“মেট্রোরেলের ড্রাইভার একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।”
বিষয়টা নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, “শিক্ষিত মানুষের হাতেই এই দায়িত্ব থাকা উচিত।”
কেউ বলছেন, “যেকোন শ্রমই গর্বের। একে এপ্রিশিয়েট করা উচিত।”
এবং অনেকেই বলছেন, “একজন ইঞ্জিনিয়ার কেন ট্রেনের ড্রাইভারের চাকরি করবে? মেধার বিপুল অপচয়!”
আমি যদিও বিশ্বাস করি হালাল পথে উপার্জিত অর্থ অবশ্যই সম্মানের, যে কারনে একজন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীর চাইতেও একজন সৎ রিক্সাওয়ালা আমার কাছে বেশি সম্মানিত, তারপরেও আমি দ্বিতীয় দলে।
আমার পয়েন্ট হচ্ছে, মেট্রোরেলের চালক হতে হলে আপনাকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স হতে হবে না। বিদেশে হাইস্কুল ড্রপআউট পোলাপান এইসব কাজ করতে পারে। এই মেধাবী ভদ্রমহিলা আরও বড় কিছু ডিজার্ভ করে। কোন কলেজের শিক্ষক, কোন কোম্পানিতে ডিপার্টমেন্ট প্রধান ইত্যাদি। আমরা তাঁর মেধাকে মূল্য দিতে পারিনি।
অনেকেই বলবেন, “বিদেশে মাস্টার্স পাশ করে থালাবাসন ধোয়ার সময় খেয়াল থাকেনা?”
উত্তর হচ্ছে, “বিদেশ” সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণেই এমন মন্তব্য। যার ভিত্তি শূন্য।
আমি আমেরিকা থাকি, এবং আমেরিকাকে বিদেশ বলাই যায়, তাই না? তা এখানকার অনেক প্রবাসীর ধারণা এখানকার স্কুল কলেজ থেকে পাশ না করলে প্রফেশনাল চাকরি পাওয়া যাবেনা। ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। তবে তারচেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে, এমন ভুল ধারণা লোকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে বেড়ায়। মানে হচ্ছে, নিজে ভুল জানি। কিন্তু সেটাকেই সঠিক ভেবে অন্যকেও ভুল শিখাই। এর ফলে অনেকের সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারকে আমরা শেষ করে দেই। যার চাকরি করার কথা কোন ভাল প্রতিষ্ঠানে, সে বেচারা সঠিক জ্ঞান, কনফিডেন্স ও গাইডেন্সের অভাবে মিনিমাম ওয়েজ জবগুলো করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। মনে রাখবেন, জীবন একটাই। সুযোগ যখন আছেই বেশি বেতনের চাকরি করে নিজের ও পরিবারের জীবনে স্বচ্ছন্দ আনার, তবে কেন সেটা হেলায় হারাবেন?
বরাবরের মতোই বাস্তব উদাহরণ দেই।
এক শিক্ষিত ছেলে চেইন ইমিগ্রেশনে আমেরিকায় এসেছে। আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে। আত্মীয় প্রথমেই ওকে নিয়ে গেলেন বাংলাদেশী এক মিষ্টির দোকানে। সেখানেই ওর চাকরি হলো। ওর আত্মীয়, সহকর্মীদের সাথে মিলেমিশে ওর বিশ্বাস জন্মে গেল যে এটাই ওর নিয়তি। বাংলাদেশী ডিগ্রির কোন ভ্যালু নেই। কাজেই এইসব করেই ওর জীবন কাটবে।
উবার চালু হবার পরে সে মিষ্টির চাকরি ছেড়ে উবার ধরলো। এবং ওটাই ওর ক্যারিয়ার হয়ে গেল।
এই কাহিনী হাজার হাজার, লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির। দেশে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এসে এদেশে রিটেইল শপে কাজ করে স্ট্রাগল করছেন। জ্ঞানের অভাবে কেউ একবার উনাদের সর্বনাশ করেছে, এখন উনারাও না জেনে নিজের ও অন্যের সর্বনাশ ঘটাচ্ছেন।
আরেক ঘটনা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু এদেশে এলো। আমি স্বাগত জানাতে ফোন দিলাম। খুবই বিমর্ষ। দেশে থাকতে সে ছিল ব্যাংক ম্যানেজার, এখানে এসে মিষ্টি/বিরিয়ানির দোকানে কাজ করতে হবে ভেবে বেচারা মরমেই মরে যাচ্ছে।
বললাম যে, অবশ্যই ও প্রফেশনাল জব পাবে। বিশ্বাস করলো না। ওর আশেপাশে সবাই পন্ডিত। সবাই ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে যে ওকে কেউ নিবেনা। মাত্র কয়েকদিনেই বেচারার কনফিডেন্সের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে সবাই।
বললাম অমুক ব্যাংকে রিটেইল ব্যাংকার হিসেবে এপ্লাই করতে। যাই বেতন বা স্কেজ্যুল হোক, ঢুকে যেতে। ছয় মাস মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে। তারপরে নিজের রেজুমে বুঝে প্রফেশনাল জব এপ্লাই করতে। ইন শা আল্লাহ হয়ে যাবে।
ছয় মাস পরে সে বিশ্বখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানে ফিন্যান্সিয়াল এনালিস্ট হয়ে গেল।
ম্যাজিক? না। এখানে রহস্য কি?
