বলা নেই, কওয়া নেই, তিন-চার-ছয়মাস অন্তর ঝুল ওঠে সুরবালার৷ তখন তিরিশোত্তর বিধবা, ভাইয়ের সংসারে নিজের ঘঁ্যাট নিজে রেঁধে খাওয়া সুরবালা কৈশোরে ফিরে আসে আর পরনের কাপড় হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে গোবরলেপা বারান্দায় থেব্ড়ে বসে নামতা-শতকিয়া-প্রথমভাগ-বর্ণ পরিচয় স্মৃতি থেকে পড়তে থাকে সুর করে৷ সেই পড়া কয় বেলা, কয় প্রহর চলবে কেউ বলতে পারে না৷ ঝুল ওঠার আগের কয়েক দিন ধরে মাথার মধ্যে কেমন জানি করতিছে, বুকের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা ঠেকতিছে, রাত নিশুত হয়, নিঝুম হয়, আলো ফুটে, বিহান হয়, আমার ঘুম আসতিচে না রে... এইসব বলা শুরু করলেই বোঝা যায় সুরবালার ঝুল উঠবে৷ তারপর ঝুল উঠলে সুরবালা কৈশোরে ফিরে যায়, চিত্কার করে পড়তে শুরু করে...
অ_তে অজগর, অ-অ- অজগর ঐ আসছে তেড়ে
আ-তে আম- আম-আমটি আমি খাব পেড়ে
... ... ...
একে চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ, তিনে নেত্র
... ... ...
তিন এককে তিন
তিন দুগুণে ছয়
তিন তিরিক্ষে নয়
তিন চারে... তিন চারে... তিন চারে...
দেড় দুইদিন এই রকম চলবে৷ এর মধ্যে মাথায় জবা-কুসুম কেশতেল, ঘৃতকুমারীর শাঁস, কপালে শ্বেত চন্দন বাটা লেপে দেয়া এইসব চলবে৷ তারপরে দেড়-দুইদিন প্রায় অভুক্ত, চেঁচিয়ে গলা ডেবে যাওয়া, আমিষবঞ্চিত অশক্ত সুরবালা নেতিয়ে পড়বে, ঘুমিয়ে পড়বে৷ বেশ দীর্ঘমেয়াদী ঘুম৷ ঘুম ভাঙলেই দেখা যাবে সে আবার নিজের সঠিক বয়স, সঠিক পরিবেশ ফিরে পেয়েছে৷ রোজকার মত ঘরকন্নায় মন দিয়েছে৷ ইন্দুবালা এ বাড়িতে এসে অব্দি এই রকম দেখে আসছে৷ দেখে আসছিল৷ এ-ভাবেই মানিয়ে নিয়েছিল সে-ও৷ চলছিলও এভাবেই৷ কিন্তু চিরকাল তো আর একভাবে চলে না৷ এদেরও চলল না৷
তবে সুধীর কামার মরার আগে পর্যন্ত পরিবর্তনের বড় কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায়নি৷ ইন্দুবালাদের জীবন যাপনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ আবার আসেনি যে একেবারে বলা যাবে না৷ মানুষ বেঁচে থাকলে বুঝুক না বুঝুক, একটু না একটু বদলাবেই৷ বয়সে বদলায়, ভাবনায় বদলায়, জীবন যাপনে বদলায়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বদলানো এতই ধীর, সে যে বদলাচ্ছে তা অনেক দিন না গেলে বোঝাই যায় না৷ তা ইন্দুবলাও বদলাচ্ছিল, সুধীর কামারও বদলাচ্ছিল৷ একদিন-দুইদিন নয়, প্রায় দুই কুড়ি বছরের সহবাস তাদের৷ ইন্দুবালা যেদিন সুধীর কামারের দখলেই এল... দখলে এল৷
