somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইফতার পোস্ট:: মেগা শক অ্যাট চকবাজার ::

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রমজান আসলেই মিডিয়া জুড়ে চকবাজার ফিভারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। সবার প্রথমে আক্রান্ত হয় প্রথম আলোর শেষপাতার বাঁদিকের ডেডিকেটেড ডাবল কলাম , দ্রুত তা ছড়ায় চ্যানেল আই বাংলাভিশনের স্পেশাল ইফতার বুলেটিনে ,এবং সবশেষে রেডিও টুডের হটস্পটে । এ রোগের লক্ষণগুলো মাঝে অন্যতম হল চকবাজারকে মোঘল সম্রাটদের ভোজনশালা-জ্ঞান করে , উচ্চস্বরে চকবাজারী ইফতারের গুণকীর্তন করা ।


কে যেন সেদিন বলছিল :
ওহে বৎস , বৃথা তোমার ১৭ আনা জীবন
রমজান বিগত , চকবাজারে যে করিলো না পদার্পন


বুয়েট জীবনের সূচনাপর্বে হিজরি ১৪২১ এর রমজান মাসে ১৭ আনা ব্যর্থ জীবনকে স্বার্থক করার সুযোগ মিলে গেল । মানসপটে চকবাজারের যে ছবি আঁকা ছিল তা স্বর্গের ছোটখাটো বালাখানার মতন । আম্রকাননে ঝুলন্ত থোকা থোকা আম আমাদের যেন হাতছানি দিয়া ডাকছে ।কিন্তু ইফতার পর্বে বিধি হলো বাম , চকবাজারের আম্রকানন , হয়ে গেল জ্বলজ্যান্ত বেল-বন । মুষলধারে বেল বর্ষণে শেষ কেশটিও হারিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কোনদিন ওমুখো হব না ।

চক তওবার পর ৩ টি বছর ঘুরিয়া আবার রমজান আসিল , হিজরি ১৪২৫ মোতাবেক ইংরেজি ২০০৭ সাল । মেঘলা কোন একদিনে ভার্সিটির কুইজ পরীক্ষা শেষে এক বন্ধু প্রস্তাব করল , চকবাজারে হানা দেবো ।বলাবাহুল্য ,বাঙালী জাতির অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণে আমার স্মৃতিও গোল্ড ফিশের মতন , তথাপি রমজান আসার পর থেকেই প্রথম আলো , চ্যানেল আই চকবাজার নিয়া যে মায়াকান্নার হিড়িক ছুটিয়ে দিলো , তাতে আমার শক্ত মন গলে জল হয়ে গেল।এক জোড়া রিকশায় এক হালি বন্ধু উপবিষ্ট হয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝে রওনা হলাম মোঘল ইফতারীর ঢাকাইয়া কিংডম চকবাজার প্রান্তরের দিকে।

চকবাজারে পৌঁছে ৪ জনা রীতিমত সংহারমূর্তি ধারণ করলাম ।রেগুলার ইফতারি আইটেমগুলো লিস্ট হইতে ছাঁটিয়া ফেলা হইলো । "খাইয়া ফালামু " স্টাইলে শুরু হলো কেনাকাটা । থলেতে প্রথম ভরলাম প্রমাণ সাইজের চারটি শাহী টানা পরোটা । একে একে কিনলাম কলিজা সিংগারা , মাটন সমুচা , চিজ সমুচা , সুতি কাবাব , জালি কাবাব , ফিরনি , ফালুদা আর সবশেষে "বড় বাপের পোলায় খায়" ।খাসির বিশাল রানের কাবাব আমার কু-দৃষ্টি তখনও এড়াইতে পারে নাই , কিন্তু বাধা দিল বন্ধুবর আদিব । রানের ভেতরকার দুর্গম অংশে মসলার অনুপস্থিতিতে কি রকম আদিম যুগীয় কাঁচা মাংসালো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সে কথা বলিয়া আমাকে নিবৃত্ত করিলো। তার বদলে হৃষ্টপুষ্ট চারপিস চিকেন ফ্রাইয়ের ভাগ্য খুলিয়া গেল ।

ইফতারির ১০/১৫ মিনিট আগে বুয়েটে ফিরে তীতুমীর হলের একটা টেবিলের দখল নিলাম । থরে বিথরে সাজানো ইফতার সামগ্রীতে টেবিল বেশ রাজসিক একটা চেহারা নিয়ে নিল। পাশের আপাত শূন্য, জীর্ণ ইফতার সাজানো টেবিল গুলোকে রীতিমত মলিন লাগছিল ।

