যেবার প্রথম রাঙামাটি যাই, দীর্ঘ পাহাড়ী পথের উঁচুনিচু বাঁকে দুলছিল আমার সুখস্বপ্ন! বিয়ের পর প্রথমবারের মত আমার স্বামীর কর্মস্থলে যাচ্ছি, স্বপ্ননীড় বাঁধব বলে! একটা ছোট্ট সংসার সাজাবো আমি আর আমার প্রাণের মানুষটি মিলে । দীর্ঘযাত্রার অবসাদ কেটে গেলো পূব আকাশে সদ্যফোটা সোনালী কিরণে । হিম বাতাসের মিষ্টি সুবাস আর ভোরের অরুণ আভা মেখে রাহাতের হাতে হাত রেখে হলো শুভ গৃহপ্রবেশ!
ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স কোয়ার্টারে আঁচলভরা সুখ নিয়ে কাটছিল আমার নতুন জীবন । ভালোবাসার মধুময় খুনসুটি আর চড়ুইভাতি সংসার! একসময় টের পাই, আমাদের ভালোবাসা অজান্তে বেড়ে উঠছে আমার জঠরে । দুহাতের মুঠোয় রাহাতের চুল টেনে কাছে এনে বলি, কিছু বুঝতে পারছো! সলাজ মিষ্টি হেসে মিইয়ে যায় রাহাত, কানপেতে অস্থিত্ব খুঁজে বেড়ায় আপন ভালোবাসার।
রাঙামাটিতে আনন্দেই ছিলাম । কিন্তু আমাদের অনাগত ভালোবাসার জন্মসময় এগিয়ে আসায় রাহাত কোন ঝুঁকি নিতে চাইলো না । আমি চলে এলাম ঢাকায় । রাহাত আর আমার জীবনে দীপ জ্বালাতে কোলজুড়ে এলো এক ছোট্ট মিষ্টি ভালোবাসা ।
ছোট্ট বাবুটা আসার পরে আমি ঢাকায় ছিলাম । রাহাত ছুটি পেলেই ছুটে আসত আমাদের কাছে । আর্মির চাকরিতে চাইলেই তো আর ছুটি মেলেনা! রাঙামাটি থেকে সময় পেলেই ফোন করত, মামনি কে দেখার জন্য পাগল হয়ে যেত । ঢাকায় থেকে থেকে আমিও অস্থির হয়ে উঠেছিলাম । আমার ছ'মাসের মেয়েটা খেলার সময় আপনমনে বু বু করে ঠোঁঠ নাড়ায় । রাহাতকে বলি, শুধু আমি না তোমার মেয়েও বাবা'র জন্য অস্থির! আমাদের নিয়ে যাও তোমার কাছে।
রাহাত রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই বদলি হয়ে গেছে । মামনিকে নিয়ে আমরা সেখানে কোয়ার্টারে উঠলাম । জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ভেতরে সংরক্ষিত এলাকায় আমাদের কোয়ার্টার । সুবিশাল লেক আর সুউচ্চ পাহাড়সারি মিলিয়ে এক অদ্ভূত সুন্দর জায়গা । লেকের পূর্বপাশে এক বিশাল পাহাড়ের মাঝখানে অফিসার্স কোয়ার্টার । নিচে পাহাড়ের ঢাল খাদ বেয়ে কাপ্তাইয়ের জল ছুঁয়েছে । উপরে বুনোজঙ্গলে ঘেরা আকাশছুঁয়া পাহাড়চূড়া, একটার পর একটা পরতে পরতে সাজানো যেন!
