somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরে পেতাম যদি সেই দিনগুলো(....আব্বুকে)

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

আমবাগান মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছি...হঠাৎ দেখি আমার ঘুড়ি নাই...অন্য একটা ঘুড়ি এসে কেটে নিয়ে গেছে আমার ঘুড়ি.....তারপর শুরু হলো আমার কান্না(তখন আমি ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি)....
আমার কান্না দেখে এলাকার কেউ একজন আমার আব্বুকে গিয়ে বলেছিলো....
(তখন আমাদের একটা মুদীর দোকান/ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিলো যেটা খুব বেশী দুরে না)
তারপর শুনে আব্বু এসে বলে.....কি হয়েছে বাবা....?
আমার ঘুড়ি কেটে নিয়ে গেছে......
তাতে কি আয় আমার সাথে আয়.....পাঁচটা ঘুড়ি কিনে দেব সাথে দুই বান্ডিল সুতা.....
তারপর সেটা নিয়ে এসে কান্না থামলো....

২.

এলাকার মাঠে একটা ফুটবল টুর্ণামেন্টের ফাইনাল ছিলো.....আমার বায়না ছিলো আমি খেলা দেখবো...আব্বু এসে আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে দোকানে চলে গিয়েছিলো সাথে দু-তিনজনকে বলে গিয়েছিলো যাতে আমাকে দেখে রাখে ( অনেক পিচ্চি ছিলাম বলে)
তারপর নেট থাকার পরেও কিভাবে যেন বল এসে আমার গায়ে লাগে....আমি সাথে সাথে কাইত....তারপর খেলা বন্ধ...(মাহ্‌বুব সওদাগরের ছেলে বলে কথা) তারপর সবাই আমাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি......ততক্ষণে আব্বু এসে হাজির....
ভাগ্যিস আমার তেমন কিছু হয়নি....হালকা লিকলিকে শরীর ছিলো বলে বলের ধাক্কায় পড়ে গিয়েছিলাম এই যা....পরে আবার খেলা শুরু হয়েছিলো....আর আমিও ছিলাম তবে সাথে দশ-বারো জনের একটা বডিগার্ড টিম।

৩.

একবার তেতুল খাওয়ার লোভে এলাকার কিছু ছেলেদের সাথে চলে গিয়েছিলাম অনেক দুরে.....কোথাকার কোন একটা বিলে....দেখি ইয়াবড় তেতুল গাছ.....তারপর সবাই মিলে ঢিল ছুড়ে তেতুল পাড়াপাড়ি.....তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো...অন্ধকার চারিদিকে.....
বাসায় আসিনা দেখে.....আব্বু টেনশনে....শুরু হলো তল্লাশি....
তারপর আমি বাসায় আসামাত্র আব্বুর চিৎকার ....এতক্ষণ কোথায় ছিলাম.....
মাথা নিচু করে আমার সহজ সরল উত্তর....তেতুল পাড়তে গিয়েছিলাম...
পরেরদিন....আব্বু বাজার থেকে কেজি-দু'কেজি তেতুল নিয়ে এসে বলে খা...তেতুল খা...।

৪.

স্কুলে থাকতে ইংরেজীতে খুব একটা ভালো করতাম না....
তাই একদিন আব্বুকে বলি আমি আহমদউল্লাহ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়বো.....
আব্বু বলে ঠিক আছে....পড়াইতে বলো....সমস্যা তো দেখি না....
আমি বলি....উনি পড়ান না...
কেন?
স্কুলের হেড টিচার পড়াইতে দেয়না....
তারপর পরেরদিন আব্বু স্কুলে গিয়ে হাজির......
আমার ছেলে আহমদ উল্লাহ স্যারের কাছে পড়তে চাই......
হেড টিচার বলে.... এ আপনার ছেলে......সমস্যা নাই
আহমদ উল্লাহ স্যারকে আমি বলে দিবো আর সে তো চাইলে আমার কাছে ও পড়তে পারে......
যাইহোক, পরের সপ্তাহে সমস্যার সমাধান হয়েছিলো.....
আমি টেস্ট এবং এস.এস.সি'তে অনেক ভালো মার্ক পেয়েছিলাম পুরোটাই আমার প্রিয় শিক্ষক আহমদ উল্লাহ স্যারের কৃতিত্ব......।

৫.

তখন আমি কলেজে পড়ি...শীতকালে এমনিতে চারিদিকে পিকনিকের আমেজ। সেবার অনেক পিকনিকে(এলাকার বাইরে) গিয়েছি এবং এলাকাতেও (একটা মাঠ ছিলো) বন্ধুরা মিলে পিকনিকের আয়োজন করেছিলাম....পরপর কয়েকটি পিকনিকে যাওয়ার কারণে বাসায় রাতে খাওয়া হতো না......
একদিন রাতে আব্বুর সাথে খেতে বসেছি..... হঠাৎ আম্মু বলে কি ব্যাপার তোমার পিকনিক কি শেষ.....যাও যাও পিকনিক করে বেড়াও..যত্তসব
আব্বু বলে.....থাক্‌ না, কিছু বলতে হবে না.....এখনি তো এসবের সময়..ওরা এখন পিকনিক করবে না তো কখন করবে......(সেদিন আব্বু ঠিকই বলেছিলেন.....কেননা, এসব এখন শুধুই স্মৃতি)

৬.

