দৈনিক আমার দেশ- সাহিত্য সাময়িকী পাতায় ২৫-০৫-১২ ইং তারিখে প্রকাশিত।
..........................
বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ছেলেটির। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, নিদারুণ ব্যস্ততায় রাশি রাশি জলকণা ছুঁড়ে দিচ্ছে এক ফালি আকাশ। জানালার ফাঁক গলে ভেতরে এসে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির ছাঁট। উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে সে। লাইট জ্বেলে দিয়ে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়। বিকাল সাড়ে পাঁচটা। একটু পরই রিডিংরুমে যাওয়ার কথা।
বৃষ্টির ওপর খুব বিরক্ত বোধ করে ছেলেটি। কি দরকার ছিল এ সময়টাতেই ঝেঁপে নামার? আকাশটা আরেকটু সময় মলিন, গম্ভীর চেহারা নিয়ে তার কান্নাটা ধরে রাখলে কি এমন সমস্যা হতো? অন্তত তারা দু’জনেই রিডিংরুমে পৌঁছানো পর্যন্ত? ক’দিন ধরে বৃষ্টি শুরু হলে থামা তো দূরের কথা, ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে কমারও কোনো লক্ষণ দেখায় না। ঝুম বৃষ্টিতে ছাতায় নিজেকে বাঁচানোই দায়, তার ওপর বইপত্র নিয়ে বকশীবাজারের এই হোস্টেল থেকে মেডিকেল কলেজের রিডিংরুম পর্যন্ত যাওয়া তো অসম্ভব! রেইনকোটও নেই। ভাবে, মেয়েটিকে ফোন করে আসতে মানা করে দেবে আজ।
মুঠোফোনটা হাতে নেয় ছেলেটি। কিন্তু নম্বর টেপার আগেই ফোন বাজতে থাকে। মেয়েটিই করেছে ফোন। মনে মনে হাসে ছেলেটি—টেলিপ্যাথি! ও-ও কি একই কথা বলার জন্য ফোন করেছে?
মেয়েটির কথা অস্পষ্ট শোনায়। নেটওয়ার্কের সমস্যা। লাইন কেটে যায়। ফোন করার চেষ্টা করে ছেলেটা বারবার, ব্যর্থ চেষ্টা। কিছুক্ষণ পর মেসেজ আসে, ‘ভীষণ পেট ব্যথা করছে। অ্যাপেনডিসাইটিসের পেইন হতে পারে। হাসপাতালে যাব। জলদি আসো।’
আঁতকে ওঠে ছেলেটি। দ্রুত বারকয়েক চেষ্টা করে ফোনের। না পেয়ে মেসেজ পাঠায়—‘৫ মিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি হোস্টেলের কাউকে নিয়ে বাইরে আসো।’
কতটা খারাপ অবস্থা কে জানে? ছেলেটির উদ্বেগ বাড়তে থাকে। যদি তেমন খারাপ হয়, কাল সকালেই হয়তো অপারেশন করিয়ে ফেলতে হবে। ডাক্তার দেখিয়ে এখনই তাহলে টেস্ট করাতে হবে কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। দ্রুত তৈরি হয়ে ড্রয়ার খোলে ছেলেটি। হাজার তিনেক টাকা আছে। পুরোটাই মানিব্যাগে ভরে ছাতাটা নিয়ে বের হয়। আকাশটা কেঁদেই চলেছে বিরতিহীন, একই তীব্রতায়। মনে মনে কষে গালাগাল দেয় বৃষ্টিকে, আকাশকেও।
মেয়েদের হোস্টেলের সামনে দিয়েই হাসপাতালে যেতে হবে। সেটুকু আসতে আসতেই অনেকখানি ভিজে যায়। ওইটুকু ছাতা শরীর বাঁচাতে পারে না।
হোস্টেলের সামনে এসে দেখে, মেয়েটি গেটে দাঁড়িয়ে। একা। রেইনকোট নেই গায়ে, হাতে ছাতাও নেই। ভিজে চুপচুপে অবস্থা।
‘কি ব্যাপার? কাউকে পাওনি? ব্যথা খুব বেশি?’ উদ্বেগে গলা কেঁপে যায় ছেলেটির।
তাকে অবাক করে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই মেয়েটি সামনে হেঁটে যায়। কলেজ ভবন আর লেডিস হোস্টেলের মাঝে ‘মিলন চত্বরে’ বসার একটা জায়গা আছে। বৃষ্টিতে জায়গাটা এখন ভেজা। সেখানেই গিয়ে বসে পড়ে ও—‘এখন ব্যথা নাই।’ ‘এখন ব্যথা নাই মানে? অ্যাপেনডিক্সের ব্যথা এত তাড়াতড়ি চলে গেল?’
