথ, অনিকে পাঠালাম, ওর হাতে দুশোটা টাকা দাও, শান্তিনিকেতন যাবো পকেটে একটা পয়সাও নেই। টিকিট কাটবো না। তোমার লোকজনকে একটু বলে দিও। শক্তিদা।
আমার হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বললেন, ছুটে চলে যাতো দোতলার ওই কোনের ঘরটায়। হাতে সময় বেশি নেই।
আমি মার টেনে ছুট।
সোমনাথদার (সেমনাথ মুখার্জী, এজিএম সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ে, এখন উনি রিটায়ার করেছেন) ঘরের সামনে আসতেই তার সিকুরিটি আটকালো, সব বললাম ভেতরে ফোন গেলো। প্রবেশাধিকার পেলাম। সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম। সোমনাথদা ঠোঁটের তলা দিয়ে হাঁসলেন।
তুইও দাদার পাল্লায় পরেছিস, লিখিস টিকিস নাকি।
হ্যাঁ।
তুই একা না আর কেউ আছে।
সোমনাথদা আছেন।
আর্টিস্ট।
হ্যাঁ।
সেমনাথদা বেল বাজালেন, একজন ভেতরে এলেন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের তিনটে এসি চেয়ারকারের টিকিট আনুন।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ পর ঘুরে এলো। হাতে টিকিট। এই নে। মানি পার্টস থেকে একশো টাকার পাঁচটা নোট দিলেন।
জিনিসপত্র কেনা হয়েছে।
না।
যা সময় হয়ে গেছে। দৌড়ো।
আবার দৌড়।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে শক্তিদার সামনে দাঁড়ালাম। টাকাটা দিলাম। টিকিটটা দিলাম। শক্তিদা হাসলেন। দেখলি, এর নাম হচ্ছে শক্তি।
আমি মাথা নীচুকরে দাঁড়িয়ে আছি।
মালের ঠেকাটা চিনিস।
চিনি।
যা তিনটে পাঁইট নিয়ে আয়। বাংলা। আর কিছু বলতে হবে।
না। ওখান থেকে কিনলে হতো না।
পাবিনা। পৌঁছতে রাত হবে।
আমি গঙ্গার ধারে চলে এলাম। পাঁইট নিয়ে ফিরলাম। শক্তিদার মুখে সে কি হাসি যেনো বিশ্বজয় করেছে।
ট্রেনে অনেক ঘটনা ঘটলো। তা আর বললাম না। পরে একসময় লিখবো।
শান্তিনিকেতন যখন পৌঁছলাম তখন আটটা বাজে।
স্টেশনের বাইরে এসে শক্তিদা রিক্সা ধরলেন। অনি তুই একা একটা রিক্সায় ওঠ আমি আর সোমনাথ একটা রিক্সায়।
কিছু নেবেন না।
ঠিক মনে করেছিস।
আবার পকেট থেকে একশোটাকা বার করে দিলেন। আমি শসা কলা পেঁয়াজ লবু লঙ্কা আপেল আঙুর কিনলাম। খিদে পেয়েছিলো।
দুটো রুটি কিনে খেলাম। আমি একটা রিক্সায় জিনিসপত্র নিয়ে, আর সোমনাথদা শক্তিদা একটা রিক্সায়। পথ প্রদর্শক শক্তিদা। বেশ কিছুক্ষণ পর গ্রামের রাস্তায় চলে এলাম। একটা মাটির দেওয়াল খড়ের বাড়ির কাছে এলাম।
কিরে সোমনাথ দাদা মনে হয় নেই।
কি করে বুঝলি।
দেখছিস চারদিক অন্ধকার।
একবার ডেকে দেখনা।
রিক্সা ওয়ালাদের বললো তোরা বাবা একটু দাঁড়া। যদি দাদা থাকে তোদের বিদায় করবো, না হলে ফিরে যাবো।
শক্তিদা কাঁটা বাঁশের তৈরি গেটটা একটু ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। চারিদিক নিঝুম অন্ধকার। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। জনমানব শূন্য। দূরে কয়েকটা ঘর দেখা যাচ্ছে। সেখানে লম্ফের আলোর ক্ষীণ রেখা দেখতে পাচ্ছি।
কিঙ্করদা ও কিঙ্করদা আছো নাকি।
ভেতর থেকে শব্দ ভেসে এলো।
কেরে, শক্তি এলি।
ফেঁস ফেঁসে গলার আওয়াজ।
হ্যাঁ কিঙ্করদা।
দাঁড়া দাঁড়া যাচ্ছি।
চারিদিক অন্ধকার কেনো।
দুর আর বলিস না। মেয়াটা আজ আসে নি। কে লম্ফ জ্বালবে। অন্ধকারে শুয়ে আছি।
দরজা খুললো। কিঙ্করদা (রামকিঙ্কর বেইজ) বেরিয়ে এলেন। মাটির নিকোনো উঠোনে এসে দাঁড়ালেন।
ওরে বাবা তোর সঙ্গে আরো কে এসেছে মনে হয়।