এখানকার বাসাগুলো বেশ পুরনো । পাহাড়ের ভাঁজ কেটে অদ্ভূত নকশায় বানানো ছোট ছোট একতলা বাড়ি । অনেকটা কিউববক্স আকৃতির । অনেকে বক্স কোয়ার্টারও বলে । মোটা লোহার গরাদের মত প্রবেশ পথ । পুরো বাড়িতে কোন দরোজা জানালার অস্থিত্ব নেই । উইন্ডোটাইপ পুরানো এসিগুলো অক্সিজেনের যোগান দেয় । প্রতিটা রুমের দেয়ালের উপরিভাগে এক ফুট বাই দুই ফুট গ্লাস ঘেরা স্কাইলাইট । সূর্যের আলো পাওয়ার এটাই একমাত্র উৎস । মশা, কীটপতঙ্গ, সাপ আর উচ্ছেদ হওয়া পাহাড়ীদের ভয়ে এরকম দুর্গসম ডিজাইন । বাসার সামনে সৃজিত সুন্দর বাগান । এই বাসাগুলো যখন তৈরি হয়, বুনো জঙ্গল আর কিছু আদিবাসী ছাড়া হয়ত এখানে আর কিছুই ছিল না ।
পাহাড়গুলো মুলত মুরং বসতি । নির্জন পাহাড়ে তাদের জুমভিত্তিক নিরিবিলি জীবন । রাহাত বলে, পরের পাহাড়গুলো আরো দুর্গম, যাওয়ার মত কোন রাস্তা নেই । হেলিকপ্টার দিয়ে ওরা প্রায়ই এই দুর্গম পাহাড়ের উপর দিয়ে উড়ে যায় । মাইলের পর মাইল বুনো প্রকৃতি, কপ্টার নামানোর মত ফাঁকা জায়গাও নেই । বিরাণ এই উপত্যকার চূড়ায় মাঝে মধ্যে দুয়েকটা বসতি চোখে পরে । আদিম এই মানুষগুলো পাহাড়চূড়া থেকে কখনোই নিচে নামেনা । জীবন যাপনের সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে তারা নিজেদের ইচ্ছকৃতভাবে দুরে রেখেছে । এমনকি তারা স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে নিজেদের শরীরটুকু আবৃত রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনা । রাহাতরা কখনো কপ্টার থেকে জামাকাপড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে আসে, কিন্তু ওরা এগুলো ছুঁয়েও দেখে না ।
সপ্তাহে দুই-তিন দিন রাহাতকে সার্চ অপারেশনে যেতে হয় । সম্প্রতি সরকারের সাথে শান্তিবাহিনীর শান্তিচুক্তি হওয়ায় পাহাড়ে শান্তির একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে । কিন্তু একটি পক্ষ এখনো এই চুক্তিতে আসতে রাজী হয়নি । দুর্মম পাহাড়ের গভীরে তারা ঘাটি গড়েছে । পাহাড়ের গভীর অরণ্যে এই সন্দেহজনক ক্যাম্প খুঁজতে আর্মির একেকটা দলকে অপারেশনে যেতে হয় । রাহাতের ডিউটি থাকলে মামনি আর কাজের দুজন মহিলাকে নিয়ে আমার বাসায় থাকতে হয় । এমনিতে নিরাপত্তা নিয়ে কোন সমস্যা নেই । কোয়ার্টারের চারপাশ কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা । কিছুক্ষণ পর পর সেন্ট্রিপোস্ট । কোনকিছুর প্রয়োজন হলে ইন্টারকমে মেইনপোস্টে জানিয়ে দিলে হয় । ওরা বাসায় এনে পৌছে দিয়ে যায় । দিনের বেলা আমরা মহিলারা মিলে গল্প আড্ডা দিয়ে কাটাই । সন্ধ্যার পর যে যার নিরাপদ দুর্গে ঢুকে পরি ।
সেই রাতে রাহাত ছিল অপারেশনে । আমার মেয়েটা ঘুমুতে দেরি করছিল । ওর বাবা না থাকলে ওকে ঘুম পাড়াতে কষ্ট হয় । অনেক রাত জেগে দুজন ঘুমিয়েছি । হঠাৎ কিসের শব্দ পেয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে এলো! চোখ খুলে দেখি আবছা অন্ধকারে এক জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে । পলকহীন উৎসুক দৃষ্টি! ভয়ের একটা শিহরণ সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে যেন! আমি চিৎকার করার চেষ্টা করেও পারছি না । আমি হাত পা নড়াতে পারছিনা, এমনকি কিছু ভাবতেও পারছি না..
