শরিফার গল্প নিয়ে দেশ তোলপাড়। এ নিয়ে কিছু কথা বলি।
আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় আমেরিকায় কাটিয়ে দিয়েছি, কাজেই দেশের অনেকেরই মন মানসিকতার সাথে আমার পার্থক্য থাকবে। এইটাই স্বাভাবিক। আশা করি ধৈর্য্য ধরে সবাই পড়বেন, বুঝবেন।
এখানে তিনটা আলাদা ইস্যু পাচ্ছি।
১. ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে কেন ক্লাস সেভেনেই আলোচনা হলো। আমরা সবাই জানি ১২-১৩ বছরের বাচ্চারা কোমলমতি হয়ে থাকে, এবং এই বিষয়টা বুঝার মতন মেন্টাল ম্যাচুরিটি ওদের ব্রেনের হয়নি।
আবার একই সাথে ঐ বয়সী ছেলেরাই চটি বই, পর্ন দেখতে শুরু করে। আপনি যদি অস্বীকার করতে চান, আপনি তাহলে বোকার রাজ্যে বাস করছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন, ঐ বয়সী বাচ্চাদের বিভিন্ন পর্নস্টারের নাম ঠোঁটস্থ মুখস্ত।
তাই আমার মতে, বাংলাদেশে সেক্স এডুকেশন অত্যন্ত জরুরি এবং সেটা ঐ বয়সেই। পুরুষ কি, নারী কি, হিজড়া কি এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে ওদের স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। যৌন হয়রানি কাকে বলে, কি করলে আত্মরক্ষা হবে ইত্যাদি জ্ঞান দিতে হবে। পারলে আরও ছোট বয়স থেকেই। আমেরিকায় কিন্ডারগার্টেনের পোলাপান “গুড টাচ” আর “ব্যাড টাচ” কি সেটা শিখে। কেউ উল্টাপাল্টা করলে যাতে বাবা মাকে বলতে পারে। আর আমার দেশের শিশুরা আত্মীয়দের হাতেই হেনস্থার শিকার হয়।
তারপরেও আপনি যদি লজ্জায় এসব বিষয়কে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, তখন ওরা এমনসব মানুষের থেকে এই “নিষিদ্ধ জ্ঞান" নিবে যার ফলে ওর ক্ষতি হবে। যেমনটা এক পর্ন ডিরেক্টর দাবি করেছিলেন, আজকের যুগে বিপুল অংশের জনতা সেক্স এডুকেশন শিখে পর্ন দেখে। মানে ড্রাগ ডিলারদের থেকে ড্রাগের জ্ঞান আহরণ!
নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ আমাদের মধ্যে জেনেটিকভাবেই আছে। আল্লাহ যদি বৃক্ষটিকে নিষিদ্ধ না করতেন, হজরত আদম (আঃ) হয়তো ওদিকে ফিরেও তাকাতেন না। যেহেতু নিষেধ করেছিলেন, তাই ইবলিশ এসে ফুস্মন্তর দিল, “তুমি জানোনা কি মিস করছো! একবার আস্বাদন করেই দেখো, আরে বাবা ভয় কি? কিছুই হবে না!”
