মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা জানি আপনি জন্মেছেন ঢাকায়, আপনার বেড়ে ওঠা ঢাকায়, আপনার পরিবারের ওপর যে মহাবিপর্যয় নেমে এসেছিল সেটাও ঢাকায়। ঢাকা আপনার স্মৃতি আর রক্তে বিচরণ করে। আপনাকে ঢাকা ছাড়তে বলা রীতিমত অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে। তবু একটি জাতির কর্ণধার বা সর্বোচ্চ সেবক হিসাবে আপনাকে অনেক চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করতে হয়েছে জীবনে। শাসনকার্যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেটা আমাদের বুঝতে তেমন অসুবিধা হয় না। তারই অংশ হিসাবে অজস্র স্তব্দ বোবা মানুষের পক্ষ থেকে ততোধিক একজন নগণ্য মানুষ হয়েও আপনাকে একটা পরামর্শ দিতে চাই সেটা হচ্ছে আপনি ঢাকা ছাড়–ন।
চারশ বছরের শাসনকার্যে ভিত্তি হিসাবে মজবুত শহর ঢাকা থেকে আপনি আপনার শাসনকার্য সরিয়ে ফেলুন অন্য কোনো বিভাগীয় শহরে। হতে পারে সেটা চট্টগ্রাম হতে পারে সেটা রাজশাহী হতে পারে সেটা বরিশাল অথবা রংপুর। কারণ আপনি জানেন, ঢাকা এখন সম্পূর্ণ বাসের অযোগ্য তবে বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সবচাইতে নির্ভরযোগ্য শহর। এ শহরে আপনি বা আপনার সহকর্মীরা যখন রাস্তায় ডজনখানেক গাড়ী নিয়ে চলাচল করেন তখন শহরের পুলিশেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে আপনাদের চলাচলের জায়গা জটমুক্ত করতে। জনগণের অসুবিধা বা অসহিষ্ণুতাকে পরোয়া না করেই। সেটার পেছনে যুক্তি আছে আপনারা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছেন। মানে এই জনগণকে রক্ষা করবার কাজেই আপনারা নিযুক্ত। সে ক্ষেত্রে জনগণ সামান্য বিরক্ত হলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু এই জনগণ যারা ঢাকায় থাকে তারা কীভাবে বেঁচে আছে সেটা আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন। এদের জীবন যাপনের মান কোন অর্থেই ইদুঁরদের চেয়ে আরাম দায়ক নয়। এটাকে মনুষ্য জীবন বলে না। হয়তো মনুষ্য জীবন বলতো যদি না আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্যান্য দেশ সর্ম্পকে অবগত না থাকত। ইতোমধ্যে তারা জেনে গেছে যে পৃথিবীতে এর চাইতেও ভাল শহর আছে। রাজধানী হওয়া সত্বেও সে সব দেশে চমৎকার জীবন যাপন করছে জনগণ এমনকি আমাদের চাইতে অনুন্নত দেশ হওয়া স্বত্বেও।
আপনি অবগত আছেন এই ঢাকাবাসীর পানি নাই, এরা ঠিকমতো গোসল করতে পারেন না। এমন কি সারতে পারে না বাথরুমে অন্যান্য কাজও এমনকি খাওয়ার পানিরও প্রচুর সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গ্যাস বিদ্যুৎ সঙ্কট বাসাভাড়া বৃদ্ধি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি মোট কথা এমন কোনো সমস্যা নাই যা ঢাকায় নাই। অন্যদিকে রাজধানী হবার কল্যাণে সব বিভাগের কেন্দ্র এখন ঢাকা। পনের কোটি মানুষের শীর্ষ কাজটি পুর্ণ করতে তারা প্রতিদিন ঢাকায় ছুটে আসছে। আর রাজধানী হওয়ার কারণে সমস্ত শ্রেণীর মানুষেরা তাদের কাজের খোঁজে ঢাকায় চলে আসছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ঢাকায় লোকের সংখ্যা। সেটা সংখ্যাগুনে বলা যায় না। ফলে দুর্লভ হয়ে উঠছে ভাড়া বাসা পাওয়া। বাসা বাড়ির অশিক্ষিত আত্মাহীন মালিকেরা নিয়ত বাড়াচ্ছে তাদের খামখেয়ালিপূর্ণ ভাড়া। কোর্ট-কাচারি থেকে শুরু করে সমস্ত টিভি অফিস, সমস্ত পত্রিকার অফিস, সমস্ত কর্পোরেট অফিস, সমস্ত সরকারি অফিস এমনকি একটা ছেলে গান গাইতে স্বপ্ন দেখলে বা কবিতা লেখার স্বপ্ন দেখলেও ঢাকা আসা ছাড়া তার জীবনের স্বপ্ন পূর্ণ হবার নয়। ঢাকা সবকিছুকে কুক্ষিগত করে রেখেছে এ কথা এখন দিবালোকের মত সত্য।
