somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আড়ং

১৫ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার অফিসে আমরা কয়েকজনের একটা দল আছে যারা একসাথে জামাতে জোহর এবং আসরের নামাজ পড়ি। সবার ওযু করতে হয়। এবং ওযুর স্থান আমাদের কমন বাথরুম।
তা একদিন আমাদের আকরাম ভাই (ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক, পেশায় ডেভেলপার) ওযু করছেন, এমন সময় আমাদের সিইও বেসিনে হাত ধুতে এলেন। আমাদের ডিপার্টমেন্ট অফিস বিল্ডিংয়ের এক প্রান্তে, সিইওর অফিস বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি। উনি সাধারণত এই টয়লেটে আসেন না। খুব সম্ভব এখানে কোন কাজ পড়েছিল, তাই আসা হয়েছে। আসলে এই সামান্য ঘটনাও আমাদের উপরওয়ালার চালেই হয়েছে।
আকরাম ভাইর ওযু ততক্ষনে শেষ, শুধু পা ধোয়া বাকি। উনি মাঝারি আকৃতির মানুষ। তারপরেও তিনি বেসিনে পা তুলে পা ধুলেন, এতে যা পানি এদিকে সেদিকে ছড়িয়েছিল, টিস্যু দিয়ে মুছে আবারও শুকনা করে ফেলেন।
ইসলাম ধর্মের এই বিষয়টা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা “ধার্মিকরা” নিজেদের ধর্ম চর্চার চেতনায় অনেক সময়ই ভুলে যাই যে আমাদের কারনে অন্যের সমস্যা বা অসুবিধা হতে পারে। যেমন সারারাত ধরে মাইক বাজিয়ে ওয়াজ করা হয়। অসুস্থ, বা ছাত্রছাত্রী বা এমনিতেই সাধারণ বা অমুসলিমদের অসুবিধার কথা আয়োজকরা মাথাতেও আনেনা। ভোটের রাজনীতির কারনে সরকারও এইসব ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক।
তা ইসলাম এইসব ফাজলামি নিষেধ করে। আমার ধর্মচর্চার পাশাপাশি কারোর যেন কোন “যৌক্তিক অসুবিধা” না হয়, ইসলাম ধর্মচর্চার এটাই মূলনীতি। এর উপকারিতা কি সেটা হাতে নাতে পাওয়া গেল।
শ্বেতাঙ্গ সিইও জিজ্ঞেস করলেন, এতক্ষন যেটা করছিলে, সেটা কি ছিল?
আকরাম ভাই সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলেন তিনি ওযু (ওরা “উদু” উচ্চারণ করে) করছিলেন, এবং কেন করছিলেন।
পরের সপ্তাহেই আমরা আমাদের নামাজের ঘরে একটা “উদুমেট” (wudu-mate) পেলাম। জিনিসটা সুন্দর। আমাদের আর বেসিনে পা তুলে ওযু করতে হয়না।
আমরা কয়জন মুসলিমই বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করি? হেড অফিসের আড়াই হাজার এমপ্লয়ির মাঝে আমাদের সংখ্যা তিরিশও না। আমরা যারা ঐ সেকশনে নামাজ পড়তাম, তাঁদের সংখ্যা মাত্র পাঁচ। বাকিরা বিল্ডিংয়ের অন্যপ্রান্তে অন্য কোন রুমে নামাজ পড়তো। মাত্র পাঁচজনের জন্য অফিস এই ব্যবস্থা করে দিল। কেন? কারন আকরাম ভাই ওযু শেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পানিটা মুছে আবার আগের মতন শুকনো খটখটে করে ফেলেছিলেন।
ঘটনা আমেরিকায়। টেক্সাসের মতন কঞ্জারভেটিভ একটি রাজ্যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে।
আকরাম ভাইয়ের এক হাত লম্বা দাড়ি, আমাদের অনেকেরই ছোট বড় দাড়ি আছে। শুধু মুসলিম না, হিন্দু, খ্রিষ্টান, সবারই দাড়ি আছে। তাতে কি তাঁদের স্মার্টনেস, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যায়? একই অফিসে হাঁটুর উপর স্কার্ট পরা আর হিজাব পরা মেয়ে পাশাপাশি কাজ করছে। কেউ কারোর চেয়ে কম না। বেতন, ভাতা, সুযোগ, সুবিধা সব সমান। চাকরিতে যখন কোন হিজাবি মেয়ে ইন্টারভিউ দেয়, তখন তাঁর হিজাবে না, যোগ্যতায় ফোকাস করা হয়। কোন মেয়ে অতিরিক্ত ক্লিভেজ প্রদর্শন করলে ওকে উল্টো নোটিস দেয়া হয় একটু ঢাকাঢাকি করতে। ছেঁড়া জিন্স, অতিরিক্ত ছোট প্যান্ট বা স্কার্ট, অতি লো কাট টপ্স, কোমরের অতি নিচে আন্ডারওয়্যার প্রদর্শন করা ঢোলা প্যান্ট ইত্যাদি সবই নিষিদ্ধ। প্রফেশনাল এটায়ার মানে কিন্তু ন্যাংটা বা অতি টাইট ড্রেস না। আবার আবায়া ধরনের বোরখাও না। মডেস্ট ড্রেস হলেই চলে। চুল-দাড়ি ঠিকঠাক যত্নে বাড়ানো হলে কিছু যায় আসেনা।
গেল আমেরিকার কথা।

