somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পড়ে পাওয়া

২৪ শে মার্চ, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১...
"আমি যাইতাম না, তুমরা যাও। আমার সুপারি, নারকেল, ঝাপকাঁঠালী কলা মাইনশে নিব, আর আমি কাজাইকাটা বইয়া থাকমু? আমার মুরগি, ছাগল কেডা দেখব?"
ছফিনা বেগম আর কথা বাড়ান না, কাজে মন দেন। ছোটখাটো এই মহিলার কথার দাম অনেক। একবার বলেছেনতো বলেছেনই! কথা আর পাল্টাবেন না।
মিনি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। কি বললেন, কিছু বললেই তর্ক করা হবে।
উনি চোখ গরম করে বলবেন,"বউ, আমার লগে তর্ক করবা না।আমি তোমারডা খাইনা, পরিয়ো না। আমার লগে চোখ গরম করবা না!"
সোহাগ আবার এই কথা ওর বাবা কাছে বলে দিবে। আর শুরু হবে মারামারি। এই বাড়ির দুই ছেলেই আশ্চর্য মা ভক্ত। সোহাগ মিনিরও ভক্ত, তবে কেবল রাতে।

মিনি সোহাগকে আদর করে বলে,"আব্বা, তুমি সব কথা তুমার বাপেরে কইয়া দেও কেন, দেখ না তুমার বাপে আমারে মারে!"
সোহাগ মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,"আম্মা, আর কইতাম না।" সকালেই সব ভুলে যায়। মিনি ছেলেকে শাস্তি দিতে চান, পারেন না। আগের মেয়েটা মারা গিয়েছে, এরপর সোহাগ হয়েছে ঠিক এতটুকু বিড়াল ছানার মত।অমন ছেলে কে মারা যায়?

সব দ্রুত চলে যায়, সোহাগ বড়ও হচ্ছিল। ওর শরীরের তুলনায় বুদ্ধি বেশি। কি গুছিয়েই না বাবার কাছে মায়ের নামে নালিশ করে! মিনি অবাক হন। ছেলেকে আদর করতে চান,ছেলে আদর নেয় না। চুমু দিলে বলে,আমার কাতুকুতু লাগে; চুল আচড়ে দিতে গেলে বলে, "তুমি কাহোই দেও বুবু আচড়াইয়া দিব।" মিনির মন ভরে না।
সোহাগ সারাদিন ছফিনা বেগমের সাথেই টইটই করে ঘুরে, রাতে ঘুমায়ও। তবে মাঝরাতে মায়ের জন্য কান্না জুড়ে দেয়। মিনি সারা দিনের অবহেলা ভুলে যান, উনার অহংকার হয়। শিক্ষা হইছে বুড়ির!

মিনি চলে যান না। দূরেই দাঁড়িয়ে থাকেন।
সমস্যা হল, ছফিনা বেগম না গেলে ছেলেও যাবে না। এই ভরা বন্যায় কোন মা ছেলেকে একা ফেলে যেতে চায়?
"আম্মা, আপনে না গেলে সোহাগও যাইত না।"
"ওর যাওন লাগতো না। ও আমার লগেই থাহুক।তুমি যাওগা। পাতাম, কামরুল, মেঘা আছে। ওরা থাকতে আমার অসুবিধা কি! বকুলরে কইবা, প্রত্যেক দিন সালুন বেশি কইরা দিতে, যাতে ৫ জনের খাইতে অসুবিধা না অয়।"
মিনি আর কথা বাড়ান না। স্পষ্টভাষী এই বুড়িকে সবাই খুব ভয় পায়, অথচ ইনি কখনো রাগেন না। মিনি মন খারাপ করেই চলে যাচ্ছে। আশ্চর্য! সোহাগ তারই ছেলে, অথচ ছেলের প্রতি তার কোন জোর নাই।

