কোথাও যাব না
আমি যেতে চাই বাংলার মানুষের কাছে, পানিবন্দী আকাশের নীচে - ছোটবেলায় টিভি খুললেই খুব শুনতাম এই গান, তখন এরশাদশাহীর রাজ আমার দেশে। বুট পরে ছপছপ করে এক দরদী (!) জননেতা (!) ঘুরে বেড়াচ্ছে বাংলার বন্যা উপদ্রত এলাকায়। আটাশি সাল। কি বাহবা! বাঘের বাচ্চা না হলে এভাবে পানি মাড়িয়ে ঘোরে! কত কি দেখেছি সেই ছোট্ট দুচোখ দিয়ে! নূর হোসেনের রক্ত বৃথা যেতে দিব না। জননেত্রী, দেশনেত্রী, আপোসহীন নেত্রীদের আস্ফালন। জয় বাংলা বাংলার জয়- বাবা বুঝাচ্ছেন এটা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সবচাইতে জনপ্রিয় গান, স্লোগান। প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ-গোলাম আযম। মাথা ঠেসে যাচ্ছে নতুন নতুন শব্দে। মা জানাচ্ছেন আমার কৌতূহরী প্রশ্নে হোয়াট ইজ সেকুল্যারিজম। চরম জামায়াতী স্কুলে পড়ে মনের মাঝে পুষে যাচ্ছি 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'। এখন মনে হয়, আই ওয়জ এ ডেম ফুল্।
সবকিছু আসলে ব্যক্তিস্বার্থ অথবা গোষঠীস্বার্থ হাসিলের এক অভিনব কায়দা ছাড়া আর কিছুই না। সেই ছেলেবেলায় বিদু্যত নেই মানে দারুণ আনন্দ-পড়তে হবে না কিছুণ সন্ধ্যার পরে, জোট বেঁধে খেলা যাবে পাগলা তোর পাগলী কই খেলা। এখন মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গে, সারাদিনের হা কান্ত শরীর, আজাবের মতো গরম, কারেন্ট নেই তো নেই ই, ঘুম সে তো অনেক দূর অস্ত! কিছু চাইলেই পুলিশের রাইফেলের বাঁটের বাড়ি, লাঠি চার্জ, শর্টগানের তোপধ্বনি। এরশাদও এত মারেনি আমাদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার যতটা মার পাঁচ বছরে মেরেছে। ইলেকট্রিসিটি নেই সেও না কি বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র! আফিম খাওয়া জনগণের একাংশ তা অবলীলায় বিশ্বাসও করছে। পানি নেই। গ্যাস নেই। এত নেই এর মাঝে
আছে অনেক টিভি চ্যানেল আর মোবাইল ফোন। বেকুব মানুষ সারাদিন রাত শুধু কথা বলছে। চারিদিকে সংলাপের চচর্া, এনশাল্লাহর ছড়াছড়ি।
আলবেয়ার কামুর ছোট্ট একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, 'দি আউটসাইডার'। বাংলা মিডিয়ামে পড়া আমি সেই বয়সে আর কি -ই- বা ইংরেজি বুঝি! তার উপর ইংরেজি উপন্যাস! এখনো ঠিকমতো বুঝি না। বাংলায় অনুবাদ হলে আমার ন্বস্তি। যাই হোক কবীর চৌধুরী আউটসাইডারের বঙ্গানুবাদ করাতে আমার সেই কৈশোরে পড়া আধোছায়ার উপন্যাস আবার বেশ লাগলো। আহ্, আমি যদি মেয়ার সল্টের মতো নির্বিকার হতে পারতাম! তাহলে এমন রিএকশনিস্ট হতে হতো না। কোন ব্যাপার্ইে হেলদোল থাকতো না। কত্ত ভালো হতো। পারি না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়, আমার বুকে বাজে বেদনা। নিজের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে। এক একটা দিন ইউনিভার্সিটি বন্ধ মানে, জীবন থেকে কি যে মুছে যাওয়া। এসব ছেলেপিলে কত েেত্র যে পিছিয়ে যাবে, অ্যাপ্লাই করতে পারবে না। কারও কোন মাথাব্যথা নেই। পিএসসি কে সরকার গণধর্ষণ করে ছেড়ে দিয়েছে। সেখানেও কর্মসংস্থানের আশা বৃথা। নারীশিা উন্নয়নে গলার রগ ফেটে যাবার উপক্রম উন্নয়নের সরকারের। আরে বাবা বিনা বেতনে যে স্কুলে পড়তে যাবে সেই যাবার পথে কলিম সলিম দাঁড়িয়ে থাকলে ঐ মেয়ে কিভাবে যাবে? মানুষেরই নিরাপত্তা নাই সেখানে আবার মনুষ্যতর প্রাণী নারীর নিরাপত্তা তার আবার সবেতন বিনা বেতন শিা!