এদিকে গবেষকরা বলছে ভুমিকম্পে বিশ্বের দ্বিতীয় ঝুকিপূর্ণ শহর ঢাকা। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ দালানের ভুমিকম্প বা অন্যান্য বিপর্যয় সামলানোর ক্ষমতাই নাই। আর ঢাকা শহরের রাস্তার অবস্থা আপনি অবগত আছেন। এই যানজট এখন প্রধান সমস্যা বললেও চলে। অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে শত শত মানুষ কখন অফিসে পৌছাতে পারবে বা আদৌ পারবে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের রাস্তায় কেটে যাচ্ছে। দোযখের যে ধরণের শাস্তির কথা পাক- কোরাণে বর্ণিত আছে তারও চেয়ে কঠিন জীবন এখন যাপন করছে ঢাকা বাসী। টেনশন খুব ভেতর থেকে তাদের ধ্বংশ করে দিচ্ছে।
মাননীয় প্রধান, বেঁচে থাকার বিনিময়ে জীবনের সমস্ত নৈতিকতা বিসর্জন দেয়া ও পাপবোধে ধ্বংশন্মুখ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ঢাকা ছাড়তে বলে লাভ নাই। বাংলাদেশে এমন কোনো শহর নাই যেখানে এই সংখ্যাহীন মধ্যবিত্তের কর্মস্থান আছে। ভুমিকম্পে যদি শহরটা উজাড় হয়েও যায় মহামারিতে যদি সকল মানুষের দেহ গলেও যায় তবুও সেই আধগলা দেহ তারা শার্টপ্যান্টে ঢুকাবে অফিসে যাবার আশায়, কারণ তাদের আর কোনো উপায় নাই। সুতরাং কোনো ভয় ওদের উৎসাহিত করতে পারবে না ঢাকা ছাড়তে।
এই মায়া আপনাকেই ছাড়তে হবে মাননীয় প্রধান। সমস্ত প্রশাসনিক ভবন নিয়ে একযোগে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া যদি সম্ভব না হয় তাহলে ইউরোপের দেশ গুলোকে ফলো করা যেতে পারে। রাশিয়ার রাজধানী যেমন সিজন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। মস্কো রাশিয়ার রাজধানী হলেও ওরা শীতের সময় পিটার্সবুর্গকেই প্রশাসনিক কর্মস্থল বানায়। এমনকি মি.প্রেসিডেন্টও সেখানেই তার দপ্তর স্থানান্তর করেন। এরকম আরো অনেক দেশ আছে পৃথিবীতে যেখানে গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলো সারা দেশে ছড়ানো রয়েছে। এতে করে প্রশাসনিক কাজে যেমন গতি আসে তেমনি এলাকাটাও ব্যাপক উন্নতির দেখা পায়। মানুষের নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই শত শত ছেলে যারা পাশ করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে তাদের কাজ দেবেন কোথায়? কোন কাজের সুযোগ না পেয়ে তারা হতাশায় ধুকে ধুকে মরতে মরতে হাতে তুলে নিক অস্ত্র অথবা করুক আত্মহত্যা তা আপনি চান না আমরা জানি। আপনি তা চাইতে পারেন না। কারন এদেশের সব চাইতে বড় জনগণের সেবকের চাকরিটা আপনার। আপনি আপনার রাজধানী দেশের অন্য কোথাও স্থানান্তর করুন হোক সেটা ঋতুভিত্তিক। ঢাকা একেবারে ছেড়ে দেবার দরকার নাই। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দপ্তর আপনি স্থানান্তর করুন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যেমন শিল্পের শহর হিসাবে চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধি আছে। শিল্প সংক্রান্ত সমস্ত দপ্তর, মন্ত্রনালয় ইত্যাদি আপনি চট্টগ্রাম স্থানান্তর করতে পারেন। আইন সম্পর্কিত সব প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করুন রাজশাহীতে। টিভি চ্যানেল পত্রিকা তথা মিড়িয়াজগত পাঠিয়ে দেন কক্সবাজার। এভাবে গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলো দেশের একেক জায়গায় পাঠিয়ে দিলে মধ্যবিত্তরা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে তাদের কাজ অথবা স্বপ্নকে নিয়ে। সৃষ্টি হবে প্রচুর মানুষের নতুন কর্মসংস্থান। যদি চারশ বছরের পুরানো এই শহরকে বাঁচাতে চান। যদি ঘুমের ভেতর ভুমিকম্পে এই লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু না চান এমনকি আপনি নিজে বাঁচতে চাইলেও মাননীয় প্রধান, আপনাকে ঢাকা ছাড়তে হবে । এর কোনো বিকল্প নাই। আপনিই পারেন আসন্ন বিপর্যয় থেকে এ শহরকে রক্ষা করতে। একটি শহরের জন্য মৃত্যুরত একটি দেশকে। অযাচিত পরামর্শের জন্য ক্ষমা করবেন।