নৌকায় চড়ে মিনি, সাত্তার, রুবা, শিউলি, সবুজ এরা সবাই চলে যাচ্ছে। নারকেলগাছ, সুপারিগাছ, কলাগাছ ঘেরা বাড়িটার চারপাশে পানি থৈথৈ করছে। দূর থেকে ঠিক দ্বীপের মত লাগে। নৌকা যত দূরে যায়, দ্বীপটা তত ছোট হতে থাকে। এক সময় বিন্দুর মত মিলিয়ে যায়। যতক্ষণ সোহাগকে দেখা যাচ্ছিল, মিনি তাকিয়ে ছিলেন। এখন আর দেখা যাচ্ছে না, মিনি তবুও তাকিয়েই আছেন।

২....
এই বছরের বন্যা ৮৮'র বন্যাকে হার মানিয়েছে। দুধেরচড় গ্রাম প্রায় পুরোটাই ডুবে গিয়েছে, যে যার মত টান অঞ্চলের আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছে। যাদের অমন আত্মীয় নেই, তাদের যায়গা হয়েছে কুটেরচড় জনাব আলী চৌধুরী দাখিল মাদ্রাসায়। এখানে থাকার সুবিধা খুব বেশি অসুবিধা নাই, তবে খাবার পাওয়া যায় না। এতগুলা মানুষের জন্য একবেলা শুকনা রুটি আরেক বেলা আটার গুলগুলি দেয়া হয়। কপাল ভালো থাকলে গুলগুলিতে চিনি দেয়া থাকে। যখন নছিমনে করে গুলগুলি নিয়ে লোক আসে, মাদ্রাসার ছোট মাঠটায় পিপড়ার মত মানুষ জমে যায়। যারা পাশে থাকে সবাই চলে আসে।

ছফিনা বেগমের খুব বেশি কাজ নেই। নামাজ-কোরআন পড়া আর বাকি সময় বাড়ির পিছনে কলাগাছের ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে নিরুদ্দেশে তাকিয়ে থাকা। উনার তন্দ্রা ভাঙে সোহাগ,"বুবু, তুমি কি কাক্কুমনির লেইগা চাইয়া রইছ? বানের পানি যেমনে বাড়ছে কাক্কুমনি বাড়ি আইবার পারবোনি!"

সোহাগের কাক্কুমনি সারোয়ার জাহান আনন্দ মোহন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ছফিনা বেগমের প্রতি বড়ছেলে সাত্তার যতটা উদাসীন, ছোটছেলে ঠিক ততটাই সতর্ক! আসলে সাত্তারের কোন কিছুর দিকেই অত মনোযোগ নাই, আজ যাত্রার নাটক করছে তো কাল দল বেধে মাছ ধরতে যাচ্ছে, পরের দিন বেড়াতে চলে যাচ্ছে দূরে কোথাও।
ছফিনা ছোট ছেলের পথ চেয়েই অপেক্ষা করেন। বাড়ি থেকে নারায়ণখোলা বাজারের পুল দেখা যায়, পথে কেউ তাড়াহুড়ো করে হেটে আসলেই তিনি ভাবেন সারোয়ার আসছে! সারোয়ার আসে না, উনার মন পোড়ে!

ছফিনা বেগমের রাতে ভয় হয়, খুব ভয় হয়। ঘরে অত টাকা নাই, তবে গয়না আছে, কেউ জানতে পারলে সর্বনাশ হবে।বাণ ডাকলে মানুষের অভাব বেড়ে যায়, কিছু লোক ডাকাতিতে নেমে পরে। ঘরে ব্যাটা মানুষ নাই, সোহাগ নিতান্তই শিশু।
অবশ্য পাতাম, কামরুল, মেঘা আছে। এদের বিশ্বাস করা যায়।

