somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশ চিরজীবী হোক!

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল আজকে কিছু একটা ঘটবে। গত দুইদিন ধরে রেডিওতে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে, "পাকিস্তানি সিপাহী, হাতিয়ার ডালদো!"
আকাশে কিছুক্ষণ পরপর উড়ে যাচ্ছে ভারতীয় যুদ্ধ বিমান। তারা বৃষ্টির মতন লিফলেট বিলি করছে। সেখানেও শত্রুবাহিনীকে একই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আরমানিটোলায় নিজের বাড়ির ছাদে এসে পড়া অসংখ্য লিফলেটের একটি কুড়িয়ে নিয়ে শাহানা খানম পড়তে চেষ্টা করেন। পারেন না। অশ্রুতে তাঁর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। তাঁর বড় ছেলে ফরিদকে মিলিটারী বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে তাঁর আর কোন খোঁজ নেই। ছেলের চিন্তায় তাঁর স্বামীর স্ট্রোক করেছে। তিনি এখন পঙ্গু হয়ে বিছানায় শুয়ে। একটাই আশা, ছেলের মুখ দেখলে যদি তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে বসেন!
জানোয়ারগুলা আত্মসমর্পণ করলে ফরিদ নিশ্চই বাড়ি ফিরবে। তিনি গত কয়েক রাত ধরেই তাঁকে নিয়ে ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন দেখছেন। আল্লাহ নিশ্চই প্রমাণ করবেন স্বপ্ন স্বপ্নই হয়ে থাকে। এর কোন অর্থ হয়না।
রাস্তা দিয়ে সাদা পতাকা (ঠিক পতাকা নয়, পতাকার মত করে বাঁধা একটি সাদা গেঞ্জি) উড়িয়ে একটি ভারতীয় গাড়িকে যেতে দেখে লুৎফা বেগমও আশায় বুক বাঁধেন। গাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যকেও তিনি দেখেছেন। এত খোলামেলাভাবে যখন ওরা ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে, তার মানে নিশ্চই ভাল কিছু ঘটতে চলেছে। যুদ্ধ কী তবে শেষ হয়ে গেছে? তাঁর স্বামী, মরিয়মের বাবা, সেই আটমাস আগে যুদ্ধে গেছেন, তিনি তাহলে ফিরে আসবেন? কচুর লতি দিয়ে ইচা মাছ খেতে তিনি খুব পছন্দ করেন। কচুর লতি পাওয়া যাবে, কিন্তু ইচা মাছ তিনি কোথায় পাবেন? আজকে দুপুরেই রান্না করে রাখতে হবে। তাঁর মন বলছে, আজকে দুপুরেই তিনি বাড়ি ফিরে আসবেন।
এদিকে ক্যান্টনমেন্টের আন্ডারগ্রাউন্ড হেডকোয়ার্টারে কবরের নিরবতা বিরাজ করছে। দুই লাইনের একটি চিরকুট ঘুরাফেরা করছে পাকিস্তানি জেনারেলদের হাত থেকে হাতে। সবাই কিছুক্ষণ পরপর চিরকুটে চোখ বুলাচ্ছেন, কিন্তু মুখে কোন কথা নেই।
জেনারেল নিয়াজি আবারও দেখলেন চিরকুটের লেখাটি।
"প্রিয় আব্দুল্লাহ, তোমার সব বাহাদুরি শেষ। বুদ্ধিমানের মত আত্মসমর্পণ কর।...."
চিরকুটটি লিখেছেন ব্রিটিশ আমলে নিয়াজিরই সাথে কমিশন্ড অফিসার্স ট্রেনিং নেয়া মেজর জেনারেল নাগরা। যিনি এখন ঢাকা মুক্তি লড়াইয়ের অধিনায়ক।
নিরবতা ভাঙ্গলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নিয়াজিকে সরাসরি উর্দূতে প্রশ্ন করলেন, "তোমার কোন রিজার্ভ বাহিনী আছে?"
নিয়াজি উত্তর দিলেন না।
রিয়াল অ্যাডমিরাল শরীফ পাঞ্জাবিতে জানতে চাইলেন, "কুছ পাল্লে হ্যায়?" (থলেতে কিছু আছে?)
নিয়াজি তাকালেন মেজর জেনারেল জামশেদের দিকে। ঢাকা রক্ষার দায়িত্বে তিনি ছিলেন। জামশেদ মাথা নিচু করে ফেললেন। বাকি জেনারেলরা যা বুঝার বুঝে নিল।
ভবনের বাইরের মাঠে জিপ থামিয়ে ভিতরে এসে একদল যুবক বলল, "আপনারা ভয় পাবেন না, আমরা মুক্তিবাহিনীর ছেলে। আপনারা আজকে থেকে মুক্ত!"
দিনের পর দিন বিরতিহীনভাবে অত্যাচারিত হতে হতে মেয়েদের ততদিনে মানসিক সুস্থ্যতা নেই। গুন্ডা মতন চেহারার মুক্তিবাহিনীর ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে তাই তাঁরা আর্তনাদ করে উঠলেন, "খবরদার! কেউ সামনে আসবি না! খবরদার!"
