somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিরামাস্ ও থিসবিঃ গ্রীক পুরাণকথার এক করুণ প্রেম কাহিনী

০৩ রা মার্চ, ২০১২ রাত ১০:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এমন এক সময়ের কথা, যখন মাল্বেরি গাছের গভীর লালবর্ণ ফলগুলো ছিল বরফের মতো সাদা। রঙের এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে অদ্ভুত এবং করুণ এক কাহিনী। এক তরুণ প্রেমিকযুগলের মৃত্যু হলো এর কারন।

পিরামাস ও থিসবি বাস করত রানী সামিরামিস্-এর রাজধানী ব্যাবিলনে। পিরামাস ছিল প্রাচ্যের সবচেয়ে সুদর্শন তরুণ; থিসবি সবচেয়ে সুন্দরী তরুনী। তারা থাকতও পাশাপাশি দুটো বাড়িতে__ মাঝখানে শুধু একটি দেয়াল। পাশাপাশি বাড়িতে বড় হওয়ার কারণে দু’জন ভালোবেসে ফেলে দু’জনকে। তারা বিয়ে করতে চায়, কিন্তু দুপক্ষের অভিভাবকরা রাজি হয় না। কিন্তু প্রেমকে তো নিষিদ্ধ করা যায় না। প্রেমের অগ্নিশিখা জতই ঢেকে রাখা যাক, ততই উষ্ঞ হতে থাকে তার উত্তাপ। আর প্রেমও কোনো-না-কোনো ভাবে নিজের পথ ঠিকই বের করে নেয়। তাই পিরামাস ও থিসবির হৃদয়ের জ্বলন্ত ভালোবাসাকেও চেপে রাখা গেল না।

তাদের দুজনের বাড়ির মাঝখানের দেয়ালে ছিল একটি ফুটো। সেটি কারো নজরে পড়েনি, কিন্তু প্রেমিক প্রেমিকার চোখ কিছু এড়ায় না। পিরামাস আর থিসবি সেই ফুটো দিয়ে ফিসফিস করে নিজেদের কথাবার্তা বলে। যে দেয়াল বানানো হয়েছে তাদের পৃথক করবার জন্যে, সেই দেয়ালই হয়ে দাঁড়ায় পরস্পরকে পাওয়ার যোগসূত্র। তারা দেয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তুমি না থাকলে আমরা পরস্পরকে স্পর্শ করতে পারতাম, চুমু খেতে পারতাম। তবে তুমি আমাদের কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছ। আমরা অকৃতজ্ঞ নই”। এভাবে তারা কথা বলতো, রাত্রি নামা পর্জন্ত। সন্ধ্যা হলে তারা দেয়ালের দুধারে চুম্বন করে দুদিকে বিদায় নিত।

প্রতিদিন সকালে যখন পুর্ব আকাশে রঙিন হয়ে উঠত, গাঢ় সূর্জের আলোকে ঘাসের উপরকার শিশিরবিন্দুগুলো শুকিয়ে উঠত, তখন তারা চুপিচুপি এসে ফাটলের পাশে দাঁড়াত। তারপর ফিসফিস করে উত্তপ্ত প্রেমের সংলাপ বিনিময় করত অথবা নিজেদের দুর্ভাগ্য নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করত। অবশেষে একদিন তারা আর সহ্য করতে পারল না। তারা স্থির করল সেই রাত্রেই তারা নগরী থেকে গোপনে পালিয়ে যাবে। খোলা প্রান্তরে অন্তত স্বাধীনভাবে মেলামেশার কোন বাধা থাকবে না। তারা ঠিক করল নাইনাসের সমাধি মন্দিরের পাশে দুজনের দেখা হবে। সেই স্থানে নম্বা একটি মালবেরি গাছ, তাতে বরফের মত সাদা ফল, কাছেই একটি শীতল জলের ঝর্না। পরিকল্পনাটি ভালোই লাগল তাদের। দিন শেষ হয়ে কখন রাত্রি নামবে, সেই আশায় রইল তারা।

