পূজার সময়ে কিছু প্রশ্ন সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করেন, মুসলিম এবং মাঝে মাঝে অমুসলিমরাও। ভাবলাম ইনবক্সে জবাব দেয়ার পরিবর্তে গ্রূপে সরাসরি বলাই ভাল। তবে প্রথমেই ডিসক্লেইমার দিয়ে দেই - আমি কোন ইসলামিক স্কলার না। ফিক্হ নিয়ে কোন জ্ঞান আমার নেই। স্বল্প জ্ঞানে যা জানি, তার উপর ভিত্তি করে বলছি। কেউ ফিক্হ (আইন) হিসেবে ইন্টারপ্রিট করবেন না। বিস্তারিত জানতে নিজে আরও গবেষণা করুন। নিজেরই উপকার হবে।
১. পূজার সময়ে মুসলিম বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে শুভেচ্ছা জানাতে মিষ্টি এবং খাবার নিয়ে হিন্দু বন্ধু এসেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কী সেই খাবার গ্রহণ করবো?
উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই। কেবল হাসিমুখে গ্রহণই করবেন না, সাথে সেই থাল ভর্তি করে নিজের থেকেও কিছু খাবার দিয়ে দিবেন। রাসূল (সঃ) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রিয়জনদের সাথে উপহার বিনিময় করতে। তাছাড়া প্রতিবেশী হিসেবে তাঁদের তিনটি অধিকার আছে আমাদের উপর। প্রথমটি ইসলামের অধিকার, দ্বিতীয়টি আত্মীয়তার (kinship) অধিকার, এবং তৃতীয়টি কেবলমাত্র প্রতিবেশীর অধিকার। ব্যাখ্যা করি, ধরা যাক আমার মামাতো ভাই আমার প্রতিবেশী। ওর তাহলে আমার উপর তিনটি হক দাঁড়িয়ে গেল। একই সাথে সে মুসলিম, আমার আত্মীয় এবং প্রতিবেশী। আবার ধরা যাক অমিতাভ বচ্চন আমার প্রতিবেশী। তখন তিনি কেবলমাত্র প্রতিবেশী হবার জন্যই আমার উপর অধিকার রাখেন।
এক্ষেত্রে আমার হিন্দু প্রতিবেশী আমার বাড়িতে পূজা উপলক্ষে খাবার নিয়ে এলে আমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই তাঁর মন ভেঙে দেয়ার। "এই খাবার আমার জন্য হারাম! আপনি ফেরত নিয়ে যান।" - এইসব বর্বর আচরণ আপনি করতে পারবেন না। আপনি স্বানন্দে খাবার নিবেন। তারপর নিজে থেকে তাঁকে কিছু দিবেন। তারপর থালি খুলে দেখবেন কি আছে। এরপর আসবেন হালাল হারামের বিচারে।
তো, প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। সবাই বুঝতে পেরেছেনতো?
২. পূজার খাবার কী আমার জন্য হারাম?
