আমি মুসলমান, তাই আমি ইসলাম নিয়ে একটু আধটু লিখি। সেই রেফারেন্সেই বলি যে ধরেন আমি একজন আধ্যাত্মিক গুরুকে খুব মেনে চলি। অনেকেই যাকে "আলেম" বলে আর কি। তাঁর কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানলাম, পড়লাম, শিখলাম, মানলাম।
এখন যদি দেখি, আমার মহামান্য গুরুজী/হুজুর/আলেম কোন খুনের ঘটনায় জড়িত। অথবা কোথাও চুরি করেছেন। কিংবা কোন নারীকে ধর্ষণ করেছেন, এবং সবগুলি কুকর্মের একদম চাক্ষুষ প্রমান আমার সামনে হাজির করা হয়েছে। তখন আমার প্রথম দায়িত্ব কি? আমাকে তখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমার লয়াল্টি কার প্রতি। আমি কি আল্লাহ এবং নবীজির (সঃ) প্রেমে মুসলমান, নাকি এই গুরুজীর প্রতি প্রেম আগে? আমার কাছে এই গুরু বড়, নাকি ইসলাম?
যদি আমি খাঁটি মুসলিম হয়ে থাকি, তাহলে আমি সত্যের পক্ষে অবস্থান নিব। এই ব্যাটা অপরাধ করে থাকলে, কেউ সাক্ষ্য প্রমান হাজির করলে আমি কোন অবস্থাতেই এই লোকটার পক্ষ নিব না। পবিত্র কুরআনে আমার প্রতি এই নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে। ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজনে নিজের পিতা মাতা আত্মীয় পরিবার এমনকি নিজের বিরুদ্ধে হলেও যাব, তবু এতটুকু বিচ্যুত হবো না। হ্যা, হয়তো এই লোকটা আমাকে ছোট থেকে পিতার স্নেহে বড় করেছে। হ্যা, হয়তো এই লোকটার প্রতি নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিলেও ঋণ শোধ হবেনা। কিন্তু এ যে অন্যায়টা করেছে, সেই অন্যায়ের বিচারের দায়িত্ব যদি আমার উপর পড়ে, তবে আমি আমার ব্যক্তিগত ইমোশন পাশে রেখে ন্যায়ের পক্ষে রায় দিব।
আমার জাজমেন্ট ভুল হতে পারে? অস্বাভাবিক কিছু না। আমি মানুষ। অন্তর্যামী নই। কিন্তু আমি অন্ততঃ আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার যে আমি জেনে বুঝে অন্যায় করিনি।
যদি আমি দ্বিতীয় দলের হয়ে থাকি? তখন আমি সব প্রমানের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের পক্ষে কোন তথ্য প্রমান ছাড়াই বলবো "আমার গুরুকে ফাঁসানো হয়েছে। এইটা ইহুদি নাসারা ষড়যন্ত্র।"
ঠিক একই ব্যাপার ঘটে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের প্রতিটা নাগরিকের ধারণা আমরা বিরাট দেশপ্রেমিক। ঘটনা কিন্তু তা নয়। আমরা দল প্রেমিক, দেশের কথা নিয়ে কেউ চিন্তা করিনা। আমার প্রিয় রাজনৈতিক দল হাতি চুরি করে ফেললেও বোবা হয়ে থাকি, কিন্তু বিপরীত দলের কেউ পিঁপড়ার ডিম নাড়াচাড়া করলেও আমরা হৈ হল্লা করি। এইটাকে "দলকানা" "দলপ্রীতি" "চামচামি" "পদলেহন" ইত্যাদি নানান নামে সংজ্ঞায়িত করলেও কোন অবস্থাতেই "দেশপ্রেম" বলা চলে না। এই কথায় আপনি সহমত না হলে বুঝে নিতে হবে আপনি দ্বিতীয় দলের।
