somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এমএস ধোনি - আধুনিক ক্রিকেটের মাস্টারমাইন্ড

১৭ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক্রিকেটের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে, এবং ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার মতই ক্রিকেটে একটি কথা ধ্রুব সত্য, "Morning shows the day" এখানে প্রযোজ্য না। এখানে সকালে মেঘলা আকাশ থাকলেও রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুর দেখা দিতে পারে। শচীন টেন্ডুলকার, যার জীবনের প্রথম দুই ওয়ানডে ইনিংস শুরু হয় জোড়া রসগোল্লা দিয়ে, ক্যারিয়ার শেষে তিনিই হয়ে যান সর্বকালের সর্বসেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। সাঈদ আনোয়ারের টেস্ট ক্যারিয়ারও চশমা পরেই, তাঁর মতন ওপেনার আজও পাকিস্তান খুঁজে পায়নি। আমাদের সোহাগ গাজীর কথা মনে আছে? ক্যারিয়ারের শুরুতেই হ্যাট্রিক, সেঞ্চুরি এবং আজ বহুদিন ধরেই গায়েব।
তেমনই রাঁচির মতন ছোট শহর থেকে উঠে আসা যুবক এমএস ধোনি, যার অভিষেক হয় তুলনামূলক কম শক্তিশালী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, এবং প্রথম বলেই শূন্য রানে সে প্যাভিলিয়নে ফিরে, যে ম্যাচে বাংলাদেশের হাতে ভারত নাস্তানাবুদ হয়, সেই একই ক্রিকেটার যখন নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের যবনিকাপাতের ঘোষণা দেন, ততদিনে তিনিই এই বাইশ গজি কুরুক্ষেত্রের একজন মহারথী। ক্রিকেট নামের খেলাটির সবচেয়ে নিবেদিত প্রাণ সেবকদের একজন।
এক-দেড়শো কোটির জনসংখ্যার দেশ ভারত। তার উপর আছে নোংরা রাজনীতি। আছে বোর্ড কর্মকর্তাদের স্বজনপ্রীতির নজির। এতটাই যে একেই "নিয়ম" হিসেবে মেনে নিয়েছে সবাই। এর মাঝে এগারোজন নির্বাচন করে দল গঠন করা খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার চেয়েও কঠিন কাজ।
প্রতিভার অভাব নেই। তবু জাতীয় দলে সুযোগ পেতে হলে গড ফাদারের প্রয়োজন হয়, কোথাও কোথাও ঘুষের প্রয়োজন হয় (বিরাট কোহলির বাবার কাছে ঘুষ দাবি করেছিল এক স্টেট লেভেল কর্মকর্তা), সর্বোপরি নির্বাচকদের কৃপাদৃষ্টির প্রয়োজন হয়। আইপিএল আর রঞ্জি পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝতে পারবেন কথাটি কতটা সত্য। একের পর এক তরুণ সম্ভাবনাময় প্রতিভা নিজের সর্বস্ব উজাড় করে খেলেও ভারতীয় জার্সি গায়ে চড়াতে পারেনা। জার্সি গায়ে মাঠে নামার পরে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেও দল থেকে বাদ পড়ার নজির আছে। সুরেশ রাইনার মতন অসম্ভব প্রতিভাবান ক্রিকেটারকেও বসে থাকতে হয়। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া ছেলের হাতের মোয়া নয়।
এমএস ধোনির না কোন গড ফাদার ছিল, না ছিল বড় বড় শহরের বড় বড় দলে খেলার অভিজ্ঞতা। পুরোটাই নিজের পরিশ্রম আর মেধার জোরে সেরা এগারোতে স্থান করে নিয়েছে। নির্বাচকরা তাঁর ব্যাটিং ও উইকেটকিপিং টেকনিকে সমস্যা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মতন কার্যকর দ্বিতীয় কোন উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানকে খুঁজে পাননি। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই তাঁকে সুযোগ দেন।
প্রতিদান কি দিয়েছিলেন?