খুবই ক্রিটিকাল প্রশ্ন। সবাই অতি সহজেই হ্যা, না তে উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের ধর্ম এত সহজেই হ্যা, না বলে না। "হারাম" একটি অতি বিরাট শব্দ। একে ঘোষণা করতে হলে অনেক দালিলিক প্রমান লাগে। কুরআনের আয়াত অথবা সহীহ হাদিসের রেফারেন্স না থাকলে কোন কিছু এইভাবে হালাল হারাম ঘোষণা করতে পারেন না কেউ। যেমন শূকর হারাম, এইটা কুরআনে এক্সপ্লিসিট। কোন কনফিউশন নেই। আল্লাহর নাম ছাড়া জবাই করা বা ভিন্নভাবে হত্যা করা প্রাণী হারাম - সেটাও এক্সপ্লিসিট। কথা প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে ফেলি দ্রুত। বন্যপশু (হরিণ) গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এটা কী হালাল হবে? উত্তর জানার আগে আপনিই আমাকে বলেন, আপনি কী হরিণকে জবাই করতে পারবেন? ছুরি নিয়ে দৌড়ে তার সাথে পারবেন? বা উড়ন্ত পাখি? শিকার করা হালাল প্রাণীর মাংস খাওয়া হালাল - শুধুমাত্র এইটা নিশ্চিত করতে হবে যে সে যেন রক্তক্ষরণে মরে। যেমন বন্দুকের গুলি, বর্শা বা তীরধনুক। গর্তে ফেলে বা পাথর চাপা দিয়ে হত্যা করা শিকারের প্রাণী হারাম।
জবাই রুল সেসব প্রাণীর উপর এপ্লাইড যেগুলো আপনার অধীনে (কাবুতে) থাকে। যেমন ছাগল, গরু ইত্যাদি। এগুলোকে ইচ্ছা করলে আপনি জবাই করতে পারেন, কিন্তু তা না করে ইলেকট্রিক শক বা গুলি করে, বা শ্বাস রোধ করে হত্যা করলে সেটা হারাম। (নিয়মটি ইয়াসির ক্বাদীর কাছ থেকে শোনা। বিশ্বাস রাখতে পারেন লোকটির জ্ঞানের উপর।)
তো যা বলছিলাম। হারাম খাবার সর্বাবস্থায় হারাম। আমাকে যদি দাড়িওয়ালা মুসলিমের বাড়িতে শূকর বা অজবাইকৃত পশুর মাংস পরিবেশন করা হয়, সেটা হারাম। কিন্তু হিন্দু বাড়িতে জবাই করা পশুর মাংস দেয়া হলে সেটা হালাল। এইটা ক্লিয়ার? এখন আসি মূল প্রশ্নে, যা হচ্ছে পূজার খাবার।
পূজার খাবারে যদি মাংস থাকে, তাহলে আপনাকে ভাবতে হবে। ভেজিটেবল বা মিষ্টান্ন নিয়ে বড় বড় স্কলারদের মধ্যেই দ্বিমত আছে। কারন কুরআনে নিষেধ করা হয়েছে আল্লাহর নাম ছাড়া হত্যা করা প্রাণীর "মাংস" খাওয়া হারাম। ভেজিটেবল বা মিষ্টান্নের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। সেটা বিভিন্ন স্কলারের বিভিন্ন রকমের ইন্টারপ্রিটেশনের উপর বিভিন্ন অঞ্চলে/স্কুলিংয়ে বিভিন্ন রুল চালু হয়েছে। এবং দুই পক্ষেই এমন সব স্কলার আছেন যারা বিশ্ববরেণ্য। কাজেই আপনি যেকোন একজনকে ফলো করতে পারেন। মানে হচ্ছে, আপনি ইচ্ছা করলে খেতেও পারেন, ইচ্ছা করলে নাও খেতে পারেন। বাকি আল্লাহ জানেন।
ঠিক যেমনটা কাঁকড়া বা ঝিনুক খাওয়ার মতন। এক গ্রূপ বলে পানির নিচের যেকোন কিছু হালাল। আরেক গ্রূপ বলে যা দেখতে "কুৎসিত" তা হালাল নয়। এখন এই গ্রূপ আবার কুৎসিতের ডেফিনেশন দিতে পারেনা। আমার চোখেতো আল্লাহ সৃষ্ট কোন প্রাণীকেই কুৎসিত মনে হয়না। তাহলে কী সব হালাল হবে আমার জন্য?
