আজ নিয়ে দুসপ্তাহ হলো, শ্রাবণীর শুভ্রর সঙ্গে কথা হয়না।
সামনের মাস থেকে বুয়েটে ইয়ার ফাইনাল শুরু হবে, এই ছুতায় শ্রাবণীর মোবাইল অফ, এমন কি নেটে'ও নেই শ্রাবণীর পদচারনা|
অন্যদেরকে এই অজুহাত দিলেও,সত্যটা ভিন্ন।
ভেবে বসবেন না, শ্রাবণী শুভ্রকে ভুলতে চাচ্ছে; বরং সত্যটা এমন যে, শ্রাবণী শুভ্রকে "শ্রাবণী" ভুলাতে চাচ্ছে।
শুভ্রর সাথে শ্রাবণীর পরিচয়টা কিন্তু অল্পদিনের না।
কলেজ থেকেই ওরা একসঙ্গে আবৃত্তি করতো। আর গত দু-তিন বছরে ঘটনাটা এমন হলো যে, ওরা শুধু আবৃত্তি নয়, একসঙ্গে সব কিছুই করতে লাগল। ওদের একজনের মাঝে একটা শখ এলে কিভাবে যেন,সেটা অন্যজনের মাঝেও ছড়িয়ে যেতে লাগলো।
ওরা এখন আর ভিন্ন-ভিন্ন সত্ত্বা নয়, ওদের "গল্প- ভালবাসা- স্বপ্ন" সবই যেনো এক।
কিন্তু এসবের মাঝেও যে অসম্ভবের "কিন্তু" আছে।
শ্রাবণী শুভ্রর "স্বপ্ন" গুলো জানে।
শুভ্র সৌন্দর্যের পিপাসু নয়। ও আহামরি গুণী কাউকেও চায় না।
শুভ্র শুধুই একটা ভালো মেয়ে চায়।
যে ভালো মেয়েটার মন গোলাপের মত সরল। যার ভিতেরে কখনই কলুষতা প্রবেশ করেনি। এক কথায়, শুভ্র একটা "পবিত্র গোলাপ" চায়।
কিন্তু শ্রাবণী....
নাহ! শ্রাবণী কিভাবে সেই গোলাপটি হবে।
সে হয়তো নিজের মনকে কলুষিত হতে দেয়নি, সে হয়তো অন্যদের খারাপ'ও কখনো করেনি, কিন্তু তাই বলে তো সে নিজেকে "পবিত্র গোলাপ" বলতে পারেনা।
শ্রাবণী জানে, ও যার জীবনেই যাবে তার জীবনে শুধুই কষ্ট আসবে।
শ্রাবণী নিজের কাছেই তো "অভিশাপ" অথবা একটি "বিষাক্ত গোলাপ।"
শ্রাবণী বুঝতে পারে যে ও আস্তে আস্তে শুভ্রর জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে।
এখন চাইলেই শুভ্র, শ্রাবণীকে নিয়ে যে স্বপ্নের ইমারত গড়ছে তা ভেঙ্গে দেওয়া সম্ভব, কিন্তু একবার তা গড়ে গেলে সারাজীবন শুভ্র শুধু কষ্টই পেয়ে যাবে।
তাই শ্রাবণী এখন সবার কাছ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
এদিকে শুভ্র সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করতে পারলেও "অবহেলা" সহ্য করতে পারে না।
আশে-পাশের অন্য-সবার জন্য পরীক্ষা হয়তো একটা "অজুহাত" কিন্তু শুভ্রর কাছে এটা "অবহেলা" সমতূল্য।
এই অবহেলাই,ভালবাসার ইমারত গড়ে ওঠার আগেই চিরদিনের জন্য ভেঙ্গে দিবে।।
যেদিন এই ইমারতটা ভেঙ্গে যাবে, সেদিন হয়তো শ্রাবণী'ও ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু শুভ্রর ভালোর জন্য এতটুকুতো করতেই হবে।।
২
কাব্য এতটুকু পড়ে ডায়রীটা বন্ধ করে রাখলো।
পাশ থেকে হৃদ্ধ চিৎকার করে উঠলো, "কি হলো ভাইয়া! আর পড়বেন না?"
