সবারই তো কোন না কোন অভিজ্ঞতা থাকে। তা কারো জীবনে প্রথম, কারো জীবনে অনেক বার। আমার জীবনে এমনই এক ঘটনা ঘটেছে যা পূর্বে কখনো হয় নি। ঘটনা টা বেহুঁশ হবার। বেহুঁশ হবার কোন অভিজ্ঞতা আমার আগে ছিল না। অন্যদের দেখতাম বেহুঁশ হতে। বিশেষত কোন মৃত্যু সংবাদ শুনে অনেককেই মুর্ছা যেতে দেখেছি। যদিও ব্যাপারটা খুব ই বেদনাদায়ক কিন্তু তখন রোমাঞ্চ অনুভূত(স্বীকার করছি তা উচিত নয়) হত।
২০০৭ সালের রমজান মাস। চারটি রোজা রাখার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। লাইনের পানিতে ছিল প্রচন্ড গন্ধ। পর্যাপ্ত পানি না খেয়ে রোজা রাখলাম চারটিই। পঞ্চম দিন ভোরে আর উঠতে পারছিনা। গায়ে কোন শক্তি নেই। রুমমেট গায়ে হাত দিয়ে দেখে প্রচন্ড জ্বর। সাথে সাংঘাতিক মাথা ব্যাথা। সেদিন আর সেহরী খাইনি। সকালে রুমমেট নাপা এক্সট্রা এনে দিল। হালকা ঠান্ডা ভাত খাওয়ার বৃথা চেষ্টা করে ওষুধ খেলাম। শরীর যে কত দূর্বল তা টের পাচ্ছিলাম কিন্তু কাউকে বুঝাতে পারছিলাম না। এভাবে একদিন গেল। পরদিন রামকৃষ্ণ মিশনে গেলাম ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তার জ্বর মেপে, চেহারা দেখে কতগুলো টেষ্ট দিলেন। ফকিরাপুলের এক ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ঠিকানা দিয়ে বললেন এখান থেকে টেষ্ট গুলো করিয়ে আনেন। টেষ্ট করালাম সেদিনই কিন্তু রিপোর্ট পেতে আরো দুদিন লেগে গেল। এদিকে আমি না খেতে পেরে আরো দূর্বল হয়ে পড়লাম। রুমমেটের মাধ্যমে টেষ্ট রিপোর্ট আনালাম সকালে। বিকালে রুমমেটরা সবাই ঘুমাচ্ছে তাই কাউকে ডাকলাম না। ভালই চলতে পারব ভেবে একাই বেরুলাম। রিকশা যোগে রামকৃষ্ণ মিশন এ গেলাম। তখনো কাউন্টারে লোকজন আসেনি। অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিশ মিনিট পর যেই কাউন্টার ম্যান আসল অমনি সবাই হুড়মুড় করে দাঁড়িয়ে গেল। পুরাতন রোগী বলে প্রথমেই আমার ডাক পড়ল। কাউন্টারের ছোট্র খুপরিতে হাত রেখে আগের প্রেসক্রিপশন এবং পঞ্চাশ টাকা (প্রথম বার ১০০ টাকা) ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাউন্টারের ভিতর ছোট একটা ফ্যান (টেবিল ফ্যানের মত কিন্তু উপরে ঝুলানো) প্রচন্ড শব্দে চলছিল। যতটা না তার আওয়াজ তার চেয়ে বেশী আওয়াজ দিচ্ছিল তাকে বন্দি করে রাখা খাঁচাটি। এমন সময় একজন ভদ্র মহিলা আসলেন চোখের ডাক্তার দেখাতে। সেদিন নাকি চোখের ডাক্তার বসেন না। পরের দিন আসতে বললেন কাউন্টার ম্যান। তাছাড়া চোখের ডাক্তার নাকি অন্য ফ্লোরে বসেন। কিন্তু মহিলার এক কথা আমার চোখ তো আজ দেখাতে হবে। সম্ভবত খুব বেশী সমস্যা হচ্ছিল তাই তিনি এতটা নাছোড়বান্দা ছিলেন। এত শব্দের ভিতর আমার শরীর বারবার ভেঙ্গে যাচ্ছিল মনেহয়। কাউন্টার ম্যানটি তার প্রতিদিনের কর্ম করছিলেন। এই রেজিষ্টার খাতা স্কেল করা, বিভিন্ন নাম ধাম লেখা, মানি রিসিট বের করা ইত্যাদি। আমি এক পর্যায়ে আর দাঁড়িয়ে থাকলে পারলাম না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে। আর কিছুক্ষণ পরে কিছুই দেখা যাবেনা। কেউই কিছু দেখবে না। হঠাৎ করেই কাউন্টারের খুপরির ভিতর হাত রেখেই পড়ে গেলাম। শুধুমাত্র ধর ধর বলে দুটো শব্দ শুনলাম। এরপর আর কিছু শুনিনি। যখন তাকালাম দেখলাম আমার দুই পা দুজন ধরে আর দুই হাত দুজন ধরে একজন মাথা ধরে আমাকে সোফায় শুয়াচ্ছেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পৃথিবীটাকে মিস করলাম। কিছুক্ষণ পর পর একেক জন আমাকে জিজ্ঞাসা করেন এখন কেমন লাগছে। মুখে বলছি ভাল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনেক লজ্জা পাচ্ছিলাম। এর পর সোফায় বসে থেকে যেদিকে তাকাচ্ছিলাম দেখছিলাম এক জোড়া স্নেহাতুর চোখ আমার দিকে পরম মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে। অনেকে মাথায় হালকা পানি দিয়ে দিতে বললেন। কেউ বললেন একা কেন আসলাম। ঘটনাটা ডাক্তারের কানে পৌঁছে গিয়েছিল। আমি যথারীতি প্রথমেই এসাইনমেন্ট পেলাম। আমার রিপোর্ট দেখে ডাক্তার যা বললেন তা হল পানিতে সমস্যার কারণে আমার হেপাটাইটিস হয়ে থাকতে পারে। তিনি আরো দুটি পরীক্ষা করতে বললেন। আমার রুমমেট আমাকে বোনের বাসায় রেখে আসে। ঘটনা শুনে ভাইয়া আসে গাজীপুর থেকে। ভাইয়া আমাকে অন্য এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। রক্ত পরীক্ষা করে কিন্তু হেপাটাইটিসের কোন কিছুই ধরা পড়েনি। যাক সে যাত্রায় রেহাই পেলাম।
এখনো গরমের দিন আসলে কথাটা মনে পড়ে। ইদানিং বেশী মনে পড়ছে। আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
সবার প্রতি একটা অনুরোধ রইল - বেশী করে পানি খাবেন। তবে তা যেন বিশুদ্ধ পানি হয়। না হলে আমার মত অবস্থা হতে পারে।
ধন্যবাদ সবাইকে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




