somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাকাং ঝিরির বুনো ক্যাসকেড। বাংলার সবচেয়ে বড় ক্যাসকেড।

১৯ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ৯:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ কয়েকটা ঝর্না ঝিরি দেখে দুই দিন পার করে দিলাম। আগামী কাল সম্ভবত ঈদ উল ফিতর তাই দলের বাকি সদস্যরা ফিরে যাবে। মনটা একটু খারাপ । কি আর করা পাহাড়েই ঈদ করতে হবে। নতুন একটা ক্যাসকেডের (cascade) সন্ধান পেলাম। (ক্যাসকেডের সংজ্ঞায় যা বলা আছে তা মোটামোটি এরকম- a waterfall, typically one of several that fall in stages down a steep rocky slope ) স্থানীয়দের ভাষ্য মতে এটা যেমন দূর্গম তেমনি সুন্দর আর তার চাইতেও বড় কথা এর আকার নাকি বিশাল। এসব শুনে দেখার ইচ্ছাটা আরও বেড়ে গেল।? যা লোকে বলে অনেক সময় তা হয় না। পূর্ব অভিজ্ঞতা তাই বলে। তারপরও লোভ সামলাতে পারলাম না। স্বভাবটাই এমন হয়তো তাই…
আগামীকাল ঈদ । দলের সবাই বিদায় নেয়ার পর নিশ্চিত হলাম। থেকে গেলাম দু’জন। চাঁন (চাঁদ) রাতটা পাড়াতে কাটিয়ে পর দিন ভোরে বের হয়ে পরলাম সেই অচেনার খুঁজ করতে। রাস্তার একটা আনুমানিক মানচিত্র বলে দিল একজন। সেও কোন দিন ঐ দিকটাতে যায় নাই। একটু হতাশা আর অনিশ্চয়তার সুর বাজতে লাগল মনের কোঠায়। তারপরও স্থানীয় এক মুরং যুবককে নিয়ে ছুটে চলা। নানান ধরণের রাস্তা পার হয়ে। অবশেষে পাহাড়ি রাস্তা। এই ট্রেইলটি কেবল পাহাড়ের রিজ ধরেই যেতে হবে। পানির কোন ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘ একটা পথ, কেবল চড়াই উৎরাই। এক সময় কাঙ্ক্ষিত পাড়ার অস্তিত্ত্ব সমন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়লাম। আমার মুরং সঙ্গীও রাস্তা জানে না। চলতি পথে কোন জুম বা কোন পাড়াও পেলাম না। যা দেখা যায় তা আমাদের গন্তব্য হবে না এটা নিশ্চিত ছিলাম। তারপরও পা চালিয়ে গেলাম। আরও অনেকটা পথ চলার পর পাহাড় থেকে দুই দুই একটা পাড়া নজরে আসে। কিন্তু যাবার রাস্তা খুঁজ করতে আরও কিছুটা সময় চলে গেল। এর মাঝে বৃষ্টি ও রোদের আনন্দ যন্ত্রনা তো ছিল নিত্য সঙ্গী। অবশেষে পাহাড় থেকে নামার একটা সরু পথ পেয়ে যাই। ধারণার উপর আস্থা রেখে নেমে গেলাম সেই পথ ধরেই। বেশ কিছু দূর নামর পর একটা শীতল জলের ঝিরি পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। এবার সেই ঝিরি ধরে চলা শুরু। অনেকটা পথ পার হয়ে তারপর গয়ালের পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে পারলাম পাড়া খুব কাছেই হবে। তারপর ঝিরির পাড়ে আচমকা সেই পাড়ার দেখা। তখন দুপুর শেষ হয় হয়। ক্ষিদে পেটের ভেতর ভয়ংকর আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। সকালে এক কাপ চা আর শুকনা একটা বিস্কুটই ছিল ভরসা। তাই সবার আগে খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। পাড়া পুরুষ শূন্য, সবাই জুমের কাজে ব্যস্ত। তারপরও একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। জুমের লাল চাল পাওয়া