অতএব সেক্স এডুকেশন নিয়ে খোলাখুলিই আলোচনা হোক। সিলেবাসে থাকুক। বাচ্চারা সুস্থ স্বাভাবিকটা শিখুক।
কিন্তু এখন সমকামী (গে লেসবিয়ান) এবং ট্রান্সজেন্ডারকে হিজড়া বলে চালানোর মানে কি? ঘটনা দেখে যা বুঝলাম, অনেক ধামরা লোকজনেরই এই বিষয়ে ধারণা নাই। আমার যতদূর জানা, হিজড়ারা জন্মগতভাবেই হিজড়া। না পুরুষ, না নারী। এমন কখনই হয় না যে “ছোটবেলায় সবাই মেয়ে মনে করতো, কিন্তু আমি নিজেকে ছেলে মনে করতাম, কাজেই আমি হিজড়া।” যেমনটা ঐ গল্পে লেখা হয়েছে।
আপনি নারী হলে আপনার মাসিক হবেই, আপনি মনে মনে নিজেকে যতই শাহরুখ খান, টম ক্রুজ, অনন্ত জলিল মনে করেন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে আপনি নারী হিসেবেই জন্মেছেন। আপনার হয়তো সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাও আছে। হিজড়াদের সেটা নেই। গে লেসবিয়ানদেরও সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা থাকে। ওরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়না, সেটা আলাদা বিষয়। তাই বলে সব লেসবিয়ান নিজেকে পুরুষ বা সব গে নিজেকে নারী মনে করেনা। এদের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন ভিন্ন।
আমি চাইলেই এখন মেয়েদের জিমের লকার রুমে ঢুকে গিয়ে বলতে পারিনা “ভয় নেই, আমি নিজেকে নারী মনে করি।” ওখানে মেয়েরা অর্ধনগ্ন বা পুরাই নগ্ন হয়ে থাকে। আমার উপস্থিতিতে কোন মেয়েই কমফোর্ট ফিল করবে না। কিন্তু একজন হিজড়া ঢুকলে ওদের রিয়েকশনে তেমন পার্থক্য আসবে না। যদি বিশ্বাস না হয় নিজে পরীক্ষা করে দেখুন। জুতা পেটা খেলে আমাকে দোষ দিতে পারবেন না।
কাজেই ট্রান্সজেন্ডারকে হিজড়া বলে চালানোর পক্ষে আমি না। এই বিষয়টা নিয়ে কনফিউশন তৈরী করাটাও অন্যায় বলে মনে করি।
বরং যদি পড়াতেই হয় তাহলে এই যে আমাদের দেশে হিজড়া সম্প্রদায়কে (ভারত-পাকিস্তানেও) ভিক্ষাবৃত্তি করতে হয়, সামাজিকভাবে ওদের অচ্ছুৎজ্ঞান করা হয়, চাকরি, লেখাপড়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে হয়, সেটা নিয়ে পড়ানো হোক। “শরীফ জন্ম হয়েছে ছেলে হিসেবে কিন্তু নিজেকে মেয়ে মনে করতো" - টাইপ গপ্পে না গিয়ে সরাসরি বলুন “শরীফ জন্ম হয়েছিল হিজড়া হয়ে এবং ওকে ওর বাবা মা ও সমাজ হিজড়া পল্লীতে ছেড়ে এসেছে।” বাচ্চারা ভাবুক, কেন আমার পরিবারে কোন শিশু হিজড়া হলে ওকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হবে? সামাজিকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করা হবে? ইসলামতো ওকে তৃতীয়লিঙ্গ হিসেবেও বিবেচনা করেনা। একদম নারী/পুরুষ হিসেবে গণ্য করে ও প্রাপ্য সম্মান (উত্তরাধিকার সহ যাবতীয় সামাজিক মর্যাদা) নিশ্চিত করে। তাহলে আমাদের ঈমানদার বান্দারা মুসলিমপ্রধান সমাজে কেন হিজড়া দেখলেই দূরদূর করে? আমার বড় ছেলের জন্মের সময়ে ওর মায়ের এপিডুরাল দেয়ার দায়িত্বে যে ছিল, সে ছিল একজন হিজড়া। আমেরিকায় একটি নামি দামি মেডিকেল সেন্টারের এপিডুরাল ডিরেক্টর একজন হিজড়া, কল্পনা করতে পারেন? আমার শ্বাশুড়িকে বলেছিলাম, “অথচ আমার দেশে থাকলে সে আজকে ভিক্ষা করতো।”
কেউ কেউ বলবেন, “হিজড়া হিজড়া করছেন কেন? তৃতীয় লিঙ্গ বলুন।” এইটাই আমার পয়েন্ট, আমি ওদের তৃতীয় লিঙ্গও মনে করিনা, ওরা আমার সমান, লিঙ্গে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় আবার কি? আমরা কি কোন কম্পিটিশন করছি নাকি? ও আমার কাছে পুরুষ বা নারী। আমার সমান মর্যাদা ওরা দাবি করে, এবং আমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব আমি ওদের সেই সম্মান দিতে চাই।
বাংলাদেশে আমার এক আত্মীয় নিজের প্রতিষ্ঠানে হিজড়াকে চাকরি দেয়ায় এলাকায় সামাজিক প্রতিবাদ উঠেছিল।
