somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নক্সী-কাঁথার মাঠ - পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীন (৩)

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ ভোর ৪:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব

নয়
***

মৎস্য চেনে গহীন গম্ভ পঙ্খী চেনে ডাল;
মায় সে জানে বিটার দরদ যার কলিজার শ্যাল!
নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ;
জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।
-গাজীর গান

আষাঢ় মাসে রুপার মায়ে মরল বিকার জ্বরে,
রুপা সাজু খায়নি খানা সাত আটদিন ধরে।
লালন পালন যে করিত 'ঠোঁটের' আধার দিয়া,
সেই মা আজি মরে রুপার ভাঙল সুখের হিয়া।
ঘাম্‌লে পরে যে তাহারে করত আবের পাখা;
সেই শ্বাশুড়ী মরে, সাজুর সব হইল ফাঁকা।
সাজু রুপা দুই জনেতে কান্দে গলাগলি;
গাছের পাতা যায় যে ঝরে, ফুলের ভাঙে কলি।
এত দুখের দিনও তাদের আস্তে হল গত,
আবার তারা সুখেরি ঘর বাঁধ্‌ল মনের মত।

দশ
***

বড় ঘর বান্দাছাও মোনাভাই বড় করছাও আশা
রজনী প্রভাতের কালে পঙ্খী ছাড়বে বাসা।
- মুর্শীদা গান

নতুন চাষা ও নতুন চাষাণী পাতিল নতুন ঘর,
বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর।
মাঠের কাজেতে ব্যস্ত রুপাই, নয়া বউ গেহ কাজে,
দুইখান হতে দুটি সুর যেন এ উহারে ডেকে বাজে।
ঘর চেয়ে থাকে কেন মাঠ পানে, মাঠ কেন ঘর পানে,
দুইখানে রহি দুইজন আজি বুঝিছে ইহার মানে।

আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হল্‌দি-কোটার গান।
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,
কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।
আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,
মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে।

আজকে রুপার বড় কাজ-কাজ-কোন অবসর নাই,
মাঠে যেই ধান ধরেনাক আজি ঘরে দেবে তারে ঠাঁই।
সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি,
সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি।

আজকে রুপার মনে পড়েনাক শাপলার লতা দিয়ে,
নয়া গৃহিণীর খোঁপা বেঁধে দিত চুলগুলি তার নিয়ে।
সিঁদুর নইয়া মান হয়নাক বাজে না বাঁশের বাঁশী,
শুধু কাজ-কাজ, কি যাদু-মন্ত্র ধানেরা পড়িছে আসি।
সারাটি বরষা কে কবি বসিয়া বেঁধেছে ধানের গান,
কত সুদীর্ঘ দিবস রজনী করিয়া সে অবসান।
আজিকে তাহার মাঠের কাব্য হইয়াছে বুঝি সারা,
ছুটে গেয়োঁ পাখি ফিঙে বুলবুল তারি গানে হয়ে হারা।
কৃষাণীর গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো;
এত কাজ তবু হাসি ধরেনাক, মুখে ফুল ফুটো ফুটো!
আজকে তাহার পাড়া-বেড়ানর অবসর মোটে নাই,
পার খাড়ু গাছি কোথা পড়ে আছে, কেবা খোঁজ রাখে ছাই!

অর্ধেক রাত উঠানেতে হয় ধানের মলন মলা,
বনের পশুরা মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা।
দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায়, কৃষাণীর কাজ ভারি,
ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি।
কোন দিন চাষী শুইয়া শুইয়া গাহে বিরহের গান,
কৃষাণের নারী ঘুমাইয়া পড়ে, ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান।
হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোৎস্নার জাল পাতি,
টেনে টেনে তারে হয়রান হয়ে ডুবে যায় রাতারাতি।

এমনি করিয়া ধানের কাব্য হইয়া আসিল সারা,
গানের কাব্য আরম্ভ হল সারাটা কৃষাণ পাড়া!
রাতেরে উহারা মানিবে না যেন, নতুন গলার গানে,
বাঁশী বাজাইয়া আজকে রাতের করিবে নতুন মানে।