প্রথম ম্যাচেই ডাক! নন স্ট্রাইকারের কল শুনে অবিবেচকের মতন দৌড় দিয়েছিলেন, মাঝপথে ফেরানো হলে সময় মতন ফিরতে পারেননি।
প্রথমদিকে দলে অবস্থান এতটাই নড়বড়ে ছিল যে একাদশ থেকে বের হতে বসেছিলেন। যদি ভারতের হাতে কোন বিকল্প ব্যবস্থা থাকতো, তবে অবশ্যই তাঁকে ছুড়ে ফেলা হতো। কিন্তু পাকিস্তান সিরিজটাই তাঁর গতিপথ পাল্টে দেয়। যত বড় মঞ্চ তত বড় সুযোগের ফায়দা তুলতেই ধোনি নিজের জাত চেনান চিরশত্রু পাকিস্তানকে বেছে নিয়ে। ঐ সফর শেষে শুধু উত্থানের গল্প। দ্রুতই ভারতীয় একাদশের অধিনায়ক হয়ে যান। একজন আদর্শ রুথলেস কর্পোরেট সিইওর মতন আবেগকে গুরুত্ব না দিয়ে দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দেরও ঝেড়ে ফেলতে পিছু হটেননি। পারফর্ম করো, নাহয় রাস্তা মাপো। ফল হাতেনাতেই পেল ভারত। প্রথম আইসিসি টি ২০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ভারত। আবারও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে পরাজিত করেই।
চার বছর পর স্বদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জয়। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিও জিততে খুব বেশি সময় নেয় নি। একমাত্র অধিনায়ক যার হাতে আইসিসির সেরা তিন ট্রফিই শোভা পেয়েছে। স্টিভ ওয়াহ বা রিকি পন্টিংয়ের ভাগ্যও তাঁদের প্রতি এতটা সুপ্রসন্ন হয়নি। জিতেছেন এশিয়া কাপও। রইলো বাকি কি? কিছুই না।
এমএস ধোনির ব্যাটিং, উইকেট কিপিং বা অধিনায়কত্ব থেকেও যা ছিল মহান, তা হচ্ছে তাঁর ক্রিকেট জ্ঞান। ক্রিকেটকে, ক্রিকেটারকে, নিজের সহযোদ্ধাদের, প্রতিপক্ষদের, ম্যাচের পরিস্থিতি এইভাবে সহজে পড়ে বুঝে ফেলার মতন মেধাবী ক্রিকেটার খুব বেশি দেখিনি। হ্যান্সি ক্রনিয়েকে মনে পড়ে, তারপরেই মহেন্দ্রসিং ধোনি। যদিও সাফল্যের দিক দিয়ে দ্বিতীয়জন প্রথমজনের চেয়ে বহুগুন এগিয়ে। সেটাই স্বাভাবিক। এখন যেমন বিরাট কোহলি সাফল্য উপভোগ করছেন। খুব দ্রুতই ধোনিকে ছাড়িয়ে যাবেন। যেমনটা স্টিভ ওয়াহকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন পন্টিং। পরিসংখ্যান বলবে বিরাট ধোনির চেয়ে সফল অধিনায়ক। নেপথ্যের কাহিনীতো পরিসংখ্যানে লেখা হয়না।
তাঁর উইকেট কিপিং, ব্যাটিং, অধিনায়কত্ব খেয়াল করুন। বোলারদের প্রায়ই পরামর্শ দিচ্ছেন এইভাবে ওভাবে বল ফেলতে। এবং সেভাবে করলেই উইকেট পড়ে যেত। কিংবা পরিস্থিতি বুঝে ব্যাটসম্যানদের ধরে খেলতে বা মেরে খেলতে বলতেন। এবং দেখা যেত অতি কঠিন ম্যাচ সহজেই ভারতের মুঠোয় চলে আসতো।
ফিনিশিংটা খেয়াল করুন। যত বিরুদ্ধ পরিস্থিতিই হোক, ম্যাচকে টেনে একদম শেষ ওভার পর্যন্ত নিয়ে যাবে। শেষ ওভারে কত প্রয়োজন? দশ, পনেরো, কুড়ি? বোলিংয়ে প্রতিপক্ষের সেরা বোলার? কোনই সমস্যা নাই। ধোনি নিজের ইচ্ছে মতন ম্যাচ বের করে আনতে পারতেন।
কিংবা মনে আছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচটি, যেখানে মুশফিক চার মেরেই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল ম্যাচ জিতে গেছি ভেবে? এবং আমরাও একই সাথে আনন্দ উদযাপন করে ফেলেছিলাম? তারপরেই শেষ তিন বলে পরপর তিন উইকেট পড়ে গিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে জেতা ম্যাচ আমরা হেরে গিয়েছিলাম? ঐ পরিস্থিতিতেও সেখানে ফিল্ডার রেখেছিলেন ক্যাপ্টেন কুল আমাদের ব্যাটসম্যানদের মানসিকতা বুঝেই। নাহলে কোন দেশের কোন বেকুব তিন বলে যেখানে দুইরান দরকার, ওভাবে বাউন্ডারিতেই ফিল্ডার বসাবে? কোন বেকুব ব্যাটসম্যান সিঙ্গেল নিয়ে ম্যাচকে নিরাপদ না করে বাহাদুরি দেখাতে যাবে?
গত বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধের ম্যাচটিই ধরুন। প্রথম পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই ভারত হেরে গিয়েছিল। কিন্তু ম্যাচটিকে একদম শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়েছিলেন। এমনও মনে হচ্ছিল যে ম্যাচটি আরেকবার তিনি বের করে আনবেন। হয়তো পারতেনও, যদি না সেদিন কয়েক সেন্টিমিটারের জন্য রানআউট না হতেন। মার্টিন গাপটিলের সেই থ্রোটি যদি সরাসরি স্টাম্প না ভাঙতো, তাহলে কি ম্যাচে ভারত হারতো? নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারন, ধোনি ছিল।
ভাগ্য লিখে রেখেছিল জীবনের প্রথম ম্যাচের মতই জীবনের শেষ ম্যাচেও তিনি রানআউট হবেন। প্রথম ম্যাচে মিস্টার ফিনিশারের উইকেট কেউ নিতে পারেনি, শেষ ম্যাচেও না। বৃত্তের এক বিন্দুতে ক্যারিয়ার শুরু হয়ে সেই একই বিন্দুতে এসে থেমেছে। মাঝের এই সময়টায় ক্রিকেটকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন এই আধুনিক মাস্টারমাইন্ড। অবসরের পরেও যে দল তাঁকে থিংক ট্যাংক হিসেবে নিবে, সে ধন্য হয়ে যাবে। শরীর অবসন্ন হয়েছে, মস্তিষ্ক তাঁর তীক্ষ্ণতা হারায় নি।
আমি ঈর্ষান্বিত, মাহির জন্ম, বেড়ে ওঠা ও সেবা সবই ভারতের হয়ে। যদি বাংলাদেশে এমন একটা ক্রিকেটার পেতাম!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১:৫২
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×