somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষা রক্ষণাবেক্ষণ একটি পবিত্র দায়িত্ব

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারী
ভাবের বাহনই হচ্ছে ভাষা। ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে, সকল প্রয়োজনে, সকল পর্যায় ও পরিসরে নিজের আবদার অধিকার ও দাবী পেশ করে থাকে। শিশুর কান্না আর্ত পীড়িতের আর্তনাদ, সুখ-আনন্দ ও খুশীর উৎফুল্যতা, বিবাদ বিষম্বাদে বাতসাল্লতা, দুঃখ-দুর্দশায় মুর্ছতা এ সবই প্রকাশ করে ভাষার মাধ্যমে। তাই ভাষাকে ভাবের মাধ্যমও বলা হয়ে থাকে। এ ভাষায় রয়েছে অন্তহীন বৈচিত্রতা। হাজার-হাজার ভাষা পৃথিবীতে বিদ্যমান, আবার একই ভাষার রয়েছে হাজার রূপ। ভাষাবিদগণ বলেন, “প্রতি ৫/৭ কিলোমিটার দূরত্বে, সময়ের ব্যবধানে ভাষার পরিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন আজ থেকে শত বৎসর পূর্বের বাংলা বা ইংরেজী ভাষা বর্তমানের আধুনিক বাংলা বা ইংরেজী ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবার একই সময়ে একেক দেশে রয়েছে একেক ভাষা, এমন কি একই দেশে একই সময়ে একেক অঞ্চলের মধ্যেও রয়েছে ভাষার ভিন্নতা। যে- যে ভাষাতে কথা বলুক না কেন তার নিকট নিজের মাতৃভাষাই অতি সমীর্হ ও সমাদৃত। তাই সব ভাষার প্রতি সবারই সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। মাতৃভাষার প্রতি দূর্বলতা আদি কালেও ছিল, এখনও আছে এবং তা থাকবে। ইহা কারও ঘারে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। যদি কেহ বা কোন জনগোষ্ঠী নিজের মাতৃভাষার প্রতি অতি অনুরক্ত হয়ে তা অন্য কোন ভাষাভাষি ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিতে চায় তাহলে সেই জনগোষ্ঠী শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যন্ত তা মেনে নেবে না। আর সে ভাষা হয় হাজার বৎসরের লালিত ও যোল কলায় পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত তা হলেতো বলাই বাহুল্য। পৃথিবীতে দেশ জয় করার ইতিহাস রয়েছে হিসাব বহিঃর্ভূত। এক সরকারকে হটিয়ে দিয়ে অন্য সরকারের শাসনভার জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে বহুবার। কিন্তু মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে অন্য ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার পর তা বহাল তবিয়তে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল বা নাই বললেই চলে। অন্য ভাষাকে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা যে করা হয়-নি এমন নয়, কিন্তু সব প্রচেষ্টাকেই মানুষ ব্যর্থ চেষ্টায় পরিগণিত করে দিয়েছে। এ পথের পরিশ্রমকে পন্ডশ্রমে পরিণত করে ভূ-তলের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে দিয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতিও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাংলা ভাষার ইতিহাস হাজার বছরের ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় চোখ ফিরালে আমরা দেখতে পাই, এ ভাষার বিরুদ্ধে অতীতে একের পর এক ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে বিভিন্ন দেশের শাসকগোষ্ঠী। এ ভাষাকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অপচেষ্টাও হয়েছে বার-বার। সেই ১২শতকে বহিরাগত বর্মন রাজারা এদেশ দখল করে। বর্ণশ্রম প্রথা পাকা পোক্ত করার জন্য বাঙালীর মুখের ভাষাকে পক্ষী ভাষা বলে অপপ্রচার চালাতে শুরু করে। তারা প্রচার করতে থাকে যে, বাংলা ভাষা পুরাণ, মহাভারত বা রামায়ন শ্রবণ করলে নরকে যেতে হবে। তখন থেকেই বাংলা ভাষার জন্য বাঙালী জাতির লড়াই শুরু হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে দীনেস চন্দ্র সেন লিখেছেন, "ব্রা‏হ্মনগণ প্রথমত বাংলা ভাষা চর্চার বিরোধী ছিলেন। কৃত্তিবাস ও কাশীরাম দাসকে রামায়ন ও মহাভারত বাংলা করার জন্য তাদেরকে "সর্বনেশ" উপাধি প্রদান করেছিল। অষ্টাদশ "পুরাণ" অনুবাদকের