এইসব নিয়ে আলোচনা হোক। শিশুরা বুঝুক যে হিজড়ারা আমাদের চেয়ে আলাদা কেউ নয়। আমরা কেউ লম্বা হই, বেঁটে হই, কেউ চশমা পরি, কেউ কানে কম শুনি, আমাদের মাঝে নিখুঁত কেউ নেই। আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি, কেউ দাবি করতে পারবে না সে নিখুঁত। আমাদের কিছু খুঁত আছে বলেই মানবজাতি এত নিখুঁত সৃষ্টি! তেমনই হিজড়াদের এই একটা খুঁত আছে। নাহলে ওদেরও ক্ষুধা পায়, কষ্টে বুক ফাটে, আনন্দে চোখে পানি আসে।
কিন্তু “আমি মনে করলাম আর মেয়ে হয়ে গেলাম" - এইটা হিজড়া না। বিদেশে বাচ্চাদের চিকিৎসা করে ট্রান্সজেন্ডার বানানো হচ্ছে। একবার ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার পরে পুরো জীবন ওষুধ নির্ভর হয়ে যেতে হয়, বেঁচে থাকার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। অনেকেতো এই মুভমেন্টের সাথে ওষুধ কোম্পানিগুলোর কন্সপিরেসীর গন্ধ পায়। আমি অবশ্য কন্সপিরেসি নিয়ে আলাপ করিনা। প্রমান ছাড়া সব বিষয়ই আমার কাছে ফালতু। যাই হোক, ট্রান্সজেন্ডারদের হতে ইচ্ছুক কাউকে এসব নিয়ে কেউ পড়ায় না। আলাদা কমপ্লিকেশনগুলি নিয়ে কেউ পড়ায় না। একবার ট্রান্সজেন্ডার হয়ে যায়, তারপরে অমুক ওষুধ, তমুক ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে যেতে হয়। কিছুই করার নেই, প্রকৃতির বিপক্ষে যাওয়ার মূল্য আছে। এইটাই মূল সমস্যা। ক্লাস সেভেন, এইট, নাইন ইত্যাদি ক্লাসগুলি এই সাবজেক্টের জন্য একেবারেই উপযুক্ত না। ঐ সময়ের বাচ্চারা আবেগ দিয়ে কাজ করে, বিবেক দিয়ে নয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ানো উচিত। কারন তখন মানুষের ব্রেন মোটামুটি একটি পর্যায়ে ম্যাচুরিটি লাভ করে। অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনা হয়ে যায়, আশেপাশের জীবন থেকেই জ্ঞান বাড়ে।
বুঝাতে পেরেছি?
২. শিক্ষকের সিলেকটিভ আউটরেজ।
যে শিক্ষক আলোচনায় এসেছেন, তিনি প্রকাশ্যে বই ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সমস্যা হচ্ছে, ঘটনাটা আমেরিকায় ঘটলে কিছুই হতো না। ফ্রিডম অফ স্পিচ এন্ড এক্সপ্রেশনের দেশ। আপনি হোয়াইট হাউজের সামনে দাঁড়ায়ে আমেরিকান জাতীয় পতাকাতে আগুন দিলেও সমস্যা নাই। তবে তার আগে নিশ্চিত হবেন, পতাকাটা যেন আপনি নিজের পয়সায় কিনেন। অন্যের পতাকা ছিনিয়ে নিয়ে বা চুরি করে আগুন দিলে চুরির শাস্তি পেতে হবে।
সেদিকে বাংলাদেশে আমরা দেখি বই মাটিতে পড়লে বা পা লাগলে আমরা মাথায় ঠেকাই। একজন শিক্ষক হিসেবে বই ছেঁড়া তাই ওভারড্রামাটিক হয়ে গেছে। পাবলিকের নেগেটিভ রিয়েকশন স্বাভাবিক।
তিনি লাইমলাইট চেয়েছেন, পেয়েছেন, কন্সিকোয়েন্সও পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উনার চাকরি থাকলে অবাক হতাম।
আমেরিকায় আমি যদি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হই, এবং প্রকাশ্যে কালোদের নিয়ে বর্ণবাদী মন্তব্য করি, তাহলে আমারও চাকরি যাবে। এইসব দায়িত্বে থাকা লোকজনকে টেকনিক্যালি কথাবার্তা বলতে হয়।
তিনি এই বিষয়ের সাথে একমত না, উনি অবশ্যই প্রতিবাদ করার অধিকার রাখেন। আমরা কি প্রতিবাদ করছিনা? নাকি সহমত পোষণ করছি বলে মনে হয়? আলোচনা, সমালোচনা, ইউটিউব ভিডিও যা খুশি করুন, শিক্ষক হয়েও বই ছেঁড়া কি একটু বেশি হয়ে গেল না? সবকিছুরই সিভিক তরিকা থাকে, এই লোক শিক্ষক হয়ে অভদ্র আচরণ করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাতো নিবেই।
৩. উনার এমন জোরালো প্রতিবাদে আরেকটা ইস্যু তাই উঠছে, পাবলিক জানতে চাইছে মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকারের ব্যাপারে উনার অনুভূতি কি?