অবশেষে সূর্জ অস্ত গেল, রাত্রির অন্ধকার ঢেকে নিল চারপাশ। থিসবি ঘর থেকে বেরিয়ে সমাধিস্থলে গিয়ে পৌছাল। পিরামাস তখনও পৌছায়নি। থিসবি অপেক্ষা করতে থাকল। হঠাৎ চাঁদের আলতে সে দেখতে পেল একটি সিংহ। হিংস্র প্রাণিটি একটি শিকার করেছে; তার চোয়াল রক্তমাখা। পিপাসা নিবৃত্তির জন্য সে আসছিল ঝর্নার দিকে। সিংহটি তখনও কিছুটা দূরে। থিসবি পালাতে গেল। তার লম্বা ওড়না পড়ে রইল পেছনে। ঝর্না থেকে ফেরার পথে সিংহ ওড়নাটি দেখে মুখে তুলে নিল এবং ছিঁড়ে ফেড়ে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের মধ্যে। কিছুক্ষণ পর পিরামাস এসে দেখে থিসবির রক্তমাখা উত্তরীয় পড়ে আছে; পাশেই মাটিতে সিংহের পায়ের ছাপ। পিরামাস ধরে নিল, থিসবিকে সিংহ খেয়ে ফেলেছে। এই বিপজ্জনক স্থানে সে-ই থিসবিকে আসতে বলেছিল, তার সুন্দরী প্রিয়তমার মৃত্যুর জন্য সে ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়, এই ভেবে দারুন মর্মপীড়া হতে লাগল তার। “আমিই তোমাকে খুন করেছি”- এরকম বিলাপ করতে করতে থিসবির রক্তাক্ত ওড়নাটি ধুলো থেকে তুলে নিল সে। বারবার চুম্বন করতে করতে সে ওড়নাটি নিয়ে গেল মালবেরি গাছের কাছে। তরবারি বের করে সোজা বসিয়ে দিল নিজের বুকে। তার রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসে পড়ল সাদা মালবেরি ফলের উপর। রক্তবর্ন হয়ে উঠল ফলগুলো।

এদিকে থিসবি সিংহের ভয়ে পালিয়ে গেলেও বেশিক্ষন দূরে থাকতে পারল না। সে ভাবল, পিরামাস নিশ্চয়ই এসে ফিরে যাবে। সাহস সঞ্চয় করে সে ফিরে এল মালবেরি গাছের কাছে। কিন্তু সাদা ফলওয়ালা সেই মালবেরি গাছটা তো কোথাও নেই! একটা গাছ আছে বটে সেখানে, তবে তার শাখায় তো একটি সাদা ফলের চিহ্নও নেই! থিসবি যখন একদৃস্টিতে গাছের দিকে তাকিয়ে, তখন হঠাৎ করে তার পায়ের নিচের মাটিতে কি যেন নড়ে উঠল। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল থিসবি। কিন্তু একটু পরেই অন্ধকারের মধ্যেও সে পরিস্কার দেখতে পেল পিরামাস শুয়ে আছে। মুমুর্ষু, সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। থিসবি ঝাপিয়ে পড়ল তার উপর, আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো তাকে, ঠাণ্ডা ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল এবং বলতে লাগল, “এই দেখ আমি এসেছি। আমি থিসবি, তোমার প্রিয়তমা”। থিসবির নাম শুনে মুহুর্তের জন্য ভারী চোখ খুলল পিরামাস। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

থিসবি দেখল, পিরামাসের হাত থেকে গড়িয়ে পড়ল তার তরবারি। তারপাশেই তার রক্তমাখা ছেঁড়া ওড়না। সব বুঝতে পারল সে। “তুমি নিজেকে নিজে হত্যা করেছ”, থিসবি বলল। “আমিও তোমার মত সাহসী হব। আমি দেখাব, ভালোবাসতে পারি। মৃত্যুই আমাদেরকে বিছিন্ন করতে পারত। কিন্তু এখন মৃত্যুর সে ক্ষমতা নেই”। পিরামাসের রক্তমাখানো তরবারি নিজের হৃদপিণ্ডে আমুল বসিয়ে দিল থিসবি।

অবশেষে দেবতারা সদয় হলেন। প্রেমিকযুগলের পিতামাতারাও। মালবেরি গাছের গভীর রক্তবর্ন ফলগুলো এই প্রকৃ্ত প্রেমিকযুগলের চিরন্তন স্মারক হয়ে রইল। আর তাদের চিতাভস্ম ঠাই পেল একই ভস্মাধারে। মৃত্যুও তাদেরকে বিছিন্ন করতে পারলনা।


এডিথ হ্যামিল্টনের কালজয়ী গ্রন্থ ‘মিথলজি’র ছায়ানুসরণে…………..
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×