তিনটা ঘটনা এই কয়েদিন ফেসবুকে দেখলাম।
১. ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র ছাত্রীদের চুমাচুমি।
২. ভ্রাম্যমান আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট।
৩. অভিশ্রুতি
১. আমি নিজেও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম, এবং টার্ক সেমেস্টারে আমরাও গিয়েছি। আমি আজও বলতে পারি, আমার ছাত্রজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মৃতি টার্ক সেমেস্টার। সেখানে আমরা পুরো সেমেস্টারের সবাই "বন্ধু" হয়ে উঠেছিলাম। সেই বন্ধুত্ব আজও আছে।
শুধু পড়ালেখা না, সকালে একসাথে জেগে নাস্তা করা, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, দুপুরে ও রাতে খাওয়াদাওয়া, বিকালে খেলাধুলা, ইন্টারডর্ম খেলার প্রতিযোগিতা, এসাইনমেন্টে একজনের সাহায্যে আরেকজনের এগিয়ে আসা, পরীক্ষার জন্য গ্রূপ স্টাডি, মাসিক ফর্মাল ডিনার, কালচারাল নাইট, এমনকি একটা দিন এমনও ছিল যে আমরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কেউ সবার জন্য রান্না করেছি, কেউ দারোয়ানগিরি করেছি অথবা কেউ বাগানের যত্ন নিয়েছি। সেটার ফ্যান্সি নাম ছিল মাইক্রোল্যাব, উদ্দেশ্য ছিল এইটা যেন আমরা বাস্তবে এসব কাজ যারা করেন, তাঁদের দিকটা উপলব্ধি করতে পারি এবং সম্মান করি।
আরে ভাই ব্র্যাকের ছাত্রছাত্রীরাই ভাল করে জানে কিভাবে কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে হয়। নাহলে সাধারণত ক্যাডেট কলেজ অথবা ডিফেন্স ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়া দাওয়ার সঠিক নিয়ম কেউ শেখায় বলে জানা নেই। অনেক বড় বড় শিক্ষিত পেশাদার বা ধনী মানুষকেও দেখেছি খাওয়ার সময়ে ঠিকভাবে চামচই ধরতে পারেনা।
আমি নিশ্চিত ব্র্যাক এই ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করেছে।
এখন রিসেন্টলি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা গেছে টার্কের ফর্মাল ডিনারের অনুষ্ঠানে পোলাপান জরাজরি করে নাচানাচি করছে, কয়েকজনতো একজন চুম্মাচাটি পর্যন্ত শুরু করে দিয়েছে।
আমি জীবনের অর্ধেকটা সময় আমেরিকায় কাটিয়ে দিয়েছি। চুম্মাচাটি দেখা আমার কাছে কোন ঘটনাই না। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক ও ধার্মিক দুই বিষয় বিবেচনাতেই এই কাজের জন্য দোষী ছাত্র ছাত্রীদের বিচার হওয়া উচিত।
সামাজিকভাবেই বাংলাদেশ কনজারভেটিভ দেশ। আর ধর্মীয় দিক বিবেচনায় নিলে শুধু ইসলামই না, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কোন ধর্মের লোকেই এইভাবে বেহায়াপনা করে বেড়ায় না।
নারী পুরুষের ইন্টিমেট সম্পর্ক একটি প্রাইভেট বিষয়। তোমাদের ইন্টিমেট হতে হয় প্রাইভেটে হও। সেখানে তোমরা কি করছো না করছো আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কিন্তু প্রকাশ্যে আসলে, বিশেষ করে বাংলাদেশের কোন ইউনিভার্সিটির পার্টিতে, তখন কিছু কন্সিকুয়েন্সতো ভোগ করতেই হবে।
কেউ বলতেই পারে, ইউনিভার্সিটির রেসিডেন্সিয়াল সেমেস্টারের ফর্মাল ডিনার পার্টিতে ঘটনা ঘটেছে, তাই এইটা "প্রাইভেট ইভেন্ট" বলাই যায়।
তাহলে বলবো, প্রাইভেট/প্রাইভেসি শব্দগুলোর মানে কি আগে সেটা জেনে নিন।
মোবাইল, সিসিটিভি ক্যামেরা, ইন্টারনেট ইত্যাদির কল্যানে এখন গোটা দুনিয়ার মানুষ এই দৃশ্য দেখছে। এমনও না যে রুমের ভিতরে গোপনে ভিডিও ধারণ করা হয়েছে। এবং তারচেয়ে বড় কথা, সেসব ছেলেমেয়েদের দেখে মনে হচ্ছে they don't care a bit!