আজিকে রুপার কোন কাজ নাই, ঘুম হতে যেন জাগি,
শিউরে দেখিছে রাজার কুমারী তাহারই ব্যথার ভাগী।
সাজুও দেখিছে কোথাকার যেন রাজার কুমার আজি,
ঘুম হতে তার সবে জাগায়েছে অরুণ-আলোয় সাজি।
নতুন করিয়া আজিকে উহারা চাহিছে এ ওর পানে,
দীর্ঘ কাজের অবসর যেন কহিছে নতুন মানে!
নতুন চাষার নতুন চাষাণী নতুন বেঁধেছে ঘর,
সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়বড়!
বাঁশের বাঁশীতে ঘুণ ধরেছিল, এত দিন পরে আজ,
তেলে জলে আর আদরে তাহার হইল নতুন সাজ।
সন্ধ্যার পরে দাবায় বসিয়া রুপাই বাজায় বাঁশী,
মহাশূন্যের পথে সে ভাষায় শূণ্যের সুররাশি।



ক্রমে রাত বাড়ে, বউ বসে দূরে, দুটি চোখ ঘুমে ভার,
"পায়ে পড়ি ওগো চলো শুতে যাই, ভাল লাগেনাক আর।"
রুপা ত সে কথা শোনেইনি যেন, বাঁশী বাজে সুরে সুরে,
'ঘরে দেখে যারে সেই যেন আজি ফেরে ওই দূরে দূরে।'
বউ রাগ করে, "দেখ, বলে রাখি, ভাল হবেনাক পরে,
কালকের মত করি যদি তবে দেখিও মজাটি করে।
ওমনি করিয়া সারারাত আজি বাজাইবে যদি বাঁশী,
সিঁদুর আজিকে পরিব না ভালে, কাজল হইবে বাসি।
দেখ, কথা শোন, নইলে এখনি খুলিব কানের দুল,
আজকে ত আমি খোঁপা বাঁধিব না, আলগা রহিবে চুল।"

বেচারী রুপাই বাঁশী বাজাইতে এমনি অত্যাচার,
কৃষাণের ছেলে! অত কিবা বোঝে, তখনই মানিল হার।
কহে জোড় করে, "শোন গো হুজুর, অধম বাঁশীর প্রতি,
মৌন থাকার কঠোর দণ্ড অন্যায় এ যে অতি।
আজকে ও-ভালে সিঁদুর দিবে না, খুলিবে কানের দুল,
সন্ধ্যা হবে না সিঁদুরে রঙের - ভোরে হাসিবে না ফুল
এত বড় কথা! আচ্ছা দেখাই, ওরে ও অধম বাঁশী,
এই তরুণীর অধরের গানে তোমার হইবে ফাঁসী।"

হাতে লয়ে বাঁশী বাজাইল রুপা মাঠের চিকন সুরে,
কভু দোলাইয়া বউটির ঠোঁটে কভু তারে ঘুরে ঘুরে।
বউটি যেন গো হেসে হয়রান, কহে ঠোঁটে ঠোঁট চাপি,
"বাশীঁর দণ্ড হইল, কিন্তু যে বাজাল সেই পাপী?"
পুনঃ জোর করে রুপা কহে, "এই অধমের অপরাধ,
ভয়ানক যদি, দণ্ড তাহার কিছু কম নিতে সাধ!"
রুপার বলার এমনি ভঙ্গী বউ হেসে কুটি কুটি,
কখনও পড়িছে মাটিতে ঢালিয়া, কভু গায়ে পড়ে লুটি।
পরে কহে, "দেখো আরও কাছে এসো, বাশীঁটি লও ত হাতে
এমনি করিয়া দোলাও ত দেখি নোলক দোলার সাথে!"

বাঁশী বাজে আর নোলক যে দোলে, বউ কহে আর বার,
"আচ্ছা আমার বাহুটি নাকিগো সোনালী-লতার হার?
এই ঘুরালেম, বাজাও ত দেখি এরি মত কোন সুর,"
তেমনি বাহুর পরশের মত বাজে বাশীঁ সুমধুর!
দুটি করে রাঙা ঠোঁটখানি টেনে কহে বউ, "এরি মত,
তোমার বাশীঁতে সুর যদি থাকে বাজাইলে বেশ হত।"
চলে মেঠো বাশীঁ দুটি ঠোঁট ছুঁয়ে কলমী ফুলের বুকে,
ছোট চুমু রাখি চলে যেন বাশীঁ, চলে সে যে কোন লোকে।
এমনি করিয়া রাত কেটে যায়; হাসে রবি ধীরি ধীরি,
বেড়ার ফাঁকেতে উঁকি মেরে দেখি দুটি খেয়ালীর ছিরি।