হৃদ্ধ অনামিকার ছোট ভাই।
সারাদিন কোনো-না-কোনো ভাবে তার অনামিকাকে ছোট করা চাই-চাই। কিন্তু এই হৃদ্ধ আবার অনামিকার লেখার বিরাট ভক্ত।
আর যেদিন থেকে হৃদ্ধ "অনামিকার" অসুস্থতার কথা জেনেছে, সেদিন থেকে তো ভুলেও ঝগড়া করছে না।
যতই যা হোক, হৃদ্ধ ওর বোনকে অনেক ভালবাসে, এমন সময় তো তাই আর ঝগড়া করে কষ্ট দিতে পারে না।
"হ্যা, ভাইয়া পড়া শেষ করেন। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে।"
অনামিকার বেডের পাশেই ওর সবথেকে ভালো বন্ধু তন্মনা'ও কাব্যকে তাড়া দিয়ে বলে উঠলো।
এদিকে কাব্য কেমন যেনো একটা বোবা চোখে তাকিয়ে, কি যেনো একটা বলতে যেয়েও থামে গেল।
হঠাৎ করেই অনামিকা শব্দ করে হেসে উঠলো।
গত তিন-সপ্তাহে, আজ প্রথম অনামিকা কোনো শব্দ করলো।
সবাই যখন এতে অবাক হবার ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত, তখন ওদেরকে আর'ও অবাক করে দিয়ে অনামিকা বললো, "ও আর কি পড়বে, আমি তো আর কিছুই লিখিনি, এটাই আমার শেষ লেখা ছিলো হয়তো।
কিন্তু দেখা কাব্য আমি এটা শেষই করতে পারলাম না।
তোর সময় থাকলে,দেখিস তো শেষ করতে পারিস নাকি।"
"বড়াপু, তুমি কথা বলছো!"
হৃদ্ধের প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়েই অনামিকা কাশতে শুরু করলো।
তন্মনা ব্যস্ত হয়ে ওর হার্টবিট মনিটর করা শুরু করলো,
হৃদ্ধ দৌড়ে ডাক্তারকে ডাকতে গেলো।
শুধু কাব্য এখনো সেই বোবা দৃষ্টিতেই বসে রইলো। ও যেনো কিছুই বুঝতে পারছে না।
ডাক্তার অনামিকাকে চেক করে বের হয়ে আসার পর কঠিন স্বরে বলতে লাগলো, "ভিজিটীং আওয়ার তো শেষ, আপনারা এখনো কি করছেন?
দেখুন, পেশেন্টের কোনই ইমপ্রুভমেন্ট নেই। হঠাৎ এক্সাইটেট হওয়ার কারনে কথা বলে উঠেছেন, কিন্তু এতে তার অনেক পরিশ্রম হয়েছে বলে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
দয়া করে তাকে আর বিরক্ত করবেন না।
আপনাদের মধ্যে একজন থেকে বাকিরা এখন চলে গেলেই তার জন্য ভালো।"
ডাক্তার চলে যাওয়া মাত্র,তন্মনা বললো "আজ রাতটা আমি অনামিকার সাথে থাকবো।"
"নাহ! আজ আমি অনামিকার সাথে থাকবো।" কাব্যের হঠাৎ করে বলা, কথাটার মাঝে এমন কিছু একটা ছিল যে, বাকিরা আর না করার সাহস দেখালো না।
"ঠিক আছে ভাইয়া, আমি তাহলে তন্মনাপুকে বাসায় দিয়ে আসছি। তোমার কিছু লাগলে ফোন দিও।"
কাব্য,হৃদ্ধের দিকে ক্ষণিকের জন্য চোখ তুলে, চোখ আবার নামিয়ে যেনো ওদের বিদায় জানালো।
হৃদ্ধ আর অন্মনা বের হয়ে যাবার অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাব্য আর চোখ তুলে দেখলো না।
বেশকিছুক্ষণ পর অনামিকা কেশে উঠলো।
সেই শব্দেই কাব্যের হুশ হলো।
ও আস্তে করে অনামিকার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো "তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে?"
