এ-যুগে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের দূরত্ব যে ক্রমশ বাড়ছে, তার একমাত্র দায় সেক্যুলারিজমের নয়—বরং মুসলিম কমিউনিটিতে জাতীয়তাবাদের উত্থানই এর প্রধান কারণ। যদিও এতে সেক্যুলারিকরণ এজেন্ডাই আখেরে পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ সেক্যুলারিজম চায় পাবলিক স্ফেয়ার থেকে ধর্মকে আলাদা করে প্রাইভেট স্ফেয়ারে বন্দি করতে। চায় ধর্ম শুধু ব্যক্তির মনের মধ্যে থাকুক—রাষ্ট্রে, সমাজে, পোশাকে, আচরণে ধর্মের রঞ্জন দেখা না-যাক। মুসলিমগণও নিজেদের নব্য জাতীয়তাবাদি পরিচয় উপস্থাপন করতে গিয়ে সেক্যুলার হওয়ার কোনও গত্যন্তর পায় নি। সো...আরও দেখুন: জাতীয়তাবাদের বিবর্তন ও একটি মুসলিম দরদি মন
বিষয়টা অনেকটা ভারত বিভাগে ব্রিটিশকে দায়ী করার মতো। ব্রিটিশ কিন্তু ভারতকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার প্রস্তাব দেয় নি—দিয়েছে আমাদের মুসলিম নেতৃত্ব; যা দ্বিজাতিতত্ত্ব নামে খ্যাত। এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দল কংগ্রেসও প্রথমদিকে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের প্রবল বিরোধিতা করেছে। কিন্তু মুসলিম নেতাদের অবস্থা তখন এমন যে, যাদের আমরা ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের বীর সেনানী বলি, তারাও তখন ইংরেজ-তোয়াজে মশগুল। ব্রিটিশমুক্তির করার চেয়ে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে জরুরি ভেবেছে বেশি। এতটাই আকুল ছিল যে, ভারতের একদিন আগেই ভাইসরয়কে নিয়ে পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে।
এই যে কাশ্মির নিয়ে গণ্ডগোল, এটাকেই-বা কেনো ব্রিটিশদের চাল বলেন? ভারত-ভাগের সময় কাশ্মিরের নেতারা সিদ্ধান্ত ননিতে পারে নি যে, ভারতের সাথে যাবে নাকি পাকিস্তানের সাথে। পাকিস্তান অস্ত্রবলে কাশ্মির দখল করতে চেয়েছে, যেহেতু সেখানকার জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ মুসলিম। বিধিবাম। কাশ্মিরের রাজা সাহায্য চেয়েছেন ভারতের। বাকিটা সবার জানা।
অর্থাৎ হতে পারে ব্রিটিশরা সত্যিকার অর্থেই এ-অঞ্চলে একটা স্থায়ী সমস্যা চেয়েছে। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন তাদের আগ বাড়িয়ে করতে হয় নি—আমাদের নেতারাই পাটাতন গড়ে দিয়েছেন।
এইসব বললাম এই জন্যে যে, আমরা যে ‘উম্মাহ চেতনা’ নিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে মুসলিম দরদে মেতে উঠেছি—কাশ্মিরি কিংবা কাশ্মির রক্ষায় ভারতে যারা সরব, তাদের কতভাগ মুসলিম? কিংবা তারা আদৌ এই চেতনা নিয়ে ভাবেন কি না?
দেখুন— সম্প্রতি কাশ্মিরের দুর্ঘটনার পর সর্বপ্রথম (০৮ আগস্ট) যিনি সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রীর মুক্তি, কাশ্মিরের অচলাবস্থা কাটানো ও আর্টিকেল থ্রি-সেভেনটি রিভোক করাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন, সেই তেহসিন পুনাওয়ালা একজন স্বঘোষিত অ্যাথিস্ট। নিজের ফেসবুক আইডিতেও তিনি তা-ই লিখেছেন। এরপর কাশ্মীরে কর্মরত সাংবাদিকদের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করার জন্য ১৩ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করেছেন কাশ্মীর টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন। তার আইনজীবী প্যানেলে রয়েছেন ভ্রিন্দা গ্রোভার, সৌতিক ব্যানার্জি, প্রসান্ন এস, রত্না আপেন্দার ও সুমিকা হাজারিকা। কারা তারা খোঁজ নিন।
কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টে সর্বশেষ আবেদন ছিল (১৭ আগস্ট) সাবেক দুই সেনা কর্মকর্তাসহ ছয়জনের—সাবেক এয়ার ভাইস মার্শাল কপিল কাক, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহরা,স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জম্মু ও কাশ্মির বিষয়ক বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য রাধা কুমার, সাবেক আইএএস কর্মকর্তা হিন্দাল হায়দার তিয়াবজি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব গোপাল পিলাই এবং আন্তপ্রদেশীয় পরিষদের সাবেক সচিব অমিতাভ পান্ডে। এদের মধ্যে কেবল একজন মুসলিম।