সেদিন রাত্রে বাশীঁ শুনে শুনে বউটি ঘুমায়ে পড়ে,
তারি রাঙা মুখে বাশীঁ-সুরে রুপা বাঁকা-চাঁদ এনে ধরে।
তারপরে, খুলে চুলের বেণীটি বার বার করে দেখে,
বাহুখানি দেখে নাড়িয়া নাড়িয়া বুকের কাছেতে রেখে।
কুসুম-ফুলেতে রাঙা পাও দুটি দেখে আরো রাঙা করি,
মৃদু তালে তালে নিঃশ্বাস লয়, শুনে মুখে মুখ ধরি।
ভাবে রুপা, ও-যে দেহ ভরি যেন এনেছে ভোরের ফুল,
রোদ উঠিলেই শুকাইয়া যাবে, শুধু নিমিষের ভুল!
হায় রুপা, তুই চোখের কাজলে আঁকিলি মোহন ছবি,
এতটুকু ব্যথা না লাগিতে যেয়ে ধুয়ে যাবে তোর সবি!
ওই বাহু আর ওই তনু-লতা ভাসিছে সোঁতের ফুল,
সোঁতে সোঁতে ও যে ভাসিয়া যাইবে ভাঙিয়া রুপার কূল!
বাশীঁ লয়ে রুপা বাজাতে বসিল বড় ব্যথা তার মনে,
উদাসীয়া সুর মাথা কুটে মরে তাহার ব্যথার সনে।

ধারায় ধারায় জল ছুটে যায় রুপার দুচোখ বেয়ে,
বউটি তখন জাগিয়া উঠিল তাহার পরশ পেয়ে।
"ওমা ওকি? তুমি এখনো শোওনি! খোলা কেন মোর চুল?
একি! দুই পায়ে কে দেছে ঘষিয়া রঙিন কুসুম ফুল?
ওকি! ওকি!! তুমি কাঁদছিলে বুঝি! কেন কাঁদছিলে বল?"
বলিতে বলিতে বউটির চোখ জলে করে ছল ছল!
বাহুখানা তার কাঁধ পরে রাখি রুপা কয় মৃদু সুরে,
"শোন শোন সই, কে যেন তোমায় নিয়ে যেতে চায় দূরে!

"সে দূর কোথায়?" "অনেক-অনেক-দেশ যেতে হয় ছেড়ে,
সেথা কেউ নাই শুধু তুমি আর সেই সে অচেনা ফেরে।
তুমি ঘুমাইলে সে এসে আমায় কয়ে যায় কানে কানে,
যাই-যাই-ওরে নিয়ে যাই আমি আমার দেশের পানে।
বল, তুমি সেথা কখন যাবে না, সত্য করিয়া বল!"
"নয়! নয়! নয়!" বউ কহে তার চোখ দুটি ছলছল।

রুপা কয় "শোন সোনার বরণি, আমার এ কুঁড়ে ঘর,
তোমার রুপের উপহাস শুধু করে সারাদিন ভর।
তুমি ফুল! তবে ফুলেতে গায়েতে বহে বিহানের বায়ু,
আমি কাঁদি সই রোদ উঠিলে যে ফুরাবে রঙের আয়ু।
আহা আহা সখি, তুমি যাহা কর, মোর মনে লয় তাই,
তোমার ফুলের পরাণে কেবল দিয়ে যায় বেদনাই।"
এমন সময় বাহির হইতে বছির মামুর ডাকে,
ধড়মড় করি উঠিয়া রুপাই চাহিল বেড়ার ফাঁকে।

