somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ আমি কোথাও যাবো না

২০ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"বোজলেন হিমু ভাই, আল্লায় কাডের চশমা পইরা থাহে।এত্ত সোন্দর দুইন্ন্যা বানাইয়া, গরীব দিয়া ভইরা থুইছে।চাইর দিগে অভাব আর অভাব!চিন্তা করছেন,মায়-বাপে জন্ম দিয়া কষ্ট দেকতে পারে না।আর হেয় নিজ আতে বানাইয়া, কষ্ট করতে দুইন্ন্যায় পাডাই দেয়।আফনে কি কন?"

মজিদ মিয়া যখন উচ্চমানের ফিলোসোফি কপচাবে বুঝতে হবে, তার সংসারে সমস্যা চলছে।বিশেষ করে তার স্ত্রী-কন্যার কোন সমস্যা হয়ছে।যদি ধারণা ঠিক হয়, তবে আমি না বললেও সে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাবে।তাই চুপ করে রিকশায় বসে রইলাম।তার সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণ করাও সমস্যা, সে বকবক করতেই থাকবে।যত বকবক, সমস্যা তত জটিল।

আমি মজিদ মিয়ার বাসার গলিতে।গলির শুরুতে যে ঘরটা পরে সেখানে প্রতিবার একই ঘটনা দেখি।মহিলা তার জামাইকে গালি দিচ্ছে, "গাঞ্জা আমি তোর....... দিব(লেখার অযোগ্য), হারামির পো!মরতে পারস না।আর পারি না।" লোকটি মেঝেতে পরে আছে, লুঙ্গি ঠিক নেই,মুখে ফেনা, তবে নিঃশ্বাস চলছে।বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে, মনে হয় কাপড় নষ্ট করছে।দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, সেই একই ঘটনা।মহিলা গালি দিতে দিতে তাকে পরিস্কার করে খাবার দিয়ে অতি স্নেহে বোঝাবে এই বয়সে এসব খারাপ।আগেই দেখেছি, তাই চলে এলাম। মেয়েছেলেদের এই অতি আদর-ভালোবাসার জন্যই হয়তো পৃথিবী কয়েক আলোকবর্ষ টিকে থাকবে।

মজিদের ঘরের বিশেষত্ব হচ্ছে,এখানে ৫ জন মেয়ে নিয়ে সে সুখে থাকে।আগে যতবার এসেছি, দেখেছি তার বৌ রহিমা গর্ভবতি। এবার কোন বিশেষ কারণে হয়তো নিয়মের ব্যতিক্রম। রহিমা আমাকে দেখে বরাবরের মতই বললো, "হিমু ভাই, আপনে আইজ আইবেন আমি আগই জানি।দেহুইন কাইল রাইতেই বিরানি রাইন্ধা থুইছি।আহেন একলগে খাই।"

অরু,তরু, নিলু,বিলু আমাকে ঘিরে ধরলো। যতটা আমি আসার আনন্দে তার চেয়েও আজ বিরিয়ানি খেতে পারবে এই আনন্দে।কাল বিরিয়ানি রান্না হয়েছে, অথচ খেতে পারেনি এরচেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে।

অরু খুব চুপচাপ। আগের মত উচ্ছ্বাসটা আর নেই।সেই আগে জিজ্ঞেস করতো, "হিমু কাকা, রুপা কাকী ভালা আছেনি?হেয় এক্কেবারে পরীর লাহান!হের একটা কিসসা কইবেন!"

সবাই খেতে বসেছি।রবীন্দ্রনাথ কোনদিন নিশ্চয়ই বাসি বিরিয়ানি খাননি,তবে অবশ্যই বাণীতে বলতেন, বিরিয়ানি স্বাদ বাসি হইলে খুলিয়া যায়। অরু ছাড়া সবাই খাচ্ছে। মজিদ বললো, "অরু, আর ঢংয়ের কাম নাই, এইবার খা কইলাম।" সবচেয়ে আনন্দ করে খাচ্ছে ছোট মেয়ে লিলিথ।

মজিদের ৫টা মেয়েই পরীর মত। ক্লিওপেট্রাও নাকি কালো ছিলেন, এদের কোন খুত নেই। এতে মজিদ খুব খুশি হলেও, রহিমা খুব বিরক্ত। তার মতে সৌন্দর্য মেয়েদের জন্য অভিশাপ।

তার সবগুলো মেয়ের নামই রুপার দেয়া। লিলিথ নামটা চমৎকার, প্রথম বিদ্রোহী মেয়ের নাম।যিনি কিনা আদি পিতাকে বলেছিলেন, জনাব আমি মাটির তৈরি আর আপনিও। আমি আপনার নিচে শোবো কেন? এমন বিদ্রোহী স্বভাবের জন্য, আল্লাহ আবার মা হাওয়াকে তৈরি করলেন। নামের পিছনে রূপার যুক্তি, সে পঞ্চম মেয়ে তাকে টিকে থাকতে হলে বাকি ৪জনের সাথে বিদ্রোহ-যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হবে।

খাওয়া শেষ করে, বসে আছি অথচ অরু,তরু,নিলু,বিলু কেউ গল্প শুনতে আসছে না, এটা নিয়মের ব্যতিক্রম। চুপ করে বসে রইলাম, দেখি আর কি কি অনিয়ম হয়।