তখন সরু চালের সের আট আনা, জোড়া ইলিশ দেড় টাকা, চাঁদি ছয় টাকা ভরি, সোনা পঞ্চাশ টাকা৷ আড়াই টাকা দিলে ঘরে পরার শাড়ি, খাসির মাংস আধা সের কিনলে আধাপোয়া কলিজা ফাও পাওয়া যায়৷
তখনো হিন্দুস্থান-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধেনি৷ বাবুরা যারা প্রথম চোটেই হিন্দুস্থান যাবার, চলে গেছে৷ কামার কুমোর জোলা কারিগর ব্যবসাদার হিন্দুরা তখনো হিন্দুস্থানমুখো হয়নি৷ কিছু কিছু বিহারী মুসলমান এসে ডেরা বেঁধেছে রেললাইনের পশ্চিমে৷ সরকারই জমি দিয়েছে ওদের সেখানে৷ তা রেললাইনের ওপার তখন তো টাউনই নয়৷ টাউন কমিটির কিছু যায়-আসেনি৷ তখনো একমাত্র সিনেমা হলে কলকাতা-বোম্বাইয়া টকি চলে৷ হিন্দু মুসলমানে মুখ দেখাদেখি বন্ধের কোনো আশংকা জাগেনি৷ এমনকি টাউন কমিটির প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারী তখনো হিন্দু৷ পৌরসভা হলো এই তো সেদিন৷ তার আগে পর্যন্ত টাউন কমিটিই শহরের মা-বাপ৷ আদালতের নামকরা মোক্তার সব ক'জনাই হিন্দু৷ হাকিমও৷ হাইস্কুলের মাস্টাররাও বেশির ভাগ হিন্দু৷
ইন্দুবালা সেই সময়ে সুধীর কামারের দখলে এল...
দখলেই এল৷
বিয়ের মাধ্যমে নয়৷ তিন তাসের জুয়ার মাধ্যমে৷
তখন ইন্দুবালার বয়স আঠার-উনিশ৷ আড়াই বছর হলো বিয়ে হয়েছে চৌকির পাড়ের বৈকুণ্ঠের সাথে৷ পাইন্যা বৈকুণ্ঠ৷ রসুলের মোড়ে তার খিলিপানের দোকান৷ বৈকুণ্ঠের মসলাদার পানের তখন টাউন-জোড়া সুনাম৷ রাতে ঘরে ফেরার সময় মাঝে মাঝে ইন্দুবালার জন্যে পান দিয়ে আসত৷ ইন্দুবালা ফরসাই৷ দোহারা গড়নের ফুলো ফুলো ঠোঁট৷ তা সেই ঠোঁটেও কী পানের রঙে কম বাহার খেলে! জুয়াই বৈকুণ্ঠের সব কিছু খেল৷ শেষে একরাতে বাজি ধরে বসল ইন্দুবালাকে৷ একঘর ভর্তি জুয়াড়ি সাক্ষ্য ছিল৷ তাদের কেউই প্রায় এখন আর বেঁচে নেই৷ তা সেই বাজিতেও হেরে গেল বৈকুণ্ঠ৷ তার পাঁচের জোড়ার ওপর টেক্কা টপ কালার দিয়ে সুধীর কামার বাজিসহ জিতে নিল ইন্দুবালাকে৷ কেউ প্রতিবাদ করেনি৷ বউকে তো বাজিতে তোলা যায়ই৷ কুরুক্ষেত্রের পাঁচালিতেই তো সবাই শুনতে পায় বউ দ্রৌপদীকে বাজি ধরে যুধিষ্টির জুয়া খেলেছিল শকুনির সাথে৷ বাজিতে হেরে দ্রোপদী গেল দুর্যোধনের দখলে৷ তখন রাজসভায় তার বস্ত্রহরণ৷ কিন্তু দ্রোপদীর সহায় ছিল তার সখা৷ কৃষ্ণঠাকুর বলে কথা! সেই-ই বাঁচাল দ্রোপদীর ইজ্জত৷ দুর্যোধন কাপড় টানতে থাকে, কাপড় আসতেই থাকে, আসতেই থাকে, শেষ আর হয় না৷ দ্রোপদীকে ন্যাংটো করার খায়েশ মিটল না দুর্যোধনের৷ কিন্তু ইন্দুবালা তো আর দ্রোপদী নয়৷
তার শাড়িও এগার হাতের বেশী লম্বা নয়৷ কাজেই তা খুলতে সুধীর কামারের কয়েকটা হঁ্যাচকা টানের বেশী লাগেনি৷
