গত বছর ঈদে প্রায় ৪৫ লক্ষ গরু-মহিষ এবং ৭০ লাখ ছাগল ভেড়া কোরবানি করা হয়েছিল । এর বাহিরে কিছু সৌখিন লোক উট দুম্বা ইত্যাদিও কোরবানি করেছিলেন। এবছর নিম্নআয়ের মানুষের হাতে টাকা নেই, নিম্নমধ্যবিত্তরা সঙ্কটে আছেন। উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত তেমন একটা সঙ্কটে সাধারণত পড়েন না । কাজেই এবছর কোরবানির সংখ্যা খুব একটা কমবে বলে মনে হয় না।
বাজারে বড় আকারের গরুর দাম দুই আড়াই লাখ টাকার কাছাকাছি । ছোট গরু ৩৫ হাজারের নিচে পাওয়া যায় না। বাজারে মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি থাকে , এ ধরনের গরুর মূল্য ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার কাছাকাছি। অনুরূপভাবে বড় ছাগল লাখ টাকার বেশি দামে বিক্রি হলেও সাধারণ আকারের ছাগল ৭ হাজার- ১০ হাজার টাকার কাছাকাছি। সেই হিসেবে গত বছরের কোরবানির পশুর বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
কোরবানির পশুর প্রায় পুরোটাই পশুর হাঁটেই বেচা-কেনা হয় (গ্রাম অঞ্চলে কিছু পশু সরাসরি গৃহস্থের ঘর থেকেও বিক্রি হয়ে যায়, পরিমান নগন্য)। পশুর হাটে বিক্রয় মূল্যের উপর প্রতি হাজারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা হাসিল আদায় করা হয় (কোথাও কোথাও আরো বেশি)। সেই হিসেবে পশুর হাটে গত বছর প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাসিল আদায় হয়েছে। এর মধ্যে সরকার ইজারা বাবদ কয়েক কোটি টাকা পেয়েছে, বাকিটা গেছে ইজারাদারদের হাতে।
আওয়ামী লীগের একটি গুণ, এই সংগঠনটি সবসময় তাদের নেতাকর্মীদের রুটি-রুজির জন্য ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে। বিগত এক দশক ধরেই পশুর হাটগুলোর ইজারা স্থানীয় লীগের নেতারা ছাড়া কেউ পাচ্ছে না। আপাতত রিলিফ বন্ধ, কোভিডের কারনে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে ধীর গতি বলে চাদাবাজীতেও ধীর গতি। ঈদে পশুর হাট বসলে নেতা-কর্মিদের পকেটে কিছু টাকা আসে।
এছাড়া গরু পরিবহনের সময় গরু প্রতি কমপক্ষে দুই হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়, যার ভাগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কিছুটা পেয়ে থাকেন (বিভিন্ন সময়ের পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে ৩০%) এবং নেতাকর্মীরা কিছুটা পায় (৬০%)। এখান থেকেও কয়েকশো কোটি টাকা চাঁদা উঠবে। কাজেই ঈদে পশুর হাট সীমিত আকারে বসার সম্ভাবনা খুব কম । সম্ভাবনা খুব বেশি যে আপনার বাড়ির আশেপাশেই কোরবানির হাট বসবে।
এবছর করোনার উপর বাড়তি চাপ হিসেবে যোগ হয়েছে বন্যা। পশু খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। অনেক জায়গায় ঘাস পাওয়া যাচ্ছে না। গৃহস্থের কাছে গরু রাখার মতো শুকনো জায়গার অভাব। গরু বিক্রি না করতে পারলে খামারিদের অনেকেই বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বন্যা কবলিত এলাকায় গৃহস্থের পশু রাখার জায়গা নেই দাম।
এই অবস্থায় যাদের কোরবানির সামর্থ্য আছে তাদের জন্য কোরবানি দেওয়াটা দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। এই টাকা অনেক হাতে ঘুরবে , অর্থনীতিতে কিছুটা গতি আসবে। উল্লেখ্য আমাদের দেশে মোট যা পশু জবাই হয় তার প্রায় অর্ধেক কোরবানির ঈদের সময় জবাই হয়।
আমাদের গ্রাম এলাকায় এমন কিছু ঘর আছে যারা বছরের এই সময়টাতেই গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ পায় (খাশি মধ্যবিত্তের জন্যই দূর্লভ, সদকা হিসেবে কেউ মুরগি দান করলে এই গরীব লোক গুলো মুরগি খেতে পায়)। আমি অনুমান করি এরকম লোক শুধু আমার গ্রামে আছে এমন না, সারা দেশেই আছে।
যারা কোরবানি দিবেন তাদের প্রতি অনুরোধ, কোরবানির মাংস ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখবেন না। দেশের অনেক লোক আধপেটা খেয়ে আছেন। তাদের জন্য আপনার হাত সম্প্রসারণ করুন।
