আগের পর্বের লিংক
কিরপিনের থাইল্যান্ড ভ্রমন (দ্বিতীয় পর্ব)
কিরপিনের থাইল্যান্ড ভ্রমন (প্রথম পর্ব)
আজকের এরোপ্লেনঃ
আজকের পরিকল্পনা কাঞ্চনাবুরি যাবো। ওখানে মূল দর্শনীয় কোয়াই নদীর উপর ব্রিজ। এছাড়া আশ-পাশে কম খরচের মধ্যে যা আছে দেখার ইচ্ছে। ফিরে এসে সন্ধ্যায় ট্র্যাং এর ট্রেন ধরবো, কাল সকালে ট্র্যাং পৌছাবো। । কোয়াই নদীর ব্রীজের উপরে জুন আপার একটা পোস্ট আছে লিঙ্ক এখানেঃ ব্রীজ অন দ্য রিভার কাওয়াই । কোয়াই নদীর উপরের ব্রীজের কথা বলার আগে ইতিহাসের বাতাবি লেবু একটু কচলা কচলি করে নেই।
স্বরচিত ইতিহাসঃ
বার্মা যখন ব্রিটিশ কলোনি হয় তখনই ব্রিটিশরা বার্মা -থাইল্যান্ড রেলপথের অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা বুঝতে পেরেছিল; কিন্তু যাত্রাপথের দুর্গমতার (পাহাড়ি জমি, সাপ, ম্যালেরিয়া, পেটের অসুখ, অপর্যাপ্ত লেবার) কারণে ব্রিটিশরা এই রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই অঞ্চল দীর্ঘ সময় জাপানিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। জাপানিরা এই রেলপথের সামরিক গুরুত্বের কথা বুঝতে পেরে যে কোন মূল্যে এই রেলপথ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
দক্ষিণ-পূর্ব মিয়ানমারের থানবাউযায়েত থেকে ব্যাংকক পর্যন্ত চারশো কিলোমিটার এর কিছু বেশি লম্বা এই রেলপথ থাই-বার্মা রেলপথ নামে বেশি পরিচিত। জাপানিরা এই রেলপথ স্থাপনের জন্য যুদ্ধবন্দিদের লেবার হিসেব কাজে লাগায়। মিত্রপক্ষের ষাট হাজারের কিছু বেশি অফিসার-সৈনিক এবং স্থানীয় প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ সিভিলিয়ান কে রেলপথ তৈরির কাজে জোর করে লেবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ব্রিজ তৈরিতে প্রায় ষোল হাজার মিত্র পক্ষের বন্দি এবং প্রায় এক লক্ষ সিভিলিয়ান মারা যায়। এ কারণে এই রেলপথের আর একটা নাম ডেথ রেলওয়ে। এই রেলপথে মোট আটটা ব্রিজ আছে- তার মধ্যে সাতটা ব্রিজ পড়েছে বার্মার ভেতরে, একটা পড়েছে থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরিতে । যুদ্ধের শেষের দিকে মিত্রবাহিনর বোমার আঘাতে কাঞ্চনাবুরির এই ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পরবর্তীতে এটা পুনঃমেরামত করা হয়।
মূল কোয়াই ব্রিজ-- ছবিঃ চুরি করা।
পিটার জন রুল ছদ্ম নামের একজন ফ্রেঞ্চ সিক্রেট এজেন্ট ও এঞ্জিনিয়ার যুদ্ধের আগে এই (মালয়) অঞ্চলে রাবার বাগানে কাজ করছিলেন (ব্লগার পদাতিক চৌধুরীর সাথে ওনার ভালো খাতির ছিল) । যুদ্ধের সময়ে তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে এক পর্যায়ে বন্দী হন এবং প্রিজন ক্যাম্পের কোন একটাতে তাকে আটকে রেখে আর সব বন্দির মতো রেলপথ তৈরির কাজে লেবার দিতে বাধ্য করা হয়। যুদ্ধশেষে পিটার জন রুল মুক্তি পান, তিন বছর রাবার প্লানটেশনে কাজ করে স্বদেশে ফিরে আসেন ।
