নব্বইয়ের দিনগুলিতে আইসিসি নিয়ন্ত্রণ করতো ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া। এতটাই যে শেন ওয়ার্ন একবার বলেছিল ও "আবহাওয়ার পূর্বাভাসের তথ্য শেয়ারের জন্য টাকা নিয়েছে" এবং কেউ ওর কিচ্ছু করতে পারেনি।
অর্জুনা রানাতুঙ্গা খুবই বিরক্ত হয়ে বলেছিল, "ও বলল আর আইসিসি মেনে নিলো? পাঁচ টাকার নিউজ পেপারে যে তথ্য থাকে, সেটার জন্য কেউ এক লাখ ডলার ওকে ক্যাশ দিবে কোন যুক্তিতে? কাজটা যদি কোন অশ্বেতাঙ্গ প্লেয়ার করতো, তাহলে কি আইসিসি চুপ বসে থাকতো?"
সে ছিল তখন শ্রীলংকার ক্যাপ্টেন, বিশ্ব ক্রিকেটে তখন শ্রীলংকার অবস্থা বাংলাদেশের মতোই। মাঝে মাঝে চমক দেখায়, সম্ভাবনাময় কিছু ক্রিকেটার আছে, কিন্তু বড় আসরে কিছু করতে পারেনা।
৯৬এর বিশ্বকাপে দিন বদলাতে শুরু করে। লোকে ওদের সমীহ করতে শুরু করে। ইন্ডিয়া, ইংল্যান্ড কেউই ওদের সামনে দাঁড়াতে পারছিল না। অস্ট্রেলিয়ার সাথে গ্রূপ পর্বের একটা ম্যাচ ছিল। নিরাপত্তা ইস্যু দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়া ওয়াকওভার দেয়। রানাতুঙ্গার খুব গায়ে লাগে বিষয়টা।
বরাবরই অস্ট্রেলিয়ার বুলি আচরণের জন্য ঠোঁট কাটা জবাব দিয়ে আসতো। বরাবর। তার উপর যখন তাঁর দেশকে "অনিরাপদ" বলল, তখনতো ক্ষেপেই আগুন।
সেমিফাইনালে ভারত বধের পরে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিল, "ফাইনালে আমি অস্ট্রেলিয়াকে চাই!"
অস্ট্রেলিয়া বরাবরই চ্যাম্পিয়ন দল। সেই বিশ্বকাপেও ওরা গিয়েছিল চ্যাম্পিয়ন কম্বিনেশন নিয়ে। টুর্নামেন্টের হট ফেভারিট ওরা। বড় টুর্নামেন্টের নক আউট স্টেজে ওরা নিজেদের অভিজ্ঞতা আর মানসিক দৃঢ়তা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে থাকে। কেউই চায় না ওদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পেতে। বিশেষ করে শ্রীলংকার মতন দল, যারা কিনা প্রথমবারের মতন বিশ্বকাপ মঞ্চের ফাইনালে খেলতে যাচ্ছে।
কিন্তু রানাতুঙ্গা চোয়াল শক্ত করে বলল, তাঁর অস্ট্রেলিয়াকেই চাই। লংঙ্কা জয় করতে হলে রাবনকেই বধ করতে হয়। নাহলে কেউ সমীহ করবে না।
কে জানে! হয়তো রানাতুঙ্গার দোয়াতেই সেমিফাইনালে অমন জেতা ম্যাচ ভুতুড়েভাবে হেরে বসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ!
ফাইনালে উঠে আসে অস্ট্রেলিয়া। দলের হয়ে ওপেন করে মার্ক ওয়াহ, যার ব্যাটিং দেখাটা ছিল একটি শিল্প। সিরিয়াসলি, যদি কেউ বলে হাজার ডলার খরচ করে কোন ব্যাটসম্যানের খেলা দেখতে চাও? অনায়াসে বলবো, ব্রায়ান লারা ও মার্ক ওয়াহ! ডিফেন্সিভ শট থেকে শুরু করে ড্রাইভ, কাট, পুল, এমন কিছুই নেই যা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়না। সেই টুর্নামেন্টেই সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি করে ফাইনালে এসেছে সে। দুর্দান্ত ফর্মে ছিল ওদের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরাও। আর বোলিংয়ে ছিল ত্রিশূল - ম্যাকগ্রা, ফ্লেমিং, ওয়ার্ন!