কিছু বেয়াক্কেল এখানে দাবি করতে পারেন, এখানে হঠাৎ মাদ্রাসা টানলাম কেন। উত্তর হচ্ছে, উনিতো মূলত রাগ ঝেড়েছেন সমকামীদের উপরেই, তাইনা? তা মাদ্রাসার সমকামী “গে” শিক্ষকরাই পুরুষ শিশুদের বলাৎকার করছে, এই বিষয়ে কবি নীরব কেন? মাদ্রাসাকে সাধারণ লোকজন মসজিদের সম্মান দেয়, আল্লাহর দ্বীন শেখানো হয়, রাসূলের জীবনী শিক্ষা দেয়া হয়, সেই পবিত্র স্থানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গরিব, অসহায় শিশুরা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়, তখন এই শিক্ষক কেন প্রতিবাদ করেন না? উনি কয়টা ধর্ষকের লিঙ্গচ্ছেদ করেছেন? কয়টা শিশুর অশ্রু মুছেছেন? কয়বার তিনি ধর্ষক ভন্ডকে আদালতে টেনে নিয়ে গেছেন?
সমকামতো সবক্ষেত্রে হারাম। ইসলামিক লেবাস পড়লেই সেটা হালাল হয়ে যাবে আর নাস্তিকরা করলেই সেটা গুনাহ, এমন আল্লাদিপনাতো নাই রে ভাই। মাদ্রাসায় শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, সেটা ডবল, ট্রিপল, কোয়াদ্রাপল গুনাহ। শাস্তি হওয়া উচিত মাটির মধ্যে অর্ধেক শরীর কবর দিয়ে বাকি অর্ধেকের উপর পাথর নিক্ষেপে মৃত্যু নিশ্চিত করা। শিশুদের সমস্ত জীবনের জন্য মানসিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দেয়ার অপরাধ বিবেচনায় এই শাস্তিও খুবই নগন্য। এসব ঘটনা যখন ঘটে কোথায় থাকেন এই শিক্ষক? একটা ফেসবুক পোস্ট দেখাতে পারবে কেউ? কেউ এসে সাক্ষ্য দিক যে সে আড্ডায়, সভায়, পারিবারিক বৈঠকখানায় এই সংবাদে রাগে ফেটে পড়েছিল। কেউ নাই!
ইজরায়েল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গণহত্যা চালায়, কেউ টু শব্দটা পর্যন্ত করেনা, অথচ ফিলিস্তিনিরা সামান্য পাথর ছুড়ে মারলেও হারেরেরে করে বুক চাপড়ে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, এইটা সিলেক্টিভ আউটরেজ নয়? ঘটনাটাতো এখানেও তাই। ভাইজান নিজের প্রিন্সিপালেই কনসিস্ট্যান্ট না কেন?
এই বিষয়ে আপনাদের ভিন্ন কিছু বলার থাকলে মন্তব্যে বলতে পারেন। আলোচনা ওয়েলকাম।
সহমত হয়ে আরও কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করতে চাইলেও বলতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ১০:১৬