কাজেই আপনি যদি মিষ্টি, ফলমূল ইত্যাদি খান - আপনি কাফির হয়ে যাবেন না। বাকিটা আল্লাহ জানেন।
যাই হোক, মাংসের ব্যাপারে সবারই রুল এক। কারন সেটা কুরআনের স্পষ্ট আয়াতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
এখন আপনি যদি জানেন (হিন্দু প্রতিবেশী এক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করতে পারেন, দেবার সময়েই অনেকে বলে দেন এই মাংস অমুক দোকানের কেনা) যে খাসির মাংসটি শাহ মোহাম্মদ বঙ্গাই মিয়ার মাংসের দোকান থেকে কেনা হয়েছে, তাহলে আপনি সেই মাংস খেতে পারবেন। কারন ওটা জবাই করা খাসির মাংস। আপনি যদি শিওর না হন, মনে খচখচানি থাকে, বা আপনি দেখেছেন তাঁদের বাড়িতে পাঠা বলি হতে - তাহলে আপনি আপনার অপর কোন হিন্দু প্রতিবেশীর কাছে মাংসটি উপহার/শুভেচ্ছা হিসেবে পাস করে দিতে পারেন। উপহার পাস করাকে ছোট চোখে দেখার কিছু নেই। এক্ষেত্রে পাস না করলে শুধুশুধু মাংসটুকু নষ্ট হবে। সেটাই বরং অপমান হবে।
এখন যদি কেউ পূজার খাবার খায়, তাঁকে নাস্তিক, কাফির মুরতাদ ডাকা, অথবা যারা খায় না, তাঁদের কট্টর মোল্লা, নয়া ছাগু, ফেসবুক মুমিন ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে উম্মাহর মাঝে বিভক্তি করাটা বরং আরও বড় পাপ। ওহুদের যুদ্ধময়দানে মুনাফিকরা যখন আলাদা হয়ে গিয়েছিল, একদল সাহাবী প্রস্তাব করেছিলেন, আগে ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তারপরে যুদ্ধময়দানে যেতে। আরেক গ্রূপ বলেছিলেন, আগে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারপরে ওদের ব্যবস্থা নিতে। এই নিয়ে দুইদল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেলে আল্লাহ কুরআনে আয়াত নাজেল করেন এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি না করতে। বরং ঐক্য ধরে রাখাটাই মুসলিমের কাজ।
পূজার খাবার খাওয়া সেই তুলনায় কোন ঘটনাই না। কাজেই এই পারস্পরিক ট্যাগা ট্যাগি বন্ধ করেন। ঐক্যে ফোকাস করুন।
৩. হিন্দুদের পূজার সময়ে কী মুসলিমদের আনন্দ করা যাবে?
বন্ধুবান্ধব এক হলে এমনিতেই সময় আনন্দে কাটে। পূজার সময়ে যদি আপনাকে আপনার প্রতিবেশী বা বন্ধু তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন, আড্ডা জমে, খাওয়া দাওয়া হয়, কেন যাবেন না? নবী (সঃ) নিজে এক ইহুদি নারীর বাড়িতে খেতে গিয়েছিলেন, সেই ঘটনা কী ভুলে গেলেন? হ্যা, মহিলা তাঁকে বিষ খাইয়ে দিয়েছিল সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমাকে বুঝতে হবে মূল বিষয়টা, নবী (সঃ) দাওয়াতে গিয়েছিলেন। এবং তাঁর সাথে অনেক সাহাবীও ছিলেন। যদি যাওয়া নিষেধ হতো, তাহলে তিনি যেতেন না। এবং নবীর (সাঃ) চেয়ে বড় মুসলিম নিশ্চই আপনি আমি না। হ্যা, আপনার প্রতিবেশী বা বন্ধু যদি আপনাকে বিষ খাওয়ানোর ধান্ধায় থাকে, তাহলে প্লিজ যাবেন না। জানের মায়া বড় মায়া।
পূজা চলাবস্থায় মন্দিরে যেতে হলে কিছু সমস্যা হতে পারে, সেটা নিয়ে আমি আগের এক লেখায় লিখেছি। এবং সেটাও হিন্দুদের ইনসাল্ট করতে নয়, বরং নিজের ধর্মকে সম্মান করতেই। অতি সংক্ষেপে সামারাইজ করলে আল্লাহকে সাকার আকৃতি দিয়ে পূজা করতে দেখলে আমাদের শক্ত ঈমানের লোকজনের মনে পূজারীদের উপর রাগ উঠতে পারে, যা আমাদের ধর্মে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ।
আবার দুর্বল ঈমানের লোকজন অনেক কিছুই নিজ ধর্মে যোগ করে ফেলতে পারে। যেমন মিলাদুন্নবী, ওরস, পীর ফকিরে বিশ্বাস, তাবিজ কবজ ইত্যাদি - সব ইসলাম ধর্মে পরে যোগ করা হয়েছে, যা হারাম।