একজন অভিভাবকের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি চাইবো না আমার ছেলে/মেয়ে বিয়ের আগে এইভাবে সাত ঘাটের পানি খেয়ে বেড়াক। "ক্রাশ" এবং "ভালবাসার" মাঝে পার্থক্য বুঝুক। নিজের ডিগনিটি ধরে রাখুক। যার তার সাথে শুয়ে পড়ে পরে কান্নাকাটি "ও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে" টাইপ কথা বললে প্রথমেই বাম গাল বরাবর দড়াম করে থাপ্পড় খাবে, তারপরে সান্তনার বাণী শুনবে।
এখন যেসব অভিভাবক কুল, ওদের ছেলে মেয়েরা কি করে বেড়াচ্ছে ম্যাটার করে না, উনাদের ব্যপারে কিছু বলবো না। যার যার চয়েস।
আমার কথা আমার মতন প্যারেন্টসদের নিয়ে যারা এই ভরসায় বাচ্চাদের স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান যাতে ওরা সেখানে মূল্যবোধ শিখে। ডিসিপ্লিনের সাথে থাকে। যেহেতু তাঁরা সেখানে উপস্থিত থাকেন না, তাই শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষই তাঁদের ভরসা। তাঁদের প্রতিনিধি। এখন অভিভাবকরা ক্ষেপতেই পারেন এই নিয়ে যে কেন তাঁদের ছেলে/মেয়েরা এইসব করে বেড়ালো এবং কেউ কোন বাধা দিল না?
আমার মেয়ের দিকে একটি ছেলে এগুলো। হরমোনাল কারনে আমার মেয়ের কাছে ঐ ছেলেকেই বলিউডের সিনেমার নায়ক মনে হবে। প্যারেন্ট হিসেবে আমার দায়িত্ব ওকে প্রোটেক্ট করা। সেই ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড, ইনটেনশন কিছুই আমি জানি না, এসে চুমাচাটি শুরু করে দিল, এ কেমন ফাজলামি? শিক্ষকরা কোথায় ছিলেন?
বলতেই পারেন এডাল্ট পোলাপানদের আইনত বাধা দেয়ার অধিকার নেই।
True। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটা প্রাইভেট, এবং সেখানে প্রতিষ্ঠান নিজের নিয়ম বানাতেই পারে। "যেকোন ধরনের ইন্ডিসেন্সির ভয়াবহ কন্সিকোয়েন্স থাকবে।" - খুব কঠিন কোন নিয়ম বা দেশের পেনাল কোডে ইল্লিগ্যাল কোন এক্ট?
Adult পোলাপান বেলেল্লাপনা করতে চাইলে নিজের রুমে গিয়ে করুক।
এখন দেখা যাক ইউনিভার্সিটি কি ব্যবস্থা নেয়।
২. এদিকে ভ্রাম্যমান আদালতের মেজিস্ট্রেটের আচরণও খুব ভাইরাল হয়েছে। এখানে আলাদা আলাদা তিনটা ইস্যু আছে।
প্রথমটা হচ্ছে, উনি চোর ধরতে গেছেন। ১৬০০ টাকার জিনিস ৩২০০ টাকায় বিক্রির ধান্দা করা এক ধান্দাবাজকে আইনের আওতায় আনতে গেছেন। খুবই জরুরি, প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এইভাবেই এক হাজারটা বদমাইশকে ঠিকঠাক মতন শাস্তি দিলেই বাজার পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
দ্বিতীয়টা হচ্ছে, "এক মিনিট হোল্ড অন" বলায় উনি এমনভাবে ক্ষেপে গেলেন কেন? আমি প্রথমে সিরিয়াসলিই মনে করেছি হয়তো দেশে ভাষার পরিবর্তন ঘটে গেছে, এখন এই শব্দ/বাক্য ব্যবহার করাকে কেউ গালি হিসেবে ধরে। যেমন আমি গেলে কাউকে অপেক্ষা করতে বললে বলবো, "হ্যাং অন" যার আক্ষরিক অর্থ "ঝুলে থাকো।" অভ্যাস হয়ে গেছে। শেষে না আবার মাইর টাইর কিছু খাই!