এক নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে, আপনি যখন আমেরিকা আসবেন, এদেশের মানুষের ভাষা বুঝতেই আপনাকে কিছুটা সময় দিতে হবে। যখন ভাষায় কম্ফোর্টেবল হয়ে যাবেন, তখন নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না। মাস্টার্স পাশ শিক্ষিত ভদ্রলোক থালাবাসন মাজে ঠিকই, সেটা টেম্পোরারিলি। আজীবনের জন্য না।
আমি নিজে ইন্টারভিউ নেই। কেউ ফাঁপোড়বাজি করলে সহজেই ধরে ফেলি। আমরা এদেশে কে কি কাজ জানে, সেটাকে বেশি গুরুত্ব দেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, সেটা যেকোন দেশেরই হোক, সেকেন্ডারি বিষয়।
আপনি হার্ভার্ড থেকে সোশ্যাল স্টাডিজে পিএইচডি করে আসতে পারেন, কিন্তু একাউন্টিংয়ের জার্নাল এন্ট্রি সম্পর্কে আপনার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কাজেই আমি আপনাকে নিব না। বরং বাংলাদেশ থেকে আসা যুবককে নিব যে ইন্টারভিউতেই আমাকে বুঝিয়ে দিবে সে কতটুকু একাউন্টিং বুঝে, কি কি কাজ করেছে, কিভাবে করেছে এবং কোন কোন সফটওয়ারে পারদর্শী। সে এনএসইউ, ব্র্যাক থেকে পাশ করেছে নাকি কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, আই ডোন্ট কেয়ার। বুঝাতে পেরেছি?
আরও জানার থাকলে ইনবক্সের চিপায় আসেন, গফসফ করা যাবে।
আপাতত মেট্রোরেলের ড্রাইভিং প্রসঙ্গে আসি।
অনেকেই বলছেন, “বিদেশে মাস্টার্স পাশ করে থালা বাসন ধোয়। তখন সমস্যা নাই।” তথ্যটি ভুল।
এদেশে কেউ মাস্টার্স পাশ করে থালাবাসন ধোয় না, যদিনা সেটা নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে। যারা ধোয়, ওরা মিসগাইডেড হয় বলেই ধোয়, অথবা বৈধ কাগজ পত্র নেই বলে নিরুপায়। সুযোগ পেলে তা করতেন না। আমেরিকা বিশ্বের এক নম্বর রাষ্ট্র এই কারণেই হতে পেরেছে যে ওরা মানুষের মেধার ইজ্জত দিতে জানে। কাগজপত্র লিগ্যাল থাকলে এদেশে আপনি আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ খুঁজুন, অবশ্যই পাবেন ইন শা আল্লাহ।
ইন্ডিয়ানরা, চাইনিজরা, ইউরোপিয়ানরা নিজ নিজ দেশে পড়াশোনা শেষ করে এদেশে এসে ভাল ভাল পদে চাকরি করছে, আর আমরা ইনফরমেশনের অভাবেই রিটেইল ধুঁকে মরছি।
মিডল ইস্টে আমরা অশিক্ষিত মজুর এক্সপোর্ট করি, উন্নত বিশ্বে উচ্চশিক্ষিত স্কিল্ড লেবার এক্সপোর্ট করতে আমাদের কে বেঁধে রেখেছে?
আমাদের দেশে মেট্রোরেল চালু হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ!
শুরুটা হয়েছে এক নারীর হাত ধরে, আলহামদুলিল্লাহ!!
মহিলা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ড্রাইভারের কাজ করছে (অনেক বেকুব একে প্লেনের পাইলটের সাথে গুলিয়ে ফেলছে। ভাইরে, অনেক দেশে এইসব ট্রেন চালক ছাড়াই চলে। আর যেসব চালক চালায়, ওদের আইনস্টাইন হতে হয়না), এখানেই আমার খটকা। হয়তো ভদ্রমহিলা কোন চাকরি না পেয়ে, নিরুপায় হয়ে, সংসারের হাল ধরতে এই পথ বেছে নিয়েছেন। কোনই সমস্যা নাই। বিদেশে চাকরি হারিয়ে, পরবর্তী চাকরি পাওয়া পর্যন্ত অনেকেই উবার চালান। অনেকে চাকরি পেয়েও উবারিং করেন। দেশেও প্রচুর শিক্ষিত ছেলে উবার পাঠাও করছে। খুবই ভাল! কিন্তু সবই পার্টটাইম। প্রফেশনাল জব পেলেই সবাই ওখানেই মেধা ব্যয় করছে।
যে কারনে আমি কনসার্ন্ড, সেটা হচ্ছে, দলে দলে ছেলে মেয়ে যখন দেখবে উচ্চশিক্ষিত হয়েও আমাদেরকে চাকরি হিসেবে মেট্রোরেলের ড্রাইভার বা এই জাতীয় কিছু জব খুঁজে নিতে হবে, তখন উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহটা ভয়ংকররূপে হ্রাস পাবে। এমনিতেই আমাদের শিক্ষার মান খারাপ, “আই এম জিপিএ ফাইভ” পোলাপানে ভরপুর, সামান্য থেকে সামান্য বিষয়ও ব্রড মাইন্ডে চিন্তা করার ক্ষমতা নেই, সেখানে এইসব ঘটনা মোটেই মঙ্গলজনক নয়।
আমাদের সরকারের উচিত, আমাদের প্রতিভাগুলো, মেধাবী মতিষ্কগুলো যেন অপচয় না হয়, সেজন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। দেশি উদ্যোক্তা, বিদেশী উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীদের পটিয়ে আমাদের শ্রমবাজারকে সঠিক কাজে লাগানো।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