রহিমা মিষ্টি পান হাতে দিয়ে বলল,"হিমু বাই,অরুরে বড়লোক বাইতে কামে দিছিলাম।পলাইয়া আইছে।মাইয়া খালি কান্দে, কিছুই কয় না।খালি কয়, আপনের লগে কইবো। আপনে একটু জিগাইবেন, কি অইছে।আমি বুজি, কি অইছে!তয় নিশ্চিত অইবার চাই।কি কমু বাই, সোন্দরের কি জ্বালা আমি বুজি।মনে অয়, মাইয়াগুলারে মাইরা নিজেও মইরা যাই।"

মজিদ দাত খিচিয়ে বলল,"কিছুই অয় নাই।তর মাইয়া ঢং করে।একখান চড় দিলেই ঢং বাইর অইব।"
রহিম বললো,"খবরদার মাইয়ারে মারতে পারবা না।এক মিনিটেই তো বাপ অইছ, পেটেধরার জ্বালার তুমি কি বুঝবা!রাইতে তো শরমের বালাই থাহে না।একবার ভাবছো, মাইয়াগুলার জীবন কেমনে যাইবো?"
এত রাগ-অভিমান নিয়েও মজিদ-রহিমা কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না,বাকিটা জীবন একসাথেই কাটাবে।অথচ অতিশিক্ষিত, কথিত সুশীলগণ যারা জীবনে সব পেয়েছে তারাও একসাথে সারা জীবন সংসার করতে পারে না। মজিদ-রহিমার কি আছে, যা তাদের নেই?

অরু একটা কাগজ কুটিকুটি করে ছিড়ছে।আমি পাশে বসে চুলে বিলি কাটলাম। মেয়েটা রুপার মত রুপ পেয়েছে, তবে চুলগুলো লালচে তাই টেইলর সুইফটের মত দেখায়। অরু আমার দিকে না তাকিয়েই বললো, "হিমু কাকা আপনে যাই বলেন।আমি আর ঐ রাড়িতে যাবো না।আমারে রাতে জ্বালায়,ঘুমাইতে পারি না।টয়লেটে গিয়ে বসে থাকি।" আমি অবাক হয়ে বললাম, অরুরে তুইতো শিক্ষিত হয়ে গেলি।ফটফট করে শুদ্ধ ভাষা বলছিস।

অরু দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো, "কাকা আরও মেলা কিছু শিখছি।ঐ বাসায় একটা ভাইয়া ছিল, কি যে সোন্দর। তয় চশমা ছাড়া কিছুই দেহে না, আর সারা দিন পড়ে।আমারে কইছে পড়ালেখা শিখাইবো।সারাদিন গান শুনে।গান শুনলেই মন খারাপ হয়ে যায়।তয় আমি কইলাম আর যামু না।"

আমি বললাম,"থাক যেতে হবে না।তুইতো শিক্ষিত হয়েই গেলি, আর যাবার দরকার কি? চল তোকে একটা বাসায় নিয়ে যাই, তুই বড় হয়ে যেমন হবি দেখবি তেমনি একজন সেখানে আছে।"
অরু খিলখিল করে হেসে উঠলো,"হিমু কাকা যে কি কয়? সত্যই এমন মানুষ অহনি আছেনি!তয় লন, দেহি গিয়া।"

আমি অরুর হাতে চিঠিতে লিখে দিলাম,

অরু মেয়েটি অল্প বয়সেই পৃথিবীর নিকৃষ্ট অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে গেছে।তবে দারুণ গান গায়।
---হিমু

অরুকে রুপাদের বাসায় ঢুকিয়ে দিলাম।রুপার রুমের বারান্দা থেকে রাস্তার পুরোটাই দেখা যায়, কেবল বকুল গাছের জন্য দেয়ালের একটা অংশে কিছু দেখা যায় না।আমি সেখানেই দাড়িয়ে আছি।কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো জানি না।রূপা অত তাড়াতাড়ি বারান্দা ছেড়ে যাবে না,আর বকুল ফুলের গন্ধও দারুণ লাগছে।

:অরু, অরু, হিমু তোর সাথে এসেছিল?
:জ্বী কাকী, হিমু কাকায় গেটেই দাড়িয়ে ছিল।আমিতো কাকারে দেখতে দেখতেই ঢুকলাম।

:তাহলে হিমু এতদ্রুত কোথায় গেল?
: মায় বলে, হিমু কাকা হইলো ফেরেশতা। বিপদে পরলে উড়ে আসে, আবার বিপদ শেষ হইলে উড়ে চলে যায়। মনে হয়, উইড়া গেছে!

আমি রূপার দীর্ঘশ্বাস এখান থেকেও অনুভব করতে পারছি।গৌতমবুদ্ধ মায়া ত্যাগ করতে পেরেছিলেন, আমিও পারবো।

অরু গান ধরলো,
"আগের জনম গেল বৃথাই তোমারই আশায়
এই জনমে থাকবো নাহয় তো তোমার বাসনায়...."
সোলস্'র পার্থ বড়ুয়া এই গলা শুনলে লজ্জা পেতেন।ভাবতেন, ভালোই হয়েছে আর গান করছি না।আলতু-ফালতু অভিনয়ই আমার সাজে।

আজ আমি কোথাও যাব না।আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম।আজ পূর্ণিমা, আমি আর রুপা একসাথে চাঁদ দেখবো।
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×