এখন আড়ংয়ের একটি ঘটনা বলি। ঘটনা সত্য। আমার বৌয়ের সাথে ঘটেছে।
আমরা দুইজনই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রী। আমি এখানে চলে এসেছি, ও পাশ করার পর ইন্টার্নশিপ করেছে আড়ংয়ে। ওর কাজে মুগ্ধ হয়ে আড়ং ওকে চাকরির অফার দিয়ে বসে। এইচআর প্রস্তাব করে, মাসিক বেতন আঠারো হাজার টাকা।
২০০৮ সালে এমন বেতনেই মানুষ চাকরি শুরু করতো হয়তো।
কোন ঝামেলা ছাড়াই চাকরি পেয়ে গেছে দেখে সেও খুশিতে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ, কবুল!“
পরেরদিনই আবার এইচআরের ফোন।
“ইয়ে, আপনাকে একটা কথা বলতে ফোন করেছি। আসলে আঠারো হাজার অনেক বেশি হয়ে যায়, নতুন এমপ্লয়িকে আমরা এত বেশি বেতনে হায়ার করিনা। আপনাকে ১৬ হাজার দিব, ঠিক আছেতো?“
এমন না যে আমার বৌয়ের দিকে ওর পরিবার তাকিয়ে আছে, ও চাকরি না পেলে ওর ভাই বোনের পড়াশোনা, বিয়ে, মা বাবার চিকিৎসা, বাড়িভাড়া ইত্যাদি আটকে যাবে। চাকরি করতে চাইছে নিজের শখেই, অর্জিত বিদ্যা খাটিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। এতে যা বেতন আসবে, তা নিজের হাত খরচে ব্যবহার করবে। বড় হবার পরেও পকেটমানির জন্য বাবা মায়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকাকে সেও সহ্য করতে পারেনা। তাই সে বলল, “ঠিক আছে, অসুবিধা নাই।”
পরেরদিন আবারও ফোন। এইবার প্রস্তাব চৌদ্দ হাজারের। তাদের নাকি এই ঐ সেই নিয়ম প্রটোকল ইত্যাদি মানতে হয়।
এইবার বৌ একটু খেপলো। ফাজলামি শুরু করলো নাকি? এইটা কেমন প্রতিষ্ঠান যাদের নিজেদের কথারই ঠিক নাই? তুই যদি চৌদ্দ হাজারই দিবি, তাহলে আগেই সেটা বলতি। প্রস্তাব করার পর দর কষাকষি, এ কি ধরনের ছোটলোকামি?
সে বলল, “না ভাই, এর নিচে আমি নামতে পারবো না।”
ভাগ্য ভাল। সেদিনই সিমেন্সের থেকে চাকরির অফার এসেছে। জার্মান কোম্পানি, ফাজলামি করেনা। বেতন চব্বিশ হাজার, তো চব্বিশ হাজার। স্বাভাবিকভাবেই বৌ সেটা এক্সেপ্ট করে নিল।
পরেরদিন আড়ংয়ের ফোন। এইবার তারা প্রস্তাব করছে বারো হাজার টাকা। আহ্লাদী শুনে যে গালি মনে এলো, সেটা লিখলে আমিই আমাকে গ্রূপ থেকে ব্যান করে দিব।
তা বৌ ভদ্রভাষায় জানায় দিল “ধন্যবাদ, আমি প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছিনা।”
কিছুক্ষনের মধ্যে সেই ম্যানেজারের ফোন যার কথায় এইচআর বারবার দেন দরবার করছিল।
“ভেবে দেখুন! আড়ংয়ের মতন কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন! এত বড় প্রতিষ্ঠান, এত বড় ব্র্যান্ড! হেন তেন।”
উনার ইয়ের ব্র্যান্ড উনার কোনদিকে কি করতে হবে সেটা বললেও আমি ব্যান হয়ে যাব। তাই সেই কথাও বাদ দিলাম।
“না ভাইয়া, আমি অন্য জায়গায় ভাল বেতনে চাকরি পেয়ে গেছি। আমি অর্ধেক বেতনে চাকরি করবো না।”
লোকটা বোধয় ধারণা করেছিল নতুন পাশ করা ছাত্রছাত্রী এত সহজে আর দ্রুত কোথায়ই বা চাকরি পাবে? এদের সাথে যা খুশি তাই করা যায়। এটাই তারা সারাজীবন করে এসেছে। গাধার খাটুনি খাটিয়ে ফকির মিসকিনের বেতন দিয়ে ব্র্যান্ডগিরি CC guy ফলায়।
“তাই নাকি? তা কোথায় চাকরি পেয়েছেন?“
“সিমেন্সে।”
আড়ংয়ের তুলনায় সিমেন্স কি সেটা নিশ্চই ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। ব্যাটার চোখ কপালে উঠে গেল। “বলেন কি? সিমেন্সে চাকরি পেয়েছেন? কিভাবে?”
“ইন্টারভিউ দিয়ে।”
যাই হোক। ভদ্রলোক নাকি এখনও আড়ংয়েই পড়ে আছেন। ব্র্যান্ড ধুয়ে পানি খাচ্ছেন। আহারে বেচারা!
আশা করি সবাই যেন যে যার যোগ্যতা অনুযায়ী ভাল বেতনের চাকরি পায়।