তবে কখন অঘটন ঘটে যায়, কে জানে?
ঘরে যা আছে, সেগুলা এদের জন্যই। পাতামের ছেলেটার পা ভাঙা, তিনি কথা দিয়েছেন হাসপাতালে নিয়ে যাবার টাকা দিবেন। নিয়ে যাবে কে? অবশ্যই সারোয়ার।
মেঘার মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না। মেয়েটা একটু ট্যারা। তিনি কথা দিয়েছেন বিয়েতে ১০০০ টাকা দিবেন, আর দিবেন বিয়ের শাড়ি। সারোয়ার ছাড়া ময়মনসিংহ থেকে শাড়ি কে কিনে আনবে?
কামরুল ছোটবেলা থেকেই এ বাড়ি কাজ করে। সে বিয়ে করবে, ছফিনা বেগম তাকে জমি দিয়ে ঘর তুলে দিবেন। এসব কাজই সারোয়ারকে করতে হবে।সাত্তারের বিশ্বাস কি? হাতে কাঁচা টাকা পেলেই সে তাস খেলা শুরু করবে!নয়তো কয়েকদিনের জন্য উধাও হয়ে যাবে। ফিরে এলে ছফিনা বেগম কিছুক্ষণ বকবেন, সাত্তার একটা কথাও বলবে না। মাথা নিচু করে থাকবে, চোখ থেকে টপাটপ পানি পরতে থাকবে। অমন ছেলেকে কি ফিরবার বকা দেয়া যায়!

৩....
প্রতিদিনের মত ছফিনা বেগম পুবের সড়কের দিকে তাকিয়ে আছেন। সারোয়ারের দেখা নাই। আজকে জুম্বাবার আসলে আসতেও পারে। কিভাবে আসবে সেটাই হল চিন্তার বিষয়।

পাতাম নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
: কিরে পাতাম, কিছু কইবি? চুপ কইরা খাড়াইয়া রইছস ক্যা?
: ফুপু, পুলাডা বেদনায় কষ্ট পায়। কান্দে আর কয়,"আব্বা, আমার ঠেংগে কুটকুট কইরা কামড়ায়।" আমি অহন কি করমু?

ছফিনা বেগম আস্তে আস্তে হেঁটে ঘরে আসেন। সিন্দুক খুলে পাতামকে কিছু টাকা দেন, আর বাজারের ব্যাগ দেন।
: যা, বাজারে যা। পুলার লেইগগা বেদনার অষুধ , সবজি আনবি, সোহাগ জিলাপি খাইতে চায় ঠাহর কইরা আনবিই। আর নৌকা লইয়া যা, সারোয়ারের লেইগগা মেলাক্ষণ খাড়াইবি।আইজকা জুম্বাবার, ও আবার পায়। ও আইলে কালই তর পুলারে লইয়া মেডিকেলে যাবি।
: ফুপু, আরেকটা কতা আছিল।
: ক, হুনি।
: কামরুল বিয়া করনের লেইগা পাগল হইছে। কাইল হাটবার দোকান থেইকা লাল শাড়ি কিনছে। আমারে তোমার কাছে কইতে কইছে।
: আইচ্ছা, মাইয়া তো পছন্দই আছে। যদি ঘর তুলার কামলা পাস, বিয়া করাইয়া ফালামু।

তিনি আরও কিছু টাকা পাতামকে দেয়ার জন্য সিন্ধুক খুললেন। পাতাম দেখার চেষ্টা করলো ভিতরে কি আছে। ঠিক পারলো না, ভেতরে অন্ধকার!
: নে, এই টেকা কামরুলরে দিবি। কইবি ঘর তুলার কামলা লাগাইতে। আমি চাইছিলাম, অর বিয়াত মানুষ খাওয়ামু। ও এত উতলা হইছে! এই বাণের মইধ্যে কিয়ের অনুষ্ঠান! হারামজাদারে এমনেই বিয়া করাইয়া আনমু।
: ঠিক কথা কইছেন ফুপু। ফুপু, আপনের সিন্ধুকে কি আছে দেখবার মন চায়।
: কিছুই নাইরে, সাত্তার সব উড়াইয়া দিছে। তর পুলার চিকিৎসা, কামরুলের ঘর,বিয়া, মেঘার মাইয়ার বিয়া ঠিকঠাক দিবার পামু কিনা কেডায় জানে? কাইলকা বাজারতে স্যাকরা আনবি, কয়েকটা গয়না বেচমু। অহন বাজারে যা, হাইঞ্জা অইল।

