ব্লগের এই মজা, নিজের আবেগ ইচ্ছে মতো প্রকাশ করা যায়। কষ্টগুলো লিখে দেখি কমানো যায় কিনা!
সেদিন মা দিবস নিয়ে লেখা প্রজাপতির একটি ব্লগ পড়ে খুব চমকে উঠেছিলাম! আসলে প্রজাপতির নয়, ওনার মা'র লেখা চিঠি পড়ে। খুব ছোটবেলায় আমি হোস্টেলে ছিলাম, তখন বাসা থেকে প্রচুর চিঠি পেতাম, মা, বাবা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন সবাই লিখতেন(চিঠি পাবার অনেক রের্কড করে ফেলেছিলাম সেই সময়), মার চিঠি থাকতো সব চেয়ে বেশী। প্রজাপতির মার চিঠির অংশের সাথে অদ্ভুত মিল আমার মায়ের কিছু চিঠির, এই চিঠি পড়ে একটু ঘোরের মতো হয়েছিলো বোধহয়, তা নাহলে কেন মনে হবে, "আমার কোন চিঠি কি কারো হাতে গেছে!" কয়েক মুহূর্তের জন্য মাথায় ছিলোনা, আরেকজন তার মা'র চিঠির কথা বলছেন।
আমার মা'র চিঠি তে মাঝে মাঝে এমন গভীর আবেগের কথা থাকতো তবে বাবা'র চিঠি একটু অন্য রকম হতো! সরাসরি আবেগের প্রকাশ ছিলো খুব কম। বাসার সবার কাছে শুনেছি, আমি চলে গেলে বাবা প্রায় ই বারান্দায় বসে থাকতেন, অন্ধকারে একা। আলো জালাতেন না, হয়তো তাঁর আবেগ কাউকে দেখাতে চাননি বলে।
বাবার একটি চিঠি পেয়ে খুব কেঁদেছিলাম মনে আছে। খুব সাধারন কথা, তেমন কষ্টের কিছুনা তবে মনে আছে সেদিন সারাদিন কেঁদেছিলাম চিঠিটি পেয়ে! বাবা লিখেছিলেন; "মামনি, এখন খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, প্রায়ই হয় ইদানিং, তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। আমার ছোট মা তো বিদ্যুত চমকালে আর মেঘের শব্দ শুনে খুব ভয় পায়, মামনি একা একা কি করছে! ঝড় হলে ভয় পেও না মা আমার।"
খুব সাধারন কথা তাই পড়ে আমি সারাদিন কেঁদেছিলাম, তার পরেও যতবার পড়েছি ততবার। এমন ই জিবন! তার অনেক দিন পর আমার বাবা কে যখন কবরে শুয়ে দিয়ে সবাই বাসায় ফিরেছে, সাথে সাথে চারিদিক কাঁপিয়ে ঝড়, বৃষ্টি। বিদ্যুতের ঝলক আর মেঘের গর্জনে চারিদিক তোলপাড়, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিলো সেদিন! ফজরের সময় বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, সারা দিন আমি একটুও কাঁদিনি। আমার সদ্য বিধবা মা নিজের শোকের মাঝে আমাকে নিয়ে ভিষন ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। আমি খুব স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরন করছিলাম, সেদিন যা ছিলো বড় বেশী অস্বাভাবিক! সন্ধ্যায় সবাই বাসায় ফেরার সাথে সাথেই শুরু হওয়া সেই ঝড়ে কি যে ছিলো, আমার সংযম শেষ হয়ে গেলো, পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করেছিলাম। আমার যে বাবা মেঘ ডাকলে আমার জন্য এমন মন খারাপ করতেন, তিনি এখন মাটির নিচে অন্ধকারে একা! মনে মনে কতোবার বলেছি তখন, "বাবা আমি খুব ভয় পাচ্ছি, তুমি এক বার এসো Please বাবা"!
তারপর এমন হলো, মধ্যবয়ষ্ক কাউকে দেখলে বাবার কথা মনে পড়ে যেতো, ওনাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। আমি তখন ইন্টার্নশীপ করছি, রুগীদের তো এড়িয়ে চলা যায়না! আমাদের দেশের বাবারা এতো ভালো, এতো সুন্দর করে কথা বলেন ওনারা! কেউ যখন বলতেন "মা, আপনি আজ কেমন আছেন?" " মা, আপনার মন আজকে খারাপ মনে হয়?" আমি একটু হেসে কোন রকমে ডক্টর'স রুমে চলে যেতাম নিজেকে সংবরন করতে। ওনারা কোনদিন জানবেন না, ওনাদের এই স্নেহমাখা কথা আমাকে কি তীব্র কষ্ট দিতো! সেসময় খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সব বাবারা এক রকম। বিত্তশালী থেকে বিত্তহীন, শিক্ষিত আর নিরক্ষর, সব বাবারা দেখতে এক রকম!
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২২