কিন্তু পূজা বাদে বাকিটা সময় আমি মন্দিরে যেতে পারবো। হিন্দুরা আনন্দ করছে বলে আমি ওদের সাথে আনন্দে যোগ দিতে পারবো না - এমনতো কোন কথা নেই।
অনেকেই এতে হজরত উমারের (রাঃ) একটি উক্তি বর্ণনা করেন। তিনি নাকি নিষেধ করেছেন "তোমরা কেউ বিধর্মীদের পূজার সময়ে ওদের মন্দিরে যেও না। কারন ঐ সময়ে আল্লাহর গজব/লানত নাজিল হতে থাকে। তোমরাও গজবের শিকার হবে।"
কথা হচ্ছে, উমার (রাঃ) যে কথাটা বলেছেন, এটি কতটা অথেন্টিক সেটা আমরা জানিনা। আমাদের ধর্মে যেখানে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) নামেই অনেক জাল হাদিস ভেসে বেড়ায় (যেমন জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চিনে যাও। বা শিক্ষকের বেতের আঘাত ছাত্রের শরীরের যেখানে পরবে, তা বেহেস্তে যাবে), সেখানে উমারতো (রাঃ) কেউই নন। তারপরেও যদি ধরে নেই উমার এমন কথা বলেছেন, তাহলেও কিছু ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে।
ক. উমারের অডিয়েন্স ছিলেন সবাই মুসলিম। আমি মুসলিমদের মধ্যে যেসব কথা, ভোকাবুলারি ব্যবহার করতে পারবো, অনেকক্ষেত্রে বিধর্মীদের ক্ষেত্রে সেই একই ভোকাব ব্যবহার করতে পারবো না। এক্ষেত্রে যেমন একজন মুসলিম মাত্রই বুঝেন শিরক তাঁর জন্য কতটা গুনাহ, কিন্তু একই সাথে এক শিরকই একজন বিধর্মীর কাছে ইবাদত - ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার মাধ্যম। তাঁকে ব্যাপারটা বুঝাতে হলে আমাকে তাঁর পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে বুঝাতে হবে। নবীর (সঃ) জীবনভর্তি এমন উদাহরণে। আমাদের দেশের নয়া মোল্লারা যার কিছুই জানেনা। নেমে যায় দ্বীনি দাওয়াত দিতে।
খ. উমার (রাঃ) তাঁর শব্দচয়নের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। নিজেও ছিলেন একজন কবি এবং দার্শনিক। তাই কুরআনের আয়াত প্রথম শুনেই চমকে উঠে বলেছিলেন, "কুরাইশরা এতদিন এর বিরোধিতা করে আসছে?" সেই উমারকে (রাঃ) বদনাম করা হচ্ছে এইভাবে তাঁর উক্তিটি প্রচার করে। উপরেই বললাম, যদি কথাটি তিনি বলে থাকেন, তবে তিনি বলেছিলেন মুসলিম জনসভায়, এবং অডিয়েন্সের মধ্যে একজনও যদি বিধর্মী থাকতো তবে অবশ্যই তিনি ভিন্ন শব্দ চয়ন করতেন। এখন মূর্খের দল তাঁর উক্তি বিধর্মীদের কাছে ফালতুভাবে প্রচার করছে। এতে বদনাম রটছে সেই ব্যক্তির যে তাঁর সাম্রাজ্যে বিধর্মীদের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা নিশ্চিত করেছিলেন। আহাম্মকেরা যদি একটু হলেও বুঝতো!
৪. পূজার সময়ে অনেকেই সিঁথিতে সিঁদুর দেন। এইটা কতটা ইসলাম সম্মত?
ইসলাম সম্মত ড্রেসই যদি পরেন, তাহলেতো আপনার চুলই দেখানোর কথা না। তাহলে সিঁদুরের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? ইসলামকে নিজে রিজেক্ট করে হিজাব ছাড়া ঘুরবেন, তারপর অন্য কেউ সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছে বলে তাঁকে অমুসলিম বলে গালাগালি করবেন, এইটাতো ইসলামের শিক্ষা না। ইসলাম কখনই কাউকে জাজ করার দায়িত্ব আপনাকে দেয় নি। বোরখাওয়ালী শয়তানও দেখেছি, বিকিনিওয়ালী ফেরেস্তাও দেখেছি। মানুষের বিচার করা হবে তাঁর মনের ভিত্তিতে, যেটা কেবল মাত্র আল্লাহর দ্বারাই করা সম্ভব। তাই কেউ হিজাব পড়লেই বেহেস্তে চলে যাবে, এবং বাকিরা দোজখী - এই জাতীয় ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন।
৫. পারফিউমে এলকোহল থাকে, সেই পারফিউম কী গায়ে মাখা হারাম?