অনেকেই বলেছেন, এইটা কোনভাবেই আদালতের ভাষা না। ঠিক। এবং এমন আচরণও মহামান্য বিচারপতির হয়না।
এই ইস্যুর হাত ধরেই আসে তৃতীয় ইস্যু, যেটা হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তারা নাকি সাধারণ মানুষের সাথে এইভাবেই আচরণ করে থাকেন। ক্ষমতা পেলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করাটা দেশের কালচার।
তা আপনারা যারা দেশে থাকেন, তাঁরা ভাল বুঝবেন, আমার দিক থেকে এ নিয়ে কিছু বলাটা অন্যায় হবে।
তবে, আমি যখন দেশে ছিলাম, তখন অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছিলাম বলতেই হয়। কলেজের প্রিন্সিপাল থেকে হেড ক্লার্ক ক্লার্ক পর্যন্ত যে যেখানে পেরেছে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন। ওসব তিক্ত অভিজ্ঞতা বলে লাভ নেই।
আমি বরং চতুর্থ ইস্যুতে যাই, যেটা কেউ কেউ মিন মিন করে বলতে শুরু করেছেন। তা হচ্ছে, এই ম্যাজিস্ট্রেটের আচরণের রিয়েকশনে দাবি তোলার চেষ্টা করছেন "অবিলম্বে এইসব মোবাইল কোর্ট বন্ধ করা হোক!"
এই ট্যাটনামীর মানে কি? কেন বন্ধ হবে? যাতে তোমরা যা খুশি তাই বেলেল্লাপনা করে বেড়াতে পারো? পাঁচ টাকার জিনিস ১০-১৫ টাকায় বিক্রি করতে পারো? এই চান্সে নিজের ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে কিছু মানুষ। খুব সাবধান।
৩. বেইলি রোডে নিহত সাংবাদিক অভিশ্রুতির পরিচয় নিয়ে অনেক নাটক, সিনেমা হয়ে গেল। মেয়েটির বাবা মা আত্মীয়রা দাবি করছেন মেয়ে মুসলিম, ওর কবর হওয়া উচিত। মেয়ের বন্ধুবান্ধব, মন্দিরের পূজারী দাবি করছেন সে হিন্দু, চিতায় পোড়ানো হোক। প্যাচ খেয়েছে ওর এনআইডি কার্ডে বাবা মায়ের নামও পাল্টে যাওয়ায়। আমি যদি কালকে খ্রিস্টান হয়ে "পেদ্রো ওয়ালেস" নাম নেই, বা হিন্দু হয়ে "দ্বীনবন্ধু নাথ" হই, আমার বাবা মায়ের নাম আশরাফ-আয়েশাই তো থাকবে। তাঁদের নাম কেন পাল্টে যাবে? ডিএনএ রেজাল্ট শেষ পর্যন্ত রায় দিল বাবার পক্ষেই।
এখন তাহলে চিন্তা করুন, সেই বাবার বুকের উপর কি পরিমান ঝড় গেছে যখন সে নিজের মৃতা মেয়ের লাশ আনতে গেছে এবং ওকে শুনতে হয়েছে "আপনিতো মেয়েটাকে পালক নিয়েছেন, ওর আসল বাবা নন" ইত্যাদি।
আল্লাহ মাফ করুক। একজন বাবা মায়ের জন্য এরচেয়ে বড় শাস্তি আর কিছুই হতে পারে না যে তাঁদের সন্তান তাঁদের পরিচয় দিতে অস্বীকার করে।
মেয়েটি মারা গেছে। বেঁচে থাকলে ও হয়তো বলতো কোন অভিমানে এমন কাজ সে করেছে।
কিছুদিন আগেই এক রিভার্টেড মুসলিম ছেলে মারা গেলে পরে ওর হিন্দু বাবা মা ওর লাশ নিতে আসেনি। পরে ওর বন্ধুবান্ধবরা ওর জানাজা কবরের ব্যবস্থা করেছিল। এমন ঘটনা বিদেশে প্রচুর ঘটে।