হালকা করে একটু হেসে, অনামিকা যেনো না-বোধক উত্তরটাই দিলো।
কিন্তু সেই হাসিতে কাব্যের জগতটা মূহুর্তেই ওলট-পালট হয়ে গেলো।
মনে পড়লো, এইতো সেদিন মল-চত্বরে তারা কবিতা আবৃত্তি করছিলো।
অথবা, চৈত্র-সংক্রান্তিতে একসঙ্গে ছায়ানটে নিজেদের লেখা গানে সুর দিয়ে, "শ্রেষ্টত্ব" নিয়ে মজা করছিল।
এইতো,সেদিন তারা একসঙ্গে রবীন্দ্র-সরোবরে টোকাই শিশুদের ছবি তুললো।
হ্যা, কাব্যের মনে পড়ছে, এখন তার সবই মনে পড়ছে।
ওর,প্রত্যেকটা "সুখময়-স্মৃতিতেই" তো এই অনামিকা।
সেই অনামিকা,যে নীল রঙ অসম্ভব ভালোবাসে। সুযোগ পেলেই যে আকাশ দেখে নইলে সাদা গোলাপের খোঁজ করে।
যার প্রত্যেকটা লেখাতেই "শুভ্র-শ্রাবণী, নীল রঙ, আকাশ, সাদা গোলাপ অথবা সেমন্তি" থাকবেই।
"কাব্য, লেখাটা শেষ করবিনা?"
অনেক কষ্টে অনামিকা কথাটা বলেই, হাপিয়ে উঠলো।
কাব্য,ডায়রীর সেই পাতাটা আবারো খুললো।
"এই অবহেলাই,ভালবাসার ইমারত গড়ে ওঠার আগেই চিরদিনের জন্য ভেঙ্গে দিবে।।
যেদিন এই ইমারতটা ভেঙ্গে যাবে, সেদিন হয়তো শ্রাবণী'ও ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু শুভ্রর ভালোর জন্য এতটুকুতো করতেই হবে।।"
শ্রাবনী ঠিকই ধরেছিল, শুভ্র "অবহেলা" একদমই সহ্য করতে পারে না। গত তিন সপ্তাহ ধরে শ্রাবনীর খোঁজ না পেয়ে শুভ্র ভিতরে-ভিতরে অনেক "ক্ষেপে" উঠেছিলো।
তখনই শুভ্র ভাবতে লাগলো,কেন শ্রাবনী এমন করছে?
ও তো এগুলো ইচ্ছে করেই করছে, কিন্তু "কেন"?
যখনই শ্রাবনী কিছু লুকানোর চেষ্টা করে তখনউ এমন "হাওয়া" হয়ে যায়।
কিন্তু এবার শ্রাবনী কি লুকাবার চেষ্টা করছে?
আচ্ছা, প্রথম থেকে চিন্তা করা যাক
১) শ্রাবনী আড্ডাতে আসছে না। কিন্তু ওতো আড্ডাগুলোতে আসেই আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য, তবে কি ও আমার সঙ্গেই দেখা করতে চাচ্ছে না?
২) শ্রাবনী আবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু কেন? আবৃত্তিকে আমারা নিজেদের জীবনের অংশ মনে করি।তবে কি আবৃত্তি ছেড়ে দেওয়া,আর আমাকে ছেড়ে দেওয়া এক হয়ে গেলো না?
৩) শ্রাবনীর ভাই অর্ণব বলেছে,শ্রাবনী গত দু-সপ্তাহে ক্যামেরা ধরেনি। কিন্তু ছবি তোলা মানেই তো আমার সঙ্গে সময় কাটানো। তবে কি ও আমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছেনা?
৪) শ্রাবনীর মোবাইল অফ, ইমেইলগুলোও বোধহয় আনচেকড। কিন্তু ওতো মোবাইলে শুধুই আমার সঙ্গে কথা বলে, অথবা ওকে মেইলোতো আমিই করি। এর মানে কি ও আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে চাইছে?
শুভ্র সবভাবে চিন্তা করে শুধু একটাই উত্তর পেল, "শ্রাবনী, শুভ্রকে নিজের থেকে দূরে রাখতে চাইছে, অথবা শুভ্রর কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইছে।"
যেটাই হোকনা কেন, কিন্তু কেন এমন করবে?
শ্রাবনী তো শুভ্রকে "অনেক" ভালোবাসে, তাহলে কেনই বা....