আর বউকে সুধীর কামারের হাতে তুলে দিয়ে বৈকুণ্ঠ দেশান্তরি৷ রসুলের মোড়ে তার পানের ঢোপের ঝাঁপি ওঠে না৷ বৈকুণ্ঠের কিছু বাঁধা খদ্দের ছিল৷ বৈকুণ্ঠের সাজা পান ছাড়া তাদের চলত না৷ বিশেষ করে টাউনের তাড়িখোরের দল আর রাত আটটার দিকে যাদের গন্তব্য ছিল ভবানীগঞ্জের মাগিপাড়া৷ রাত আটটাই তখনকার দিনে অনেক রাত৷ কেরোসিনের টেমি আর হ্যারিকেন ততোক্ষণে প্রায় সব ঘরেই নিভে যেতো৷ টাউনের
রাস্তায় একপাক ঘুরে যেত শেয়ালের দল৷ রাত নয়টায় সিনেমা ভাঙার পর দর্শকদের নিজ নিজ বাড়ি যেতে যেটুকু সময় লাগে! তারপর আর একজন লোককেও রাস্তায় পাওয়া যাবে না৷ তো সিনেমা ভাঙা পর্যন্ত বৈকুণ্ঠের দোকান খোলা থাকত৷ সিনেমাভাঙা দর্শক বাড়িতে নিয়ে যেত বৈকুণ্ঠের খিলি পান৷ কিন্তু ইন্দুবালাকে সুধীর কামারের হাতে তুলে দেবার পর আর কেউ বৈকুণ্ঠকে দেখেনি৷ শোনা যায়, সেই রাতেই সে নর্থ বেঙ্গল মেইল ধরে চলে গেছে হিলি বর্ডারে৷ বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়ায়৷ ইন্দুবালার কি খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন? আজ আর মনে পড়ে না৷ তবে অনুভূতি বোধ হয় কিছুই ছিল না৷ কেননা, এমন ঘটনা তার জীবনে ঘটতে পারে, কোনো মেয়ের জীবনে ঘটতে পারে, চরম দুঃস্বপ্নেও তা ভাবতে পারেনি বলেই তার সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ সে তখন রক্তমাংসের পুতুল বৈ আর কিছু নয়৷
আবার, আশ্চর্য্যের ব্যাপার যে, নিজের সমস্ত অতীতকে মন থেকে মুছে ফেলে সুধীর কামারের সাথে মানিয়ে নিতে তার বেশিদিন লাগেনি৷ নিজেদের গুটিয়ে নেবার, সবকিছু সয়ে নেবার শক্তি মেয়েদের এত বেশী! সুধীর কামারের বউ মরেছিল মাস আষ্টেক আগে৷ কোনো ছেলেপুলে রেখে যায়নি৷ বাড়িতে থাকার মধ্যে সুধীর কামারের বিধবা বোন সুরবালা৷
এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারে ইন্দুবালা৷ প্রথম প্রথম সুধীর কামার তার ওপর হামলে পড়ত৷ যেন দখলীস্বত্ব প্রতিষ্ঠা করছে জোর করে৷ তারপর ধীরে ধীরে নরম হয়ে এল লোকটা৷ ভালোও বেসে ফেলল এক সময়৷ এমনকি একদিন তার মরা বউয়ের সিঁদুরের কৌটা বের করে তুলে দিল ইন্দুবালার হাতে৷
সুধীর কামারের বোন সুরবালা তার ছোঁয়া এড়িয়ে চলত৷ খাবারের জল-টল ছুঁতে দিত না ইন্দুবালাকে৷ ভাইয়ের জন্য রান্না করত নিজেই৷ সরাসরি কোনো কথা বলত না ইন্দুবালার সঙ্গে৷ কথা বললেও তার সাথে যোগ করত খিস্তি৷ একদিন; সেদিন খুব বর্ষা, সুধীর কামারের নেহাইয়ের আগুন নেভানো৷ সৃষ্টি ভেসে যাবার মতো বর্ষা৷ গায়ে সুখের আলসেমি নিয়ে চৌকিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল সুধীর৷ হঠাত্ বলল_ইন্দু রাঁধ দেখি আজ, খিঁচুড়ি কেমন পারিস!
