ইরানে এখন হিজাব নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। মেয়েরা হিজাব খুলে ফেলছে, মাথার চুল কেটে পতাকা বানাচ্ছে, পুলিশ গুলি করে ওদের হত্যা করছে, সবার সামনে নির্মমভাবে খুন করছে, কিন্তু কেউতো এতে ভয় পাচ্ছেই না, উল্টো বিক্ষোভের আগুনে আরও জোর হাওয়া লাগছে। ঘটনার সূত্রপাত, এক মেয়ে হিজাব না পরায় পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে যায়, এবং পুলিশি হেফাজতেই ওর মৃত্যু ঘটে।
বিক্ষোভের আগুন ইরান সীমানা ছাড়িয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে যাবে খুব দ্রুতই। আমাদের দেশেও পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে গত কিছুদিন অনেক হৈচৈ হলো।
কিছু বলার আগে বরাবরের মতোই আমাদের নবীর জীবনীতে একটু ঢুঁ মারা যাক। যাকে আল্লাহ স্বয়ং আমাদের সবার জন্য উদাহরণ স্বরূপ পাঠিয়েছেন, এবং যার জীবনী সম্পর্কে আমরা কিছুই জানিনা।
নবীজির (সঃ) সময়ে আরব, বিশেষ করে মক্কা ছিল বিশ্ব পাপের রাজধানী। এমন কোন কুকর্ম নাই যা তখন ঘটতো না। ব্যাভিচার, বর্ণবাদ, খুন, কন্যাশিশু হত্যা, বাটপারি ইত্যাদিতো ঘটতোই, খোদ কাবা ঘর দখল করে রেখেছিল ৩৬০ টি দেবমূর্তি। পুরুষ নারীরা সেখানে ন্যাংটা হয়ে হজ্ব করতো। আল্লাহর ঘরে তখন শয়তান ইবলিসের রাজত্ব।
এই সময়ে একজন এসে বলা শুরু করলেন "এক আল্লাহ ছাড়া কোন ঈশ্বর নাই, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই, তোমাদের অর্জিত টাকা আসলে আল্লাহর দান, তাঁর নির্দেশ হচ্ছে সেটা থেকে অনাহারিকে অন্ন দান করো, বস্ত্রহীন বস্ত্র!"
স্বাভাবিক কারণেই তিনি মার খেয়েছেন। তাঁকে যারা বিশ্বাস করেছে, তাঁরাও খেয়েছে। তাঁদেরকে সমাজ থেকে বয়কট করা হয়েছে। তিনটা বছর তাঁরা খাদ্য, পানীয় ইত্যাদির কষ্টে ভুগেছেন। বেঁচে থাকার জন্য মরুর শুকনা ঘাস খেয়েছেন, পশুর চামড়া সিদ্ধ করে খেয়েছেন।
দাস শ্রেণীর মুসলিমদের মরুভূমির রোদে খালি গায়ে শুইয়ে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো। কেউ মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন, যারা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের আরও নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছে।
অবশেষে তাঁদেরকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
তাঁদের সময়কার দেশত্যাগ আর আমাদের বৰ্তমানের বিদেশ যাওয়া এক না। তখন কোন ব্যাংক ব্যালেন্স ট্রান্সফারের সিস্টেম ছিল না, পুলিশ আইন শৃঙ্খলা কিছুই ছিল না। চৌদ্দ পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে শূন্য হাতে একটি সম্পূর্ণ অচেনা দেশে নতুনভাবে জীবন শুরু করা মোটেই সহজ ছিল না। পথে দস্যু আক্রমন করলে কিছুই করার নেই। নতুন দেশেও যদি কেউ লুটে নেয়, কিছু বলা যাবেনা। আবহাওয়াও অনেক বড় ব্যাপার ছিল। এক অঞ্চলের লোকের অন্য অঞ্চলের আবহাওয়া সহ্য না হওয়ায় মরে যাওয়াটা ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। মক্কার মুহাজিররা মদিনায় এসে প্রথম প্রথম সবাইই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।
যে কারনে এই ঘটনাগুলো বললাম, এর কারন হচ্ছে, লক্ষ্যণীয়, এদের কাউকেই জোর করে ইসলাম ধরিয়ে দেয়া হয়নি। ওদের কাছে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, ওদের যৌক্তিক মনে হয়েছে, ওরা কলিমা পাঠ করেছে। এরপরে ওদের উপর হাজারো নির্যাতন চালানো হলেও তাঁদের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে "আহাদুন আহাদ!"