সকালে কাজের মহিলা জানালো আমি ঘুমের মাঝে জ্ঞান হারিয়েছিলাম । রাতের সেই চোখজোড়া তখনো চোখে ভাসছিল । কাজের মহিলাদের সেটা জানাই নি । ওরা ভয় পেলে আর এখানে থাকতে চাইবে না । বাসায় কিছু সমস্যা হয়েছে জানিয়ে ইন্টারকমে মেইনপোস্টে জানালে তারা সাথে সাথে ওয়্যারলেসে রাহাতকে খবর দেয় ।
রাহাত আসার পর কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি । কিন্তু সে তো হেসেই খুন! বলে, এই নিরাপত্তা বেস্টনি এড়িয়ে কারো পক্ষে এখানে আসা নাকি সম্ভব নয়! এটা নাকি আমার মনের ভুল! অথবা আমি নাকি বেড়ালের চোখ দেখেছি! অন্ধকারে বেড়ালের চোখ জ্বলজ্বল করে, সেটা দেখেই নাকি আমি ভয় পেয়েছি ।
আমি আর কিছু বলতে পারছিলাম না । শুধু মনে মনে মেলানোর চেষ্টা করছিলাম, ঐ চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছিল কিনা! আমার মনে হচ্ছে চোখজোড়া ছিল নিষ্প্রভ, নিবিড় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল । সে কথা আর রাহাতকে বললাম না । তবে রাহাত বেশকিছু সতর্কতামুলক পদক্ষেপ নিয়েছে । বাসার ছাদে সার্চ লাইট বসিয়েছে, যেন সেন্ট্রিপোস্ট থেকে আমাদের ছাদ পরিষ্কার দেখা যায় । এর পরে আর কোন সমস্যা হয়নি । রাহাত পাশে থাকলে এমনিতে আমার মাঝে কোন ভয়ডর কাজ করে না ।তবু রাতের বেলা রাহাতের আড়ালে চোখ ঘুরিয়ে দেখেছি, না সেই চোখজোড়া দেখতে পাইনি । কয়েকদিন যেতেই বিষয়টি প্রায় ভুলে গেলাম ।
পরের সপ্তাহে আবার রাহাতের সার্চ অপরেশন ডিউটি । রাতের খাবার খেয়ে রাহাত মামনিকে কাঁধে চড়িয়ে অনেকক্ষণ হাটলো । আমার মেয়ে তার বাবার কাঁধে চড়া খুব পছন্দ করে । বাবার আহ্লাদ পেয়ে তার দুষ্টুমির মাত্রাও বেড়ে যায় । বাসার সামনে জিপ এসে হর্ণ বাজাচ্ছে । "নায়লা লক্ষ্নীটি, ভয়টয় পেয়োনা, সেন্ট্রিপোস্টে বলে দিয়েছি সারারাত যেন নজরদারি করে । কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে মেইনপোস্টে জানিয়ে দিও!"
রাতে মামনির সাথে খেলতে খেলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি । ঘূণাক্ষরেও বুঝিনি সেই বিভীষিকাময় রাত আবার ফিরে আসবে । কাঁপুনি দিয়ে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় । শরীরজুড়ে সেই ভয়ার্ত শিহরণ, সেই অদৃশ্য কারো নড়াচড়া! একজোড়া স্থির কৌতুহলী চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে । চোখের ভাষাটা যেন কিছুটা পড়তে পারছি । ক্রোধ নয়, কেমন যেন কামুক চাহনী । চিৎকার দেব না বলে মনস্থির করলাম । পাশে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট মামনিটা ভয় পেতে পারে । ইন্টারকমের ফোনটা হাতের নাগালেই ছিল । কাঁপা কাঁপা হাতে কোনরকম ফোনটা উঠিয়ে হ্যালো হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে একজন বললো, "ভয় পাবেন না ম্যাডাম, আমরা দেখছি!" সেন্ট্রির গলা শুনে প্রাণ ফিরে পেলাম যেন! আবার তাকিয়ে দেখি, পূর্ণবয়স্ক মানুষের একটা অবয়ব! ধুপধাপ একটা শব্দ, তারপর কেউ যেন সন্তর্পনে চলে গেলো! স্কাইলাইটের গ্লাসে সার্চ লাইটের আলো পড়ছে । বিছানা ছেড়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিলাম ।
"চোখজোড়া কোন জায়গা থেকে তোমাকে দেখে বলতে পারো? স্কাইলাইট থেকে??