তার বোন তো থ! ইন্দুবালাও৷
আমার হাতের রান্ধন খাবে!
আরে অসুবিধা কী! সব করতিছি, খাওয়া কী দোষ করল?
এইভাবে রান্নাঘরে৷ সুরবালাও যেন গোপনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে৷ নিজে বিধবা মানুষ৷ মাছ-মাংস-পেঁয়াজ ছুঁতে ইচ্ছা করে না৷ কিন্তু ভাইয়ের জন্য রাঁধতেই হতো৷ এখন ইন্দুবালার ওপর ভার পড়ায় শুধু নিজের ঘঁ্যাটটুকু ফুটিয়ে নিলেই হলো৷ সিঁদুরের কৌটা, রান্নাঘর, খাবার জল ধরে একে একে সংসারের সবকিছু৷ আর ইন্দুবালা খাটিয়ে মেয়ে মানুষ৷ ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কামারশালায় উঁকি দেয়৷ জলের চাড়ি ভরে রাখে৷ নেহাইতে কয়লা গুঁজে দেয়, হাপরের দড়ি টানে৷ হুঁকোয় ফুঁ দিতে দিতে কামারের দিকে এগিয়ে দেওয়া তো আছেই৷ বছর না ঘুরতেই ইন্দুবালা ছাড়া সুধীরের আর চলে না৷
তো এইভাবে সুধীর কামারের সংসারও চলে এল ইন্দুবালার দখলে৷ তার পর বছরের পর বছর৷ মাঝখানে কত কিছু ঘটে৷ সুরবালা মরেছে৷ ইন্ডিয়া পাকিস্তান দুইবার যুদ্ধ বেধেছে৷ ওরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে একাত্তরের নয় মাস৷ এ গাঁওয়ে সে গাঁওয়ে৷ কিন্তু ইন্ডিয়া যায়নি৷ সুধীর অনেকবার বলেছে তাদের ইন্ডিয়া যাওয়া উচিত৷ কিন্তু ইন্দুবালার এক গোঁ, না৷ সেই গোঁ-এর কাছে হার মেনেছে সুধীর৷ শেষ পর্যন্ত সেই নয় মাসও পাড়ি দেয়া গেছে৷ তারা ফিরে এসে ফের পুড়ে যাওয়া ভিটায় ঘর তুলেছে৷ কামারশালায় চামড়ার হাপর জুড়েছে, আগুন জ্বেলেছে নেহাইতে কয়লা ঠেসে৷ নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করেছে পুরনো জীবনযাপন৷ সুধীর কামার শুধু একটা জিনিস দেয়নি ইন্দুবালাকে৷ সন্তান দিতে যে তার অনিচ্ছা ছিল তা-ও নয়৷ তবে হয়নি৷ হয়তো সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা ছিল তাদের কোনো একজনের৷ কিংবা হয়তো দু'জনেরই৷ এই নিয়ে খুব আলতোভাবে ডাক্তার বদ্যি করার বায়না ধরেছে ইন্দুবালা৷ কিন্তু সুধীর পাত্তা দেয়নি৷ হাবে-ভাবে বুঝিয়েছে, ছেলেমেয়ে না হওয়াতেই তারা ভালো আছে৷
বংশরক্ষার কথা তুললে সুধীর হেসেছে৷ কামারের আবার রংশরক্ষা! সেকি রাজ-রাজত্ব রেখে যাচ্ছে যে সেসব রক্ষা করার জন্য বংশধর লাগবে?
