somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: মৃত মানুষদের গল্প

২০ শে জুন, ২০১৩ রাত ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(১)

ট্যাবলেটগুলো গলায় ঢেলে দিলাম, তারপর পানি দিয়ে গিলে ফেললাম। ব্যস, জীবন শেষ করে দেয়া মোটেও কঠিন কাজ না। বেঁচে থাকাই বরং কঠিন যখন সব হারিয়ে যায়, একা বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন। মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেয়া অবশ্য বেশ টাফ ছিল, তারচেয়েও বেশি টাফ মনে হচ্ছে ট্যাবলেট খাওয়ার পর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা।

(২)

অনেকক্ষণ থেকে হাঁটছি। পা দুটো ব্যাথায় টনটন করার কথা এতক্ষণে। কিন্তু তেমন কোন অনুভূতি হচ্ছে না। শরীরটা বরং বেশিরকমের হালকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে হাঁটছি না, হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছি। তবে একটা সমস্যা হচ্ছে, আলোতে অসস্তি হচ্ছে। আজ পূর্ণিমা, চাঁদের আলো তো আছেই, সাথে রাস্তার সোডিয়াম বাতির আলো, ছুটে চলা মোটর গাড়ির হেড লাইটের আলো। দেয়াল টপকে পাশের সোহরোয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে গেলাম। এখানে আমি প্রায়ই আসি অবশ্য, নিশাতের চলে যাওয়ার পর থেকে এই জায়গাটায় নির্জনে বসে ওদের কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে। ওদের বলতে নিশাত আর আমাদের অনাগত সন্তান রোদসী। রোদসী নামটা আমি আর নিশাত মিলেই ঠিক করেছিলাম। সেই রোদসীকেই আনতে গিয়েই নিশাতের চলে যাওয়া পৃথিবী ছেড়ে, রোদসীও একই পথ ধরেছিল, দুদিনের বেশি থাকেনি পৃথিবীতে। দুদিন পরই তাকে ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল মায়ের কাছে। মাত্র দুদিনের আয়ু নিয়ে এসে কেমন ওলট-পালট করে দিয়ে গেল সবকিছু। সেই ভিষণ একা মুহূর্তগুলো কাটাতেই এখানে আসি আমি মাঝে মাঝেই, গত একবছর ধরেই এই বেন্চিটাতে বসি আমি।

(৩)

ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চোখ খুলতেই রাতপরীর মুখটাকে চোখে পড়লো। আমার পায়ের কাছে চুপচাপ বসে আছে মেয়েটা। রাতপরী প্রায়ই বসে এসে এখানে। খদ্দর যখন থাকে না, তখন আমার সাথে এসে গল্প করে। দুঃখী মানুষের সাথে গল্প করা খুব কষ্টকর। শুধু দুঃখের কথাই শুনতে হয়। দুঃখের কথা শুনতে কখনোই ভালো লাগে না। প্রথমদিকে মন খারাপ হয়ে যায় মানুষটার কষ্টে, তবে এই মন খারাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত লাগতে থাকে। তবে রাতপরী তেমন নয়। ওর সাথে কথা বলা সবসময়ই আনন্দের। মেয়েটা দারুণ মজা করে কথা বলে। সিগারেট খেয়ে পানি খেলে ক্ষিধে চলে যায়, জোনাকির গায়ে লিপস্টিক লাগিয়ে কপালে লাগালে আগুনের টিপ হয়ে যায়, 'জিম' বলে জোরে টেনে শব্দ করতে থাকলে আশেপাশে সব মশা মুখে এসে বসে, তখন থাপ্পর দিয়ে একসাথে অনেক মশা মেরে ফেলা যায়, এসব জ্ঞ্যানভান্ডার ওর কাছে থেকেই পাওয়া। রাতপরীর সাথে কথা বলার সময় মনেই হয় না, কী কষ্টে শরীর বিক্রি করা অর্থে ওকে পেটে ভাত জোগাতে হয়। ওর যন্ত্রণায় কারো পৈশাচিক আনন্দ আর গোটা সমাজের ঘৃণার মাঝে মাঝে ওকে বাঁচতে হয়। রাতপরী ভুলে যায় ওর সব বিষাদ, আমি ভুলে যাই আমার একাকিত্বের কষ্টগুলো। ওর হাত নেড়ে নেড়ে কিশোরী মেয়েদের মত হড়বড় করে কথা বলতে থাকে, তখন ভিষণ ভালো লাগে। মনে হতে থাকে, জীবনটা খুব বেশি খারাপ নয় যতটা আমরা ভাবি। এসময় আমার মনে হয় বেঁচে থাকাই যায়। এখন, এই মুহূর্তে আমার আবার মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাই
মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাই যায়। কেমন শ্বেত শুভ্র পরীদের মত লাগছে রাতপরীকে আজ। এসব মেয়েরা যদিও সবসময় সেজেগুজে বের হয়, তবু এদের মাঝে কেমন একটা অপরিচ্ছন্ন ভাব থাকে সবসময়। রাতপরী অবশ্য তাদের তুলনায় বেশ পরিষ্কার। তবু আজ বেশিরকম মনে হচ্ছে, সাদা জামা পড়ায় অন্যরকম এক পবিত্রতা ঘিরে রয়েছে ওকে।
রাতপরীর সাথে পরিচয়টা এখানেই। নিশাত চলে যাওয়ার পরের প্রচন্ড নিঃসঙ্গ সময়গুলো কেটেছে আমার এই বেন্চিটাতে, তখনই পরিচয় রাতপরীর সাথে। পরিচয় শব্দটা মাথায় আসতেই হাসলাম আমি। কি জানি আমি রাতপরীর সম্পর্কে! ওর নামটা পর্যন্ত কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। আজ কি জিজ্ঞেস করবো?
রাতপরীকে আজ পবিত্র লাগলেও কেমন বিষণ্ণ মনে হচ্ছে । ওর কি খুব মন খারাপ? জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতেই ও আমাকে সামনের দিকে যেতে ইশারা করে উঠলো। আমি ওর পিছু পিছু গেলাম। এটাও বেশ অস্বাভাবিক, রাতপরি প্রচুর কথা বলা মেয়ে, হড়বড় করে কথা বলতেই থাকে। আজ এতো চুপচাপ কেন! প্রয়োজনীয় কথাও যেন ইশারায় সারতে চাইছে।

এবারো কথা না বলে একটা ঝোপের দিকে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করলো। আমি ওর আঙ্গুল অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, ভয়ে আতকে উঠলাম, শিউরে গেলাম আতঙ্কে।

(৪)

আমি দেখলাম ঝোপের ভেতর একটা লাশ, নগ্ন, বিভত্সভাবে রক্তাক্ত, সারা শরীর ভর্তি জখম। শুধু মুখটা দেখে চেনা যাচ্ছে, মুখটা হুবুহু রাতপরীর মুখের মত। আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না, জমে যাচ্ছিলাম আতঙ্কে। হঠাতই আমার মাথায় এলো, লাশটা যদি রাতপরীর হয়, তাহলে আমি এতক্ষণ কার সাথে ছিলাম? মুহূর্তেই চোখ খুলে চারপাশে তাকিয়ে আমি আর কাউকে খুঁজে পেলাম না। লাশটার দিকে আর একবার তাকিয়ে আমি একটু চারপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম আর ভাবছিলাম। তবে কি রাতপরীর আত্মা এসে জানিয়ে গেল তার মৃত্যুর খবর? প্যারানরমাল কিছুতে আমার বিশ্বাস নেই, তবু এর চেয়ে গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা আমার মাথায় আসছে না।

ঝোপের কাছাকাছি ফিরে আসতেই দেখলাম তিনজন তরুণ বয়সের ছেলে লাশটাকে নিয়ে রাস্তার দিকে চলে যাচ্ছে। আমি প্রথমে থমকে গেলেও পরমুহূর্তেই দৌড়ালাম ওদের পেছন পেছন। আমি বুঝে গেছি, এরাই খুনী, এরাই খুন করেছে রাতপরীকে। এখন লাশ গুম করে দেয়ার জন্যই হয়তো ছুটছে লাশটাকে নিয়ে। রাতপরীর আত্মার উদ্দেশ্যও এখন আমি আন্দাজ করতে পারছি। নিশ্চয়ই আমাকে চিনিয়ে দিয়ে গেল ওর খুনীদের! আমি প্রতিশোধ নেবো রাতপরী, আমি প্রতিশোধ নেবোই।