বুখারী শরীফের এক হাদিস হতে জানা যায় আমাদের নবী কোন এক বছর সাহাবীদের মধ্যে যারা কোরবানি দিয়েছেন তাদের কোরবানির মাংস তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ না করার নির্দেশ দিলেন। পরের বছর সাহাবীরা এই বিষয়ে নির্দেশনা চাইলে তিনি সংরক্ষণের অনুমতি দিয়ে বলেন যে আগের বছর মানুষের খাদ্যাভাব ছিলো যার কারনে তিন দিনের বেশি না রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আপনারা নিজেরা বিবেচনা করে দেখুন এখন দেশে কি ধরনের অবস্থা যাচ্ছে এবং এতে কোরবানির মাংস সংরক্ষণ করে রাখাটা কত খানি উচিত হবে ।
ইদানিং রাস্তায় বের হলে প্রচুর ভিক্ষুক চোখে পড়ে। আগে এদেরকে কখনো ভিক্ষা করতে দেখেনি। এদের মধ্যে কেউ কেউ আগে বাসাবাড়িতে কাজ করতো, কোভিডের কারণে চাকরি হারিয়েছে। বাস শ্রমিকদের বেশির ভাগ ভাগ কাজে ফিরতে পারেনি। রাস্তার ধারে যে লোক গুলো ফল বিক্রি করত তারা এখন বেকার। আদালতের মুহুরি, টাইপিস্ট এরা বেকার। যারা টিউশনি করে চলতো এরা বেকার। বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অধিকাংশ মার্চের পর বেতন পান নি। অসংখ্য লোক কর্ম হীন হয়ে পড়েছে।
বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে পেরেছে এমন লোক কম। সবজি বিক্রেতার সংখ্যা কিছু বেড়েছে। এছাড়া কর্মহীন দের মধ্যে কেউ কেউ মাস্ক হ্যান্ড স্যানিটাইজার এগুলো বিক্রি করছে। অধিকাংশই বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারে নি। লক্ষ লক্ষ লোক ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে। মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে বন্যা। বন্যা কবলিত এলাকায় মানুষ অবর্ননীয় কষ্টে আছে। বন্যার কারণে কোভিড ছড়িয়ে পড়ার আরো বেশি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ব্লগারদের কারো কারো উপার্জন কমে গিয়েছে। অনেকেরই উপার্জন স্বাভাবিক আছে, কারো কারো বেড়েও গিয়েছে। যাদের সামর্থ্য আছে, অনুরোধ করবো, আপনার বাসায় আগে যে গৃহকর্মী ছিল (বেশির ভাগ বাসায় ছিলো), তাকে পুরোপুরি পুনর্বহাল করার দরকার নেই; কিন্তু ফোনে যোগাযোগ করে বাজার করার দায়িত্বটা এবং বাসা থেকে ময়লা ফেলে দেওয়ার কাজটা তার হাতে দিতে পারেন। ভিক্ষা দেওয়ার বদলে এই সামান্য পরিশ্রমের বিনিময়ে তাকে টাকা দিলে তার আত্মসম্মানে লাগবে না, আপনারও কষ্ট কিছু কমবে।
যারা ঈদ উপলক্ষে বোনাস পাচ্ছেন, বোনাস এর পুরো টাকাটা ব্যাংকে জমা না করে কিছুটা অভাবী মানুষের জন্য খরচের চেষ্টা করেন। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে আমন বোনায় দেরি হবে, এবং ফসল ওঠাও দেরি হবে। সেপ্টেম্বর নাগাদ কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে শোনা যায়। আমার হিসেবে অন্তত নভেম্বর-ডিসেম্বরে ফসল ওঠার আগ পর্যন্ত আপনার সাহায্যের হাত প্রসারণ করে রাখুন।
বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে খোলা জায়গায় কোভিডের সংক্রমন ছড়ানোর সম্ভাবনার চাইতে বদ্ধ জায়গায় ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি। এরপরেও সরকারের বুদ্ধুজীবী আমলারা নির্দেশনা দিয়েছে খোলা জায়গায় ঈদের নামাজ আদায় করে বদ্ধ জায়গায় ঈদের নামাজ আদায়ের। যারা ঈদের নামাজ আদায় করতে চান তাদের জন্য অধিকতর নিরাপদ হবে নিজের পরিবারের সদস্যদের কে নিয়ে ঘরে নামাজ আদায় করা অথবা বাড়ির ছাদের খোলা জায়গায় জামাত আয়োজন করা। যারা মসজিদ ছাড়া নামাজ পড়বেন না একেবারে নিশ্চিত নিয়ত করে নিয়েছেন, তাদের জন্য মাস্ক, পার্সোনাল জায়নামাজ , এবং হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করা ভালো হবে।
গত বছর কোরবানির চামড়া বড় বিড়ম্বনার সৃষ্টি করেছে। চামড়া নিয়ে কি করা যায় এ বিষয়ে ঈদের আগে পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে রাখি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৮:৩১