গেল তবে খাবার মতো কোন তরকারি নেই। কি আর করা আমাদের রেশন থেকে আলু ভর্তা আর স্থানীয় একটা সবজি পাওয়া গেল, অরসুক। দেখতে অনেকটা লেমন গাসের মতো। কি আর করা আলু ভর্তা আর সেই আদিবাসীদের সবজী রান্না করে দুপুরের খাবার শেষ করে আমাদের লক্ষ্য নিয়ে কথা বলা শুরু করি। আমার মুরং সঙ্গীর সহায়তা কথা হলো ঠিকই কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারলো না। তবে আমাদের টার্গেট পাড়া খুব কাছেই তা জানতে পারলাম। সেখানে গেলে ঐ ক্যাসকেডের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যাবে। সময় কম তাই সন্ধ্যা হবার আগেই সেই পাড়ার উদ্দেশে পা বাড়াই।


খুব বেশি হাঁটতে হলো না। কেবল নেমে গেলাম অনেকটা পথ। নামতে নামতে পাড়ার দেখা পেয়ে গেলাম। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। পাড়ায় পৌঁছে অল্প বিশ্রাম নিয়ে চলে গেলাম গোসল করতে। আজ তিনদিন পর সাবান দিয়ে আয়েশ করে ঝিরির জলে স্নান পর্ব শেষ করি। মাচাং থেকে দেখা আগুন রাঙা গোধূলির মায়াবি আবেশে ক্লান্ত শরীর নতুন করে চাঙা হয়ে উঠে। সন্ধ্যার আঁধার হুট করেই নেমে আসে রক্ত রাঙা সাঁজের আবীরকে গ্রাস করে। জুম থেকে ফিরে আসা ছেলেটার সাথে কথা বলা শুরু করি। যার ঘরেই আমরা আশ্রয় নিয়েছি। রাতের খাবার তৈরির ফাঁকে তার সাথে বেশ কথা হল, ভাবও তৈরি হয়ে গেল। যা শুনেছি তা সত্য। তার কথা মতো আরও অনেকটা পথ আমাদের যেতে হবে। এমনিতে বর্ষাকাল তার উপর ঐ দিকটাতে কেউ যায় না। তাছাড়া রাস্তাও নেই আর ঝোপঝাড় কেটে রাস্তা তৈরি করে যেতে হবে। জোকের উপদ্রবও বেশ হবে। সে এক বাক্যে বলে দিল আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমি তাকে বললাম, পারবো দেখে নিও। রাতের খাবার সেরে সব কিছু গুছিয়ে নিলাম। যেহেতু আমরা এই পথে ফিরবো না তাই রসদপাতী পিঠেই থাকবে।


রাতে ঘুম হল ভালই। তবে অজানা একটা উত্তেজনা বিরাজ করছিল মনে। খুব ভোরেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। হাতের কাজ শেষ করে রাতের বাচানো খাবার দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে বের হলাম তীর্থের উদ্দেশে।
প্রথম দিকের পথটা বেশ ভালই বলতে হবে। পাড়াটার চারদিকেই উঁচু পাহাড় ঘেরা তাই পাড়া থেকে যে দিকেই যাবেন আপনাকে প্রথমে খাড়া চড়াই উঠতেই হবে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। পথে পথে অসংখ্য বুনো ফুল আপনার সঙ্গী হবে। রামাপাও, চিংরিংপাও আর কত কি (মুরং ভাষায়)। লাজুক হাওয়া কখনও কখনও বেয়াড়া হয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠবে, হয়তো বলতে চায়, দাঁড়াও না পথিক কিছুটা সময়, চল না আমার দেশে মায়ার স্বপ্নপুরীতে। হাওয়ার মাখামাখির মায়া কাটিয়ে আবার এগিয়ে যেতে হবে। আমি এ ফুল ঐ লতা আর পাহাড়ের নাম জিজ্ঞাসা করে চলেছি আমার নতুন মুরং সঙ্গীর কাছে। মনে লাগার মতো কয়েকটা পাহাড়ের নাম জানতে পারলাম। একটার নাম নিমরুয়া বাংলায় আয়না পাহাড় আর একটা নাকংহু যার অর্থ হচ্ছে নাক পাহাড়। আরও কিছু পাহাড়ের