হাজারিবাগের চামড়া/শাহী পরোটা
খেজুর মুখে দেয়ার পরপরই ঝোলা থেকে বের করিলাম শাহী পরোটা। রেক্সিনের দাপটে বাজারে চামড়া সামগ্রী পাওয়া দায় , শাহী পরোটা মুখে নিয়া মনে হইলো কত যুগ পর প্রকৃত চর্মের সন্ধান পাইয়াছি । চর্মে নির্মিত পরোটা নামক যে দস্তরখানের কদর হইত ইফতারীর প্লেটের নিচে , আমাদের মুখগহ্বরে তার প্রবিষ্ট হওয়া কতই না বেমানান।

বুড়িগঙ্গার মাটি/সুতি কাবাব
চর্মের দস্তরখানের সহযাত্রী হয়ে উঠা বিখ্যাত 'সুতি কাবাবের' কথা না বললেই নয় । ম্যাগাজিনে পড়িয়াছিলাম , অনেক মাটি খাইয়া বাঁচে , মাটি খাওয়ার শখ এবার মনে হয় মিটিল । এঁটেল , দোআঁশ মাটির চাইতে বেলে মাটির সাথে এ কাবাবের বিশাল সাযুজ্য খুঁজিয়া পাইলাম । নিকষ কালো রঙের নোনতা বালু বালু সে কাবাবের জন্ম কি করিয়া হইয়াছে তাহাই ভাবিয়া দিশেহারা হইতেছিলাম । শেষ পর্যন্ত সোয়ারিঘাটস্থ বুড়িগঙ্গার নিকষ কালো পানির তলদেশের গন্ধময় বেলে মাটিই ইহার উৎস বলিয়া মন সায় দিলো ।

হাজারিবাগের চামড়ার সহিত বুড়িগঙ্গা তলের কালচে সুতি কাবাব অভিসারে যে অপরিসীম তৃপ্তি অর্জন করছি সেটা বুঝাতে মুখে কৃত্রিম হাসি ফোটালাম ।

বন্ধু আদিব আমার মত ভালো অভিনয় জানে না , হঠাৎ করেই রাশেদের ছোট বোনের জন্য তার দরদ উপচাইয়া পড়িতে লাগিলো । সে প্রস্তাব করিল , রাশেদ তাহার ছোট বোনের জন্য সবটুকু কাবাব লইয়া যাইবে ।আমরাও এমন ভাব করিলাম যে ছোট বোনকে না দিয়া সুতি কাবাব খাওয়ার মত মহাঅন্যায় কিছুতেই বরদাশত করা হইবে না। রাশেদ মৃদু স্বরে একটু প্রতিবাদের চেষ্টা করিলো , কিন্তু আমাদের স্বরের নিচে চাপা পড়িয়া তা গোঙানির মতই শোনালো ।

নতুন সূত্র/ কলিজা সিংগারা
পাঠকরা ইতোমধ্যেই জানেন , এক বালতি দুধে এক চিমটি গোবর পড়িলেই দুধ তার কুমারিত্ব হারায় । কিন্তু এক বালতি গোবরের মাঝে এক ফোঁটা দুধ ফেলিলে, পুরো বালতি যে দুধে রুপান্তর ঘটে সে কথা প্রথম জানিলাম কলিজা সিংগারা খাইতে গিয়া। সিংগারার পেট চিরিয়া আলুর প্লাবনে ক্ষুদ্র এক টুকরো কলিজার দেখা মিললো । ক্ষুদ্রাকায় কলিজার একটি টুকরো কি করে আলুর বিশাল সম্ভারকে কলিজার মর্যাদা আনিয়া দেয় , তা আর অস্পষ্ট থাকিলো না ।

অনুভবে সমুচা :
ধাক্কার রেশ কাটাইতে বের করিলাম মাটন সমুচা । ঠান্ডা মাটন সমুচাতে দাঁতের দাগ পড়তেই পড়তেই শুরু হলো ঝুরঝুরে পাউরুটি গুঁড়ার পতন। শেষমেশ দেখা মিললো সবেধন নীলমনি অভেদনযোগ্য এবং অছেদনযোগ্য ছোট্ট এক টুকরো নাড়ির । ভাবলাম , এই সেই অখাদ্য এক টুকরো নাড়ি যা পাউরুটি সমুচাকে দানিয়াছে মাটনের সম্মান ।

