আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি! নাহলে ওদেরকে এত ভোরে হাতি দিয়ে টেনে তোলাও কষ্ট। সারা রাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে সকালে আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে চায়।
কিন্তু যেই মুহূর্তে ওদের কানে যায় আজ স্কুল নেই, তখনই বিছানার সাথে ওদের সম্পর্কচ্ছেদ হয়, সকাল থেকেই বাড়িতে শুরু হয়ে যায় ধুন্ধুমার কান্ড!
আমাদের প্রবাসীদের ঈদ মানে হচ্ছে বন্ধু, আত্মীয়ের বাড়িতে বাড়িতে যাওয়া, খাওয়া আর আড্ডা।
ঈদে বাচ্চাদেরকে ওদের মত করে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করে থাকি। আমরা জানি আমাদের শৈশবের ঈদের আনন্দের একটা বড় অংশ ছিল নতুন জামা, নতুন জুতা পাওয়ার আনন্দ। কাউকে দেখানো যেত না, দেখালেইতো পুরানো হয়ে যেত। নতুন জামা, নতুন জুতা বা স্যান্ডেল মাথার পাশে রেখে ঘুমাতাম। শীতের ভোরে কম্বলের উষ্ণতা ত্যাগ করে গোসলের জন্য ছুটতাম শুধু নতুন জামা গায়ে দেয়ার আনন্দে।
আমাদের প্রবাসী বাচ্চাদের নতুন জামার খিদেটা নেই। প্রতি মাসেই একটি দুইটি বা আরও বেশি করে নতুন জামা কেনা হচ্ছে। জুতা স্যান্ডেল ইত্যাদি বদলও ঘটছে নিয়মিতই। নতুন জামা ওদের কাছে বিশেষ কিছু নয়। পাঞ্জাবি পাজামা ওদের কাছে "মাসজিদ ড্রেস" - যা শুক্রবার জুম্মায় বা রমজান মাসের রাতে তারাবীহ পড়ার সময়ে পরতে হয়।
কিন্তু ওদের কাছে উৎসব মানে হচ্ছে বাড়িতে আলোকবাতির আয়োজন। ফায়ার প্লেসের পাশে গিফট বক্স। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে ওরা বক্স খুলে ওদের পছন্দের কোন খেলনা দেখে আনন্দে আত্মহারা হবে। উপহার পেলে থ্যাংকস দিতে হয়।
"কাকে থ্যাংকস দিব?"
"আল্লাহকে।"
"আল্লাহ কখন এসে গিফ্ট রেখে গেছে?"
"আল্লাহ নিজে আসেননি, তবে একজনকে দিয়ে পাঠিয়েছেন।"
"থ্যাঙ্ক ইউ আল্লাহ!"
"এখন বল ঈদ মুবারক!"
"ঈদ মুবারক!"
ঈদের নামাজের জন্য মসজিদে যাই। মসজিদটিকে চোখের সামনে জন্ম ও বড় হতে দেখি। মাত্র কয়েক বছর আগেও একটি মোবাইল হোমে হাতে গোনা কয়েকজন মুসল্লি নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এক কাতারও পূরণ হয় না। ধীরে ধীরে মুসল্লি সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক কাতার পূর্ণ হয়ে দ্বিতীয় কাতার, তারপরে তৃতীয়, মসজিদে হয় উপচে পড়া ভিড়। মসজিদ সম্প্রসারণ শুরু হয়। মাত্রই কয়েক বছরের ব্যবধানে এই মসজিদটিই হয়ে যায় পৃথিবীখ্যাত EPIC মসজিদ। বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ও এই মসজিদের রেসিডেন্ট স্কলার ড. ইয়াসির কাদির কারনে এর নাম এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। প্রতি ঈদে এই মসজিদে চারটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়, এবং প্রতি জামাতেই কাতারে কাতারে হাজারে হাজারে মুসলমান নামাজে শরিক হন। কে বলবে আমেরিকায় মুসলিম সংখ্যা কম?
মুয়াজ্জিনের কাজ হচ্ছে আজান দেয়া, আল্লাহর কাজ মুসল্লিদের মসজিদে আনা। কয়েক বছর আগেও এক অস্থায়ী মোবাইল হোমে এক মুয়াজ্জিন আজান দিয়েছিলেন, আল্লাহ মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে হাজার মুসল্লি দ্বারা এই মসজিদকে আবাদ করেছে।
আমি দুই পুত্র নিয়ে মসজিদে বসে মানুষের আনন্দ দেখি। ওদের মা মহিলা সেকশনে নামাজ পড়ছে। আজকের দিনে সবার মুখ হাসিহাসি। অথচ এদের কেউ ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট, পরিবারের বাইরে এই প্রথম ঈদ করছে। গত রাতেই হয়তো দেশে মায়ের সাথে কথা হয়েছে। মাকে হাসিমুখে বলেছে, একা একা ঈদ করতে ওর কোন অসুবিধাই হচ্ছে না। আশেপাশের বড় ভাই, ভাবিরা ওকে ঈদের দিন বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। খাওয়া দাওয়ার কোনই সমস্যা নেই। সে জানে ও না থাকায় বাবা মায়ের ঈদ আগের মত আনন্দময় হবে না। টেবিল ভর্তি খাবার থাকবে, কিন্তু কোন পদই গলা দিয়ে নামবে না। এখন যদি সে বলে ঈদ উপলক্ষ্যে ওরও কোন আয়োজন নেই, ঈদের নামাজ শেষেই ক্লাসে ছুটতে হবে, পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে, রেস্টুরেন্টের কাজেও যেতে হবে, তাহলে শুধু শুধু ওদের কষ্ট বাড়ানো হবে। সামান্য মিথ্যা যদি মাকে খুশি করে, তবে কেন নয়?
সেই লোকটিরও মুখে হাসি দেখলাম যে প্রবাসে ও দেশে নিজের দুইটি পরিবার চালাতে দুই তিনটি চাকরি করে অমানুষের মতন খাটে। প্রতিটা পয়সা হিসেব করে চলতে হয়, তবু খরচের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। হাপিয়ে উঠবেন, সেই সুযোগটাও তাঁর নেই।
তবে একজন বৃদ্ধকে দেখলাম উদাস নয়নে বসে খুৎবা শুনছেন। ভদ্রলোক গেল বছরই নিজের যুবক ছেলেকে হারিয়েছেন। ছেলের সাথে ঈদের জামাতে আসতেন। আজ হয়তো পুত্রবধূর সাথে এসেছেন। নামাজ শেষে গোরস্থানে যাবেন ছেলের জন্য দোয়া করতে।
গোরস্থানে আরও অনেকেই যাবেন। যাদের অভ্যাস ছিল নামাজ শেষে বাবা মাকে সালাম করে দোয়া নেয়া, সেই দোয়ার হাত অনেকের মাথার উপর থেকেই গত বছর সরে গেছে। তবু ঈদ বলে কথা। কবরবাসীরা হয়তো আজকের দিনে আমাদের অপেক্ষায় থাকেন। কেউ গিয়ে তাঁদের জন্য যদি একটু দোয়া করেন!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