এগারো
*******

সাজ সাজ বলিয়ারে শহরে পৈল সাড়া
সাত হাজার বাজে ঢোল চৌদ্দ হাজার কাড়া।
প্রথমে সাজিল মর্দ আহ্লাদি ডগরী,
পাঁচ কাঠা ভূঁই জুইড়া বসে মর্দ এয়সা ভারি।
তারপরে, সাজিল ,মর্দ তুরুক আমানি,
সমুদ্দুরে নামলে তার হৈত আটুঁপানি।
তারপরে সাজিল মর্দ নামে লোহাজুড়ী
আছড়াইয়া মারত সে হাতীর শুঁড় ধরি।
তারপরে সাজিল মর্দ নামে আইন্দ্যা ছাইন্দ্যা,
বাইশ মণ তামাক নেয় তার লেংটির মধ্যে বাইন্ধ্যা।
তারপরে সাজিল মর্দ নামে মদন ঢুলি,
বাইশ মণ পিতল তার ঢোলের চারটা খুলী।
আতালী পাতালী সাজে গগনেরী ঠাটা,
মেঘনাল সাজিয়া আইল তাম তুরুকের বেটা।
তুগুলি মুগুলি সাজে তারা দুই ভাই,
ঐরাবতে সাইজা আইল আজদাহা সেপাই।
বন্দুকি বন্দুকি চলে কামানে কামান,
ময়ূর-ময়ুরী চলে ধরিয়া পয়গাম।
- মহরমের জারী

"ও রুপা তুই করিস্‌ কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে?
বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূঁয়ে।"
"কি বলিলা বছির মামু?" উঠল রুপাই হাঁক ছাড়িয়া,
আগুনভরা দুচোখ হতে গোল্লা-বারুদ যায় উড়িয়া।

পাটার মত বুকখানিতে থাপড় মারে শাবল হাতে,
বুকের হাড়ে লাগল বাড়ি, আগুন বুঝি জ্বলবে তাতে!
লম্ফে রুপা আনলো পেড়ে চাং হতে তার সড়কি খানা,
ঢাল ঝুলায়ে মাজার সাথে থালে থালে মারল হানা।
কোথায় রল রহম চাচা, কলম শেখ আর ছমির মিঞা,
সাউদ পাড়ার খাঁরা কোথায়? কাজীর পোরে আন ডাকিয়া?
বন-গোঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরে গফর-গাঁয়ে,
এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান্‌ গোরের ছায়ে?
'আলী-আলী' হাঁকল রুপাই, হুঙ্কারে তার গগন ফাটে,
হুঙ্কারে তার গর্জে বছির আগুন যেন ধরল কাঠে।
ঘুম হতে সব গাঁয়ের লোকে শুনল যেন রুপার বাড়ি;
আকাশ হতে ভাঙছে ঠাটা, মেঘে মেঘে লাগছে বাড়ি।
ডাক শুনে তার আস্‌ল ছুটে রহম চাচা, ছমির মিঞা,
আস্‌ল হেঁকে কাজেম খুনী নখে নখে আচঁড় দিয়া।
আস্‌ল হেঁকে গাঁয়ের মোড়ল মালকোছাতে কাপড় পরি,
এক নিমিষে গাঁয়ের লোকে রুপার বাড়ি ফেলল ভরি।
লম্ফে দাঁড়ায় ছমির লেঠেল, মমিনপুরের চর দখলে,
এক লাঠিতে একশ লোকের মাথা যে জন আস্‌ল দলে।
দাঁড়ায় গাঁয়ের ছমির বুড়ো, বয়স তাহার যদিও আশী,
গায়ে তাহার আজও আছে একশ লড়ার দাগের রাশি।

গর্জি উঠে গদাই ভুঁঞা, মোহন ভূঁঞার ভাজন* বেটা,
যার লাঠিতে মামুদপুরের নীল কুঠিতে লাগল লেঠা।
সব গাঁর লোক এক হল আজ রুপার ছোট উঠান পরে,
নাগ-নাগিনী আসল যেন সাপ খেলানো বাঁশীর স্বরে।

*ভাজন - ঔরসজাত।

রুপা তখন বেড়িয়ে তাদের বলল, "শোন ভাই সকলে,
গাজনা চরের ধানের জমি আর আমাদের নাই দখলে।"
বছির মামু বলছে খবর - মোল্লারা সব কালকে নাকি;
আধেক জমির ধান কেটেছে, আধেক আজও রইছে বাকি।
"মোদের খেতে ধান কেটেছে, কালকে যারা কাঁচির খোঁচায়;
আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায়।"
থামল রুপাই - ঠাটা যেমন মেঘের বুকে বাণ হানিয়া,
নাগ-নাগিনীর ফণায় যেমন তুবড়ী বাঁশীর সুর হাঁকিয়া।
গর্জে উঠে গাঁয়ের লোকে, লাটিম হেন ঘোড়ার লাঠি,
রোহিত মাছের মতন চলে, লাফিয়ে ফাটায় পায়ের মাটি।