তাঁদেরই বা কী দোষ? এইরকম চেহারার একদল বাঙ্গালি যুবকই তাঁদের বাড়ি থেকে ধরে এনে জানোয়ারদের হাতে তুলে দিয়েছিল।
মুক্তিবাহিনীর এক যুবক মাথার গামছা খুলে এক যুবতীকে শরীর ঢাকার জন্য এগিয়ে দিয়ে বলল, "ভয় নাই বোন, আমরা আপনার ভাই! আমরা আপনাদের নিতে এসেছি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে!"
বিকাল চারটা উনত্রিশ মিনিটে জনঅরণ্যে পরিণত হওয়া রেসকোর্স ময়দানে লজ্জায়, অপমানে লাল হয়ে যাওয়া নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণ দলিলে সই করছেন, তখন শহরবাসী মানুষদের কারোরই মাথার ঠিক নেই।
মগবাজারের লিটন একবার বাড়ির ছাদে ছুটে যাচ্ছে, আবার রাস্তায় নেমে আসছে। "হাহাহা" করে চিৎকার করে হাসছে। মুক্তির আনন্দ তাঁর মাথা এলোমেলো করে দিয়েছে।
রামপুরার কলেজ পড়ুয়া ছাত্র সেলিম ছাদে উঠে নিজের বই খাতা কুচি কুচি করে ছিড়ে বাতাসে কাগজ উড়াচ্ছে। তাঁর কাছে এটাই পুষ্পবৃষ্টি।
ফুলবাড়িয়ার আকরাম হাউমাউ করে কাঁদছে। যাকেই সামনে পাচ্ছে, তাকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আর মুখে বলছে, "আমরা জিইত্যা গেছি! ও ভাই! আমরা জিইত্যা গেছি!"
চারিদিকে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। চারিদিকে মানুষের উল্লাস শোনা যাচ্ছে। "জয় বাংলা! জয় বাংলা!"
বাসের ছাদে বসে রাইফেল উঁচু করে উল্লাসরত গেরিলারা বাড়ি ফিরে আসছেন। লোকজন তাঁদের দেখে আরও জোরে স্লোগান দিচ্ছে। কেউ কেউ কাছে এসে জড়িয়ে ধরছেন। সারা জীবনের জন্য একটা গল্প তাঁরা পেয়ে গেলেন।
"যুদ্ধফেরত এক মুক্তিযোদ্ধাকে জড়িয়ে ধরার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল!"
নিজের স্বামীকে বরণ করতে কচুর লতি দিয়ে ইচা মাছ রান্না করতে বসেন লুৎফা বেগম। অনেক ঝামেলা করে তিনি মাছ সংগ্রহ করেছেন। মানুষটা ফিরে এসে প্রিয় খাবার দেখে নিশ্চই খুশি হবেন।
ছেলের সন্ধানে মিলিটারী ক্যাম্প, থানা, বন্দীশিবিরের গেইট থেকে গেটে খুঁজে ফেরেন শাহানা খানম। তারপর তাঁর মনে হয়, খোকা বুঝি বাড়িতেই ফিরে গেছে। তিনি আবার বাড়ি ফিরে আসেন। কাউকে না পেয়ে আবার ছুটে যান নতুন কোন ঠিকানায়। অনেক দিন হয়ে গেছে তিনি ছেলেকে দেখেন না। তিনি আর একদিনও অপেক্ষা করতে রাজি নন।
বন্দিনী অবস্থা থেকে মুক্ত করে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিদেশী ক্যাম্পে। সেখানে তাঁদের চিকিৎসা করানো হবে। তাঁদের সন্ধানে বাড়ি থেকে কেউ আসছে না কেন? তাঁদেরকে জানোয়ারেরা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের কী দোষ ছিল এতে? সমাজ কেন তাঁদের পরিত্যাগ করবে? তাঁরা যে বীরাঙ্গনা! দেশ স্বাধীনের পেছনে তাঁদের কী কোনই অবদান নেই?
যুদ্ধ শেষে অনেক, অনেক দিন পর্যন্ত লুৎফা বেগম প্রতি বেলায় কচুর লতি দিয়ে ইচা মাছের তরকারী বানিয়ে স্বামীর প্রতিক্ষায় বসেছিলেন।
অনেক, অনেকদিন পর্যন্ত শাহানা খানম তাঁর বড় ছেলে ফরিদের খোঁজে বন্দীশিবির থেকে হাসপাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে আবারও বন্দীশিবিরে ছুটে গিয়েছেন। অবচেতন মন বুঝে ফেলেছিল ছেলের ভাগ্য! তবু তিনি একটি অলৌকিকতার আশায় ছোটাছুটি করেছেন।
বীরাঙ্গনা দূর্গা রানী দাশ এখনও প্রায়ই একই দুঃস্বপ্ন দেখেন। তাঁকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে এক বুনো দাঁতাল শুয়োর তাঁর উপর চড়ে বসছে।
মতিন সাহেব এখনও সেই দিনটির কথা ভুলতে পারেন না যেদিন তাঁরা দল বেঁধে নজরুলের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা মার পা ছুঁয়ে তাঁদের সন্তানের শহীদ হবার খবর দিয়েছিল।
যাদের নিঃস্বার্থ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশে পেয়েছি, বিজয়ের এই আনন্দ দিনে তাঁদের পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক!
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×