এনিওয়েজ, শুনলাম আড়ং নাকি কাকে দাড়ি রাখার অপরাধের কাউকে চাকরি দিবেনা বলছে। সেটা আড়ংয়ের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। ওদের প্রতিষ্ঠান, ওরা সিদ্ধান্ত নিবে ওদের কর্মচারীরা কে কেমন হবে। ওদের যদি মনে হয়ে থাকে দাড়ি রাখা না রাখার উপর মানুষের বুদ্ধিমত্তা নির্ভর করে, তাহলেতো কিছু বলার নাই। এদের প্রতিষ্ঠানে শিখ সম্প্রদায়ের ছেলেরা চাকরি পাবেনা, সে যতই দুনিয়া জয় করার ক্ষমতা রাখুক না কেন। কারন ওরা শুধু দাড়িই রাখেনা, পাগড়িও পরে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই ধরনের আহাম্মক ম্যানেজমেন্ট নিয়ে বেশিদূর আগানো যায়না। এরা বাংলাদেশেই “ব্র্যান্ড” “ব্র্যান্ড” বলে নিজেরা ফুর্তিতে ভুগে, দেশের বাইরে কেউ পাত্তাও দেয়না। এপল, গুগল, কোকাকোলা, এমাজন হওয়া এদের দ্বারা সম্ভব না। কেবলমাত্র এই ছাগ্লামি মেন্টালিটির কারণেই।

এর আগে একবার এক সরকারি কর্মকর্তা দাবি তুলেছিল ওর প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হলে গোড়ালির উপর প্যান্ট আর মেয়েদের হিজাব পরতে হবে। অথচ উনার প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি দমনে উনার অ্যাকশন কি জানিনা।

মানুষের ব্যক্তিজীবনে আঙ্গুল মারার অভ্যাসটা আমরা জাতিগতভাবে আয়ত্ত করেছি। কে ধর্ম মানবে, কে অল্প মানবে, কে মানবে না - সে ব্যাপারেও ফাত্রামি আমাদের করতেই হবে।
আমরা ভুলে যাই, ওযুর পরে বেসিনের আশেপাশে পানি ছিটিয়ে থাকলে সেটা মুছে দিতে হয়। অনেকক্ষেত্রে, সেটা আসল ইবাদতের চাইতেও অনেক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×