রুপাই তাদের বেড়িয়ে বলে, "থাল বাজারে থাল বাজারে,
থাল বাজারে সড়কি ঘুরা হান্‌রে লাঠি এক হাজারে।
হান্‌রে লাঠি-হান্‌রে কুঠার, গাছের ছ্যান* আর রাম-দা-ঘুরা,
হাতের মাথায় যা পাস যেথায় তাই লয়ে আজ আয়রে তোরা।"
"আলী! আলী! আলী!! আলী!!!" রুপার যেন কন্ঠ ফাটি,
ইস্রাফিলের শিঙ্গা বাজে কাঁপ্‌ছে আকাশ কাঁপছে মাটি।
তারি সুরে সব লেঠেলে লাঠির পরে হানল লাঠি,
"আলী-আলী" শব্দে তাদের আকাশ যেন ভাঙবে ফাটি।

*গাছের ছ্যান - খেজুর গাছের ডগা কাটবার অস্ত্র।

আগে আগে ছুটল রুপা - বৌঁ বৌঁ বৌঁ সড়কি ঘোরে,
কাল সাপের ফণার মত বাবরী মাথায় চুল যে ওড়ে
চল্‌ল পাছে হাজার লেঠেল "আলী-আলী" শব্দ করি,
পায়ের ঘায়ে মাঠের ধুলো আকাশ বুঝি ফেলবে ভরি।
চল্‌ল তারা মাঠ পেরিয়ে চল্‌ল তারা বিল ডিঙিয়ে
কখন ছুটে কখন হেঁটে বুকে বুকে তাল ঠুকিয়ে।
চল্‌ল যেমন ঝড়ের দাপে ঘোলাট মেঘের দল ছুটে যায়,
বাও কুড়ানীর মতন তারা উড়িয়ে ধূলি পথ ভরি হায়।

দুপুর বেলা এল রুপাই গাজনা চরের মাঠের পরে,
সঙ্গে এল হাজার লেঠেল সড়কি লাঠি হস্তে ধরে।
লম্ফে রুপা শূন্যে উঠি পড়ল কুঁদে মাটির পরে,
থাক্‌ল খানিক মাঠের মাটি দন্ত দিয়ে কামড়ে ধরে।
মাটির সাথে মুখ লাগায়ে, মাটির সাথে বুক লাগায়ে,
"আলী! আলী!!" শব্দ করি মাটি বুঝি দ্যায় ফাটায়ে।
হাজার লেঠেল হুঙ্কারী কয় "আলী আলী হজরত আলী,"
সুর শুনে তার বন-গেঁয়োদের কর্ণে বুঝি লাগল তালি!
তারাও সবে আসল জুটে দলে দলে ভীম পালোয়ান,
"আলী আলী" শব্দে যেন পড়ল ভেঙে সকল গাঁখান!
সামনে চেয়ে দেখল রুপা সার বেঁধে সব আসছে তারা,
ওপার মাঠের কোল ঘেঁষে কে বাঁকা তীরে দিচ্ছে নাড়া।
রুপার দলে এগোয় যখন, তারা তখন পিছিয়ে চলে,
তারা আবার এগিয়ে এলে এরাও হটে নানান কলে।

এমনি করে সাত আটবারে এগোন পিছন হল যখন,
রুপা বলে, "এমন করে 'কাইজা' করা হয় না কখন।"



তাল ঠুঁকিয়া ছুটল রুপাই, ছুটল পাছে হাজার লাঠি,
"আলী-আলী-হজরত আলী" কন্ঠ তাদের যায় যে ফাটি।
তাল ঠুঁকিয়ে পড়ল তারা বন-গেঁয়োদের দলের মাঝে,
লাঠির আগায় লাগল লাঠি, লাঠির আগায় সড়কি বাজে।
'মার মার মার' হাঁকল রুপা, - 'মার মার মার' ঘুরায় লাঠি,
ঘুরায় যেন তারি সাথে পায়ের তলে মাঠের মাটি।
আজ যেন সে মৃত্যু-জনম ইহার অনেক উপরে উঠে,
জীবনের এক সত্য মহান লাঠির আগায় নিচ্ছে লুটে।
মরণ যেন মুখোমুখি নাচছে তাহার নাচার তালে,
মহাকালের বাজছে বিষাণ আজকে ধরার প্রলয় কালে।
নাচে রুপা-নাচে রুপা-লোহুর গাঙে সিনান করি,
মরণরে সে ফেলছে ছুঁড়ে রক্তমাখা হস্তে ধরি।
নাচে রুপা - নাচে রুপা - মুখে তাহার অট্টহাসি,
বক্ষে তাহার রক্ত নাচে, চক্ষে নাচে অগ্নিরাশি।
-হাড়ে হাড়ে নাচন তাহার, রোমে রোমে লাগছে নাচন
কি যেন সে দেখেছে আজ, রুধ্‌তে নারে তারি মাতন।
বন-গেঁয়োরা পালিয়ে গেল, রুপার লোকও ফিরল বহু,
রুপা তবু নাচছে, গায়ে তাজা-খুনের হাস্‌ছে লোহু।