মোটকথা সন্তান পায়নি ইন্দুবালা৷ আর সেই না পাওয়ার ফল আজ হাড়ে হাড়ে বুঝছে৷ সুধীর কামার মরার সঙ্গে সঙ্গে৷ ইন্দুবালা ভেবেছিল কেউ জানে না৷ অন্তত যারা জানত তারা মরে-টরে গেছে৷ তাদের বাড়ির উত্তর দিকের বাড়িটাই সিরাজ মোক্তারের৷ সে এলাকার আদি বাসিন্দা নয়৷ ঐ বাড়িটা ছিল টগর সরকারের৷ আয়ুব খানের আমলে একবার ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধল৷ সেই সময় একটু উত্তেজনা ছড়িয়েছিল টাউন জুড়েও৷ শোনা যাচ্ছিল, রেল লাইনের ওপারের শামসু বিহারির নেতৃত্বে হিন্দুদের জবাই করার জন্য ঘোঁট পাকাচ্ছে বিহারিরা৷ তাদের সঙ্গে আমজাদ খাঁর দলের কসাই পট্টির লোকেরা ছিল৷ সেই সনেও দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়া পালাল অনেকে৷ তাদের মধ্যে টগর সরকারও ছিল৷ নামমাত্র দামে সে বাড়ি বিক্রি করেছিল সে সিরাজ মোক্তারের কাছে৷ সিরাজ মোক্তার তখনো বেশিদিন হয়নি আইন ব্যবসা শুরু করেছে৷ গাঁ থেকে বিছানা-বেডিং, বদনা-জায়নামাজ নিয়ে উঠেছিল মজিদ মোক্তারের বৈঠকখানায়৷ সেখান থেকে উপরবাজারের নেয়ামত উল্লার বাড়িতে ভাড়া থাকা৷ তারপরেই সুযোগ বুঝে টগর সরকারের বাড়ি কিনে নেয়া৷ তো সিরাজ মোক্তার তাদের প্রতিবেশী হবার অন্তত তিন বছর আগে ইন্দুবালার এই বাড়িতে আগমন৷
তবুও সিরাজ মোক্তার ব্যাপারটা জানে৷ মনেও রেখেছে৷ ধবধবে সাদা পায়জামার ওপর গলাবন্ধ আচকান, মাথায় লিয়াকত টুপি পরে আদালতে যেতে দেখেছে সিরাজ মোক্তারকে নিয়মিত ইন্দুবালা৷ তার পোশাক, তার চলাফেরা, তার চেহারার মধ্যে একটা সম্ভ্রম জাগানিয়া ভাব৷ সেই সিরাজ মোক্তার একাত্তরের পরে পালিয়ে ছিল অনেক দিন৷ বেশ কিছুদিন পরে ধরা পড়েছিল মুক্তিবাহিনীর হাতে৷ একাত্তরের নয় মাস সে নাকি ছিল শান্তি কমিটির মেম্বার৷ মুক্তিযোদ্ধারা আচ্ছাসে পেঁদিয়ে তাকে ভরে দিয়েছিল হাজতে৷ দালাল আইনে দুই বছর ফাটক খাটার পরে শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমার সুযোগে ছাড়া পেয়ে যায় সে৷ করিত্কর্মা মানুষ৷ কিছুদিনের মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছিল নিজের সেরেস্তা ব্যবসা, ঘরবাড়ি৷ তা শান্তিকমিটি হোক আর যাই-ই হোক, ইন্দুবালা আর সুধীর কামার যথেষ্ট ভক্তিশ্রদ্ধা করত তাকে৷ ঘরের লাগোয়া একটা লেখাপড়া জাননেওলা লোক থাকতে সময়ে-অসময়ে বুদ্ধি পরামর্শ অন্তত চাওয়া যায়৷ কিন্তু সুধীর কামার মরার পরে সেই লোকই ইন্দুবালার কাছে এল প্রথম ভক্ষক হয়ে৷
দ্যাখো ইন্দুবালা, আইনত-ধর্মত তুমি সুধীরে কামারের বউ নও, কেউ নও৷ তার বিষয় সম্পত্তির ওপর তোমার কোনো হক নেই৷ তবু আমি তোমাকে কিছু টাকা দিচ্ছি৷ ভিটেটার দখল আমাকে দিয়ে দাও৷
ইন্দুবালা হতভম্ব! আমি তো বাড়ি বেচতে চাইনি৷
আহা বিক্রির কথা আসে কোত্থেকে!