এইটা অতি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। এটা মাথায় রাখুন।
এরপরে আসা যাক মদিনার ঘটনায়।
মুসলিমরা এসে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। মদিনায় তখন তিন ধর্মের মানুষের বাস। মুসলিম, ইহুদি এবং মুশরিক।
বদর যুদ্ধের সময়েও মদিনার মুশরিকদের সমর্থন ছিল মক্কার কুরাইশী মুশরিকদের প্রতি। বদর যুদ্ধ জিতে যাওয়ার পরে "বাটে পড়ে" এই মুশরিকদের থেকে একদল ইসলাম গ্রহণ করে। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে, ইচ্ছার বিপরীতে ওরা কলিমা পড়ে। ওরাই ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল। কুরাইশ কাফিরদের থেকেও। কারন ওরা ভিতরে শত্রুতা লালন করতো এবং বাইরে বন্ধুত্ব দেখাতো। সুযোগ পেলেই দংশন করে গেছে এই সাপের দল। এরাই জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরের বাসিন্দা, এরাই মুনাফেক।
তাহলে আমরা এই দুই ঘটনা থেকে কি জানলাম?
জোর করে কাউকে ধার্মিক বানানো সম্ভব না। কুরআনে (সূরা বাকারায়) বলা হয়েছে, নবীর (সঃ) জীবনী উদাহরণ হিসেবে আছে, তারপরেও আমাদের অনেকের মাথাতেই ঢুকে না।
এখন বলি মা আয়েশার (রাঃ) বিখ্যাত হাদিস। তিনি নিজে বলছেন, কুরআন যদি প্রথমেই মদ্যপান ও জেনাহ করতে নিষেধ করতো, তাহলে এই সাহাবীরাই তখন ইসলামকে ত্যাগ করতো, এবং মদ্যপান জেনাহ অব্যাহত রাখতো। কিন্তু প্রথমে ওদের অন্তরে ঈমান দৃঢ় হবার সময় দেয়া হয়েছে, এখন ওরাই ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। তেইশ বছর ধরে কুরআন নাজেল হয়েছে। একসাথে একটি কিতাব নেমে আসতেই পারতো, সেটা হয়নি। কারন? আল্লাহ আমাদের "ঈমান" প্রতিষ্ঠা করার সময় দিয়েছেন। নিশ্চই তিনি সর্বজ্ঞ।
মূল বক্তব্য পরিষ্কার।
আপনি জোর করে কোন নারীকে বোরখা পরাবেন, সে প্রথম সুযোগেই সেই বোরখা, হিজাব খুলে ফেলবে। আমাদের পরিচিত অনেকেই আছেন এমন। বাড়ি থেকে হিজাব মাথায় বেরিয়ে বাসে উঠেই হিজাব খুলে ফেলে।
আবার যে নিজ থেকে পরে, তাঁর সামনে এক হাজার হায়েনা দাঁত খিচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে জোর গলায় বলে, "আল্লাহু আকবার!" ভারতে অতি সম্প্রতি এই ঘটনাই ঘটেছে। ফ্রান্সে "হিজাব ব্যান" যখন হলো, তখন ফ্রেঞ্চ মুসলিম নারীদের পাশাপাশি গোটা বিশ্বেই প্রতিবাদ উঠেছিল। আমাদের দেশেও এমন লাখে লাখে নারী আছেন, যাদের "বস্তা" "টেন্ট" ইত্যাদি বলে বলে টিটকারি করা হয়, তবু তাঁরা তাঁদের পোশাকের ব্যাপারে অনড়।
কাজেই দিনরাত "পর্দা কর পর্দা কর" বলে ঘ্যান ঘ্যান না করে আগে ফোকাস করুন মানুষের ভিতরকার ঈমানকে, তাকওয়াকে দৃঢ় করতে। সেটা প্রতিষ্ঠিত হলে লোকে আপনাতেই ধর্ম পালন করবে। ওটাতে গন্ডগোল থাকলে লোকে মোনাফেকি শুরু করবে। কারোর কাজের জন্য আপনাকে প্রশ্ন করা হবেনা। কাজেই আপনি শুধু শুধু কারোর মনকে বিষিয়ে তুলবেন না। আপনার ঘ্যানর ঘ্যানরের জন্য কেউ যদি ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়, সেই দায়িত্ব আপনি নিতে পারবেন?`এই যে ইরানি মেয়েগুলি, ওরা এমন করতো না যদিনা তাঁদেরকে বছরের পর বছর জোর জবরদস্তি করা না হতো। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওরা ইসলামের বিরুদ্ধে চলে গেল। দায় কি সরকারের নয়? আল্লাহ কোথাও বলেছেন "জুলুম" করতে?
অতি সম্প্রতি ফেসবুকে টুপি মাথার সাদা দাড়িওয়ালা এক ঘুষখোরের ছবি ভাইরাল হচ্ছে। আমাদের গোটা মুসলিম বিশ্বের প্রতীক যেন এই লোক। আমরা সবাই উপরে উপরেই মুসলমান, অন্তরের দিক দিয়ে মুসলিম আছি কয়জন? যখন কেউ থাকেনা, এবং শয়তান আমাকে লাখ টাকার ঘুষ সাধে, কিংবা সুন্দরী রমণী হয়ে প্রলোভন দেখায়, তখন আমাদের কয়জনে নিশ্চিত হয়ে বিশ্বাস করে আমাদের দুইজনের সাথে তৃতীয়জন হয়ে সেই ঘটনাস্থলেই উপস্থিত আছেন আমার মালিক, আমার বিচারক, আমার আল্লাহ?
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১২:৪৩