সম্প্রতি আল জাজিরা একটা ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছে। যেখানে দেখানো হয়েছে মোহাম্মদপুরের রাস্তা থেকে উঠে আসা এক গুন্ডা কিভাবে দেশের সেনাপ্রধান এবং তার খুনি ও গুন্ডা ভাইয়েরা সরকারি মদতে একটা মাফিয়া চক্র গড়ে তুলেছে। এতে কিছু মানুষ খুব ক্ষিপ্ত হয়েছেন। ক্ষিপ্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এরা পীরের মতন যে পার্টিকে মানে, নিজের পরিবারের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করে যে পার্টিকে, তারা যখন এমন আকাম কুকাম করে ধরা খায়, ক্ষেপাটা দোষের কিছু না। সমস্যা হচ্ছে, এই ঘটনায় কারোর কারোর মাথার তারও প্যাঁচিয়ে গেছে। কি আবোল তাবোল বকছে আল্লাহ মালুম। যেমন একজন বললেন," বাংলাদেশের উন্নতিতে হিংসা করে কাতার (আল জাজিরার হেডকোয়ার্টার) ইচ্ছা করেই এমন নাটক সাজিয়েছে।"
ভাইরে ভাই! কাতারের মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি এক লাখ বত্রিশ হাজার আটশো ছিয়াশি ডলার। যা বিশ্বে এক নম্বর। বিশ্বমাতবর আমেরিকার বার্ষিক জিডিপি মাথাপিছু পঁয়ষট্টিহাজার ডলার। মানে সাধারণ কাতারীরা সাধারণ আমেরিকানদের ডবল ধনী। সেই হিসেবে বাংলাদেশের জিডিপি পার ক্যাপিটা কত জানেন? আঠারোশো ডলার। মানে দুই হাজার ডলারের মাইল ফলকও আমাদের ছোঁয়া হয়নি। আমাদের চেয়ে তিয়াত্তরগুন ধনী কাতারীদের আমাদের নিয়ে হিংসা করার মতন কি আছে একটু বুঝায়ে বলেন, আমি সত্যিই শুনতে আগ্রহী। একটা সলিড যুক্তি দেন যে মালেশিয়া (এগারো হাজার ডলার) সিঙ্গাপুরকে (১ লাখ তিন হাজার ডলার) হিংসা না করে আমাদের জিডিপিকে হিংসা করবে।
নিজেকে তাচ্ছিল্য করতে ভাল লাগেনা। কিন্তু ভিত্তিহীন বাগাড়ম্বরও ভাল না। আমাদের বহুদূর যাবার বাকি আছে। সেটা না করে এখনই এ হিংসা করে ফেললো, সে জ্বলে মরলো জাতীয় মনোভাব পোষণ করাটা আহাম্মকি। আমাদের নিয়ে জেনুইনলি যদি কেউ সত্যিই জ্বলে, তাহলে তারা হচ্ছে পাকিস্তান, যেহেতু একটা ইতিহাস আছে তাদের সাথে। ওরা যখন দেখে আমরা সবদিক দিয়ে ওদের ছাড়িয়ে যাচ্ছি, তখন ওরা সত্যিই হিংসা করে। সেই সাথে আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলিও জ্বলে। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিবেশী মার্সিডিজ কিনলে নিজের টয়োটা গাড়ি তখন ভাল লাগেনা। আমাদের জিডিপি গ্রোথও তাই কেবলমাত্র আমাদের প্রতিবেশীদেরই একটু কুদৃষ্টির শিকার হবে। গুলশান বনানীর লোকেরা দূর মফস্বলের কোন লোক সাইকেল বিক্রি করে মোটর সাইকেল কিনলো এ নিয়ে যেমন মাথা ঘামায় না, এক্ষেত্রেও ঘটনা সেটাই। মাঝে দিয়ে নিজেকে নামাবেন না।
আরেক গ্রূপ সবকিছুতেই একাত্তরের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, বিএনপি জামাত ষড়যন্ত্র ইত্যাদি টেনে আনে। ওদের যুক্তি "আল জাজিরা জামাতের টাকা খেয়ে এই প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে।"
জামাতের এত টাকা হয়ে গেছে যে ওরা কাতারের এক টিভি চ্যানেলকে দিয়ে সার্কাসের বান্দর ড্যান্স নাচাতে পারে? এবং কোথাকার কোন জামাতে ইসলামীর স্বার্থে আল জাজিরার মতন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া নিজেদের রেপুটেশনকে বাজিতে খেলে ফেলবে? লজিক কোথায় থাকে আপনার?