সিরাজ মোক্তারের বিরক্তি আর চাপা থাকে না-বিক্রি কিসের অঁ্যা? তোমার কি কেন হক আছে সুধীর কামারের বাড়িঘরের ওপর? তুমি কি সুধীর কামারের বউ?
এবার ভেঙে পড়ে ইন্দুবালা_ভিটেছাড়া করলে আমি কুন ঠাঁয়ে যাই!
দ্যাখো দেখি, সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে! আরে সময় থাকতে থাকতে টাকা কয়টা নিয়ে কেটে পড়ো৷ নাহলে এইটাও পাবা না শেষে৷ এই জমি এখন হয়ে যাবে ভেস্টেড ল্যান্ড, মানে শত্রু সম্পত্তি আর কি!
ঐ শালা বুড়া মুক্তার বলল আর শত্রু সম্পত্তি হয়ে গেল! আশ্বাস দেয় সুশান্ত উকিল৷ সে আবার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের লোকাল নেতা৷ সে ইন্দুবালাকে সাহস যোগায়_ঐ শালা ব্রিটিশ আমলের মূর্খ মুক্তার, জানেই না যে দেশে এখন শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল৷ ওর বাপেরও ক্ষমতা নেই তোমার ভিটাত হাত লাগায়৷ তুমি নিশ্চিন্তে থাকো৷
কিন্তু নিশ্চিন্তে থাকো বললেই কী আর থাকা যায়! নিশুত রাতে ইন্দুবালার টিনের ওপর ভুতুড়ে ঢিল পড়া শুরু হয়৷ এক রাত দুই রাতও নয়৷ রোজ রাতে! ইন্দুবালা তক্তপোশে জুবুথুবু বসে 'ভগবান ভগবান' জপ করে, কিন্তু ভগবানের নামে ভূত ভাগে না৷
চালা ছেড়ে ভূত এবার ঘরে ঢোকে৷ যে কয়টা কাগজের নোট আর মামুলি সোনা-চাঁদির গয়না রেখে গিয়েছিল সুধীর কামার, সেগুলো উধাও হলো এক রাতে৷ তক্তপোশের নিচে টিনের বাক্সে জিনিসগুলি রেখেছিল ইন্দুবালা৷ বাক্সসহ সব লোপাট৷
কে এসব করাচ্ছে তা জানে ইন্দুবালা৷ কিন্তু জেনে-বুঝেও কোনো উপায় নেই৷ শরণ বলতে আছে ঐ সুশান্ত উকিল৷ সে বোলচাল ঝাড়ে_দাঁড়াও না৷ এইসব করে পার পাবে না কেউ৷ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সেন্ট্রাল কমিটিকে আমি সব জানাচ্ছি৷ তারা বিবৃতি দিলে পেপার-পত্রিকা সয়লাব হয়ে যাবে৷ তখন আর কেউ তোমার চুলের ডগাও ছুঁতে পারবে না৷
৩
কিন্তু সিরাজ মোক্তার অনেক বেশি ঘাগু৷ ডিসি, এডিসি, রেভিনিউ, এসি-ল্যান্ড বরাবর দরখাস্ত পড়ল৷ এতিমখানার জন্য অর্পিত সম্পত্তি লিজ চেয়ে দরখাস্ত৷