স্থানীয় নাম জানতে পারলাম তার ভেতর ত্যাংহু, প্রিহু বা বাক্কে পাহাড় উল্লেখযোগ্য। এভাবে চলতে চলতে তিনটি পাহাড় উঠানামা করে নেমে আসলাম একটা ঝিরিতে। তারপর আর কোন প্রমিনেন্ট রাস্তা নেই। কথায় কথায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম এই ঝিরি ধরে আমরা কতদূর যেতে পারবো। আমাদের নতুন মুরং সঙ্গীটি বললো, অনেক দূর-তবে এটা ধরে তো কেউ যায় না। আমি বললাম চল আমরা যাই। সে প্রথমে আমতা আমতা করলো তারপর আমি বললাম দেখ, এই ঝিরিটি বেশ সুন্দর আর আমরা এখন পর্যন্ত বেশকটা ছোট ঝর্না ও ক্যাসকেড দেখে ফেলেছি, আমার মনে হয় এ পথে আরও আছে। সে এবার বুঝতে পারলো। বলল, চলেন, এই পথে আরও রাক / রাগ আছে। মুরং ভাষায় ঝর্না বা ক্যাসেকেডকে রাক বলে।


অসাধারণ একটা ঝিরি, প্রতি বাঁকে বাঁকেই এর অসম্ভব সুন্দর ঝর্না আর বিশাল বিশাল ক্যাসকেড। সময় একটু বেশি লাগবে জেনেও এই পথটাই বেছে নিয়ে অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা হলো। শুধু এই পথটাই আপনার মন ভরিয়ে দিতে যথেষ্ট। একটুখানি ঝুঁকি নিতে হবে কেননা রাস্তা বেশ পিচ্ছিল আর রাস্তা আপনাকে বের করে নিতে হবে ঝর্নার পাশ দিয়ে। কখনও গাছের শিকড় আর ঝিরির পাথর খামছে ধরে জলের বিপরীতে বেয়ে উঠতে হবে ২০ থেকে ৩০ ফুট কিম্বা আর একটু বেশি। সাহস আর সাবধান হলে এটা ব্যাপার না। আর জোকের বিষয়টা মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে হবে। ওটা আপানার পথের সাথী। ঝিরির বাঁধাগুলো একে একে পার হয়ে অবশেষে এর শেষ মাথায় এসে একটা দুর্গমনীয় ক্যাসকেড এর নিচে এসে থমকে দাঁড়ালাম। হয় এই ক্যাসকেডটি বেয়ে উঠতে হবে, নয় তো আবার অনেকটা পথ পিছনে গিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এটা বেয়ে উপরে চলে যাবো। আমার অন্য তিন সঙ্গী এতে সায় দিল না। ওদের অনেক বুঝিয়ে আমি বললাম যদি আমি উঠতে পারি তবে সেই পথ ধরে তোমরাও চলে আসবে। তারা রাজি হলো। আমি কিছুক্ষণ ভেবে একটা রাস্তা তৈরি করে নিলাম। তারপর পা বাড়াতেই ওরাও বলল আমরাও আছি। ব্যস হয়ে গেল। অবশেষে সেই বাঁধা অতিক্রম করে উপরে এসে সবাই বলল, অনেকটা পথ ও সময় বেঁচে গেল। আর লাভ হল অসাধারণ একটা ঝর্নার দেখা পেলাম।
ঝিরি ছেড়ে আরও কিছুটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা উঠতে হবে। তারপর নেমে গেলেই পড়বে একটা পাড়া। এখান থেকেই শুরু আমাদের সেই আরাধ্য ক্যাসকেডের মূল ট্রেইল। পাড়ায় অল্প বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে গেলাম সেই অচেনা তীর্থের পথে।
পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে কিছুটা নামলেই অসাধারণ একটা একাকি জুম ঘর । তাকে পাশে রেখে আমরা এগিয়ে চলি। কিছুটা চড়াই ভেঙে উপরে উঠে তারপর হঠাৎ করে থমকে দাঁড়াল আমাদের নতুন মুরং সঙ্গীটি। এখান থেকে হাতের বামে জঙ্গল কেটে নামতে হবে। কি আর করা, যথা আজ্ঞা…। ঝোপ-ঝাড়, কাঁটালতা কেটে-মাড়িয়ে নামতে লাগলাম। কেবল জলের একটা শব্দকে সঙ্গী করে। অবশেষে সেই বুনো মাকাং ঝিরির দেখা পেলাম। এটা ধরেই