ব্রিজ- এখনকার অবস্থা।
১৯৫২ সালে তিনি তার যুদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখেন। বইটি হলো দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই। ওনার আসল নাম পিয়েরে বুল। বইটি লেখার পরেই হিট হয়ে যায়, ১৯৫৪ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হলে সুপার হিট হয় এবং ১৯৫৭ সালে এখান থেকে ব্রিজ অন দা রিভার কোয়াই নামে একটা সিনেমা করা হয়। সেই সময়ে এই সিনেমাটা সাতটা অস্কার পেয়েছিল। পিয়েরে বুলের বই থেকে আরো একটা সুপারহিট সিনেমা হয়েছিল --প্ল্যানেট অফ দা এপস।
বইটি হিট হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ টুরিস্ট থাইল্যান্ডে কোয়াই নদীর উপর ব্রিজ দেখতে আসে। সমস্যা বাধে তখনই, কারণ কোয়াই নদীর উপরে আসলেতো কোন ব্রিজ নেই। আসলে এই ব্রিজটি (বৃষ্টি) যেই নদীর উপরে সেই নদীর নাম 'মায়ে খলং-- Mae Klong'। তবে কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান থাকে। থাই কর্তৃপক্ষ নদীটার নামই বদলে কোয়াই নদী করে দিল। ঝামেলা শেষ। নাম বদলের ঘটনা ঘটে ১৯৬০ সালে।
পাঠকের জন্য কুইজঃ কঠিন সমস্যার সহজ সমাধানের আরেকটা সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বলতে পারেন? উত্তর পোস্টের শেষে।
কোয়াই ব্রিজ ভ্রমনের শানে নুজুলঃ
সত্তর বা আশির দশকের টেলিভিশনে দা ব্রিজ অন দা রিভার কোয়াই দেখেছিলাম। তবে ভাষার কারণে বিষয়টা অতখানি দাগ কাটতে পারেনি। প্রায় একই সময়ে ব্রিজ অন দা রিভার কোয়াই বইটির একটি ভারতীয় বাংলা অনুবাদ হাতে পেয়েছিলাম। ওই বই পড়ার পরে থেকে মনের মধ্যে কোয়াই নদীর ব্রিজ দাগ কেটে ছিল। কাজেই যখন সিদ্ধান্ত নেই থাইল্যান্ডে যাব, স্বাভাবিকভাবেই আমার লিস্টে এক নম্বরে ছিল কোয়াই নদীর ব্রিজ।
দ্বিতীয় দিনের শুরুঃ
কাঞ্চনাবুরি বা কাঞ্চন নগর যাবার সহজ উপায় হলো ট্রেন। ব্যাংককের মূল রেল স্টেশন হলো হুয়া লামফঙ স্টেশন, তবে কাঞ্চনাবুরির ট্রেন ছাড়ে থনবুরি স্টেশন থেকে। প্রথম ট্রেন সকাল ৭-৫০। স্টেশনের দূরত্ব আমার হোটেল থেকে হাঁটা পথে তিন কিলোমিটারের কিছু বেশি, বাসে প্রায় চার কিলোমিটার। হেঁটে বা বাসে গেলে খরচ কম, কিন্তু অনেক আগে রওনা দিতে হবে। এরা ব্রেকফাস্ট সার্ভ শুরু করে সাতটায়। মনে মনে হিসেব করে দেখি এখান থেকে খেয়ে, তারপর ট্যাক্সি/মটর সাইকেলে রওনা হলে বাইরে সকালের খাবার টাকা যা বাঁচবে, তাতে পুশিয়ে যায়।
আজ সূর্যোদয় সকাল ছটা পাঁচে। ৫-৫০ এ এলার্ম দেয়া ছিল, কিন্তু এর আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সকালের নামাজ সেরে ব্যাগ গুছিয়ে ফোনে রুট ইত্যাদি আবার দেখে নিচ্ছিলাম। সাতটার আগেই এরা ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেললো। রান্না খাবারের মাঝে শুয়োরের সসেজ ভাজা আর শুয়োরের মাংস দিয়ে নুডুলস। আরেক কোনে ভেজিটেরিয়ান অপশন- পাউরুটি, মাখন, কয়েক রকমের জেলি আর জ্যাম। সাথে চা আর ইনসট্যান্ট কফি। পরের খাবার কখন খাবো জানি না, দশ টুকরা রুটি, খানিকটা মাখন আর সব রকমের জ্যাম জেলি একটু ট্রাই করে চা ঢালতে যেয়ে দেখি গ্রিন টি ছাড়া সব টি ব্যাগ শেষ। বাধ্য হয়ে ইনসট্যানট কফি নিতে হলো। এই হোস্টেলে নিজের প্লেট নিজে ধুয়ে রাখার নিয়ম।