ওরা ততক্ষণে রাস্তায় পৌছে গেছে। মেনহোলের ঢাকনা খোলার চেষ্টা করছে। তারমানে রাতপরীকে ওরা মেনহোলের ভেতর ফেলে দেবে। আমি এগিয়ে ওদের বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলাম।

কিন্তু দুঃখজনক ও আশ্চর্যজনকভাবে আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমি ওদের ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলাম, কিন্তু সরাতে পারলাম না। আমি ওদের স্পর্শই করতে পারছিলাম না। আমার হাত ওদের শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছিল। এরাও কি তাহলে অশরিরী আত্মা? নাকি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে, এসব কিছুই হয়তো ঘটছে না, সবটাই আমার কল্পনা। আমি সবসময় ডিপ্রেশনে ভুগি, আমার হ্যালুসিনেশন হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক কিছু না। তবে কোন কিছু টের পাওয়ার আগেই এতো আপার স্টেজে চলে যাবে ভাবতে পারিনি। তাছাড়া হ্যালুসিনেশনে ঘটা ঘটনাগুলো এতো পরিষ্কার হওয়ার কথা না।

এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। তিন তরুণ লাশটাকে মেনহোলে ফেলে চলে গিয়েছে একটা গাড়ি করে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি শুধু, কিছুই করতে পারিনি। অবাক করা বিষয়, ওরা আমাকে গ্রাহ্যই করলো না, একবার চোখ তুলেও তাকালো না, যেন দেখতেই পায়নি আমাকে।

হঠাত আমার শরীরটা খুব হালকা লাগতে লাগলো। নিচে তাকাতেই দেখলাম আমি আসলে হাঁটছি না, ভেসে বেড়াচ্ছি বাতাসে। আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছি।
আমার মনে পড়লো ট্যাবলেট খাওয়ার কথা, তারপর পার্কের বেন্চিতে ঘুমিয়েছিলাম। আমি কি তাহলে মরে গেছি? ঘুমের মধ্যেই? তাই তো স্বাভাবিক, এতগুলো ট্যাবলেট খাওয়ার পর ঘুম থেকে জাগার কথা না, মরে যাওয়ারই কথা। এই তাহলে ব্যাপার, ওই তিন তরুণই তাহলে জীবিত, আমিই মৃত? আমার পৃথিবী ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে।

(৫)

চোখে রোদ লাগছিল। তবু চোখ বন্ধ করে পড়েছিলাম। রোদসীর অত্যাচারে আর পারা গেল না। পিঠের উপর চড়ে বসে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, '' এই দুষ্টু বুড়ি, বাবাকে ঘোড়া বানানো হচ্ছে, না?'' রোদসী জবাব দেয় না, সুন্দর করে হাসে। মামনিটার স্বর্গীয় হাসিতে আমার মন ভরে যায়। নিশাত ড্রেসিং টেবিলের সামনে, এই সকাল সকাল গোসল করেছে, দারুণ দেখাচ্ছে ওকে। ওর চুলের গন্ধে আমার স্বর্গীয় অনুভূতি হয়। আজকের সকালের আলোটা স্বরগীয় আলোর মত লাগে, নরম, মোলায়েম রোদ। স্বর্গ কি এর চেয়েও বেশি সুখের জায়গা?

আমার গতরাতের সপ্নের কথা মনে পড়ে, ভয়াবহ তো বটেই। আজকের এই স্বর্গীয় পরিবেশের মধ্যে সেই বিভত্স সপ্নের কথা ভাবতে চাই না, দুঃসপ্ন তো বটেই, যে কোন সুন্দর সপ্নের চেয়েও আমার বাস্তব জীবন অনেক বেশি সুন্দর। স্বর্গের জীবনও এত সুন্দর হয় না সম্ভবত।

'স্বর্গ' শব্দটা হঠাত মাথায় লাগলো! আমি কি তাহলে স্বর্গেই আছি, গতরাতে সত্যি মরে গেছি? সপ্নটা কি সত্যিই ছিল?

নাকি এখনো সপ্ন দেখছি? তড়িঘড়ি করে হাতে চিমটি কাটলাম। চিমটি কেটে সপ্ন নাকি বাস্তব বোঝা যায়, স্বর্গে আছি না মর্ত্যে আছি তা কি বোঝা যায়? কিংবা জীবিত আছি নাকি মৃত, জানা যায়?
১৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×