ধারাবাহিক উর্ধগতির কারণে বিনিয়োগ ঝুঁকি বাড়লেও পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগকারীদের আগমন থামছে না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য প্রতিদিনই বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব খুলছেন অসংখ্য মানুষ। পুঁজিবাজারমুখী স্রোতের এ ধারা অব্যাহত থাকায় ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। গত বছর বিও হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৬৭। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়েছে ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৬৩৯।
সেন্ট্রাল ডিপোজটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রবিবার পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের আওতাধীন বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ ১৮ হাজার ১২২টি। বর্তমানে সক্রিয় বিও হিসাবগুলোর মধ্যে ২২ লাখ ২১ হাজার ৬৭৪টি পুরুষ বিনিয়োগকারী এবং ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩৪টি নারী বিনিয়োগকারীদের। এছাড়া বাকি ৭ হাজার ৯১৪টি বিও হিসাব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশীদের নামে চালু থাকা বিও হিসাবের সংখ্যা ১ লাখ ২৩ হাজার ৪০৪।
সিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএইচ সামাদ জানান, প্রতিমাসেই বিও হিসাবের সংখ্যা বাড়ছে। গত দেড় বছরের মধ্যে এ সংখ্যা বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়েছে। তিনি বলেন, এবার বিও হিসাব নবায়নে ভাল সাড়া মিলেছে। ফি বাড়ানো হলেও হিসাবধারীরা নির্ধারিত সময়ের আগেই নবায়ন করেছেন।
বাজার বিশেস্নষকদের মতে, শেয়ারবাজারে যে হারে বিও হিসাবধারীর সংখ্যা বাড়ছে তা অস্বাভারিক নয়। বিশ্বের অনেক দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নিজস্ব পেশাগত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শেয়ারবাজারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। কিন্তু সে অনুযায়ী বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় বিনিয়োগকারীর হার অনেক কম। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশেরও কম। তবে শেয়ারবাজারের বর্তমান গতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হলে নিশ্চিতভাবেই শেয়ারবাজারের সঙ্গে জড়িত মানুষের সংখ্যা অনেক বাড়বে।
তাঁদের মতে, বর্তমান বাজারকে ধরে রাখতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ভাল শেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
ডিএসইর সিনিয়র সহ-সভাপতি নাসিরউদ্দীন চৌধুরী বলেন, বাজারে বিও হিসাব বৃদ্ধির মানে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। এটি পুঁজিবাজারের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। বাজারে এখন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে বলেই সাধারণ জনগণের এ মার্কেটের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। তবে বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সঙ্গে ভাল শেয়ারের সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে চাহিদার সঙ্গে শেয়ার সরবরাহের সমন্বয় নেই। এ সমন্বয়হীনতা দূর করা জরম্নরী।
সংশিস্নষ্টরা জানান, ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি গত এক বছরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিও হিসাবের সংখ্যা ৭ হাজার ৯১৪টি। শেয়ারবাজারে এ ধরনের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাল শেয়ারের চাহিদা বেড়ে গেছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ না থাকার কারণে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বাজার মূলধন ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার এটাই মূল কারণ।
বিশেস্নষণে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালের বড় ধসের পর শেয়ারবাজার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল। ওই সময়ে পুঁজি হারানো হাজার হাজার মানুষের মধ্যে শেয়ারবাজার ছিল বড় আতঙ্কের নাম। ‘৯৬-এ পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা তো বটেই, সাধারণ মানুষের মধ্যেও নতুন করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের চিনত্মা আসেনি। ফলে হাতেগোনা কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে শেয়ারবাজারের লেনদেন। ২০০৪ সালের পর থেকে বাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়তে থাকে। মূলত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ দেয়ার কারণেই সেই সময় বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
তবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের উর্ধগতি শুরম্ন হয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সরকারের নানামুখী অভিযানের কারণে দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগের সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকে লাভজনক মনে করতে শুরম্ন করেন। তাছাড়া দুর্নীতির বিরম্নদ্ধে অভিযান চালালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কালো টাকার প্রশ্নহীন বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ায় শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর বর্তমান মহাজোট সরকার ৰমতাগ্রহণের পর শেয়ারবাজারে লেনদেন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। বিপুল পরিমাণ নতুন বিনিয়োগ যুক্ত হওয়ায় বেড়ে যায় অধিকাংশ শেয়ারের দর। গত ২০ মাসে শেয়ারবাজারের শক্তি-সামর্থ্য ব্যাপকমাত্রায় প্রসারিত হলেও চাহিদার তুলনায় শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে না পারায় ইতোমধ্যেই দেশের শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পেঁৗছেছে বলে বিশেস্নষকরা মনে করেন।
২০০৯-১০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে পুঁজিবাজারবান্ধব বিভিন্ন সিদ্ধানত্ম এবং উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগে মন্দার কারণে শেয়ারবাজারে অর্থপ্রবাহ ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও শেয়ারবাজারের বিকাশে বিভিন্ন পদৰেপের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেয়ায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জে (ডিএসই) দৈনিক লেনদেনের গড় ছিল প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে গড় লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে ৬০৪ কোটি ৬০ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। চলতি বছরে দৈনিক লেনদেনের গড় ইতোমধ্যে ২০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে গত ৭ অক্টোবর ২৮০১ কোটি ৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকার শেয়ার, মিউচু্যয়াল ফান্ড ইউনিট এবং কর্পোরেট বন্ড লেনদেন হয়েছে_ যা দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বিনিয়োগকারী এবং অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাল শেয়ারের যোগান না বাড়ার কারণেই শেয়ারের দর ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশেস্নষকরা। দরবৃদ্ধির এ হার কোম্পানির আয় বৃদ্ধির চেয়ে বেশি হওয়ায় বাড়ছে শেয়ারের পিই অনুপাত_ যা বাজারকে ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোকেই সবচেয়ে বড় সমাধান বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
Source: The Daily Janakantha, 25 Oct 2010

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