রিসিপসনে যেয়ে বললাম চেক আউট করব, তবে ব্যাগটা রেখে যাওয়া সম্ভব কিনা-- পরে এসে নিয়ে যাব। রিসিপশনিস্ট লেডি বলল কোন সমস্যা নেই (কোন কোন হোটেলে ব্যাগ রাখার জন্য বাড়তি চার্জ নেয়)। এরপর জানতে চাইলাম রেলস্টেশনে যাওয়ার জন্য কম খরচে সহজ উপায় কি। সে grab- ইন্সটল করতে পরামর্শ দিল। লোকাল সিম বলে গ্রাব ইন্সটলে কোন সমস্যা হলো না, তবে প্রথমবার ব্যবহার করার আগে গ্রাব ফাইলে একটা ক্রেডিট কার্ড এড করতে হবে অথবা নিজের ছবি প্রোফাইলে এড করতে হবে। ব্যাগ থেকে আবার ক্রেডিট কার্ড বের করে এড করার বদলে নিজের ছবিই দিতে চাইলাম। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরেও গ্রাব বারবার এরর দেখায়-- ইমেজ টু ডার্ক, ইউজ প্রপার লাইট। বন্ধুরা জুতা কেনার সময় আমাকে দেখিয়ে এই কালারের জুতা দ্যান এমনি এমনি বলে না। বিষয়টা সমাধান করতে হবে, মাথায় রাখলাম।
স্টেশনের পথেঃ
থনবুরি ট্রেন স্টেশন
যা হোক, রিসিপশনিস্ট আমার অবস্থা দেখে নিজের ফোন থেকে গ্রাব ডেকে দিল। তার একাউন্টে কিছু ডিসকাউন্ট সুবিধা ছিল, কাজেই মূল ভাড়া ৬০ বাথের বদলে আমাকে ৫৪ বাথ দিতে হবে । ৫ মিনিটের মধ্যে মটর সাইকেল এসে হাজির। পথ মাত্র চার কিলোমেটারের মতো, সময় লাগলো দশ মিনিটের কাছাকাছি। রাস্তায় অনেক সিগন্যাল - না হলে আরো কম লাগতো। রেলস্টেশনের পাশে বিশাল পাইকারি বাজার।
বাজার
বাজার
(থনবুরি স্টেশন এবং বাজারের ছবি টুকলি করা)
কাঞ্চনাবুরি যাবার ট্রেন মূলত একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন, তবে ট্যুরিস্টই বেশি দেখলাম। শেষ স্টেশনের নাম 'নাম টক', এটা বার্মা বর্ডারের কাছে, থন বুরি থেকে প্রায় দুশ কিলোমিটার। পথে থামবে নাখন পাথম, কাঞ্চনাবুরি, কোয়াই নদীর ব্রিজ, থাকিলেন, থাম খ্রাসাই, এবং ওয়াং পো। মোট সময় লাগে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা। আমি নামবো কোয়াই ব্রিজ স্টেশনে। ওখানে যেতে সময় লাগার কথা প্রায় তিন ঘন্টা। এই ট্রেনে একটাই ক্লাস, থার্ড ক্লাস। ট্রেনের ভাড়া লোকালদের জন্য এক রকম, ট্যুরিস্টদের জন্য ফ্ল্যাট ১০০ বাথ- যেখানেই নামি না কেন। আমি খানিক ক্ষণ চান্স খুঁজলাম লোকাল কাউকে দিয়ে কম দাম টিকিট কাটা যায় নাকি, পারলাম না ।
থাই ট্রেনগুলো খুব পরিচ্ছন্ন। তবে সাধারণত টাইম মতো চলে না, আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা লেট করা খুব স্বাভাবিক। আটটা দশে একটা ট্রেন আসতে তাতে লাফ দিয়ে ওঠায় পর গার্ড বললো এটা যাবে না। দশ মিনিট পরে আবার বললো এটাই যাবে। মনে হলো জেরোম ক্লাপকা জেরোমের থ্রি ম্যান ইন এ বোটের ওয়াটারলু থেকে কিংস্টন যাবার ট্রেনের মতো ঘটনা।
ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠে যুদ্ধ জয়ের হাসি দিয়ে সিটে বসে দেখি ট্রেনের অর্ধেকই খালি। যা লোক উঠেছে তার অন্তত ৬০% ট্যুরিস্ট। স্থানীয়দের প্রায় সবাইই খেটে খাওয়া মানুষ। খুব সাধারণ চেহারা, আরো সাধারণ পোষাক। বিজ্ঞাপনে থাই এয়ার হোস্টেসের চেহারা দেখে যে থাইল্যান্ডের কথা মাথায় আসে বাস্তবে সেই থাইল্যান্ড মাত্র কয়েক কিলোমিটার যায়গায় সীমাবদ্ধ। টিকেট চেকার কিছুক্ষনের মধ্যেই টিকেট চেক করে কি একটা যন্ত্র দিয়ে টিকেটের মাথায় ইংরেজী ভি চিহ্নের মতো একটা অংশ কেটে দিল। বিনা টিকেটের যাত্রি কাউকে দেখলাম না।
টিকেট, তবে এটা ফেরৎ আসার সময়ের কাটা, যাওয়ার টিকেট সংরক্ষণে রাখি নি (বিনা টিকেটে চড়িনি কিন্তু)
রাস্তায় অনেক ফেরিওয়ালা উঠছে, একের পর এক। খাবার বিক্রেতাই বেশি। পোষাক দেখে অনুমান করলাম কয়েকজন মুসলমান। বিক্রেতাদের সবাইকেই খুব গরীব বলেই মনে হলো। একজনের কাছ থেকে আমি কিছু আম এবং বাতাবি-নেবু কিনলাম, কুড়ি আর কুড়ি - চল্লিশ বাথের। ব্যাংককে এটা ষাট যোগ ষাট - একশ কুড়ি বাথ দামে বিক্রি হতে দেখেছি। বাংলাদেশের বাদামের সঙ্গে যে রকম মরিচের গুড়া মিশিয়ে বাদামি রঙের লবন দেয়, ফলের সাথে পেলাম সেরকম লবনের বড় দুটো প্যাকেট। বাতাবি নেবু খাবার জন্য লবনের প্যাকেট খুলে দেখি লবন না, চিনি, সাথে মরিচের গুড়া । লবণের ব্যবহার আসলেই এদেশে কম। বাতাবি লেবু খুব মিষ্টি ছিল, আমটা টক মিষ্টি ছিল।
জানালে থেকে দেখা কাঞ্চনাবুরি স্টেশন।
যদিও ট্রেন প্রায় ত্রিশ মিনিট লেট ছিল, প্রায় রাইট টাইমে, দশটা পঞ্চাশে কাঞ্চনাবুরি এসে পৌছালাম। কোয়াই ব্রিজ স্টেশন এখান থেকে মাত্র চার কিলোমিটার বা আরো কম। ওখানে ভালো হোটেল কম বলে বাক্স প্যাটরা সহ আসা বেশির ভাগ টুরিস্ট এখানেই নেমে গেল। এরা কয়েকদিন থেকে ঘুরবে, আমার মতো এক বেলায় ঘোরার কিরপিন না।
কোয়াই ব্রিজ স্টেশন
অবশেষে আমার গন্তব্যে পৌছে গেলাম। ট্রেন থেকে নেমে আগে ব্রিজের দিকে দৌড়ালাম, ব্রিজ না দেখেই লাইক দিয়েছি, যদি কেউ জেরা করে!!
ব্রিজের ছবি
ব্রিজের শেষ মাথা
মিটার গেজ লাইন
ব্রিজ থেকে দেখা ভাসমান রেস্তোরা।
কিরপিনের থাইল্যান্ড ভ্রমন (চতুর্থ পর্ব)
*কুইজের জবাবঃ সম্প্রতি কোনো একটি দেশে লোকে পর্ন গ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ার পর কতৃপক্ষ দেশবাসিকে বাচানোর জন্য পর্নোগ্রাফিক সাইট গুলোকে নিষিদ্ধ করার পর দেখা গেল অনেক লোক চুরি করে বিপল্প উপায়ে পর্ন সাইট ভিজিট করছে। সমস্যার সমাধান কল্পে কতৃপক্ষ নিষিদ্ধ সাইটকে বৈধ ঘোষনা করে দেয়। কঠিন সমস্যা, সহজ সমাধান।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৫