হ্যা, জামাতের একদম উপর মহলে হয়তো কিছু নেটওয়ার্ক থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে দোস্তি বলিউড সিনেমা শোলের জয়-ভিরুর মতন "হাম নেহি তোরেঙ্গে" টাইপ না। এখানে পয়সা, ইজ্জ্ত ইত্যাদির কাছে বাপ ছেলের সম্পর্কও কিছু না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। আহাম্মকের মতন শুধু কন্সপিরেসি থিওরি পড়েই ফেসবুকে লেখালেখি শুরু করে দিয়েন না।
এরা হচ্ছে সেই কাঠ মোল্লাদের প্রতিনিধি যারা সবকিছুতেই "ইহুদি নাসারা" ষড়যন্ত্র খুঁজে। দুইয়ের মাঝে কোনই পার্থক্য নাই।
আরে ভাই, তুই যদি আসলেই দেশটাকে ভালবেসে থাকিস, তাহলে তুই আগে দেখবি দেশ। তোর দেশে কেন একটা গুন্ডা স্বজনপ্রীতির ফায়দা তুলে ফাঁসির মঞ্চ থেকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নিয়ে বিদেশে চলে যাবে? তোর দেশের পলাতক আসামি কিভাবে সবার সামনে একটি বিয়েতে এসে নাচাকুদা করবে? আমাদের দেশের গর্ব করার মতন যদি কিছু থাকে, তার একটি আমাদের সেনাবাহিনী। বিশ্বজুড়ে যাদের সুনাম আছে। সেই বাহিনীর প্রধান কেন নিজের পদের ভুল ফায়দা তোলার চেষ্টা করবে? এতো দেশকে বিক্রির সমান। অন্যদেশ হলে প্রথমেই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি উঠতো। আর আমাদের দেশে উঠে টিভি চ্যানেল বয়কটের দাবি। ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেছে কে কি করেছে, কে কি বলেছে, তারপরেও ঐ পীরের মতন মিনমিনে স্বরে জপ করছে "এইসব ইডিট করা যায়!"
খুনিকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা ঘোষণা করে বিদেশে পাচার করে দেয়ার ঘটনায় একজনকে দেখলাম বলতে "প্রেসিডেন্সিয়াল পার্ডনতো সব দেশেই হয়। বারাক ওবামাও কতজনকে ক্ষমা করেছে।"
জ্বিনা, খুনের আসামিকে বারাক ওবামা ক্ষমা করেনাই। ব্যাংকচেক ফ্রড, এই ফ্রড ঐ ফ্রড জাতীয় আসামিদের তিনি ক্ষমা করেছেন। খুন একটি ক্যাপিটাল ক্রাইম। বারাক ওবামা সাহেবের মন আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতিদের মতন মহান ও বিশাল না। একটা দাগি ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করতে তাই তাঁদের কলিজা কাঁপে। খুন হওয়া মানুষটার পরিবারের লোকজনের চোখের দিকে তাকাতে পারবেন না, এই ভয়েই তাঁরা তাদের ক্ষমা করেন না। আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতিদের এত সংকীর্ণ মন না। তাঁদের হৃদয় বিশাল। আকাশ ধারণ করা যায়। একটা কেন, ষোল সতেরোটা খুনিকে মাফ করে দেন তাঁরা। খুনি ছাড়াও ওদের মাঝে আরেকটা কমন পরিচয় আছে। সবার দলই আওয়ামীলীগ। জয় বাংলার লোক। চেতনার লোক। চেতনায় চেতিত হয়ে খুন করতেই পারে। ফাঁসিতে ঝুলতে হবে কেন?