অশিক্ষিত চক্ষু যেখানে ধুলি কর্দম দেখে , শিক্ষার আলোয় সেথায় মেলে হীরার সন্ধান ।ঠিক একই ভাবে চিজ সমুচার মহিমা বুঝিতে হইলে আপনাকে সপ্রতিভ হইতে হইবে , নতুবা আপনি চিজ সমুচাকে নিমকি বলিয়া অসম্মান করিয়া বসিতে পারেন । চিজ হচ্ছে মাখনের ন্যায় সাতিশয় মোলায়েম এক ধরণের চিজ যাহা গরম তেলে গলিয়া , সমুচার অঙ্গে মিশিয়া যায় ।কাজেই সমুচার মাঝে চিজের খোজ করা বাতুলতা মাত্র , শুন্য সমুচার মাঝে তাহাকে অনুভব করিয়া লইতে হয় ।


ব্র্যান্ড নেইম/জালি কাবাব

ব্র্যান্ড নেমের মূল্য বুঝিলাম জালি কাবাব খাইবার কালে ।জালি কাবাবের জালের ফাঁকে পেঁয়াজ , বাঁধাকপি আর সবজির দেখা মিললো । ভেজিটেবল ভাজিয়া যদি আপনি জালি কাবাব ব্র্যান্ডটি লাগাইয়া দিতে পারেন , একলাফে আপনার কাবাব চড়া মূল্যের জাতে উঠিয়া যাইবে।

মুড়ির,পেয়াজু বেগুনি , আর অনেক শত ধরণে মসলা সহযোগে প্রস্তুত করা "বড় বাপের পোলায় খায়" , মুখে নিয়া দাঁতের ফাকে চাপ দিতেই মুড়ি মুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ার বদলে বায়ু নির্গমন করে চ্যাপ্টা হইয়া গেল ।

আইসক্রিমের কাঠি/ মুরগীর হাড্ডি
চিকেন ফ্রাই বুকের মাঝে রেখে গেল না পাওয়ার এক গভীর ক্ষত । হাড্ডি ধরে হৃষ্টপুষ্ট দেহটা বিদীর্ণ করে কেবল ডালের দেখা মিললো । সত্যিই যদি মুর্গি এমন ডাল নির্মিত হত , নির্ঘাত পৃথিবীর সব মুরগী অপমানের জ্বালায় আত্মহননের পথ বেছে নিতো । খালি পড়ে থাকা চারটি হাড্ডি , ফেরত দিয়ে আসতে ইচ্ছে করছিল , কে জানে আগামী দিন হয়তো এই চারটি হাড্ডি নতুন চার টুকরো মুরগী দেহের জন্ম দিতো ।

কর্নফ্লেক্স/ময়দা দিয়ে বানানো দুধ ...অতঃপর ফিরনি
দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে তারপর সে দুধে বানানো হয় ফিরনি .........প্রথম আলোর এমনতর ভাষ্যই তখন শেষ ভরসা । ফিরনি তে মুখ দিয়ে বুঝা গেল , দুধের ছোঁয়া সেখানে লাগেনি । সাদা সাদা তরলগুলো ভাতের ফেনের অবদান। ফিরনিতে আটা/কর্নফ্লাওয়ার পরিমাণমত হওয়ায় বেশ আঠালো আকার ধারণ করেছে । দুধ ঘন হয়ে লাল হয়ে গেছে , এমন অনুভূতি আনার তাগিদে ব্যবহার করা হলুদ আর অন্যান্য রংয়ের ব্যবহার রী্তিমত অশ্লীল দেখাচ্ছে ।

বিবমিষা/ফালুদা
ফালুদার প্যাকেট খুলে নাকের কাছে নিতেই মাথা চক্কর দিলো। দুধের মালাইয়ের বদলে এখানে যেন টলটলে চুনের পানি , তার সাথে সেদ্ধ অসেদ্ধ কিছু নুডলস , সাগুদানা । বাদামের কোন দেখা তো মিললোই না , আপেল , আনার , কলা ৩/৪ রকমের ফল মেশানোকে এর হয়তো অহেতুক ভজঘট পাকানো ভেবে কলা কেটে দিয়েছে , সে কলার দুধ মালাইয়ের মাঝে হাবুডুবু খেয়ে খেয়ে ভেসে উঠার কথা , নির্লজ্জ ভাবে তা পানিতে ডুবে আছে ।


ফেরা :
আমার তখন তাড়া , বাসায় ফিরতে হবে । সাথে ইফতারের ব্যাপারটা চেপে যেতে হবে । মাথায় হাত দিয়ে দেখি দ্বিতীয় দফা বেলের আঘাতে আমার সব কেশ আবার ঝরে পড়েছে । অগত্যা পরচুলার আশ্রয় নিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালাম ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:৫৮
৯৪টি মন্তব্য ৮৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×