আগে চিন্তা করেন, এলকোহল হারাম, নাকি মদ হারাম? এলকোহল মদের স্রেফ একটি কম্পোন্যান্ট। ওটা ওষুধেও ব্যবহৃত হয়। তখনতো হারাম হচ্ছেনা। মদ হারাম হয়েছে কারন এর ফলে আমরা হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যাই। পারফিউমতো আপনি সেবন করছেন না, গায়ে মাখছেন। এতে কী আপনি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যাচ্ছেন? না। তাহলে কেন হারাম হবে?
উদাহরণ দেই। আল্লাহ যেদিন মদ পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা দিলেন, সাহাবীরা তাঁদের বাড়িতে সঞ্চিত মদ রাস্তায় ফেলে দিলেন। এক সাহাবীর বর্ণনায় "মদিনার রাস্তায় সেদিন শরাবের নদী বইছিল।"
তারপর নামাযের সময়ে সাহাবীগণ সেই রাস্তা দিয়েই হেঁটে মসজিদে এসেছিলেন। নবী (সঃ) কী কোন নির্দেশ দিয়েছিলেন পা/জুতা ধুয়ে পরিষ্কার করে মসজিদ প্রাঙ্গনে আসতে? এমনতো কোন বর্ণনা শোনা যায় না। তাহলে গায়ে পারফিউম মাখলে নামাজ কেন নিষিদ্ধ হবে?
৬. এইবারে আসি সবচেয়ে অসভ্য আচরণে। সেটা হচ্ছে গোমাংস ভক্ষণ প্রসঙ্গ। অনেকে যুক্তি দেন "হিন্দুরা কোরবানির গরুর মাংস খায়না, তবে আমি কেন পূজার মাংস খাব?"
প্রশ্নটাতেইতো সমস্যা। হিন্দুরা যদি গোমাংস খেত, তাহলে কী আমি পূজার মাংস খেতাম? না, তাহলেও আমার জন্য পূজার মাংস (আল্লাহর নাম ছাড়া জবাই বা হত্যা করা যেকোন প্রাণী) খাওয়া হারাম থাকতো। তাই এই ফালতু যুক্তি প্রথমেই বাদ।
হিন্দুরা কিন্তু কোরবানির ঈদে খাসির মাংস খাচ্ছে। খ্রিষ্টানরা এসে খাচ্ছে গোমাংস। আমার বাবার এক হিন্দু বন্ধু ছিলেন, যিনি আমাদের বাড়িতে এসে গরুর কাবাব খেয়ে যেতেন। এমনকি এই ডালাসেই আমার এক সিনিয়র বন্ধু আছেন, যিনি আমার ছেলের আকিকার গরুর কিমা কাবাব খুব আনন্দ নিয়ে খেয়েছেন। যদিও আমি সার্ভ করার আগেই বলে দিয়েছিলাম কোনটা বিফ, কোনটা খাসি, কোনটা ভেজিটেবল। এখন কি আমি গিয়ে তাঁর বাড়িতে জবাইছাড়া মাংস খাব?
কিংবা কেউ বলতে পারেন "ওরাতো আমাদের ইবাদতে আসেনা। আমরা কেন যাব?"
