somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ অমানিশাকাল ।

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



[ সংবেদনশীল পাঠকের সতর্কতা কাম্য ]

বাচ্চাটা আপন মনে খেলছে । ঘর জুড়ে ছুটছে । ছন্দ তালে ছড়া কাটছে । তাল কেটে হাঁপাচ্ছে । তার বাবা অবিরাম বকছে ।

একটানা বকাবকি বেশ পুরনো অভ্যেস বাবার । সাঁজ সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই বকাবকি । স্নান ঘরে যেতে আসতে বকাবকি । দাঁত মাজা নাস্তা খাওয়ায় বকাবকি । অফিসযাত্রায় তৈরি হতে বকাবকি । অশ্রাব্য কটু শব্দগুলো কবেই ছেলেটির অভ্যস্ত কানে মানিয়ে গেছে ।

তার মা বসে বসে ধুঁকছে । পুরনো চশমার ফ্রেমে চোখের কালি ঢাকা পড়েছে । একমনে সুঁই সুতো দিয়ে সুইস ভয়েল কাপড়ে ফুলের নকশা আঁকছে । এক আজব নেশা মায়ের । দিন রাত কথা বলা বন্ধ, সময় পেলেই শুধু সুঁই সুতো ।

বাবার বকাবকি এবার মায়ের দিকে ধেয়ে যায় । এই সেকেলে মহিলা কিছুই বুঝেনা । এর হাতে তার ছেলের ভবিষ্যত নিশ্চিত অন্ধকার । ছেলেকে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের উপযোগী করে গড়ে তোলার দায়িত্ব মায়ের । কিন্তু এই মহিলার হাতে তার আদরের ছেলেটা দিব্যি রসাতলে যাবে ।

বাপের একটানা বকাবকিতে মায়ের বুনোট ধ্যান ভাঙ্গে । সুঁই সুতো রেখে ছেলের প্রতি মনযোগী হন তিনি । স্কুল বন্ধ হলেও কোচিং আছে । কোচিংয়ে যাবার জন্য মা ছেলেকে তৈরি করে । বাবা তখনো বকে যায় । এবার লক্ষ্য ছেলের স্কুলবাড়ি । অযত্ন অবহেলা আর দায়িত্বহীনতার অভিযোগের তীব্র শ্লেষ ছুটে যায় স্কুলের মাস্টার মশাইদের দিকে । শেখায় না কিছুই, শুধুই রুটিন যাওয়া আসা । দুদিন পর জাতীয় আনন্দ মহোৎসব । ঐ উৎসবের জন্য বাচ্চাদের ভালো করে গড়ে তুলবে- তা না । এক সপ্তাহ আগেই স্কুল বন্ধ- আনন্দের ছুটি ।

আনন্দ মহোৎসবের জন্য ছেলেকে উত্তমরুপে প্রস্তুত করতেই স্পেশাল কোচিং । ছেলে বাবার হাত ধরে হেটে যায় । বাবা একটানা বকে যায় ছেলেকে উদ্দেশ্য করে । তুমি যত বেশি কদর্য হবে, যত বেশি নোংড়া হবে- বেড়ে যাবে তোমার টিকে যাবার সম্ভাবনা । পঙ্কিলতায় যত তুমি ডুবে যাবে, ততোই বেঁচে থাকার রসদ পাবে । শুভ চিন্তা শুভকর্ম আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, ওটা তোমার প্রাচীন মা'কেই ভাবতে দাও ।

ছেলে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে বাবার সাথে হেটে যায় । পথ চলতি কয়েক যুবক তাদের দিকে একদলা কাদা ছুড়ে দেয় । চোখ মুখ পোষাক পরিচ্ছদ সব পচা কাদার দুর্গন্ধে ভেসে যায় । বাবা সাথে সাথে তার শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ থেকে দু'চারটি সেরা গালি তাদের দিকে ছুড়ে দেয় । যুবকেরা উল্লাস করতে করতে চলে যায় । একরাশ বিবমিষা ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে, পচা কাদার ডোবায় যেন সে সাঁতার কাটছে ।

বাবা ছেলের দিকে তাচ্ছিল্যের হাসি ছুড়ে দেয় । এতদিন ছেলেকে স্কুলে পড়িয়ে কোচিং করিয়ে কিছুই শেখাতে পারেনি বলে আহাজারি করে । তোমার দিকে কাদা ছুড়লে তুমি তাদের দিকে কুকুরের মল ছুড়ে দিবে । নোংড়া খিস্তি দিয়ে তাদের সম্ভাষণ জানাবে । এত দিন ধরে তাহলে কি শিখছ!