এখন একজন মুসলিমের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে জেনেরিক একটি কথা বলি।
ইসলামে আপনি আপনার কাজের জন্য দায়ী। আপনার সন্তান যদি ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে, তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিজে ওকে ঐ পথে ঠেলে দেন নাই, নিজের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন, আপনাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবেনা। উদাহরণ চাইলে আমাদের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাসূল নূহ (আঃ) আছেন, যার সন্তান তাঁরই সামনে ডুবে মরেছে। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেও সন্তানকে ফেরাতে পারেননি। এবং সেই সন্তানের কর্মের জন্য আল্লাহ তাঁকে দায়ী করবেন না।
এখন সন্তান যদি ইসলাম ত্যাগ করে মারা যায়, তাহলে পরকালে ওর পরিণতির জন্যও সেই দায়ী। আপনি যদি ভেবে থাকেন কবর হলেই ওর সবকিছু মাফ হয়ে যাবে, তাহলে আপনার জ্ঞাতার্থে, কবর হওয়া না হওয়ার উপর কিছুই নির্ভর করে না। আপনার লাশ যদি শেয়াল কুকুর ঠুকরে খায়, কিংবা আগুনে পোড়ানো হয় - কিন্তু আপনার নেকির পাল্লা ভারী থাকে, তাহলে আপনি শেষ বিচারের দিন পুরস্কৃত হবেন।
আর যদি পাপের পাল্লা ভারী হয়, তবে কাবা ঘরের নিচেও যদি আপনার কবর হয়, তাহলেও শেষ রক্ষা নাই।
যা করার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগেই করে যেতে হবে।
এই হচ্ছে জেনেরিক নিয়ম।
এখন এই স্পেসিফিক ঘটনায় আমি সেই পিতা মাতার ইমোশনের ব্যাপার বুঝতে পারছি। মায়া লাগছে খুব। কতটা অসহায়!
শেষ বাক্যটা বলে ফেলি, কেউ যখন মারা যায়, আপনি জানেন না কোন অবস্থায় সে মারা গেছে। ওপারের জীবনের কোন ঘটনাই যেহেতু আমরা জানি না, কাজেই ও বেহেস্তি, সে জাহান্নামী ইত্যাদি নিশ্চিত করে বলাটা আপনার বেয়াক্কেলামিই না, ক্ষেত্র বিশেষে মারাত্মক রকমের "অহংকারের" পরিচয়। আল্লাহ নিজে বিচারের মালিক, এখানে আপনি নিজেকে বিচারক ঘোষণা করে দিয়েছেন।
আপনাকে জেনেরিক বাক্য বলতে হবে। "আহারে, বেচারি! এইভাবে মৃত্যু কেউই ডিজার্ভ করে না।"
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে "ওর পরকালে কি হবে?"
তাহলে উত্তর দিবেন, "ওর পরিণতির উপর তোমার আব্বুর কিছু নির্ভর করে? তাহলে এত বেহুদা কিউরিওসিটি ক্যান? তুমি বাবাজি তোমার ফরজ সুন্নত নফল নিয়ে ব্যস্ত থাকো। প্রতিবেশী যে মাসের শেষের সপ্তাহে এক বেলা না খেয়ে কাটাচ্ছে, সেটার খোঁজ নিয়েছো?"
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ২:০৬