বিছানায় সোহাগ ঘুমাচ্ছে। ছফিনা বেগম নাতির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
উনার বুক ধরফর করছে কেন? নাতিকে মিনির সাথে দিয়ে দিলেই পারতেন, এখন আফসোস হচ্ছে। তিনি অযু করলেন, নফল নামাজ পড়বেন। বুক ধরফর করলেই তিনি নফল নামাজ পড়েন।

৪....
বান ডাকলে ম্যালা সুবিধা, পরের বৎসর ফলন ভালো হয়, মাছ পাওয়া যায়, ময়লা সব ধুয়ে যায়, ক্ষেতের ইন্দুর মইরা যায় আরও কত কি! তবে সব চেয়ে বড় অসুবিধা অইল, ল্যাট্রিনে যাওয়া। গ্রামে ল্যাট্রিন তৈরি করা হয় অনেক দূরে, ক্ষেতের কাছাকাছি। বাণ ডাকলেই ল্যাট্রিন ডুবে যায়।

বাড়ির ল্যাট্রিন ডুবে গেছে। ছফিনা বেগম নৌকা নিয়ে দূরে চলে যান। আজকে নৌকা নাই, তিনি ভেলা নিয়ে দূরে চলে যাচ্ছেন৷ কোন নীরব জায়গা নাই। সব জায়গায় পুলাপানের দল ঝাঁপাঝাপি করছে। তাদের সামনে তো আর এগুলা করা যায় না। পাশেই একটা পাট ক্ষেত আছে, সেখানেও যাওয়া যায় না। গাছে দলে দলে বিছা, আর সবুজ পক্ষীরাজ সাপ জড়িয়ে থাকে। এই সাপ নাকি উড়তে পারে, তবুও কেন পাট গাছে জড়িয়ে থাকে? ছফিনা বেগম সাপ অত ভয় পান না, হুস হুস করলে সাপ চলে যায়। বিছা যায় না, তিনি বিছা ভয় পান।

তিনি পুলাপানের দল থেকে একটু দুরেই গেলেন। এখানটা ফাঁকা, কোন আড়াল নাই। তবে ঘরবাড়ি থেকে ম্যালা দূর কেউ কিছুই দেখতে পাবে না। তিনি কাজ সেরে পানি ব্যবহার করলেন। আশ্চর্য ব্যাপার! তিনি যে পানিতে কাজ করলেন, সে পানিতে পাক হলেন। হাদিসে আছে, যেখানে এক মণ পানি আছে সে পানিতে ময়লা থাকলেও সেইটা পাক পানি।

তিনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বৈঠা হাতি নিয়েছেন, বাড়ির ঘাটে ফিরবেন। পুবে দেখতে পেলেন একটা কালো বাক্স, সিন্ধুকই হবে হয়তো। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন, আগে বক্সটা কাছাকাছি আসুক।
হ্যা, একটা সিন্ধুক। কালো কাঠের উপর জব্বর নকশা করা সিন্ধুক।

ছফিনা বেগম সেটা ভাসিয়ে ঘাটে নিয়ে এলেন। এসেই দেখলেন সোহাগ দাঁড়িয়ে আছে, সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
: বুড়ি তুই কই গেছিলি? আমি তরে খুঁইজা পাই না।
: ও আল্লাহ, এই জন্য তুই কানবি? পুলা মানুষের কান্দন লাগে না।
: আমি মনে করছি তুমি মইরা গেছ, আমি না কাইন্দা কি করমু? তুমিতো জানই না, ঐ বাড়ির এক বেডারে হাপে কামড়াইছে। পুব পাড়ার এক গেন্দা বাণের পানিত ভাইশা গেছে! মায়ে লইয়া হুতছে, বিয়ানে দেহে গেন্দা নাই। আমি তুমার লেইগগা হেই জইন্যই কানছি।
: আয় দাদা, আমার বুগল আয়৷ তরে আদর কইরা দেই।
তিনি নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে, গালে চুমু খেয়ে আদর করে দিলেন।
: বুবু, এই সিন্ধুক কার?
: হেইডা জানি না। নে ধর, দেহি দুইজনে তুলবার পারি কিনা।
তারা দুজনে অনেক টানাটানি করলেন, সিন্ধুক পাড়ে তুলতে পারলেন না৷ অনেক ভারী। অগত্যা দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বেধে রাখলেন যাতে স্রোতে ভেসে না যায়।

