এটাই যেন স্বাভাবিক, হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়ার মতই স্বাভাবিক। বাসার সবাই’ও বিয়ের আকষ্মিকতায় খুব একটা অবাক নয়। তারাও যেন মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিল।
বিয়ের দিন একটি মেয়ের মনে হাজার রকমের চিন্তা আসে। হাজার রকমের দুঃখ শোকের কথা, হাজার রকমের স্মৃতি মনের কোটায় ভীর জমায়। কিন্তু শ্রাবণীর বুকে কেমন একটা নোনা ব্যথা ছাড়া আর কিছুই নেই। আর নোনা ব্যথাটাও কেন যেন বের হয়ে আসতে চাইছে না। অভিমানের ভাষাগুলো কেন যেন অস্তিত্বহীন হয়ে আছে।
‘শ্রাবণী..’
হঠাৎ করেই শুভ্রর ডাকে শ্রবণী সতবিৎ ফিরে পেল।হ্যা এইতো সেই শুভ্র। আচ্ছা, শুভ্র কি শেষবারের মত কিছু বলবে?
শেষ মুহুর্তে এসে কি ও সব ধরতে পেরেছে?
‘কিরে কথা বলিস না কেন?’
শ্রাবণী শুভ্রর অহেতুক প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন বোধ করছে না। কিন্তু এমনটা ছিল না, শুভ্রর ঘন্টার পর ঘন্টা অহেতুক- ফালতু কথাগুলোই শ্রবণী অধীর হয়ে শুনতো। শুভ্রর প্রতিটি ভাললাগা- খারাপলাগা যেন ওর নখদপর্ণে। কিন্তু শুভ্রটা এমন কেন? গত তিন বছরে কেন ও শ্রাবণীকে সামান্য’ও চিনল না।
‘‘কি ব্যাপার চুপ করে আছিস কেন? কিছু হইছে?’’
নাহ্! শুভ্র আর পালটালো না। শ্রাবণীর কিছু একটা হলে ও ঠিকই টের পাবে, কিন্তু জিজ্ঞেসা করবে না। শ্রাবণী যতক্ষণ যেচে এসে না বলবে ততোক্ষণ গাধার মতো কথা বলতেই থাকবে, কিচ্ছু বুঝার চেষ্ঠা করবে না।
‘‘ এই জানিস আজকে কি হইছে? তোর একটা বন্ধু আছে না-আনিলা, ওর সঙ্গে কথা হইল। মেয়েটা দেখি হেব্বি জোস! জটিল-জটিল কথা বলে। তুই আমাকে ওর কথা আগে বললিনা কেন?
কি হইল?
এই পেত্নী, কি হইছে, মন খারাপ?’’
উফ্! কেউ শুভ্রর গলা টিপে ধিরছেনা কেন! সব-সময় একরকম। সব কিছুই কি বুঝিয়ে বলতে হবে? কবে ও নিজে থেকে কিছু বুঝতে শিখবে?
‘‘ তুই কি আজ আসবি?’’
হঠাৎ শ্রাবণীর ঠান্ডাগলা শুনে শুভ্র ভয় পেয়ে গেল। শ্রাবণী জানে, শুভ্র সবই বোঝে, শুধু-শুধুই না বোঝার ভান করে যায়।এই ভানটাই তো এতো ভাল লাগে। এই ভানেই জন্যই তো শুভ্রকে চেনা, শুভ্রর এতো কাছে আসা, আর শুভ্রকে এতো..
‘‘ হুমম, দেখি। কেন কি হইছে?’’
আহ! কি সুন্দর প্রশ্ন! শুভ্র যেন কিছুই জানে না। আজ শ্রাবণীর বিয়ে। সেই শ্রাবণী যাকে ছাড়া কোনোদিন শুভ্রর সকালের ঘুম ভাঙ্গেনা, সেই শ্রাবণী যাকে ছাড়া শুভ্র রাস্তায় হাটতে পারে না, যাকে ছাড়া শুভ্রর স্বপ্নগুলো অর্ধসমাপ্ত, যাকে ছাড়া… নাহ! শ্রাবণী আর ভাবতে পারছেনা। ওর ভাবনার জালের প্রতিটি বিন্দুতেই যেন শুভ্র জড়িয়ে আছে। ও জানে আজকের পর আর শুভ্রর সাথে কথা হবে না। শুভ্ররই কথা বলবে না। কিন্তু যখন দেখা হলে বলবে, ‘আরে কি খবর তোর!’ যেন কিচ্ছু বদলায়নি।
‘‘ এই, তুই আছিস?’’