ক্যান্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচ.এস.সি' পাশ করে ইচ্ছা হলো বাইরে পড়ব...কিনতু আব্বু চাই আমি চ.বি'তে পড়ি.....
যাইহোক, চ.বি'র ভর্তি পরীক্ষায় ৬৭ নাম্বার পেয়ে বি.বি.এ'তে চান্স পেয়েছিলাম....কিনতু আম্মুকে বলে দিয়েছি আমি দেশে পড়ব না...
কেন?
আমার সব বন্ধুরা বিদেশে চলে যাচ্ছে.....আমিও যাবো
দেশে যদি পড়তে বলো তাহলে আমি 'নর্থ সাউথ' এ পড়বো.....
আমার সহজ সরল আম্মু বলে সেটা আবার কি?
এটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি.....
না তোমার আব্বু পড়াবে না সেখানে....কেন?
আব্বু সারাজীবন শুনে আসছে চ.বি. কিংবা ঢা.বি'র কথা.....তার কথা দেশের এত ছেলে মেয়েরা এখানে পড়তেছে তাইলে আমার সমস্যা কি?
যাইহোক, পরে দুইসপ্তাহ অনশন করলাম(বাসায় কারো সাথে কথা না বলে)
তারপর আম্মু আব্বুকে গিয়ে বলেছিলো.....ও যখন বাইরে যেতে চাচ্ছে তাহলে ওর সাথে কথা বলে তো দেখতে পারেন....
তারপর আব্বু একদিন শুনলেন সবকিছু(হলবর্ন কলেজে আসার কথা বলেছিলাম)
আব্বু চেয়েছিলেন আমি বাইরে গেলে 'নিউ ইয়র্কে' যায় কারণ সেখানে আমার মামা থাকেন সো আমাকে দেখে রাখার কেউ আছেন....।
পরে আমার কথামতই লন্ডনে আসার জন্য সবকিছু রেডি করলাম...ভিসাও হয়ে গেলো তারপর চলে আসার পালা.....(তখনকার অনুভুতি ছিলো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত)

৭.
২০০২ সালের ৩০শে অক্টোবর লন্ডনে আসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম....
চট্টগ্রামের শাহ আমানত এয়ারপোর্টে যখন আসলাম আব্বুর চোখে তাকানো যাচ্ছিলো না...মনে হচ্ছে আব্বু এখুনি চিৎকার করে কাঁদবে...
চেক ইনের সময় হওয়াতে আব্বুকে বললাম...আসি..
আব্বু দেখি এবার কেঁদেই দিলো সাথে ছোট্ট বোনটাও....
ওদের সাথে আমিও কান্নার উৎসবে যোগ দিলাম.....
তখন মনে মনে ভাবছিলাম আরো কিছুক্ষণ সময় কি দেওয়া যায়না....
পরক্ষণে আব্বুকে বললাম.....আব্বু আমি যাব না চলো বাসায় চলে যাই বলে কান্না....
তারপর আব্বু বলে পাগলামো করিস না....লন্ডনে পড়তে তোর ইচ্ছে হয়েছে...যা গিয়ে ভালো একটা ডিগ্রী নিয়ে আয়...
আমি তোকে যেতে না দিলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।

এই হলো আমার আব্বু।

৮.

আমরা গ্রামে ছিলাম তাই বাসায় চট্টগ্রামের আন্চলিক ভাষায় কথা বলতাম...এখনও বলি..
অনেক শহুরে বন্ধুদের মত করে কখনো বলিনি কিংবা বলতে শিখিনি 'আব্বু তোমাকে অনেক ভালবাসি'

আমার আব্বু দারিদ্রের অভিশাপে বেশীদুর পড়ালেখা করতে পারেনি...তাই ছেলেমেয়েদের করিয়েছে এবং করাচ্ছেন সবচে ভালো স্কুল, কলেজে কিংবা প্রাইভেট পড়তে দিয়েছেন সবচে ভালো টিচারের কাছে।

আব্বু কোনদিন কিছুতে না বলেন নি...সবসময় আমার নিরাপত্তা নিয়ে টেনশন করবে..যেন আমি এখনো সেদিনের অবোধ বালক....এমনকি এখানে আছি পাঁচ বছরের বেশী হয় তাও বলবে...ঠিকমত চলাফেরা করো, পড়ালেখা করো, উল্টাপাল্টা কোন কিছু করো না...সময় করে নামাজ পড়বে....আমাদের জন্য চিন্তা করতে হবেনা, আমরা সবাই ভালো আছি।


৯.

আজ অনেক কিছুই নেই....
নেই সে ছেলেবেলার দুরন্তপনা....
নেই সেই মাঠ...যে মাঠে উড়িয়েছিলাম ঘুড়ি...সেখানে দাড়িয়ে আছে হাসপাতাল...
সেই বিল... যেখানে ছিলো তেতুল গাছ....সেখানে আজ মানুষের ঘরবাড়ি, উঠেছে দালানকোঠা...
সেসব বন্ধুরা যাদের সাথে পিকনিক করেছিলাম.....জীবন যুদ্ধে সবাই বড্ড ব্যস্ত....পড়ে আছে দেশে-বিদেশে (আমার মত)

এত সব না থাকার মধ্যে শুধু আছে কিছু স্মৃতি.....

সেসব দিনগুলোর কথা ইদানীং খুব মনে পড়ছে.....
মনে পড়ছে আমার আব্বুকে...
কেউ কি পারবে ফিরিয়ে দিতে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো....
যদি একবার ফিরে পেতাম....
চিৎকার করে বলতাম 'আব্বু তোমাকে অ-নে-ক ভালবাসি.... তুমি অনেক ভালো....তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ট আব্বু।


সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সকাল ৮:২৬
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×