হ্যাঁ সোমনাথ আছে। একে তুমি আগে দেখো নি।
ওটা আবার কে রে।
অনি।
সেটা আবার কে।
একটু আধটু লেখা লিখি করে।
পদ্যলেখে না গদ্যলেখে।
কিলেখে ওইই জানে।
বড়ো খারাপ রোগ। খেতে পাবে না। আয় আয় ভেতরে আয়।
আমরা ভেতরে এলাম। কিঙ্করদা একটা হেরিকেন জ্বাললেন।
আমরা একটা মাদুর পেতে বসলাম।
আমার কাছে আজ নেই।
আমি নিয়ে এসেছি।
বেশ করেছিস।
সবার খোঁজ খবর নিলেন। বুঝলাম শক্তিদা প্রায়ই কিঙ্করদার কাছে আসেন। সোমনাথদাও আসেন। কে বাদ আছে। আমি সর্বশেষ সংযোজন।
অনি যা ওগুলো রেডিকর।
কিঙ্করদা ওকে একটা বঁঠি দাও।
বঁঠিতো নেই একটা চাকু আছে। বাইরের জানলার ওপর।
যা হারিকেনটা নিয়ে গিয়ে খুঁজে নে।
আমি উঠে গেলাম। চারিদিকে স্কাল্পচার। কোনোটা ভাঙাচোড়া কোনোটা গোটা। একটা সাঁওতাল মেয়ের ফিগার দেখতে পেলাম। অসমাপ্ত। তাড়াহুড়ো করে আমার কাজ সারলাম। সব গুছিয়ে নিয়ে এলাম।
দেখেছো কিঙ্করদা, কেমন করিতকর্মা ছেলে।
কিঙ্করদা হো হো করে হেসে ফেললেন। বুঝলি শক্তি একটু মাংসো হলে ভালো হতো।
কোথায় পাওয়া যায় ওকে বলে দাও, ও ঠিক নিয়ে আসবে।
কিঙ্করদা আমার দিকে তাকালেন।
মনে মনে বললাম পৃথিবীর যে প্রান্তেই পাওয়া যাক আমি নিয়ে আসবো। এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাঁকে স্পর্শ করা যায় না, আর আমি কিনা তাঁর সামনে বসে আছি, উনি একটু মাংস খেতে চাইছেন আমি আনতে পারবো না।
তুই এই পাশের লালা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যা সামনে শবর পাড়া পরবে। দেখবি ওরা মাংস পোরাচ্ছে। দুটো পয়সা দিয়ে নিয়ে আয়। আমার কাছে যে সাঁওতাল মেয়েটা থাকে, ও থাকলে তোকে কষ্ট দিতুম না।
আমি বেরিয়ে এলাম। ওই নিঝুম অন্ধকারে শবরপাড়া থেকে মাংসো নিয়ে এলাম।
আমাকে দেখে কিঙ্করদার মুখে শিশু সুলভ হাঁসি।
দে দে শক্তি ওকে একটু দে।
ও এসব ধ্যেনো খায়না।
ধ্যেনো না খেলে লেখা বেরোবে না। যাতো বাবা ওখান থেকে রং-এর আর একটা ভাঁড় নিয়ে আয়।
তাকিয়ে দেখলাম তিনজনে কিঙ্করদার ছবি আঁকার রং-এর ভাঁড়ে বাংলা ঢেলে খাচ্ছে। আমি উঠে গিয়ে একটা ভাঁড় নিয়ে এলাম। কিঙ্করদা নিজের বোতল থেকে আমাকে একটু ঢেলে দিলেন। চারিদিক ম ম করছে গন্ধ। মাথা ধরে যাবার অবস্থা।
শুরু হলো কবিতা দিয়ে আলোচনা চললো অনেক রাত পর্যন্ত। শেষ হলো স্কাল্পচারে এসে। আমার মাথায় কিছু ঢুকলো কিছু ঢুকলো না, কপালে ধাক্কা খেয়ে মাথার ওপর দিয়ে চলে গেলো। যেটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলো তিনজনের শৈল্পিক স্বত্বার আদান প্রদান হচ্ছে। আমি যেনো সঙ্গমে ডুব দিয়েছি। তল খুঁজে পাচ্ছি না। তখন মোবাইলের যুগ নয় যে ক্যামেরা বন্দি করে রাখবো। একে একে তিনজনে বেহুঁশ হয়ে ওই ঘরে শুয়ে পরলো। আমি একা।
আমি বাইরের বারান্দায় এসে একটা মাদুর জোগাড় করে শুয়ে পরলাম। মাথাটা ঝিন ঝিন করছে। কখন ঘুমিয়ে পরেছি জানি না। হঠাৎ মশার কামরে ঘুম ভাঙলো। চোখে একটা লম্ফের আলো এসে পরেছে। ভয় পেয়ে গেলাম। উঠে বসলাম। কে ওখানে ? এই গভীর রাতে। সম্বিত ফিরতে দেখলাম কিঙ্করদা উলঙ্গ অবস্থায় সেই সাঁওতাল মেয়েটার অসমাপ্ত স্কাল্পচারে মাটির প্রলেপ দিচ্ছেন। চোখ স্থির। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য। ধ্যানমগ্ন কোনো মহাপুরুষ। লম্ফের আলো থিরি থিরি কাঁপছে। আমার চোখের পলক পরে না।
সংগ্রহীত
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