‘‘ হুমম, বল ‘’
‘‘ তোর কি হইছে বল তো?’’
শুভ্র, কেন তুই এমন করিস? তুই জানিস না আজ আমার বিয়ে! তোর শ্রাবণীর বিয়ে! যে তোকে পাগলের মত ভালবাসে, যে তোকে ছাড়া এক মুহুর্ত’ও থাকতে পারে না, যে তোকে ফোন না দিলে তুই পাগল হয়ে যাস, যে তোকে কষ্ট দিয়ে নিজেই কাদেঁ। শুভ্র, আজ তোরই বন্ধু শাহেদেই সঙ্গে সেই শ্রাবণীর বিয়ে! তোর কি একবারের জন্য’ও কষ্ট হয় না? তোর কি মনে হয় না আজকের পর আর কথা হবে না! তোর কি একবার’ও মনে হয় না, আজকের পর আর তোর শ্রাবণীকে ‘মেঘলা’ নামে ডাকতে পারবি না। তোর আসলেই কষ্ট হয় না!
‘‘ আকাশ দেখতেছি তো, তাই ভাবে আছি। আচ্ছা, আমি ফোন রাখি।’’
‘‘ফোন রাখবি? আচ্ছা ঠিক আছে, রাখ তাইলে।’’
ফোনটা রেখেই শুভ্রর মনে হল, আর এক মিনিট কথা বললে কি হতো? শ্রাবণী কেন বঝে না, ওর কথা না শুনলে শুভ্র পাগল হয়ে যায়, কিচ্ছু ভাল লাগে না, ছবি আকাঁ- কবিতা লেখা কিছুতেই তো মন বসে না।গত তিন বছর ধরে শুভ্রর প্রতিটি মুহুর্তে শ্রাবণী জড়িয়ে আছে। শুভ্রর মনের আনাচে-কানাচের প্রতিটি অলি-গলিই তো শ্রাবণীর চেনা। তাহলে এমন কেন করল?
‘‘হ্যা, বল।’’
শুভ্র জানতো, শ্রাবণী আবার ফোন করবে। শুভ্রকে কষ্ট দিয়ে ও কিছুতেই শান্তি পাবে না। শুধু শ্রাবণী না, শুভ্র’ও শ্রাবণীর মনের আনাচে-কানাচের প্রতিটি অলি-গলি চেনে।
‘‘আনিলার কথা কি বলতেছিলি?’’
শুভ্র,এটাও জানে, শ্রাবণী শুভ্রর কথা না শুনে থাকতে পারবে না। ও একটা কথা অর্ধেক বলে ফেলল, আর শ্রাবণী বাকিটুকু জানবেনা, তা কি করে হয়।
‘‘ওহ্ এইতো আজকে চারুকলায় দেখা হল। মেয়েটা খারাপ না, ভালই।’’
‘‘ খারাপ না! তোর কাছে না হেব্বি জোস লাগছে?’’
এইতো,এই হচ্ছে শ্রাবণী। আমি কি বলি না বলি সব শুনবে। ও যে মন দিয়ে শুনছে,সেটা বুঝতে দিবে না, কিন্তু প্রতিটা কথাই মনে রাখবে।আর সময়-সময় মনে করিয়ে দিবে। নাহ! শ্রাবণীকে ছারা আমার চলবেই না। তবুও..