এতিমখানা মানে অনেক সওয়াবের কাজ৷ জনস্বার্থে অর্পিত সম্পত্তি লিজ প্রদানের বিধান সর্বশেষ আইনেও আছে৷ আর এতিমখানার চেয়ে বড় জনস্বার্থ আর কী আছে! হাদিসে আছে, এতিমের মাথায় একবার দরদের সাথে হাত বুলালে হাজার রাত এবাদতের নেকি পাওয়া যায়৷
সেই এতিমখানা কোথায় হবে? সুধীর কামারের পরিত্যক্ত বাড়িতে! দাগ নং ৭৩১, খতিয়ান নং ১২০, মৌজা নিচাবাজার, জমির পরিমাণ সাড়ে ছয় শতক, সীমানার পূর্বে পৌরসভার পাকা সড়ক, পশ্চিমে ভেদর খাল, উত্তরে জনাব মোঃ সিরাজউদ্দিনের বাড়ি, দক্ষিণে মেছো বাজারের শুরুর দেয়াল৷
সিরাজ মোক্তার সবজান্তা হাসে৷ অর্পিত সম্পত্তি নয়, কিন্তু করলেই হয়ে যায়৷ কেননা সুধীর কামারের মৃতু্যর পরে তার কোনো বৈধ ওয়ারিশ এদেশে নেই৷
তহসিলদারও স্থানীয় মানুষ৷ অবাক হয়ে বলে_ক্যান, তার বউ?
আরে ঐটা তার বউ না, রক্ষিতা৷ বান্ধা মেয়েমানুষ৷ তার কোনো আইনগত অধিকার নেই ঐ জমির ওপর৷
তহসিলদার এবার বোঝে৷ এসি ল্যান্ডও৷ বোঝা আরো সহজ হয় যখন সিরাজ মোক্তার পরিমাণ মতো পাত্তি গুঁজে দেয় দু'জনের হাতে৷ এইবার!
এইবার তোমার আর উপায় নাই ইন্দুবালা! আমার পরামর্শ মানো! এই টাকাগুলো নিয়ে দখল ছাড়ো৷ অন্য কোথাও যাও!
কই যাব! অসহায় ইন্দুবালা প্রশ্ন করে না স্বগতোক্তি করে বোঝা যায় না৷
আরে কোথায় যাবে সেটাও আমি বলে দেব নাকি! দ্যাখোতো কাণ্ড! কেউ নাই তোমার বাপের কুলে মায়ের কুলে? তাদের কাছে যাও৷
না কেউ নাই৷ থাকলেও এই দুই কুড়ি বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নেই৷ তাদের কাউকে ইন্দুবালা চেনে না৷ ইন্দুবালাকে চেনে না কেউ৷
তাহলে আর কী! ইন্ডিয়াতেই যাও৷ তোমার জাতের ঠিকানা তো ইন্ডিয়াই৷
ফোঁস করে ওঠে ইন্দুবালা_না! ইন্ডিয়াও আমি যাব না৷ দাঙ্গার মধ্যে যাইনি, দুই দুইবার যুদ্ধ হইছে, যাইনি, তাঁইন মরার আগে অনেকবার কইছে, যাইনি! ইন্ডিয়াত আমি যাব না! কিছুতেই না!
অবাক হয় সিরাজ মোক্তার! ইন্ডিয়ার কথায় তো হিন্দুদের মন নেচে ওঠে৷ এ যে দেখি উল্টা!