আলিম পড়, কামিল, ফাজিল যাই পড়, জাল সার্টিফিকেট হোক, কুছ পরোয়া নেহি। একটা ঘোষণা, দলীয় পরিচয়, তুমি ডিগ্রী পাবে, বিচারপতি হবে সব হবে। আমরা ভদ্দরনোকের (!) সন্তানরা বিশবছর লাগিয়ে শুধু মুধু বাপমায়ের হাড় জ্বালিয়ে বছরের পর বছর লেখাপড়া খেলা খেললাম এত্তগুলো বছর। খুব আফসোস হয় ইদানীং। আমি কেন জাতীয়তাবাদী, নিদেনপ ে(ভন্ডামী) তথাকথিত ইসলামবাদী হলাম না! সেই যে কুলসুম যে সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর খোপে বসে, হাকিম চত্বরের অন্ধকারে প্রায়ই পায়জামার বিশেষ জায়গা ছিঁড়ে ফিরতো সেও আমার চাইতে সতীসাধ্বী বরাবরই বোরখার কারণে। আমি ফুলস্লিভ জামা পরেও, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েও অনেকের চোখে বেদ্বীন শুধূ বোরখা পরি না বলে। আমার চেনা মানুষগুলো কি সাত তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে! যে স্যারের প্রায় চাকুরী চলে যাবার যোগাড় ছিল আমরা স্কুলে থাকতে কমু্যনিস্ট ছিলেন বিধায়, এত বছর পর সে স্যারকে দেখলাম। মাথায় টুপি, দাঁড়ি। জামায়াত ইসলামীর রোকন না কি যেন হয়েছেন। পাশে মেয়ের বয়সী বউ, বেশি বয়সে বিয়ে করলে যা হয়। "ধর্ম আর রাজনীতি কখনো এক করতে নেই, দেশে শুধু ইউনিকোড পারিবারিক আইন না থাকাতে মেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে। শরীয়া আইন মানলে সব েেত্রই মানা উচিৎ। চুরি করলে কেন জেলে যাবে, শরীয়া আইন অনুযায়ী হাত কেটে ফেলুক"- এইসব কথা দিনের পর দিন যে স্যার আমাদের বলেছেন সেই স্যারকে দেখে আমার কেমন লাগলো বুঝাতে পারবো না। মানুষ কি তবে তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী লেবাস পরিবর্তন করে? নীতি আদর্শ এগুলো অল্পবয়সের একধনের হ্যালুসিনেশন?
বন্ধুরা প্রায়ই বলে যারা দেশের বাইরে - এই তুই চলে আয়। তোর যা কথার ধার, ফটফট করিস, নীতি, টিকতে পারবি না। আমার যাওয়া হয় না। আমার দেশটা তো কোন দোষ করেনি। দোষ তো আমার, আমাদের। যারা যেখানে থাকার কথা না তারাই সেখানে। বানরের হাতে কোদাল পড়লে যা হয়, আমার দেশেও তো তাই। অযোগ্য, অশিতি, কুশিতি, লোভী কিছুলোক দেশ পরিচালনার ভার পেয়ে গেছে আমাদের বোকামীতে, ঔদাসীন্যে।
সেপ্টেম্বরের 15 তারিখে স্কুলের পুনর্মিলনীতে গিয়েছিলাম। একযুগ হয়ে গেল এসএসসি পাশ করেছি। গলা ছেড়ে সেই ছোটবেলার মতো জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছি। একে অন্যের চোখের দিকে তাকাচ্ছি আর গেয়ে যাচ্ছি প্রাণের তাগিদে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কেউ বলেনি গাইতে হবে। গান শেষে চেয়ারে বসতে বসতে বলে ফেললাম 'কি যে ভালো লাগলো!' পাশের বন্ধুকে বললাম, দেখ্ আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে! এরপরেও কি আমি দেশ ছাড়তে পারি?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