জন্য ইহায়া "রৌরব" নামক নরকে স্থান নির্ধারণ করেছিল। আশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে বহিরাগত সেন বর্মনরা বাংলা ভাষাকে ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। আর পরবর্তীকালে বহিরাগত মুসলমানরা তা বুকে টেনে নিয়েছিল এবং মুসলিম রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালীরা বাংলা ভাষাকে তার স্ব-স্থানে পূণঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। এ ব্যাপারে দীনেশ চন্দ্র সেন তার ভঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য শীর্ষক গ্রন্থের খন্ডে লিখেছেন "আমাদের বিশ্বাস মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই বঙ্গভাষার এই সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাড়াইয়া ছিল।"
১৯৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য্য স্তমিত হবার পরও বাংলা ভাষার বহমান স্রোতকে প্রকারান্তরে দূর্বল বা বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। প্রখ্যাত ভাষা তাত্ত্বিক স্যার জর্জ গ্রীয়ার্সন বলেছেন; "শতকরা নব্বইটি প্রকৃত বাংলা শব্দের স্থলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংস্কৃত শব্দ বসিয়ে বাংলা ভাষাকে তথা কথিত সাধু ভাষা বানানোর চেষ্টা করেছিল সংস্কৃত পন্ডিতগণ।" বহুভাষাবিদ হ্যালহেড লিখেছেন "এর ফলে বাংলা গদ্যের এই নব রূপায়ন ঐতিহ্য বিরোধী ভাষার স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করেছে।" এদেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়িত হবার পর স্বাধীন পাকিস্তান হয়েও বাংলা ভাষা শত্রুদের হাত হতে বিমুক্ত হলো না। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার উপর উর্দূ ভাষার জগদ্দল পাথরকে চাপিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল। সেদিন সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা দিয়েছিল "উর্দূই হবে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা" সাথে সাথে বাঙালী জাতি নিজেদের স্বাধীন স্বকীয়তা বজায় রাখার লক্ষ্যে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষুধার্ত বাঘ্রেরমত গর্জে উঠেছিল। সেদিন বাঙালী জাতির সিংহ শাবকের হুংকারে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের মতকে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল। তবে এর জন্য বাঙালী জাতিকে অনেক খড়-কুটে পুরাতে হয়েছে, অনেক চড়া দাম দিতে হয়েছে, রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার ও আরও অনেককে শাহাদাতের নাজরানা পেশ করতে হয়েছে। যার ফলশ্র“তিতে পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
ভাষা তথা মাতৃভাষা একটি উজ্জ্বল আলোক প্রদীপের মত। ইহা সকলকে অভিভূত করে, আন্দোলিত করে এবং চিত্তের প্রশান্তি আনে। ভাষাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করলে ইহা আরও দ্বিগুণ ঔজ্জল্যে প্রজ্জলিত হয়, ভাষা চিত্তের প্রশস্ততা বৃদ্ধি করে। জার্মানের ভাষা বিজ্ঞানী ম্যাক্স মোয়েলার তো ভাষাকে আত্ম জীবনী বলেই আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন; খধহমঁধমব রং ঃযব ধঁঃড়নরড়হমৎধঃযু ড়ভ ঃযব যঁসধহ সরহফ. মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই মাতৃভাষার পূর্ণ হেফাজত করা, রক্ষা করা ইহাকে পরিবর্ধন, পরিমার্জন স¤প্রসারণ ও সমৃদ্ধি করণ প্রতিটি সচেতন, বুদ্ধিমান, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকগণের পবিত্র দায়িত্ব। মহান আল্লাহ বলেন ; "আমি তোমাদিগকে বিভিন্ন গোত্র, বংশ, বর্ণ ও ভাষার বিভক্তি করে সৃষ্টি করেছি যাতে করে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার" (সূরা রূম: ২২) সুতরাং ভাষা আল্লাহর এক বিশেষ দান, ইহার রক্ষণাবেক্ষণ করা ঈমানী দায়িত্বের আওতাভূক্ত।


৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×