রাহাতের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলাম । উপরে স্কাইলাইটের দিকে তাকালাম, সারা ঘরের দেয়ালজুড়ে খুঁজলাম । ঠিক কোথায় যেন চোখজোড়া দেখি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না । রাহাত আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, "ঘুমানোর সময় তোমার পরণে কি ছিল?" প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমি বলি, মানেটা কি?
"না মানে, কোন ড্রেস পড়ে ঘুমিয়েছিলে?"
-এইতো নাইট গাউন পড়ে!
"গাউনটা ঠিকঠাক শরীরে ছিল? মানে.."
-কি সব পাগলের মত কথা বলছো! গাউন ঠিক থাকবে না কেন?
আমি অবাক হয়ে রাহাতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি । রাহাত চোখমুখ শক্ত করে আছে । বিড়বিড় করে বলছে, 'সার্চ লাইট দিয়েও সেন্ট্রিরা কিছু দেখতে পায় নি..!!'
তারপর কেটে গেলো আরো কয়েকটা দিন । রাহাত এবার ব্যাপারটা খুব গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে । হাতে একটা টর্চ নিয়ে সারারাত ঘুমানোর ভান করে বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে । সারাক্ষণ তার গোয়েন্দা দৃষ্টি স্কাইলাইটের উপর ঘুরে বেড়ায় । এই কয়দিনে চোখজোড়ার ছায়াও দেখা মিলেনি । এদিকে রাহাত ঐ রহস্যমানবকে ধরার একটার পর একটা পরিকল্পনা করে যাচ্ছে । কিন্তু তার কোন পরিকল্পনাই কাজে আসছে না, কারণ রহস্য মানব লাপাত্তাশয়ে গেছে।
অন্ধকারে সেই পরিচিত খচখচ শব্দটা কানে আসতেই সতর্ক হয়ে গেলাম । রাহাতের পিঠে হাত রেখে বুঝলাম সে ঘুমোচ্ছে । তার আর দোষ কি! রহস্য মানবকে ধরার জন্য টানা কয়েকরাত জেগে সেও দুর্বল হয়ে গেছে । স্কাইলাইটের দিকে ভালো করে তাকালাম । সেই এক জোড়া চোখ! আজকে মুখের অবয়বটা আরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । তবে রহস্য মানবকে আজ কিছুটা অস্থির দেখাচ্ছে । একবার স্কাইলাইট দিয়ে ভেতরটা দেখছে, আবার ডানে বায়ে মাথা ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখে নিচ্ছে । রাহাতের পিঠ মৃদু খামচি দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ঐ যে আসছে!
রাহাত আমার হাতে চাপ দিয়ে বলে, চুপ আস্তে! তারপর টর্চের তীব্র আলো গিয়ে পড়ে স্কাইলাইটের উপর । মুখের উপর আলো পড়তেই রহস্য মানবটা মনে হলো প্রচন্ড ভড়কে গেছে! কিছু মুহূর্তের জন্য তার চোখজোড়া কেঁপে উঠে । তারপর ধুপ করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় । রাহাত সাথে সাথে মেইনপোস্টে ফোন করে । সার্চলাইটের আলোতে পুরো কোয়ার্টার এলাকা উজ্জ্বল হয়ে উঠে । আধ ঘন্টা ধরে পুরো এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেন্ট্রিরা সন্দেহজনক কিছুই পায় নি ।
রাহাত বিষয়টা নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে । তার চোখে মুখে চিন্তার বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে । সে একটার পর একটা ছক কষে যাচ্ছে, কিন্তু কোনটাই কাজে আসছে না । আমি হঠাৎ করে বললাম, আচ্ছা সে তো রহস্য মানব না হয়ে অন্য কিছুও হতে পারে? প্রশ্ন শুনে রাহাত আমার দিকে বোকার মত চেয়ে বলে, কি বলতে চাও তুমি? আমি বলি, এই পাহাড়ে জঙ্গলে অশরীরী বা অতিপ্রাকৃত অনেক ঘটনাই ঘটে । কত গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে এগুলি নিয়ে!