বার
***

রাইত তুই যারে যা পোহাইয়ে।
বেলা গেল সন্ধ্যা হইল - ও হৈলরে! গৃহে জ্বালাও বাতি,
না জানি অবলার বন্ধু আসবেন কত রাতিরে
রাইত তুই যারে - যা পোহাইয়ে।
রাইত না এ পরের হৈল, ও হৈলরে। তারায় জ্বলে বাতি;
রান্ধিয়া বাড়িয়া অন্ন জাগ্‌বে কত রাতিরে;
রাইত তুই যারে - যা পোহাইয়ে।
রাইত না দুই পরের হৈল ও হৈল রে, ডালে ডাকে শুয়া,
অঞ্চল বিছায়া নারী কাটে চেকন গুয়ারে।
রাইত তুই যারে - যা পোহাইয়ে।
রাইত না পরভাত হৈল - ও হৈলরে, কোকিল করে কুয়া,
খুইলে দাও মন্দিরার কেওয়াড় লাগুক শীতল হাওয়ারে।
রাইত তুই যারে - যা পোহাইয়ে।

- রাখালী গান

রুপাই গিয়াছে 'কাইজা' করিতে সেই ত সকাল বেলা,
বউ সারাদিন পথ পানে চেয়ে, দেখেছে লোকের মেলা।
কত লোক আসে কত লোক যায়, সে কেন আসে না আজ,
তবে কি তাহার নসিব মন্দ, মাথায় ভাঙিবে বাজ!
বালাই, বালাই, ওই যে ওখানে কালো গাঁর পথ দিয়া,
আসিছে লোকটি, ওই কি রুপাই? নেচে ওঠে তার হিয়া।
এলে পরে তারে খুব বকে দিবে, মাথায় ছোঁয়ায়ে হাত,
কিরা করাইবে লড়ায়ের নামে হবে না সে আর মাত্‌।

আঁচলে চোখের বারবার মাজে, না রে সে ত ও নয়,
আজকে তাহার কপালে কি আছে, কে তাহা ভাঙিয়া কয়।
লোহুর সাগরে সাঁতার কাটিয়া দিবস শেষের বেলা,
রাত্র-রাণীর কালো আঁচলেতে মুছিল দিনের খেলা।
পথে যে আঁধার পড়িল সাজুর মনে তার শতগুণ,
রাত এসে তার ব্যথার ঘায়েতে ছিটাইল যেন নুন!

ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা,
সেলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা।
পাথায় পাথায়, খস্‌ খস্‌ খস্‌ শুনে কান খাড়া করে,
যারে চায় সে ত আসেনাক শুধু ভুল করে করে মরে।
তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে, ভাল লাগেনাক তার;
আলো হাতে লয়ে দূর পানে চায়, বার বার খুলে দ্বার।
কেন আসে নারে! সাজু যদি গো পাখা দিত আজ বিধি,
উড়িয়া যাইয়া দেখিয়া আসিত তাহার সোনার নিধি।
নক্সী-কাঁথায় আঁকিল যে সাজু অনেক নক্সী-ফুল,
প্রথমে যেদিন রুপারে সে দেখে, সে খুশীর সমতুল।
আঁকিল তাদের বিয়ের বাসর, আঁকিল রুপার বাড়ি,
এমন সময় বাহিরে কে দেখে আসিতেছে তাড়াতাড়ি।