৫....
মেঘা, কামরুল, পাতাম মিলে সিন্ধুকটা ঘরে তুলে রাখলো। বেশ ভারী, সেগুন কাঠের সিন্ধুক। গায়ে নকশা করা, লতাপাতার নকশা না; মালুদের দেবদেবীর নকশা করা। কালো চকচকে রঙ করা সিন্ধুক। এদিকে তখন কালো রঙ করার চল আসে নাই। কার বাড়ি ডুবলো, কার সিন্ধুক ভেসে এলো?
কামরুল কৌতুহল লুকিয়ে রাখতে পারলো না।
: দাদী, লন সিন্ধুক ভাইঙা দেহি এর মইদ্যে কি আছে।
: হের কাম নাই। তুই টেকা পাইছস? ঘরের কাম শুরু কর। ঘর তুইলাই তর বিয়া।
: হ, দাদী। কাম শুরু করছি।

মেঘা, পাতামেরও ইচ্ছে ছিল দেখার ভিতরে কি আছে। নকশা দেইখা মনে হয়, মালাউনদের সিন্ধুক। মালাউনদের সিন্ধুকে সোনা ছাড়া আর কিছুই থাহে না।
যেহেতু ছফিনা বেগম না করেছেন, তারা আর কথা বাড়ালো না। খেতে বসলো, আজকে খানা ভালো; কুইতরের বাচ্চা ভূনা, নাইল্যা পাতা ভাজি আর কাতলার মাথা দিয়া কালো ডাল!

খাওয়া শেষে কামরুল নিজের ঘরে চলে গেল। সে ছাত্তারদের বাড়িই থাকে। পাতাম, মেঘা যার যার বাড়ি চলে যায়।

একটুপরই পাতাম, মেঘা কামরুলের কাছে ফিরে এলো। কামরুল বিরক্ত, কাল ম্যালা কাম বাকি। যত তাড়াতাড়ি ঘর তুলবে তত তাড়াতাড়ি তার বিয়া।
: পাতাম কাকা, আইজকা আমার গরে তামুক খাইবার দিতাম না। দাদীর হাপানী, জানো না! দাদী তামুকের বাসনা পাইলে কাশে। তুমরা বাইতে যাও।
: আইজকা তামুক খাইবার আসি নাই, আইজ অন্য কাম। তুই সাথে থাকলে ভালা, আর না থাকলে নাই। মেঘা ভাই, আমি কি কমু, তুমিই কও।

মেঘা ফিসফিসিয়ে কথা শুরু করলো।
: কামরুইল্যা, আমরা সিদ্ধান্ত লইছি, সিন্ধুকে কি আছে দেখমু।
: দাদী রাজি হইব না। দাদী কইছে, যার সিন্ধুক হেরে ফেরত দেওন লাগবো। কাইলকা মজিদে মজিদে মাইক মারবো, যার সিন্ধুক হেয় আইসা নিয়া যাইবো।
: সেইডার বুদ্ধিও আছে। ঘরে দুইডা সিন্ধুক_একটা কুড়াইয়া পাইছে আরেকটা ছফিনা ফুফুর। আমরা দুইডাই ভাঙমু!

কামরুল ভীত হয়ে পরে।
: তুমরা কি কইবার চাও? ছফিনা বুবু বাইচা থাকতে রাজি হইব না।
: হেরে মাইরা ফালামু!

