দেবতার ধনুর্বাণ: চিনুয়া আচেবে- ভূমিকা ও অনুবাদ: খালিকুজ্জামান ইলিয়াস ॥ প্রকাশকাল: জুন ২০১২ ॥ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন ॥ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সব্যসাচী হাজরা ॥ মুল্য: ৪০০ টাকা
চিনুয়া আচেবে’কে বলা হয় আফ্রিকার আধুনিক সাহিত্যের জনক। আফ্রিকার জীবিত শ্রেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে তিনি একজন। নাইজেরিয়ার অ্যানামব্রা প্রদেশে জন্ম নেয়া এই লেখক ১৯৫৯ সালে থিংস ফল এপার্ট উপন্যাস লিখে সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দেন। ঔপনিবেশিক যুগের পূর্ব এবং পরের নাইজেরিয়ার সামাজিক, সাংস্কিৃতিক, রাজনৈতিক প্রক্ষাপট হলো আচেবের বেশিরভাগ লেখার উপজীব্য। চিনুয়া আচেবে নিজে ইগবো সম্প্রদায়ের লোক। ফলে ইগবোদের নিজস্ব সংস্কৃতি, আচার-আচরন, রাজনৈতিক সচেতনতা ইত্যাদি তিনি দেখেন একদম ভেতর থেকে।
দেবতার ধনুর্বাণ বা অ্যারো অব গড আচেবের তৃতীয় উপন্যাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা আফ্রিকার অধিবাসীদের যেভাবে শোষন করেছে, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে যেভাবে পদদলিত করে নিজেদের শাসন ও নিয়মকানুন চালু করতে বাধ্য করেছে তাতে আফ্রিকান কোন লেখকই এসব অনুষঙ্গকে বাদ দিয়ে তাদের লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। তাদের লেখায় অনিবার্যভাবেই ঔপনিবেশিক অনুষঙ্গ বিদ্যমান। পঞ্চাশের দশকে চিনুয়া আচেবে নাইজেরিয়ায় ট্রেডিশনাল ওরাল লিটারেচার নামক একটি নতুন ধারার সাহিত্য রচনার প্রবর্তন করেন। এই ধারাটি নাইজেরিয়ান সমাজ বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।
দেবতার ধনুর্বাণ উপন্যাসটি মূলত পরিবর্তমান পরিস্থিতিতে ইগবো সমাজের মতাবান এবং দাম্ভিক এক পুরোহিত ইজুলু চরিত্রটিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। কাহিনীর প্রথমদিকে আমরা দেখবো ব্রিটিশরা তাদের প্রসারিত বাহু বিস্তার করে ঢুকে পড়ছে প্রত্যন্ত নাইজেরিয়ার আনাচে কানাচে। ছয় গ্রামের প্রধান পুরোহিত ইজুলুকে এসময় ব্রিটিশদের সাহায্যকারী হিসেবে মনে হয়- যে কিনা তার এক ছেলেকেও খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষীত হবার জন্য পাঠায়। জমি নিয়ে বিরোধে ব্রিটিশদের উপস্থিতিতে তাদের শত্রুগ্রামের পক্ষেই সায় দেয় এই প্রধান পুরোহিত। ফলে নিজের গ্রামের মানুষের রোষানলে পড়ে সে। উপন্যাসের মাঝামাঝি এসে বোঝা যায় এসবই ইজুলুর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ঔপনিবেশিক শাসকের চারিত্র বোঝার জন্যই সে পদ্ধতি হিসেবে এগুলোকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু নিজের গ্রামের এমনকি পরিবারের লোকেরাও তাকে বুঝতে পারেনা। ইজুলুর চরিত্রের জটিলতা এবং প্রচণ্ড একরোখা দাম্ভিকতা তাকে মহাকাব্যিক নায়কের সমান্তরাল করে তোলে। শেষ পর্যন্ত সে তার প্রিয় সন্তান এবং ছয় গ্রামের লোকের সমর্থন হারায়। তার দেবতাও ঔপনিবেশিক দেবতার কাছে হার মানে। এসবই, পাঠকের মনে হয়, কেবল উজুলুর আত্মরম্ভিতার জন্য ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সনাতন অস্ত্রসস্ত্র আর প্রাচীন মাটিবর্তী সরলতা হার মানে অধিকতর কৌশলী ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার আছে। তবু, পাঠকহৃদয়ে উজুলুর জন্য বিয়োগান্তক মহাকাব্যের নায়কের মতই সমবেদনা জেগে উঠতে বাধ্য। উপনিবেশ পূর্ববর্তী ইগবো সমাজের ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিবার, কৃষি, লোকজ বিশ্বাস, সমাজ কাঠামো এসবের একটি বস্তুনিষ্ঠ বর্ননা রয়েছে এ উপন্যাসে।
চিনুয়া আচেবে প্রথাগত ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবের বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আফ্রিকান সাহিত্য নির্মানে ব্রতী হন। ঔপনিবেশিক সাহিত্যের বিপরীতে অর্থাৎ জোসেফ কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস কিংবা জয়েস কেরির মিস্টার জনসন যেরকম খণ্ডিত ও বর্ণবাদী আফ্রিকাকে উপস্থাপন করে, তার বিপরীতে গিয়ে নতুন এক সাহিত্যিক দর্শন নির্মান করেন তিনি। ফলে আফ্রিকান সাহিত্যে তাঁর আসনটি চিরকালের জন্য পাকা হয়ে যায়। ইংরেজিতে লিখলেও ইগবো সমাজের মিথ, ইগবো শব্দ, লেকজ অলংকার, প্রবাদ প্রবচন ইত্যাদির প্রচুর ব্যবহার করে ভাষাগত একটি সমন্বয়ে পৌঁছান আচেবে। এমনকি তিনি কোনো টীকাভাষ্যও দেন না এসবের জন্য। চিনুয়া আচেবে তাঁর উপন্যাসে প্লট নির্মানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ভঙ্গি বর্জন করে ইগবো সমাজে গল্প বলার প্রচলিত রীতিকে বেছে নেন। অনেক সমালোচক এ ব্যাপারটিকে তাঁর দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এটি তাঁর সচেতন নিজস্ব নির্মান। বস্তুত ঔপনিবেশিক শিক্ষার (উপনিবেশ স্থাপনের পূর্ববতী সবকিছুই খারাপ, অন্ধকারাচ্ছন্ন, বর্বর, অ-সভ্য ইত্যাদি) বিপরীতে চিনুয়া আচেবের দেবতার ধনুর্বাণ মূর্তিমান এক দ্রোহেরই প্রকাশ।
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য উপন্যাসটির একটি সাবলীল অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদে উপন্যাসের ইগবো সমাজের আঞ্চলিক অনুষঙ্গগুলো বেশ ভালোভাবে ধরা পড়েছে। এছাড়া উপন্যাসটি নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা লিখেছেন তিনি। বেশ কিছু অপরিচিত বিষয় ভূমিকায় বর্ননা করার ফলে পাঠকের জন্য এটি বাড়তি পাওনা হিসেবে ধরা যেতে পারে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