দুয়ার খুলিয়া দেখিল সে চেয়ে - রুপাই আসিছে বটে,
"এতক্ষণে এলে? ভেবে ভেবে যেগো প্রাণ নাই মোর ঘটে।
আর যাইও না কাইজা করিতে, তুমি যাহাদের মারো,
তাদের ঘরে ত আছে কাঁচা বউ, ছেলেমেয়ে আছে কারো।"
রুপাই কহিল কাঁদিয়া, "বউগো ফুরায়েছে মোর সব,
রাতে ঘুম যেতে শুনিবে না আর রুপার বাঁশীর রব।
লড়ায়ে আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে,
আগে বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে।
লোহু লয়ে আজ সিনান করেছি, রক্তে ভেসেছে নদী,
বুকের মালা যে ভেসে যাবে তাতে আগে জানিতাম যদি।
আঁচলের সোনা খসে যাবে পথে আগে যদি জানিতাম,
হায় হায় সখি, নারিনু বলিতে কি যে তবে করিতাম!"

বউ কেঁদে কয়, "কি হয়েছে বল, লাগিয়াছে বুঝি কোথা,
দেখি! দেখি!! দেখি!!! কোথায় আঘাত, খুব বুঝি তার ব্যথা।"
"লাগিয়াছে বউ, খুব লাগিয়াছে, নহে নহে মোর গায়,
তোমার শাড়ীর আঁচল ছিঁড়েছে, কাঁকন ভেঙেছে হায়।
তোমার পায়ের ভাঙিয়াছে খাড়ু ছিঁড়েছে গলার হার,
তোমার আমার এই শেষ দেখা, বাঁশী বাজিবে না আর।
আজ 'কাইজার' অপর পক্ষে খুন হইয়াছে বহু।
এই দেখ মোর কাপড়ে এখনো লাগিয়া রয়েছে লোহু।
থানার পুলিশ আসিছে হাঁকিয়া পিছে পিছে মোর ছুটি,
খোঁজ পেলে পরে এখনি আমায় ধরে নিয়ে যাবে টুঁটি!
সাথীরা সকলে যে যাহার মত পালায়াছে যথা-তথা,
আমি আসলাম তোমার সঙ্গে সেরে নিতে সব কথা।
আমার জন্য ভাবিনাক আমি, কঠিন ঝড়িয়া-বায়,
যে গাছ পড়িল, তাহার লতার কি হইবে আজি হায়!
হায় বনফুল, যেই ডালে তুই দিয়েছিলি পাতি বুক,
সে ডালেরি সাথে ভাঙিয়া পড়িল তোর যে সকল সুখ।
ঘরে যদি মোর মা থাকিত আজ তোমারে সঙ্গে করি,
বিনিদ্র রাত কাঁদিয়া কাটাত মোর কথা স্মরি স্মরি!

ভাই থাকিলেও ভাই-এর বউরে রাখিত যতন করি,
তোমার ব্যথার আধেকটা তার আপনার বুকে ভরি।
আমি যে যাইব ভাবিনাক, সাথে যাইবে কপাল-লেখা,
এ যে বড় ব্যথা! তোমারো কপালে এঁকে গেনু তারি রেখা।"
সাজু কেঁদে কয়, "সোনার পতিরে তুমি যে যাইবে ছাড়ি,
হয়ত তাহাতে মোর বুকখানা যাইতে চাহিবে ফাড়ি।
সে দুখেরে আমি ঢাকিয়া রাখিব বুকের আঁচল দিয়া,
এ পোড়া রুপেরে কি দিয়ে ঢাকিব - ভেবে মরে মোর হিয়া।
তুমি চলে গেলে পাড়ার লোকে যে চাহিবে ইহার পানে,
তোমার গলার মালাখানি আমি লুকাইব কোন্‌ খানে!"

রুপা কয়, "সখি দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই,
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই।
মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে,
তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণ তলে।"



এমন সময়ে ঘরের খোপেতে মোরগ উঠিল ডাকি,
রুপা কয়, সখি! যাই-যাই আমি-রাত বুঝি নাই বাকি।"
পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায়; সাজু কয়, "ওগো শোন,
আর কিগো নাই মোর কাছে তব বলিবার কথা কোন?
দীঘল রজনী-দীঘল বরষ-দীঘল ব্যথার ভার,
আজ শেষ দিনে আর কোন কথা নাই তব বলিবার?"
রুপা ফিরে কয়, "না কাঁদিয়া সখি, পারিলামনাক আর,
ক্ষমা কর মোর চোখের জলের নিশাল* দেয়ার ধার।"

*নিশাল - অবিরাম

শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১১ সকাল ৮:০২
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×