আমাদের ডালাসে প্রায়ই (জুম্মা বা ঈদ) দেখা যায় চার্চের লোকজন বা এমনিতেই খ্রিষ্টান লোকজন মসজিদে আসেন। আমাদের নামাজ শেষে তাঁরা বক্তব্য দেন। কেউ ইলেকশনে দাঁড়ালে ভোট চান, অথবা কোন ইন্টার ফেইথ আলোচনা থাকলে বা সোশ্যাল ইস্যুজ থাকলে কথা বলেন। আমি নিশ্চিত, বিশ্বের আরও অন্যান্য খ্রিষ্টান প্রধান দেশের মসজিদেও একই দৃশ্য দেখা যায়। এখন যেহেতু ডালাসের মসজিদে তাঁরা আমাদের ইবাদতে নিয়মিত আসেন, তাহলে কী ডালাসে তাঁদের ইবাদতে আমাদের যাওয়া হালাল হবে এবং বাংলাদেশে হারাম হবে? ইসলাম কী এলাকাভিত্তিক ধর্ম? সৌদিতে যা হালাল, বাংলাদেশে তা হারাম? না। আমাদের নিয়ম ইউনিভার্স্যাল।
প্রথম কথা হচ্ছে, হিন্দুদের গোমাংস খাওয়ানোটাকে অনেক পার্ভার্ট ঈমানী দায়িত্ব মনে করে থাকে। যদিও আমাদের ধর্মে গোমাংস ভক্ষণ ফরজ নয়। ইনফ্যাক্ট, এইটা সত্য, উপমহাদেশ ছাড়া আমার মনে হয়না অন্যান্য দেশের মুসলিমদের মধ্যে গোমাংস ততটা জনপ্রিয়। এর কারন হতে পারে গরুর কালা ভুনা, বা শিক কাবাব, বা শুধু ভুনা, বা একশো মশলা ব্যবহার করে কাবাব ইত্যাদি ওরা বানাতে পারেনা। ওদের দৌড় কাঁচা মাংসে হালকা লবন এবং ব্ল্যাক পেপার ছিটিয়ে স্টেক, অথবা বারবিকিউ করে ব্রিসকেট বা রিব্স খাওয়া পর্যন্ত। ইউরোপে ভেড়ার মাংস, এবং মেডিটেরেনিয়ানদের ল্যাম্ব শ্যাক ছাড়া আর কিছু বিখ্যাত আছে কিনা জানিনা।
লোকাল এক ফার্মে এক আফগান "আমরা গরুর মাংসের ভক্ত" শুনে খুবই অবাক হয়েছিলেন। চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, "তোমরা বীফ খাও? ভেড়া না? কিভাবে?"
ওদের এলাকায় ভেড়ার মাংসের চাহিদা এক নম্বরে। পারলে একেকজন একেক বসায় একেকটা ল্যাম্ব খেয়ে ফেলতে পারে। বিফের চাহিদা সবার নিচে। তাই ভারতের কোন কোন রাজ্যে গোমাংস ভক্ষণে নিষেধাজ্ঞা জারিতে লোকজন যে জান দিয়ে দিচ্ছে, এইটা একটু বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছে আমার কাছে। বেহেস্তে যাবার জন্য গরুর মাংস খেতেই হবে, এমন কোন শর্ত নেই। আমার মনে নেই কোথাও পড়েছিলাম কিনা যে আমাদের নবী (সঃ) জীবনেও গোমাংস খেয়েছেন। আরবে তাঁরা উট এবং দুম্বার (ভেড়া) মাংস খেয়ে জীবন কাটিয়েছেন।
যাই হোক, পূজার সময়ে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বন্ধ করেন। যারা করছেন তাদের কথা চিন্তা করেই রাসূলুল্লাহ তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণে বলে গেছেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে। আল্লাহ নিজে বলেছেন তিনি চাইলে পৃথিবীতে কেউই শিরক করতো না।
মানে হচ্ছে, সবই তাঁর বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। আমাদের উচিৎ তাঁর নির্দেশ মেনে চলা। তাঁর দরবারে টোটাল সারেন্ডার। তাঁদের দেবদেবীকে নিয়ে মন্দ কথা না বলা।
অন্যের ধর্মকে ছোট করার চিন্তা মাথায় আসলে প্রথমেই ভাবুন, আপনি নিজের ধর্মকে কতটুকু জানেন? আপনি কী নবী এবং রাসূলের পার্থক্য জানেন? নবীর (সঃ) জীবিনী কখনও পড়েছেন? কুরআন খুলে কয়বার অর্থসহ পড়েছেন?
জানার জন্য পড়াশোনা করুন। যতই জানবেন, ততই বুঝবেন, অন্যকে ছোট করার চেষ্টা করলে নিজেকেই কেবল ছোট করা হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৩:৩০