এই সময় ভোট আসে৷ ভোটে সাজসাজ রব৷
আপাতত চাপা পড়ে ব্যাপারটা৷ চেপে যায় সিরাজ মোক্তার৷ ভোটে কী হয় বলা যায় না৷ আওয়ামী লীগ আরেকবার পাওয়ারে এলে বোধহয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যাকিংয়ে ইন্দুবালা টিকেই যাবে সুধীর কামারের ভিটায়৷ সিরাজ মোক্তার তাতেও অবশ্য হাল ছাড়বে না৷ নিজে একাত্তরে যাই করুক, নিজের মতাদর্শ যাই হোক, মেজো ছেলেটাকে কায়দা করে ঢুকিয়ে দিয়েছে যুবলীগে৷ সে এখন মাঝারি গোছের ক্যাডার৷ বোমা-ককটেল-পিস্তল নাড়া-চাড়া করতেও দেখেছে তাকে৷ খুশী হয়েছে৷ ছেলেটা অসময়ে কাজে দেবে৷ অন্য দুই ছেলে তো বিএনপিতে আছেই৷ আওয়ামী লীগ হারল৷
এবার সিরাজ মোক্তারকে পায় কে! ইন্দুবালা এবার ভাগো!
ইন্দুবালা আছড়ে পড়ে সুশান্ত উকিলের দরজায়৷ কিন্তু সুশান্ত নিজেই এখন ভয়ে কাঁপছে৷ পারে তো দুয়ারে খিল তুলে বসে থাকে৷ কে বাঁচে কে বাঁচায়!
ইন্দুদিদি তুমি বরং ইন্ডিয়াতেই যাও! নিচাবাজারের নিতাই সাহারা এখন মালদহে থাকে৷ তুমি ওদের কাছে উঠতে পারবে৷ আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি৷
না, আমি ইন্ডিয়া যাব না!
কেন?
ইন্দুবালা কেন ইন্ডিয়া যাবে না তা ওরা কেউ বুঝবে না৷ ইন্ডিয়ায় বৈকুণ্ঠ থাকে৷ পাইন্যা বৈকুণ্ঠ৷ যে তিন তাসের বাজিতে নিজের বউকে বাজি রেখেছিল৷ যে জুয়ায় হেরে নিজের বউকে তুলে দিয়েছিল অন্যের হাতে৷ ইন্ডিয়াতে গেলে যদি তার সাথে দেখা হয়ে যায়! তার সাথে দেখা হওয়ার চেয়ে নরকে যাওয়া ভালো৷ না, ইন্দুবালা নরকে যাবে কেন? ভগবানের কি বিচার নেই? নরকে যাবে ঐ হারামির বাচ্চা, না-মরদ বৈকুণ্ঠ৷
ইন্দুবালার ছানিপড়া চোখে আগুন জ্বলে৷ মরি কী বাঁচি, ইন্ডিয়া যাব না৷ রাত যত বাড়ে, ভয় ততো বাড়ে৷ বাড়তে বাড়তে ইন্দুবালা এক সময়ে আর নিজের মধ্যে থাকতে পারে না৷ তার মধ্যে ঢুকে পড়ে সুরবালা৷ ইন্দুবালা তাকে তাড়াতে চায়৷ সে বারবার উঁকি দেয়৷
অ_তে অজগর ঐ আসছে তেড়ে৷
ঝ_তে ঝড় উঠেছে ঈষাণ কোণে৷
দ_তে দৈত্যরা সব আসছে ছুটে
ভ_তে ভূতের নাচন চারদিকেতে৷
হ_তে হায়নারা আজ খুবলে খাবে রক্ত-মাংস৷
স_তে সর্প আসে বিষ-ছোবলের হুমকি নিয়ে৷
অনিবার্য অস্তিত্বহীনতার হুমকি নিয়ে কেরোসিনের ডিবে জ্বালিয়ে হাতের বাঁকা লাঠিটা চেপে ধরে ইন্দুবালা বসে থাকে একরোখা অশ্বের মতো৷ দমকা বাতাসে কেরোসিনের ডিবেও নিভে যায়৷ তবু ইন্দুবালা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে_ইন্ডিয়া যাব না! আমি ইন্ডিয়া যাব না!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