এবার পাতাম কথা বলে।
: তুই চিন্তা কর, এই বাড়িতে কাম কইরা লাভ কি? কুন লাভ নাই। যা টেকা পাওন যাইব হেইডা দিয়া তর বিয়া, মেঘা বাইয়ের মাইয়ার বিয়া, আমার পুলার চিকিসসা কইরাও ম্যালা টেকা থাকবো।
: সিন্ধুকে যে টেকা আছে তুমরা জানলা কেমনে?
: আমি নিজের চৌক্ষে দেকছি, বুড়ির সিন্ধুকে ম্যালা টেকা, আর গয়নাতো আছেই।
: গয়না নাই, গয়না দাদী কাইল স্যাকরারে দিয়া দিছে।
: ধুর বলদ, সব দিছেনি?

আবার মেঘা কথা বলে।
: মনে কইরা দেখ, ফির বৎসর মোড়ল বেডায় একটা সিন্ধুক পাইলো উজানে। কি আছিল কইছে আংগরে? কয় নাই। হেরপর থাইকাই মোড়লের কাড়িকাড়ি টেকা। আগে আংগর মতন ক্ষেত কাম করতো অহন গেরামের মোড়ল হইছে!
: আমার মাতা কাম করতাছে না। দাদী আমারে ম্যালা আদর করে।
: রাখ তর আদর! সারা জীবন মাইনশের কাম করবি? তর পুলাপানও এই বাড়ির কামলা খাটবো?

পাতাম আরও উৎসাহ দেয়।
: সিন্ধুকে মালাউনের নশকা! যেই নশকা করা, এই সিন্ধুক ধনী মাইনশের না হইয়া যায় না! আংগর দেশের মাইনশে এই সিন্ধুক বানাই নাই। এই সিন্ধুক বডার ঐপার থেইকা আসছে, সন্দেহ নাই। নশকা দেইখা মনে লয় রাজা-বাশশারও অইতে পারে। তুমি কি কও মেঘা বাই?
মেঘা মাথা নাড়ে।
: যার করবার আইজকাই করন লাগবো। সাত্তার বাইতে আইলে করন যাইবো না।

কামরুল রাজি হয়ে যায়। যা পাওয়া যাবে, সব তিন ভাগ হবে।
আকাশে সজাগ চকচকে চাঁদ, প্যাচা ডাকছে নাকি কাঁদছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবে জেগেই আছে। চিরচির করে বয়ে চলে বাণের পানিও হয়তো জেগে আছে, জেগে আছে বিরামহীন ডেকে চলা ব্যাঙ আর ঝিঝি পোকার দল। অথচ কেউ জানতেও পারলো না, কি যুক্তি তারা করলো?

৬....
তিনজন উত্তেজিত মানুষ বড় ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কামরুল দাঁড়িয়ে পরলো, মেঘা তাকে হাত ধরে টেনে আনলো। এটাই সুযোগ, জীবনে সুযোগ বারবার আসে না।

ঘরের দরজা ভাঙতেই ছফিনা বিবি চিৎকার দিয়ে উঠেন,"কামরুল, ঐ কামরুল! ঐ কামরুল্যা! মরছস নাহি?"
বিছানার কাছেই হারিকেন জ্বালানো থাকে, হারিকেনের সলতে বাড়ি দিতে দিতে মেঘা আর পাতাম তার টুটি চেপে ধরে। ছফিনা বেগমের হাপানী আছে, তিনি আর উচ্চবাচ্য করতে পারেন না। বুড়ির পায়ের দাপাদাপিতে সোহাগ জেগে যায়।
ও তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। কামরুল তাকে কিছু একটা করে, সে আর টু শব্দটিও করে না।
মেঘা সিন্ধুকের চাবি চায়।
ছাড়া পেয়ে ছফিমা বেগম হিসহিসিয়ে বলেন,"কি করতাছস তরা? তরা কি করতাছস? আমার লগে এইগুলা করিস না!ছাত্তার তগেরে ছারতো না।"
পাতাম উনার গলায় ডেগার ধরে বলে,"জানলে পরে তো।"
ছফিনা বেগমের কলিজা শুকিয়ে যায়। তিনি কথা বলতে পারেন না। সিন্ধুকের চাবি দিতে দিতে বলেন," আমার সিন্ধুকে কিছুই নাই। তরা মাতাডা ঠান্ডা কর, আমার নাতিডারে ছাইড়া দে।"
মেঘা চাবি নিয়ে সিন্ধুদের দিকে চলে যায়। পাতাম কুড়িয়ে পাওয়া কালো সিন্ধুকটা ভাঙতে থাকে।