রানাতুঙ্গার বদলে যাওয়া দল যথারীতি "লাউড মাউথ" অজিদের নতজানু হতে বাধ্য করে।
অস্ট্রেলিয়ার আচরণ তারপরেও শুধরায় না। ডিএনএ এমন, কি করবেন?
রানাতুঙ্গাও তেমনই, "মাথা কেটে ফেলে দিক, তবু নত হবো না" নীতি।
অস্ট্রেলিয়ায় এক ম্যাচে মুরলীধরনের বলকে "নো বল" ডাকতে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার। অথচ আইসিসি তাঁকে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিয়েছে। অসহায় মুরলি তাঁর ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলেন "আইয়া!" (বড় ভাই!)
বড় ভাইও তখন নিজ দায়িত্ব পালন করেন। দল নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসেন। ফাইজলামির সীমা থাকা উচিত। কি মনে করে ওরা নিজেদের? গোটা বিশ্ব দেখে, বুঝে নেয় শ্রীলংকাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবেনা। ওদের অধিনায়কের নাম অর্জুনা রানাতুঙ্গা। দুর্ভেদ্য ঢাল!
আগেও বহুবার বহু লেখায় লিখেছিলাম, আমার জীবনে দেখা অন্যতম সেরা অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। একটি অতি সাধারণ দলকে কিভাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দিলেন - সেই যাত্রাটা ছিল দেখার মতন। এবং ওর সবচেয়ে বড় গুন যেটা ছিল তা হচ্ছে, খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়ানো। তাঁর বুদ্ধিতে, উৎসাহে, প্রেরণায় মুত্তিয়া মুরলীধরণ টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করেছে আটশো উইকেটের অবিশ্বাস্য এভারেস্টে উঠে। বিশ্বের সর্বকালের সর্বসেরা অফস্পিনার সে। জয়সুরিয়ার মতন সাধারণ এক ক্রিকেটার হয়ে যায় বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। প্রতি বলে বাউন্ডারি মারতে গিয়ে আউট হয়ে যাওয়া অরবিন্দ ডি সিলভা ক্যারিয়ার শেষ করেন শ্রীলংকার ইতিহাসের সর্বকালের সর্বসেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে। চামিন্দা ভাস, রোশন মহানামা, মারভান আতাপাত্তু - তালিকা বাড়তেই থাকে।
আমাদের নারীদলের ক্যাপ্টেন জ্যোতির মাঝে হঠাৎই রানাতুঙ্গার দ্যুতি দেখতে পেলাম।
ইচ্ছা করলেই সে অসভ্য মেয়েটার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে পারতো। গোটা ম্যাচেই, বিশেষ করে ছবি তোলার সময়ে সে সব সীমাই অতিক্রম করেছে। ডেনিস লিলি, শেন ওয়ার্ন, জাভেদ মিয়াঁদাদ টাইপের কেউ হলেতো ব্যাট নিয়েই দৌড়ানি দিত। সে মাথা ঠান্ডা রেখে চমৎকার ক্রিকেটীয় প্রফেশনালিজম দেখিয়ে দল নিয়ে সরে এসেছে। বুঝিয়ে দিয়েছে কুকুর ঘেউ ঘেউ করলেই পাল্টা ঘেউ ঘেউ করতে নেই।
আমাদের অধিনায়ককে নিয়ে গর্ব হচ্ছে খুব। সাফল্য দিয়ে ক্যাপ্টেন্সি বিবেচনা করা উচিত না। রানাতুঙ্গা মাত্র একটাই বিশ্বকাপ জিতেছিল, দুই আড়াই বছরের বেশি রাজত্ব ধরে রাখতে পারেনি, অন্যান্য পরাশক্তিরা উঠে আসে। শুরু হয়ে যায় স্টিভ ওয়ার রাজত্ব। কিন্তু তাঁর লেগেসি রয়ে গেছে আজও। সেটা ইতিহাসের অংশ। বদলানো অসম্ভব।
জ্যোতি কয়টা ট্রফি জিতবে সেটা সময়ই বলে দিবে। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে নেতৃত্বের অসামান্য গুন, জাতিগতভাবে ইন্ট্রোভার্ট বাংলাদেশী মেয়েদের নিয়ে মাঠে নেমে খেলানো থেকে শুরু করে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলার মতন ছোট খাটো বিষয়েও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া - সেটা যেন আরও ফুটে উঠে, আরও প্রকাশ পায়, এবং দিকে দিকে ছড়িয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০২৩ রাত ২:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




