আমার শ্বশুরবাড়ির মসজিদের ঘটনা।
মসজিদের ইমামের দুই দুইটা মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এটি শুধু গর্বেরই বিষয় না, এটি ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করার মতন বিষয়।
কিন্তু মসজিদ কমিটির মাথায় বসে আছে অশিক্ষিত, মূর্খ একটা অভদ্র লোক। যার কাজই হচ্ছে লোকজনের কাছে হজ্বের ফার্স্টক্লাস প্যাকেজ বিক্রি করে থার্ডক্লাস সার্ভিস দিয়ে মাল কামানো। ছাগল যেমন কাঁঠাল পাতা আর Adansonii Variegata ($৩৮,০০০ এ বিক্রি হয় পাতাবাহার টাইপের গাছ) এর পার্থক্য বুঝে না, তেমনই শিক্ষার গুরুত্বও এই ছাগলের মাথায় ঢুকে না। ওর নিজের ছেলেমেয়েরাও মূর্খ, তাই সামান্য ইমামের মেয়েদের এই সাফল্য মানতে পারেনি। সে নিজের ক্ষমতা দেখাতে ইমামের চাকরি খেয়ে ফেলল। ওর যুক্তি ছিল, মেয়েদের কাজ হচ্ছে বাড়িতে থাকা, ওরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করবে? এতে পর্দা নষ্ট হবে, জিনা ব্যাভিচার বাড়বে। এমন অশ্লীলতাকে যে ইমাম প্রশ্রয় দেয়, ওর পেছনে নামাজ আদায় হবে না।
সবাই বলল "ঠিক ঠিক!"
ইমামের চাকরি শেষ।
ইমামের অভিশাপের সাথে সাথে আমিও বদলোকটাকে অভিশাপ দেই! আল্লাহ যেন বেঁচে থাকতে থাকতেই ওর বিচার করেন।
ফেসবুকে দেখলাম, ঢাবির প্রফেসরও এমনই এক মন্তব্য করেছেন। যারা পর্দা করতে চায়, ওদের বাড়িতেই থাকা উচিত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ ওদের জন্য নয়।
প্রথমত, শিক্ষা ও বস্ত্র দুইটাই মানুষের মৌলিক অধিকার। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতো মামুলি বাত, খোদ প্রধানমন্ত্রীও এতে কাউকে বাঁধা দেয়ার অধিকার রাখেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দান খয়রাতের প্রতিষ্ঠান না, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। এখানে যে কেউ ইচ্ছা করলেই ভর্তি হতে পারেনা। যারা ভর্তি হয়, নিজেদের প্রমান করেই ভর্তি হয়। ওদের মেধা নিয়ে কারোর সন্দেহ থাকার প্রশ্নই উঠে না।
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পোশাকের স্বাধীনতা। আমেরিকায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে "হিজাবি" টিচারের অধীনে আমি মাল্টিপল ক্লাস করেছি। আমার "ফাইনাইট ম্যাথ" প্রফেসর ছিলেন একজন হিজাবি, আমার হিউম্যানিটিজ প্রফেসর ছিলেন আরেক হিজাবি, আমার ফাইন্যান্স প্রফেসরও ছিলেন হিজাবি। এছাড়া কেমেস্ট্রি, কম্পিউটার সায়েন্স, ফিজিক্সেও বেশ কিছু লেকচারার ও প্রফেসর ছিলেন হিজাবি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হাফ প্যান্ট পরা মেয়ে যেমন ক্লাস করতো, তেমনই হিজাবি মেয়েরাও ক্লাস করেছে। ঘটনা শুধু এক বিশ্ববিদ্যালয়ের না, হার্ভার্ড, এমআইটি, ইয়েলেও আপনি হিজাবি ছাত্রছাত্রী, প্রফেসর পাবেন। আমাদের ফেসবুক গ্রূপ ক্যানভাসেরই সাবেক এডমিন হিজাবি, এবং সে হার্ভার্ড থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে।
শুধু হিজাবি নারীই না, শিখ পুরুষেরাও পাগড়ি বেঁধে ক্লাসে আসে। কেউ ওদের "টার্বান" মুখ ভর্তি দাড়ি ইত্যাদি নিয়ে কিছু বলার অধিকার রাখেনা। ইন্ডিয়ান বেশ কিছু হিন্দু ছেলে মেয়েদের চিনতাম যারা কপালে টিকা দিয়ে ক্লাসে আসতো। বিশেষ করে পরীক্ষার দিনেতো এইটা মাস্ট!
আমেরিকায়, টেক্সাসের মতন কনজার্ভেটিভ খ্রিষ্টানদের স্টেটে ওদের পোশাকে, ধর্মীয় রীতিতে কারোর কোনরকম চুলকানি উঠে না। আমাদের বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসরের উঠে গেলেতো সমস্যা।
উল্টো বিদেশে প্রফেসরদের মানসিকতা কেমন হয় জানেন? তাঁরা আরও বেশি উৎসাহ দেন। কারন এই সমস্ত মেয়েদের মা-দাদি-নানীরা হয়তো আজীবন পর্দার আড়ালে থেকে আধুনিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই মেয়েরা সেই পরম্পরা ভেঙে এগিয়ে এসেছে। তাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন। সেই সাহায্যের হাত এই সমস্ত উচ্চশিক্ষিত (স্বশিক্ষিত) প্রফেসররা না বাড়ালে কারা বাড়াবে? অন্ধ সমাজতো ওদের অন্ধকারেই রাখতে চায়। সুশিক্ষিত মানুষ কেন অন্ধদের প্রতিনিধিত্ব করবে?