শুভ্র এতোদূর ভাওবতে-ভাবতেই উত্তর পেয়ে গেল।
"শ্রাবনী, শুভ্রকে অনন্ত-মায়ায় ভালবেসে ফেলেছে। আর ভালোবাসা যেখানে,সেখানেই না পাওয়ার ভয় কাজ করে। শ্রবনীও না-পাওয়ার ভয়েই এগুলো করছে।"
হাহাহা! পাগলি একটা। এতোটুকুও বুঝলোনা যে শুভ্র'ও শ্রাবনীকে ভালবাসে। অনেক-অনেক ভালবাসে।
শুভ্রর প্রতিটি স্বপ্নে শ্রাবনী শুধুই জড়িয়ে নেই, বরং স্বপ্ন জুড়েই শুধু শ্রাবনী। শুভ্রর কাছে তো স্বপ্ন দেখা মানেই শ্রাবনী।
(দু-মাস পর) "নীল" একটা শাড়ি পড়ে শ্রাবনী বুয়েট-ক্যাফের ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল।
এই ছাদটাতে ওরা সবাই মিলে কতই না আড্ডা দিয়েছে, কিন্তু আজ সব কেমন যেনো "ফাঁকা-ফাঁকা।"
-"শ্রাবনী, আমি জানিনা আমরা কবে একজন আর একজনকে দেখেছিলাম। কিন্তু সেদিন থেকেই যে আমাদের গল্পটা শুরু হয়ে গিয়েছিল এটাকি তুই জানিস? "
প্রশ্ন করেই শুভ্ররুপী কাব্য,অনামিকার দিকে তাকালো।
-"জানি শুভ্র,আমি জানি বলেই তো ভয় পাই। গল্পের সমাপ্তিতে তোর স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যাক তা আমি চাইনা।"
শ্রাবনী হয়ে ওঠা অনামিকা, এবার কোনো কষ্ট ও জড়তা ছাড়াই উত্তর দিলো।
-"তুই এতো ভয় পাস কেন? তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি। দেখবিনা?"
কাব্য, ওর জ্যাকেটের ভিতর থেকে একটা "সাদা গোলাপ"- এর কলি বের করলো।
-"অনামিকা, তুই শুধু-শুধু ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেয়ে সময় নষ্ট করলি। তোকে কখনই বলা হয়নি, তোকে আমি ভালোবাসি।
তোকে আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে চাই, এটা বলবোনা; কেননা তুই তো আমার জীবনের অংশ, সেই প্রথম থেকেই আমার জীবন সঙ্গী।"
কখন যে, "শ্রাবনী" নামটা অনামিকা হয়ে গেল তা কেউই খেয়াল করলোনা।
অশ্রুসিক্ত চোখে অনামিকা অথবা "শ্রাবনীই" বলে উঠলো, "কাব্য, এখন যে আমার হাতে সময় নেই।"
কাব্য যেন এবার সত্যিই "শুভ্রর" মত ক্ষেপে উঠলো,
-"সময় নেই তো কি হয়ছে?
শোন, তুই শুধুই আমার। তুই শুধুই কাব্যের অনামিকা।
সময়ের ছোবল আর কিইবা করতে পারে,বড়জোর তোকে কেড়ে নেবে, কিন্তু আমার স্বপ্নগুলো থেকে তোকে কেড়ে নিবে কিভাবে?"
গভীর আবেগে,কাব্য অনামিকার হাত দুটি ধরে বলল, "তুই কি আমাকে ভালবাসিস? বল, তুই কি আমার হবি?"
অনামিকার চোখে তখন যেনো কান্নার কোনোই বিরাম নেই।
হাপাতে-হাপাতে, বহু কষ্টে অনামিকা বললো, "আমি তো তোরই। আবার নতুন করে হবো কিভাবে?"
৩
সারাটা রাত কাব্য অনামিকার হাত ধরে রাখলো।
সকালে নার্স এসে দেখলো অনামিকার হার্টবিট নেই।
নার্সের চিৎকারে ডাক্তার এসে দেখলো, শুধু অনামিকা নয়,কাব্যের'ও পালস পাওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু ডাক্তার অথবা নার্স কেউ'ই খেয়াল করলো না,
বেডের নিচে অনামিকার বন্ধ ডায়রী পড়ে আছে।
আর সেই ডায়রীতে অনামিকা-কাব্যের ভালবাসার "সেমন্তি" এক মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে।
ভোরের আলোতে সেমন্তিটি এক "পবিত্র-গোলাপ" হয়েই ফুটেছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