বাইট্টা পাতামকে আজকে আরও ছোট দেখা যায়। অতিউৎসাহী ওর চোখদুটো আরও ছোট হয়ে আসে। খাটো ফরশা মেঘার মুখে বসন্তের দাগগুলো আজকে আরও স্পষ্ট হয়।বিশালদেহী কামরুল যখন সোহাগের গলায় পোজ দেয়, ওর হাতও কেঁপে যায়। ওদের বীভৎস দেখায়, কে বলবে ওদের? কেউ কি দেখতে পাচ্ছে? হ্যা পাচ্ছেন, সৃষ্টিকর্তা। উনি সব দেখতেই পান, কিছুই করতে পারেন না বা করেন না!

ঘরে জমাট বাধা অন্ধকার, একটা হারিকেন নিয়ে তারা নিজেদের সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যস্ত। কিছু সময় চলে যায়, ছফিনা বেগমের পায়ে গরম কিছু লাগে। তিনি হাতড়িয়ে হাত নিজের চোখের সামনে আনেন।
ও আল্লাহ! হাতে তাজা রক্ত! তিনি চিৎকার জুড়ে দেন," হারামীর বাচ্চারা! ত্বরা করছসডা কি? আমার দুধের নাতিডারেও........."
তিনি কথা শেষ করতে পারেন না, পাতাম হুট করে গলা ব্লেডের পোছ দেয়। বুড়ি হাত-পাও নাড়ে না।
গলাকাটা দাদী-নাতি বিছানায় পরে থাকে! ঘর থেকে একটা খুনের ধারা বাণের পানিতে চলে যায়।

মেঘা বুড়ির সিন্ধুক খুলতে পেরেছে।সব খুঁজে, দেখে মেঘার ফরশা মুখও কালো হয়ে গেল!
ছফিনা বিবির সিন্ধুকে কয়েকটা খুচরা পয়সা ছাড়া আর কিছুই নাই। আছে আছে, আরও বেশ কিছু জিনিস আছে_ মেঘা, কামরুল লেখা দুইটা ব্যাগে দুইটা লাল শাড়ি, স্বামী হুরমুজ আলীর কয়েকটি ছবি, কয়েকটা পুরনো শাড়ি, শুকনো সুপারি, কাঁচা কলা, আর দুই প্যাকেট টোস্ট বিস্কুট আরও কত কি!
মেঘা প্রাণপণে আরও কিচ্ছুক্ষণ হাতড়ালো। ধুর! আর যাই থাকুক নগদ টাকা পাওয়া গেল না!

পাতাম কালো সিন্ধুক ভাঙলো। সিন্ধুক খুলতেই কামরুল হারিকেন নিয়ে এগিয়ে গেল। ডালা খুলে ভিতরে তাকিয়েই দুজনে 'ও বাবাগো' বলে দু'হাত দূরে মাটিতে বসে পরলো।

সিন্ধুকে কি আছে দেখার জন্য মেঘাও এগিয়ে এল। কি দেখলো কে জানে? সে দু'হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো।

মুয়াজ্জিন আযান শুরু করতেই অন্ধকার কেটে যেতে লাগলো। একটা ভয়াবহ সুযোগের রাত চলে গেল।
সিন্ধুক দুটো ঠিকই খুলেছে, কিন্তু মেঘা,কামরুল, পাতামের ভাগ্য খুলে নাই। তাতে কি? চেষ্টা করতে তো দুষ নাই! তারা সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। বাণের পানি কিছুটা রঙিন হয়েছে, এটাই কম কি?

কালো সিন্ধুকে কি পাওয়া গিয়েছে?
তবে টাকা-গয়না পাওয়া যায় নাই, এটা নিশ্চিত।
ঘরে এখন ছয়টা লাশ, তিনজন জীবন্মৃত!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৮
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×