কোচিংয়ে আজ চুড়ান্ত প্রস্তুতির দিন । জাতীয় আনন্দ মহোৎসবের ইভেন্ট গুলো আজকে ডেমো করে দেখাবে । সেই উৎসবের প্রতিটা পর্বের আনুষঙ্গিক নিয়মগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ রুপে শিখিয়ে দিবে । ভবিষ্যত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার প্রথম পরীক্ষায় ছেলেটি অবতীর্ণ হবে আগামিকাল ।

উৎসবের আগের রাত থেকেই ঘরে ঘরে পৈচাশিক আনন্দের ঢেউ বয়ে যায় । ভোর হতে দলে দলে মানুষ ছুটে চলে জাতীয় স্কয়ারের দিকে, মহোৎসবের মুল ভ্যেনু যেখানে । লাখো কোটি মানুষের পদচারনায় মুখরিত হতে থাকে জাতীয় স্কয়ার । ছেলেটির বাবার উৎসাহের শেষ নাই । সেই সকাল থেকেই তার বকাবকির আতিশত্য বেড়ে যায় । সারা বছর জমিয়ে রাখা সবচেয়ে নোংড়া কাপড়ে সজ্জিত হওয়া উৎসবের নিয়ম । বাবার উৎসাহে ছেলেরও উৎসাহ বেড়ে গিয়েছে বহুগুন । এই প্রথমবারের মত সে আনন্দ মহোৎসবে যেতে পারছে । বাবার বকাবকিতে মা ও তৈরি হয়ে নেয়, গোপনে সুঁই-সুতো-নকশাকাপড়ের ফ্রেম নিতে ভুলেন না তিনি ।

রাস্তায় নেমে প্রথা মত প্রথমেই তারা ড্রেন থেকে ময়লা কাদা আবর্জনা তুলে নিজেদের ভালোমত মাখিয়ে নেয় । এই সময় নিজের বাবা-মা পূর্বপুরুষদের শাপশাপান্ত করার নিয়ম । বাবা কঠিন নিয়মানুবর্তি, চিৎকার করে করে পূর্বপুরুষের গুষ্টি উদ্ধার করে । ছেলেও বাবার সাথে যোগ দেয় তার পূর্বপুরুষকে গালি দিবার হোলিতে ।

পুরো রাস্তা জুড়ে উৎসবগামী মানুষের পদভারে মুখরিত । ময়লা এঁটোকাদা দুর্গন্ধ মেখে সবাই চলেছে উৎসব পথে । কাদাছোড়াছুড়ি আর পৈচাশিক গগণ বিদারি চিৎকার উল্লাসে মাতোয়ারা সবাই ।

জাতীয় স্কোয়ারে প্রবেশদ্বারের কাছে এসে মায়ের পথ চলা হঠাৎ থেমে যায় । ছেলেটাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন মা । বাবা সমানে তাড়া দেয়, আগে আগে না পৌছালে উৎসবের সামনের সারিতে থাকা যাবে না । মুল মঞ্চবেদির কাছে থেকে উৎসব দেখার মজাই আলাদা । আর এর জন্যেই সারা বছর ধরে নেয়া হয়েছে প্রস্তুতি ।

বাবার চিৎকারেরও মা নড়েনা, ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে চুপটি দাড়িয়ে থাকে । বাবা এবার তার উপর চুড়ান্ত রুপে চড়াও হয় । মুখের অশ্রাব্যতার সাথে যোগ হয় শারীরিক আঘাত । বাবা যেন হয়ে উঠে সাক্ষাৎ পিচাশ । তবু মা অনঢ়, অটল । পৈচাশিকতার গন্ধ পেয়ে তাদের ঘিরে ধরে কিছু অতি উৎসাহী আনন্দ মহোৎসব যাত্রীর দল । বিভীষিকাময় স্লোগানে মেতে উঠে তাদের চারপাশ ।