‘হ্যাঁ, গেল। কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যথা থাকলেই তুমি বেশি খুশি হতে?’
কি কথার কি জবাব! ছেলেটি ভ্রূ কুঁচকায়। তবে ব্যথা নেই শুনে স্বস্তি বোধ করে। মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেজা জায়গায় বসে না। ওর মাথায় ছাতাটা ধরবে কি-না ভাবে। লাভ নেই, ততক্ষণে ওর প্রতিটি চুলের গোড়া পর্যন্ত ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। হিমালয়ের গা ছুঁয়ে ছুটে আসা জলো হাওয়া স্পষ্টতই কাঁপন ধরাচ্ছে গায়ে, তবু ওর চোখে-মুখে চাপা আনন্দের উজ্জ্বল আভা।
‘তুমি ছাতা ধরে আছো কেন? দেখছো না আমি পুরো ভিজে গেছি? তোমার কি আমার প্রতি সমবেদনা জানানোর উদ্দেশ্যেও ছাতা সরিয়ে রাখা উচিত না?’ কিছুটা আহ্লাদি ভঙ্গিতেই বলে মেয়েটি।
একটু ইতস্তত করে ছাতাটা মাথার ওপর থেকে পাশে সরিয়ে রাখে ছেলেটি। আর তখনই হঠাত্ করে মাথায় ঢোকে পুরো ব্যাপারটা। বাঁকা চোখে মেয়েটির দিকে তাকায়—‘আ-চ্ছা!’
না হাসি, না ভেঙানো—এমনভাবে মেয়েটি বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে দেখায়, তার ‘ষড়যন্ত্র’ যে ধরা পড়ে গেছে, বুঝতে পারে। সুর করে বলে—‘জ্বিইই।’
বেশ ক’দিন ধরেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন। মেয়েটি প্রতিদিনই আবদার করে ছেলেটির সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবে। ছেলেটির সায় নেই। বৃষ্টিতে ভেজার আইডিয়াটা তার বরাবরই না-পছন্দ। ভেজার মধ্যে কি আর মজা! বৃষ্টির মধ্যে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকা। হাতঘড়িটা না হয় ওয়াটার-প্রুফ, মোবাইলে না হয় কাভার দেয়া—তার পরও, যদি পানি ঢোকে, নষ্ট হয়ে যায়? আবার ভেজা অবস্থায় হোস্টেল পর্যন্ত যাওয়া—আরেক বিরক্তিকর অবস্থা!
তবে এখন যে পুরো বিপরীত অনুভূতি হচ্ছে ছেলেটির! ভিজতে মোটেই খারাপ লাগছে না। মেয়েটির মুখজুড়ে মুক্তো দানার মতো ছড়িয়ে আছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। ওর কপাল, কপোল, চিবুক ছুঁয়ে কোলের ওপর আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টির জল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে ছেলেটির। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে মেয়েটির চোখ, ঠোঁট, গ্রীবা। ওর চোখের তারায় এখন যে আনন্দের উচ্ছ্বাস, তা দেখার জন্য ছেলেটি তার এক পৃথিবী ওর পায়ে লুটিয়ে দিতে পারে। সেখানে হাত-ঘড়ি, মানিব্যাগ তো অতি তুচ্ছ ব্যাপার! একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ থেকে মূর্খের মতো এতদিন অযথাই নিজেকে বঞ্চিত করেছে এমনটাই মনে হয় এখন। মেয়েটির পাশে ভেজা জায়গাটায় গিয়ে বসে ছেলেটি। মনে মনে ওকে ধন্যবাদ দেয় অসংখ্যবার। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়—‘চলো, হাঁটি’।
একহাত দিয়ে বৃষ্টি থেকে চোখ আড়াল করে আকাশের দিকে মুখ তোলে ছেলেটি। সরাসরি মুখে এসে পড়ে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। ভালো লাগে। হালকা গলায় বলে, ‘তোমার অবস্থা একদিন ওই রাখাল বালকটার মতো হবে। এভাবে মিথ্যা কথা বলতে থাকলে দেখবে একদিন সত্যি কথাও বিশ্বাস করবো না।’
মেয়েটি ফিরে তাকায়, চোখের তারায় নাচন তুলে বলে—‘কে? তুমি? বাজি লাগো, আমি যা-ই বলি, জীবনে কখনোই তা
তোমার কাছে মিথ্যে বলে মনে হবে না।’
তা-ও ঠিক! মনে মনে ওর সঙ্গে একমত হয় ছেলেটি। নিশ্চিত পরাজয়ের এই বাজি ধরার কোনো ইচ্ছে হয় না তার।
.................................................