ভাইরে ভাই! একে দেশপ্রেম বলে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে? নারে ভাই। এটাই দলপ্রেম, দলীয় চেতনা। জঙ্গিরা যেভাবে জিহাদি জোশে ব্রেন ওয়াশড হয়, পীর যদি মানুষ খুন করতে বলে, তখন আল্লাহু আকবার বলে মানুষ খুনে করে ফেলে, এই মেন্টালিটিও তেমনই ব্রেনওয়াশড হবার লক্ষন। পার্থক্য নাই।
এনিওয়েজ।
এই প্রতিবেদনে নতুন কিছুই দেখায়নি। এইসব স্বজনপ্রীতির জোরে লুটতরাজ আমাদের দেশের নিয়মিতই ঘটনা। দেশ স্বাধীন হবার পরদিন থেকেই এমনটা ঘটে আসছে। একজন ভদ্রলোক তখন সাহসী ছিলেন, তাই মুখ ফুটে বলে ফেলেছিলেন, "মানুষে পায় সোনার খনি, তেলের খনি, আমি পাইছি চোরের খনি।"
ওনার পরে আরও যত সরকারই এসেছে ক্ষমতায়, কখনই এই লুটতরাজ, চুরিচামারি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ হয়নি। আমার জন্ম আশির দশকে মাঝামাঝি সময়ে। নব্বই দশকে বেড়ে ওঠা। এইসব চোখের সামনে দেখা। চোরের খনি থেকে চোরের বাম্পার ফলন ঘটতে দেখেছি কেবল। এইটা দিনের আলোর চাইতেও পরিষ্কার সত্য যে আপনার সাথে সরকারি দলের কেউ পরিচিত থাকলে আপনার কোনই সমস্যা হবেনা। এবং আপনার যদি কারোর সাথে পরিচয় না থাকে, তাহলে আপনি শেষ। "কিন্তু, তবে" ইত্যাদি বলে আমাকে অং বং বুঝাতে এসে লাভ নাই। আমি, আমার পরিবার, আমার আত্মীয়ের পরিবার, বন্ধুর পরিবার নিজেরাই ভুক্তভোগী। ঐ সব চেতনার বুলি আলাভোলা অন্যকে কাউকে শুনান।
বিদেশী টিভি চ্যানেলকে গালাগালি না করে আমাদের দেশের সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ তদন্ত সাপেক্ষে এই মুহূর্তে এই সমস্ত বিষধর সাপদের ধরে ধরে বাক্স বন্দি করা। সাপ সবচেয়ে বেশি সাপুড়েকেই কামড়ায়। তিনি নিজেও যদি জেনে অজান্তে এইসবে জড়িয়ে থাকেন, তবে অবশ্যই যেন সরে আসেন। আমাদের জন্য লেটেস্ট উদাহরণ মিয়ানমার। অং সু চি দীর্ঘদিনের সংগ্রাম শেষে ক্ষমতায় এসে চেয়েছিল দূষিত মিলিটারিকে তেল দিয়ে চলতে। ওদের কুকর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে ওদের পোষ মানাতে। ওরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণযজ্ঞ চালানোর পরেও সে ওদের লাই দিয়ে গেছে। এখন নিজের পোষা পাগলা কুকুর অন্যকে কামড়াতে কামড়াতে এক সময়ে মালিককেই কামড়ে বসেছে। আওয়ামীলীগে কি নিবেদিতপ্রাণ বিশ্বস্ত কর্মী/নেতা নেই? নিশ্চই আছে। কেন থাকবে না। আমি নিজেইতো চিনি এমন কয়েকজনকে। কিন্তু ওদের ভাত নাই। দলই ওদের দাবিয়ে রাখে। এই সমস্ত পদে এই সমস্ত বেঈমানদের, পা চাটা চাটুকারদের, বিশ্বাসঘাতকদের পুষতে থাকলে কি পরিণতি হতে পারে তাঁর চেয়ে নির্মমভাবে আর কারই বা সেই অভিজ্ঞতা আছে? তারপরেও কি তিনি বুঝবেন না?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:২৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