রাহাত আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, নায়লা কল্পনায় ফ্যান্টাসির ঘোড়ায় চড়ে সাগর নদী পাড় হওয়া খুবই সহজ! কিন্তু আমি এই দুর্গম পাহাড়ের গভীর অরণ্যে রাতের পর রাত ডিউটি করেছি । অশরীরী বা অতিপ্রাকৃত কিছু থেকে থাকলে অনেক আগেই তাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হতো । তুমি এটা নিয়ে ভেবোনা, এই রহস্য মানবকে ধরার সব সায়েন্টেফিক উপায় আমি খুঁজে দেখছি ।
রাহাত রিডিং রুমে কম্পিউটার খুলে বসে আছে । মামনি হাটিহাটি পা পা করে একবার ওর বাবাকে ছুঁয়ে আসছে, আরেকবার আমাকে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে । বাবা বাসায় থাকলে ওর আনন্দের শেষ নেই! রাহাত সারাদিন ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে বিকেলে বেরিয়ে গেল । সন্ধ্যায় টেকনেশিয়ান এনে ছাদে কি সব করলো! রাহাত আমার দিকে মিচকা হেসে বললো, সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছি!!
-কেন?
"লুকিয়ে দেখতে আসা আমার বউয়ের প্রেমিক বাবাজিটা কে, সেটা দেখতে হবে না!
আমি হাসতে হাসতে ওর পিঠ জড়িয়ে বলি, 'তুমি থাকলে কেউ আসবে না! রাহাত কপাল কুঁচকে বললো, "ও তাই নাকি! আচ্ছা, এত দুর..!' আমি পেছন থেকে চুলের মুঠি ধরে টান দিয়ে বললাম, ফাজলামো হচ্ছে খুব!
রাহাত এবার আরো সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, "আমি তোমার পাশে আছি কি না, এটা জানতেও তিনি একবার আসতে পারেন!'
হাহাহা, তারপরে দুজনেই হেসে হেসে লুটোপুটি খেলাম ।
রাতে রাহাত বললো, 'তুমি শুয়ে পড়ো, ক্যামেরায় সেই রহস্যময় আগুন্তক ধরা পরেন কিনা, আমি চেক করি!' আমি বাবুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম । রাহাত পাশে থাকলে দস্যু দানোর ভয় আমি করি না! সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি রাহাত বিছানায় নেই! রিডিং রুমে কম্পিউটারের সামনে মাথা রেখে বসে বসে ঘুমোচ্ছে । 'আশ্চর্য্য, বিছানায় এসে ঘুমোবে না! এখন উঠো, ফ্রেস হও, আমি চা আনছি!' রাহাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গোপন ক্যামেরায় আসা গত রাতের ভিডিও ফাইল টেনে টেনে দেখতে থাকে । চা নিয়ে এসে দেখি সে চোখদুটো বড় বড় করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে ।
-কি হলো? 'না- কিছু না' বলে ভিডিওটা বন্ধ করে আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দেয় । একি, বাসি মুখে..
'হ্যাঁ, তুমি আমার পাশে এসে লক্ষ্ণীটির মতো করে বসো! তোমাকে মুরংদের একটা মজার গল্প শুনাই..।'
আমি রাহাতের পাশে এসে বসলাম । চা'য়ে চুমুক দিতে দিতে রাহাত গল্প বলে যাচ্ছে । দুরের পাহাড়ের চূড়ায় এক ধরণের হনুমান বাস করে । এরা কখনো চূড়া ছেড়ে নিচে নামে না । আগে সংখ্যায় অনেক ছিল, এখন কমতে কমতে অতিবিলুপ্ত শ্রেনীতে নাম লিখিয়েছে । এই হনুমানেরা ছিল অসম্ভব প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন । অনেকটা মানুষের মত । মানুষের মতোই ছিল তাদের অঙ্গভঙ্গি, ভাব প্রকাশের কায়দা । তো, এই হনুমানদের একটা মজার প্রবৃত্তি মুরংদের বেশ ঝামেলায় ফেলে দিত । পাহাড়ী ঝিরিতে স্নান করার সময় তারা মুরং মেয়েদের জামাকাপড় ছিনতাই করতো!
'হাহাহা, এতো দেখি হনুমানের কৃষ্ণলীলা!' রাহাতের গল্প শুনে আমি হেসে ওর উপর লুটিয়ে পড়ি!