বাবা এবার দাঁতমুখ খিচিয়ে মা'কে শাসায় ।
তুমি কি করছ বুঝতে পারছ! উৎসবের স্বেচ্ছাসেবীরা এখনই তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে । পৃথিবীতে যে কয়টি শুভচিন্তাধারী মঙ্গলাচারী খুঁজে পায়, সবাইকে ধরে নিয়ে আসে এই উৎসবে । স্কয়ারের কেন্দ্রে মুল বেদীতে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশাখায় তাদের জীবন্ত পুড়ানো হয় । আধপোড়া মানুষের বীভৎস চিৎকারের সাথে সাথে হর্ষধ্বনি বেজে উঠে পুরো উৎসব জুড়ে । আনন্দযাত্রীরা বেদি পরিভ্রমনের সময় আধপোড়া মানুষের দিকে উত্তপ্ত তৈল আর ক্ষার ছুড়ে দেয় । অর্ধপোড়া মানুষটি যতক্ষন যন্ত্রনায় ছটফট আর আর্তচিৎকার করতে পারে ততক্ষন ধরে চলে এই পাশবিক যন্ত্রণা দান । তারপর মরে গেলে পুরো শরীরটা উন্মুক্ত কড়াইয়ে ভেজে পোড়া মাংসগুলো ছুড়ে দেয়া হয় শুভ্যার্থিদের কাছে । সোমরসে ভিজিয়ে সেই উৎকৃষ্ট প্রসাদ ভোগ করে প্রতিটি আনন্দযাত্রী ।

একের পর এক মঙ্গলাচারীকে আনা হয় বেদিতে । তাদের যন্ত্রণাদায়ক আর্তচিৎকার রাঙিয়ে দেয় মহোৎসব । সেই বীভৎস দৃশ্য আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই উপভোগ করে । তেরো বছর বয়সী বাচ্চাদের জোর করে তা দেখানো হয় । যেন এই বাচ্চারা সব ধরণের বিভীষিকার সাথে ছোট থেকেই অভ্যস্ত হয়ে যায় । যাবতীয় কদর্যতা, পন্কিলতা, বীভৎসতাকে যেন তারা জীবনে আদর্শরুপে গ্রহন করতে পারে । আর তাহলেই তারা এই গ্রহে অভিযোজিত হতে পারবে, বেঁচে থাকতে পারবে বংশপরষ্পরায় ।

"তুমি কি চাও আমার ছেলে তোমার আধপোড়া মাংস খেয়ে তার জীবনে সারভাইভের প্রথম পাঠ নিবে"??

ঘিরে থাকা জনতা সোল্লাসে চিৎকার করতে থাকে । "একে ধরে বেদিতে নিয়ে যাও । এই মঙ্গলাচারিনীকে সবার আগে পোড়াও" ।

সমবেত জনতা চিৎকার আর হর্ষধ্বনি দিতে দিতে মায়ের দিকে আসতে থাকে । যেন এক্ষুনি ছিড়েফুড়ে খেয়ে নিবে কাঁচা হাড় মাংস শরীর । আগ্রাসী জনতার পাশবিক চিৎকারে মিলিয়ে যায় বাবার উল্লম্ফন ।

হায়েনা দলের ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্বমুহূর্তে মা চোখ খুলেন । ধীরে ধীরে মাথা উপরে তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন তিনি । অপার্থিব হাসির আলোকছটায় থমকে যায় সবাই । উল্লসিত জনতার চোখ মুখ থেকে যুগপ্রাচীন কদর্যতার পর্দা সরে যেতে থাকে । ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আসা প্রাচীন অবয়ব নব রুপে দেখে তারা হতবাক হয় ।

বৃষ্টিধারায় স্নাত মা পরম আদরে ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে চুমু খান । মঙ্গল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শাড়ীর আঁচলে লুকিয়ে রাখা সুঁই সুতো ফ্রেম বের করেন তিনি । সেখানেই দাঁড়িয়ে সুইস ভয়েল কাপড়ে রঙীন নকশা বুনায় মনযোগী হন ।


********************সমাপ্ত********************

দুর্বোধ্যতার একটা অভিযোগ এসেছে গল্পটিকে ঘিরে । একটা সূত্র দেই, Cannibalism..

উইকিপিডিয়ার মতে, Cannibalism (from Caníbales, the Spanish name for the Carib people,[1] a West Indies tribe formerly well known for practicing cannibalism)[2] is the act or practice of humans eating the flesh or internal organs of other human beings.

সাম্প্রতিক মানুষ পুড়িয়ে মারার বীভৎস উল্লাস আমাদের হয়ত Cannibalism এর দিকেই নিয়ে যাচ্ছে..
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৫২
৭৫টি মন্তব্য ৭৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×