‘‘ হুমম, লাগছিল। কিন্তু এখন আর লাগতেছে না। গাধাদের এমনই হয়।’’
‘‘ জানিতো, কিন্তু গাধারাতো কাউকে ভাল'ও বলতে পারে না। তুই কেন বললি? এর মানে তুই কি গাধা না? ’’
ইস! আমি জানতাম, তুই এই কথাটাই বলবি। আমাকে গাধা বললে তোর সহ্য হয় না। কিন্তু কেন তুই আমাকে মানুষ বানাতে চাস? আমি মানুষ হয়ে গেলেই তো সমস্যা, তখনতো তোর প্রেমে পরে যাব।আর ভালবাসি বলে তোকে ছাড়তে পারছি, কিন্তু প্রেমে পরে গেলে তো আর ছাড়তেও পারব না।
‘‘ ঠিক তো, ভুল হয়ে গেছে। আর কাউকে ভাল বলা যাবে না।’’
‘‘ এইতো ঠিক আছে।’’
হা-হা-হা। তুই পালটাবি না। হিংসুটে একটা।অন্য কাউকে ভাল বললে একদমই সহ্য করিসনা। বেচারে শাহেদের ভালই সমস্যা হবে।
‘‘তোর আকাশ দেখা হইছে? ’’
‘‘ হুমম, এখন রেডী হব। শাহেদরা ৭'টার মাঝেই চলে আসবে। ’’
ছি! কেমন অকপটে কথাটা বলে ফেললি। ‘শাহেদরা ৭'টার মাঝেই চলে আসবে।’ বলার আগে আমার জন্য একবার খারাপ লাগল না। তুই কি বুঝিস না, তোকে শাহেদের সাথে দেখলে আমার বুক ফেটে যায়। তুই কি বুঝিস না, যে শাহেদকে নিয়ে আমি বড় হয়েছি, সেই শাহেদের জন্য তোকে ভুলে যাওয়া আমার জন্য মৃত্যুর সমান।
নাহ! তুই বুঝবি না। আমার আপন মানুষগুলো যখন খারাপ হয়ে যায়, তখন নিজেকে নিকৃ্ষ্ট মনে হয়। তোর জন্য শাহেদ খারাপ হয়ে যাছে, এটা আমি কেমনে দেখি বল।
‘‘ এই, তাইলে সময় নষ্ট করতেছিস কেন? যা-যা রেডী হ্। এইতো ৭’টা বাজে প্রায়। আমি রাখি, তাড়াতাড়ি যা।’’
‘‘ হুমম, ঠিক আছে, রাখলাম।’’
নাহ! শুভ্র কিছু ভেবে পাচ্ছে না। শেষবারের মত’ও শ্রাবণীর সঙ্গে কথা বলা শেষ। শ্রাবণীকে তো বলা হল না, ‘‘শ্রাবণী, তোকে আমি অনেক ভালবাসি, তোকে ছাড়া আমার কিচ্ছু ঠিক থাকবে না। আমি শেষ হয়ে যাব। প্লিজ, বিয়েটা করিস না। আমাকে ছেড়ে যাস না। দেখ, তুই না আমার সব কথা মানিস, তাহলে এই কথাটাও রাখ।’’
ধুর! কেন তুই আমার সব কথা শুনিস, কে বলছে আমার কথা শুনে শাহেদের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হতে? তুই তো বুঝিস তোকে আমি ভালবাসি, এটা বুঝিয়ে না বললে কি এমন ক্ষতি? তুই তো সব বুঝিস, তাহলে এটা কেন বুঝলিনা যে শাহেদের কাছে আমি বেধে গিয়েছিলাম, ওর অনুরোধ আমি ফেলে দিতে পারি না। কিন্তু তুই কেন আমার ওকালতিটা মেনে নিবি। তুই কি আমাকে জোর করে কাছে টেনে নিতে পারলি না?
প্লিজ, তুই ফিরে আয়। তোকে ছাড়া আমি রাস্তায় হাটতে পারব না, কিছু চিন্তাও করতে পারব না। তুই তো আমার সব। তুইতো শুভ্রর শ্রাবণী।
দুই.
গভীর রাতে শাহেদের ঘুম না ভাঙ্গিয়ে, খুব আস্তে করে শাহেদের হাতের মুঠো থেকে হাত সরিয়ে শ্রাবণী ফোনটা ধরল।
‘‘ হ্যালো, শ্রাবণী আছে?’’
‘‘ হ্যা বলছি, আপনি কে?’’
‘‘ জি, একজন ভদ্রলোক এক্সিডেন্ট করেছেন। সম্ভবত এখন মৃত, তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে উনি বিরবির করে একটা ফোন নাম্বার বলল। আর তার পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। সেখানে লেখা ‘তোকে অনেক ভালবাসি, ভাল থাকিস শ্রাবণী – ইতি শুভ্র।’
আপনি কি ‘শুভ্র’ নামে কাউকে চেনেন?’’
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১০ রাত ৮:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