-হ্যাঁ, হনুমানের কৃষ্ণলীলা! ওরা মুরং পুরুষের কাপড়চোপড় কখনো ছিনতাই করতো না । শুধু মুরং মহিলাদের..
"ওমা, তাই!"
-"হ্যাঁ, পার্ভাটেড মানুষের প্রবৃত্তি যেন! কাপড় ছিনিয়ে নিয়ে ওরা মেয়েদের নগ্ন দেহ দেখে মজা পেত । বুড়ো মুরংদের কাছে অতীতে ওদের মহিলাদের উপর এই হনুমানের আক্রমনের অনেক গল্প শুনা যায় । ঘটনাগুলো হয়ত বিশ-পঞ্চাশ বছর আগের । তখন এই পাহাড়ে ছিল মানুষে হনুমানে যৌথ রাজত্ব! ইন্টারনেট ঘেটে জানলাম, বিরুথ গেল্ডিকাস নামের একজন জার্মান মহিলা এই প্রজাতির হনুমানের বোর্ণিওয়ান আত্মীয় ওরাংওটাং নিয়ে গবেষণা করতেন । অনেক বছর ধরে বোর্ণিওর গহীণ জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন । একবার কয়েকটা দামড়া পুরুষ ওরাংওটাং তাকে আক্রমন করে বসে । আক্ষরিক অর্থে আক্রমন নয়, সেক্সোয়াল এসাল্ট!
"কি বলো! এও কি সম্ভব?"
-'হ্যাঁ সম্ভব! মানুষের সাথে এদের প্রায় নব্বোই শতাংশ জিনগত সাদৃশ্য রয়েছে । আমি ঐ ভদ্রমহিলার ছবি দেখেছি, তিনি নিঃসন্দেহে অসম্ভব রুপবতী ছিলেন!
আমি অবিশ্বাসী সুরে বলি, 'এই সকালবেলা এসব গালগল্প না শুনালে হয় না!'
রাহাত তার হাত দিয়ে আমার কাঁধ শক্ত করে ধরে বলে, "না নায়লা, গালগল্প নয়! চরম বাস্তব একটা সত্য তোমাকে শুনাতে যাচ্ছি..
আমি জানতাম, এই পাহাড়চূড়ায় এখনো দু'চারটা হনুমান থাকা বিচিত্র নয় । অতীত অভিজ্ঞতায় তারা জানে আমাদের এই কোয়ার্টারগুলোতে মহিলারা থাকেন । সেন্ট্রিদের নিরাপত্তাবেস্টনী এড়িয়ে এদের এখানে চলে আসা অসম্ভব কিছু নয়! অন্তত আমার গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়া ভিডিও ফুটেজ এটাই বলে, গতরাতেও এই দামড়া হনুমান অনেকক্ষণ ধরে তোমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল! তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছিলে বলে টের পাওনি । হয়ত কোনদিন বেখেয়ালে তোমার গাউন ঠিক ছিলনা, হতেই তো পারে এরকম! তোমার উন্মুক্ত শরীর আর রুপসৌন্দর্য্য তাকে আকৃষ্ট করেছে! তারপর থেকে রোজ রাতে, বিশেষকরে যে রাতে তুমি একা থাকো- স্কাইলাইটের গ্লাসের ওপার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখে..
আমি কিছুই ভাবতে পারছিনা! মাথাটা ভনভন করে যেন ঘুরছে । রাহাত ইতিমধ্যে গত রাতে তোলা ভিডিও টেপ ছেড়ে দিয়েছে । একটা বুড়ো আদিম বনমানুষ হেলে দুলে ধীর পায়ে হেটে যাচ্ছে । কিছু সময়ের জন্য ক্যামেরার দিকে তাকিয়েছে, তার মুখটা ভেসে এলো স্ক্রীনজুড়ে । সেই একজোড়া উৎসুক চোখ আমার সামনে! হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই চোখ জোড়া..
*******************************************
গল্পটি সত্যকাহিনী নিয়ে লেখা । গল্পের মুল থিম এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন ব্লগার নিমচাঁদ ভাই । শিরোনামটাও তার দেয়া ।