একদল লোক দাবি করবে, পর্দাও করবে আবার বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়বে - এ কেমন কথা? উনারা অতি জ্ঞানী লোকসমাজ, আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে ধরে না যে পোশাকের সাথে পড়াশোনার দ্বন্দ্বটা ঠিক কোথায়? আমি ন্যাংটা হয়ে গেলেই মেধাবী হয়ে যাব? শার্ট প্যান্ট পরা আর শাড়ি পরা নারী বিজ্ঞানীদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই - এই পয়েন্ট প্রমানে গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে চন্দ্রযানের নারী বিজ্ঞানীদের ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাহলে হিজাব পরলেই কারোর মেধা নষ্ট হয়ে যাবে? ওরা কি মনে করে যে হিজাব ছাতার মতন জ্ঞানবৃষ্টি থেকে মস্তিষ্ককে প্রটেক্ট করে? Sounds stupid? তাহলেই বুঝেন কতটা স্টুপিডের মতন কথাবার্তা! ইরানেই কয়টা নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট, ডাক্তার, প্রফেসর হিজাবি জানেন?
কেউ যদি পোশাকের সাথে পড়ালেখা ও মেধার দ্বন্দ্ব আমাকে বুঝাতে পারেন, একটু বুঝায়ে দেন। আর যে জিনিস বুঝানোর ক্ষমতা রাখেন না, সেটা না বলাই কি উত্তম না?
এই প্রফেসরের নামে আরেকটা ঘটনা পড়লাম। ও নাকি কবে দুইটা পর্দানশীন নারী ছাত্রীকে উনার ডিপার্টমেন্টের টয়লেট মোবারক ব্যবহার করতে দেন নাই। এই সমস্ত টক্সিক লোকজন কিভাবে শিক্ষকতা করে? এদের কাছ থেকে লোকজন কি শিখে?
হ্যা, আমাদের সমাজে যাবতীয় বদমায়েশি ধর্মীয় লেবাসের নিচেই ঘটে। আমাদের সমাজ বলতে আমি গোটা উপমহাদেশীয় সমাজই বলছি। ইন্ডিয়াতে যেমন বহু খুন বা ধর্ষণের মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি পুলিশের চোখে ধুলা দিতে সাধু সেজে সাধুদের সমাজে মিশে যায়, তেমনই আমাদের দেশেও পতিতারা, মাদক ব্যবসায়ীরা, ঘুষখোরেরা কিংবা পরীক্ষায় নকলকারীরা দাড়ি ও বোরখাকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দাবি করতেই পারে যে পর্দার আড়ালে কে পরীক্ষা দিচ্ছে, সেটা যেহেতু আমরা ধরতে পারিনা, কাজেই এতে নকলের সুযোগ বাড়ে। ভ্যালিড সমস্যা।
তবে এর সমাধানটাও খুবই সহজ। নারীদের সামনে যেহেতু পর্দার আবশ্যকতা নেই, কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী কোন কর্মী ওদের আইডেন্টিটি যাচাই বাছাই করবে। নারী কর্মীকে প্রফেসরই হতে হবে, গাদাগাদা সুযোগ সুবিধা দিতে হবে, এমনও কোন শর্ত না। পিওন লেভেলের কোন কর্মীই কাজটা করে দিতে পারে।
আর যদি কেউ আইডি কার্ডে ছবি তোলা নিষিদ্ধের জন্য হাউকাউ করে, যেমনটা কিছুদিন আগেই একদল করেছিল, তখন বলতেই হবে "তুমিতো বইন থাপ্পড় খাওয়ার মতন ফাইজলামি শুরু করে দিলা!"
আইডি কার্ডে ছবি তোলা পর্দার খেলাপ হতে যাবে কোন দুঃখে? আপনি কি সেটা বিলবোর্ডে ঝুলাবেন? টিভিতে প্রচার করবেন? লোকজন পাসপোর্টে ছবি তুলে হজ্ব, ওমরায় যাচ্ছে না? আইডিতেই তোমার সমস্যা কেন? তারমানে হয় তোমার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই নেই, নিজেই জানোনা ধর্ম কি, কোথায় কোথায় কি বলা হয়েছে। আর নাহলে তোমার নিয়ত হচ্ছে তোমার জায়গায় তোমার মামাতো বোন বোরখা পরে এসে পরীক্ষা দিয়ে যাবে।
এখন কেউ যদি এই স্পেসিফিক ঘটনাকে নারীর জেনারেল পর্দা করার সাথে গুলিয়ে ফেলে তাহলেও বলবো, "প্রিয় ভাই ও বোন, পড়ালেখা করো, নিজের ব্রেনকে আরেকটু প্রসারিত করো। মূর্খের জীবন আর কতদিন যাপন করবা? টায়ার্ড হও না?"
এনিওয়েজ।
শিক্ষিত, অশিক্ষিত, প্রগতিশীল, পর্দানশীন এবং এমনই আরও অনেকের পোস্ট পড়ে পড়ে যা বুঝলাম, তা হচ্ছে, বাঙ্গু পাব্লিকের আধুনিক মানসিকতার হতে আরও দুইশ বছর সময় লাগবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