আরও দেখুন—সরকারি সিদ্ধান্তকে একজোট হয়ে ভারতের ২০০ জনেরও বেশি বুদ্ধিজীবী নিন্দা জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে খ্যাতিমান হলেন—অমিতাভ ঘোষ, অমিত চৌধুরী, পেরুমল মুরুগান, টি এম কৃষ্ণা, পি সাইনাথ, অশোক বাজেপেয়ি, জেভি পাওয়ার, বেজওয়াদা উইলসন, শশি দেশপাণ্ডে, শরণকুমার লিম্বালে, দমোদর মাউজো, দালিপ কাউর তিওয়ানা, বামা, সাবভাজি ভাগাত ও জেরি পিন্টো। এরা সবাই অমুসলিম।
এ-পর্যন্ত এই কয়টিই ছিল কাশ্মিরের পক্ষে ভারতের ভেতর থেকে আসা সবচে’ শক্তিশালী প্রতিবাদ। মুসলিম দেশগুলো কী করছে তা তো দেখছেনই।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো— কাশ্মির নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ডাকা রুদ্ধদার বৈঠকে যিনি ভারতের পক্ষে (কাশ্মিরের বিপক্ষে) লড়েছেন, তিনিও একজন মুসলিম। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভারতের স্থায়ী দূত সৈয়দ আকবর উদ্দিন। তিনি সেখানে পাকিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে এ-ও বলেছেন— “নির্দিষ্ট উদ্বেগ হলো, জিহাদ শব্দটি ব্যবহার করছে একটি রাষ্ট্র এবং তাদের নেতাসহ ভারতে সন্ত্রাসে মদত দিচ্ছে।”দেখুন: চ্যানেল আই
এইসব বলার অর্থ হলো, কাশ্মিরকে শুধু চেতনার জায়গা থেকে না-দেখে রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে দেখার জরুরত বেশি। আর কাশ্মির যদি কখনও রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়ায়, তবে সেটা সেক্যুলার রাষ্ট্রই হবে—ইসলামি রাষ্ট্র তো নয়ই, মুসলিম রাষ্ট্রও নয়। এতগুলো ধর্মের সহাবস্থান নিয়ে তারা ইসলামি রাষ্ট্রের গঠনে যাবেই না। এবং তাতে সেক্যুলারিজমের প্রবক্তাদের চাপ দিতে হবে না—সেখানকার মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের নেতারাই স্বেচ্ছায় করবেন। আচ্ছা, কাশ্মিরি মুজাহিদিনের কাছে কি রাষ্ট্র গঠনের কোনও ফর্মুলা আছে, কিংবা তারা কখনও তা প্রকাশ করেছে?
এমনকি আফগানিস্তানে এই যে তালেবানের সাথে মার্কিন আলোচনার এত রমরমা, সেখানেও মধ্যস্ততা করছে ধর্মনিরপেক্ষতায় সিদ্ধ জার্মানি। সেখানেও আমেরিকানরা আফগান ছেড়ে যাবে ঠিক, অমনি তালেবানও গণতন্ত্রে ঢুকে পড়বে নিশ্চিত। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের মতো নেতারা নির্বাচনে আসছেন, এসেছেন, নতুন নির্বাচনের দাবি করছেন, তালেবানের ছায়া নেতৃত্ব গত নির্বাচনে সক্রিয় ছিল। গণতন্ত্র তো মোল্লা ওমরের ইসলামি এমারত দেবে না। সেক্যুলার রাষ্ট্র কাঠামোই বহাল থাকবে।
সুতরাং রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ধর্ম ফিট করতে যারা উদগ্রীব—তাদের এখান থেকে শেখার আছে। এমনিতেও আমরা যখন নিপীড়নের মুখে পড়ে বলি—এখন আমেরিকা কেনো কিছু বলে না, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেনো চুপ, জাতিসংঘ খেঢ়া হয়ে গেছে; এমনকি নিপীড়কদের ওপর তাদের প্রেসার দেখলে আপ্লুত হই—এসব নিশ্চয় এ-কারণে নয় যে, তাদের আমরা মুসলিম জাতি ভাই কিংবা ইসলাম-দরদি ভাবি। বরং তাদেরকে এমন প্রতিষ্ঠান ভাবি, যাকে পুরোপুরি ভিন্ন ধর্মীয় বলয়ে আবদ্ধ ভাবতে এখনও সংকোচ হয় এবং ভাবি তাদের কিছু করার আছে, চাই তারা ভিন্ন ধর্মীয় হোক, অথবা ধর্মই না-থাকুক। সুতরাং রোহিঙ্গা-মুসলিমদের দরদে ভাসা সত্ত্বেও যখন তাদের অর্থায়নের সিংহভাগ অমুসলিমদের হাত থেকে কিংবা ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে আসতে দেখি, আমরা ‘না’ করি না। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে উম্মাহ চেতনা তখন আমাদের ফিকে হয়ে আসে, ধর্মীয় পোশাক আলগা হয়ে যায়।
এটাই সেক্যুলারিকরণ। আমরা স্বেচ্ছায় তাতে ঢুকে পড়েছি—কেউ জোর করে নি। দুর্বলদের জোর করতে হয় না, মাথায় হাত বুলালেই প্রভুর ভালোবাসায় তারা উথলে ওঠে।...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ১০:৩৩