জন্ম থেকে আজ অবধি ভিন্ন সম্প্রদায়ের কোনো অত্যাচারী চাক্ষুষ করি নি । যত নিপীড়ক দেখেছি সব নিজ সম্প্রদায়ের । ধনাঢ্য হোক, রাজনীতিক হোক, ধর্মনেতা হোক চারপাশের সব জালেমই মুসলিম । আশেপাশে কোনো হিন্দু অত্যাচারী দেখলাম না; যা ছিল সব ইতিহাসে ।
বরং উল্টোটাই দেখেছি । মুসলিমদের দেখেছি, কোনোদিন কপাল মাটিতে ঠেকায় নি, কিন্তু ‘মালাউন’ ডাক দিয়ে মার মার কাট কাট করে হামলে পড়ছে । কোনো অত্যাচারী হিন্দু, কিংবা খ্রিষ্টান, কিংবা বৌদ্ধ কোনো মুসলিমকে নিপীড়ন করেছে—দেখি নি । বিভিন্ন দেশে ঘটছে, আমার আশেপাশে না ।
আজব তামাশা হলো, মুসলমান তার স্বজাত মুসলমান ভাইকে খুন করার পরপরও যদি তাকে জিজ্ঞেস করেন—তার জাত কী । বলবে মুসলিম ।
সরকার মুসলমান । পুলিশ মুসলমান । সন্ত্রাস মুসলমান । জঙ্গি মুসলমান । ঘুষখোর, সুদখোর, হারামখোর মুসলমান । জুয়াবাজ, মাগিবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ মুসলমান । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিজাব পরলে তিরস্কার করে এবং দাবি করে সে মুসলমান । হল, জমি, দোকান, সম্পদ জোরপূর্বক দখল করে মুসলমান । ধর্ষকও মুসলমান । ভণ্ড, প্রতারক, শয়তান—চোখে দেখা সব জালেম মুসলমান ।
অথচ যারটা খাচ্ছে, যাকে মারছে, যার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, যারটা দখল করছে, যাকে তিরস্কার করছে—সেও যে তার মতো (তারচে’ ভালো না হোক) মুসলমান এ-বিষয়ে অত্যাচারীর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ।
এইসব ক্ষেত্রে ‘মুসলমান’ পরিচয়টা কি আসলেই ‘মুসলিম’ জাতি পরিচয়কে বোঝায়, নাকি আজকালকার বংশ পরিচয়ের মতো একটা ঠুটো বুলি এটা । অর্থাৎ তুমি হাওলাদার, আমি শিকদার । তেমন তুমি হিন্দু, তো আমি মুসলমান । আর কিছু কি আছে ?
কট্টর মুসলিম-বিরোধীও জাতীয় পরিচয়পত্রে লিখছে মুসলমান । তসলিমা নাসরিন, আসিফ মহিউদ্দীন, জাফর ইকবালরা কী লেখে ? আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দাররা কী লিখতো ?
এমনকি ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসায় একজন মুসলমান শিক্ষক তার ছাত্রকে, যে ভালো মুসলমান হতে এসেছে, তাকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলছেন । কিভাবে ?
বাসে-টেম্পুর গায়ে লেখা থাকে—ব্যবহারে বংশের পরিচয় । আচ্ছা, এইখানে ‘বংশ’ শব্দটা কি ‘হাওলাদার’ বা ‘শিকদার’ বোঝায় ? অর্থাৎ ভালো ব্যবহার করলে ভালো হাওলাদার, কিংবা খারাপ ব্যবহারে খারাপ শিকদার চেনা যায় ? এসব বংশ পরিচয়ের কি আদৌ এখন আর কোনো মূল্যমান আছে ? মুসলমান শব্দটাও কি এমনই হয়ে গেছে ?
চতুর্পার্শ্বে সব জালেম মুসলমান দেখার পরেও সারাক্ষণ মাথার মধ্যে বিধর্মী, ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু পোকা কিলবিল করে । এটাই হয়তো স্বজাতির সব জুলুমকে প্রক্সি দেবার মানস তৈরি করছে । হয়তো সারা পৃথিবীর ঘটনা-দুর্ঘটনার সংবাদ নিজের প্রতিবেশকে ভুলিয়ে দেয় । যার ফলে নিজে একজন জালেম মুসলমান হওয়ার পরও ভেতরে অপরাধবোধ জেগে ওঠে না । আপন ভাইয়ের সাথে প্রতারণতা করে কিন্তু ফিলিস্তিনের সংবাদে উত্তাল ।
আমার মনে হয়, যে-কোনো প্রকার জালেমকে মুসলমান পরিচয় দিতে বাধা দেওয়া উচিত । একজন মানুষ জঘন্য অমানবিক কাজ করবে, আর মানবতার ধর্ম ইসলামের পরিচয়ে নিজেকে ‘মুসলিম’ বলবে—সেটা তো কাদিয়ানিদের মতোই হয়ে গেলো; যা-ই করেন, মুসলমান পরিচয় ক্ষুণ্ন হবে না । তাতে চাই শত মুসলমানকে হত্যা করুন, হাজার নারীকে ব্যাভিচার করুন ।
আমার মনে হয়, একটা মিথ্যা বলা হলেও মুসলমান পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হওয়া উচিত—ইসলামের স্বার্থেই । বরং যে-ধর্ম তাকে মিথ্যা বলার অনুমতি দিয়েছে—সেই পরিচয় দিক । এইভাবে প্রতিটা অন্যায়ের বেলায় দেখা যাক । দেখুক, কোন অন্যায়ে সে হিন্দু হয়, কোনটায় খ্রিষ্টান, কোনটায় ইহুদি, কোনটায় জরথ্রুষ্ট্রী । কোনোটায় যদি না থাকে, তাহলে প্রশ্ন করা যায়— সে কি কোনো ধর্ম মানে না ? মানলে করলো কেনো ? ধর্ম না মানলে মানবতার প্রশ্ন সামনে আনা যায়—অর্থাৎ একজন মানুষ হয়েও কি সে এমন অমানবিক কাজ করতে পারে ? নাকি সে মানুষ পরিচয়ও দিতে চায় না ?
এরপর তাওবা করে, ভুল শোধরানোর পরেই লজ্জিত মুসলমান হিসেবে দাঁড়ানো উচিত । এই বোধের অভাবেই মুসলমান জালেমের সংখ্যা বাড়ছে, এমনকি আমি নিজেও জালেম হওয়ার প্রশ্রয় পাচ্ছি ।
ইসলাম যদি ইনসাফের ধর্ম হয়, তাহলে কোনো মুসলমান জালেম হতে পারে না । একজন জালেম নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়ে ইসলামের মানহানী করবে—এর চেয়ে ক্ষমার অযোগ্য অধার্মিক ইসলাম-বিরোধী কোনো অপরাধ হতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৮ সকাল ১১:৪২