ডাউনস্ট্রিমে নেমে যেতে হবে। মাকাং অন্য আর দশটা ঝিরি মতো নয়। বড় বড় বোল্ডার আর হড়কা বানের জন্য জমে থাকা প্রমাণ সাইজের গাছের ডালপালার বাঁধাগুলো পার হওয়া বেশ কষ্টকর। আর ঝিরিটা চলতে চলতে হঠাৎ করেই খাড়া নিচে নেমে যায়। যার জন্য প্রতি পদক্ষেপেই নতুন নতুন বাঁধা আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে। কখনও পাশের খাড়া দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে জঙ্গল কেটে আবার ঝিরিতে নামতে হবে। কখনও খাড়া পাথর বেয়ে ঝর্নার পাশ দিয়ে নামতে হবে। যেমন পিচ্ছিল সেই রকম জোঁক আর পাথর ও মাটি গুলোও পলকা। এভাবে অনেকটা পথ চলতে চলতে বেশ কয়েকটা বড় ক্যাসকেড কষ্ট করে পার হলাম। নতুন একটা চিন্তাও মনে নাড়া দিতে শুরু করল, আমরা যেভাবে যে পথে নামছি সেই পথেই তো আবার উঠতে হবে। কারণ অনেকটা পথ নেমে এসেছি সেই সাথে এমন কিছু খাড়া ও পিচ্ছিল ক্যাসকেড নেমেছি যা উঠার সময় বেশ বেগ পেতে হবে। তারপরও রাস্তা আর শেষ হয় না। মাথার উপর আকাশের দেখা পাওয়া বেশ কষ্টকর। দু পাশের ঘন জঙ্গল আর খাড়া পাহাড়। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় এসে দাঁড়ালাম একটা ঝর্নার মুখে। নিচে নামার রাস্তা কই? কি করি! ডান পাশের কাঁটা ঝোপ কেটে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম। সেখানে একটা নাম না জানা বুনো গাছ পেলাম। গাছটা মাটি ধসের ধার এ (কিনারায়) দাঁড়িয়ে। তার অল্প নিচে আরও একটা গাছ। সেই গাছটার শিকড়গুলো অনেক দূর নেমে গেছে। আমার নতুন মুরং সঙ্গীটিকে বললাম এই পথে যাবো নাকি। সে বলল, এটাই হতে পারে একমাত্র নামার পথ। আশপাশে সব তো ৪০/৫০ ফিট হবে খাড়া এবং ধসে যাওয়া পাহাড়ের ধার। তবে একটা সমসা আছে, প্রথম গাছটা থেকে দ্বিতীয় গাছটার দূরত্বটা এমন যে যেতে হলে প্রথম গাছ হতে আপনাকে কিছুটা ঝুলে তারপর আলতো করে পা দিয়ে দ্বিতীয় গাছটা স্পর্শ করে শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দ্বিতীয় গাছটা ধরতে হবে। আমার মুরং সঙ্গীটি এরই মাঝে নামতে শুরু করে দিয়েছে। আমার অন্য সঙ্গী এই রাস্তা দেখে থ বনে গেল। ভয় তো লাগবারই কথা। দ্বিতীয় গাছের গুড়ি থেকে শিকড়ের দিকে যেতে হলে কিছুটা বামে সরে যেতে হবে এরপর মোটা লতা ধরে কিছুটা ঝুলে আবার গাছের দিকে এসে শিকড়ে পা দিয়ে গাছটার ডান পাশে যেতে হবে। সরাসরি ডান দিকটা একদম খাড়া আর গাছের কান্ডটা প্রায় শূন্যে। এখান দিয়ে শিকড় পর্যন্ত যাওয়া অসম্ভব। আর একটা কারণ হচ্ছে বাম দিক দিয়ে নেমে ডানদিকেই যেতে হবে কেননা ডান পাশের শিকড়টাই নিচে নেমে গেছে। পিঠের উপর দশ কেজির বোঝাটা বেশ বিপত্তি ডেকে আনতে পারে। তাই ব্যাগগুলো আগে নামিয়ে দিয়ে আমার বন্ধু সঙ্গীকে বেশ কসরত করে নামাতে লাগলাম। সে যখন গাছটার বাম থেকে ডানে যাবার চেষ্টা করছে ঠিক তখনই গাছটার গুড়ি হতে অনেকটা মাটি ও পাথর ধসে গেল। সেই মুহূর্তে আমরা তিনজন সেই গাছটার বিভিন্ন অংশের সাথে ভর দিয়ে আছি। যা হউক ভয়কে জয় করে অবশেষে নিচে নেমে এসে পাথরের বোল্ডারের উপর দাঁড়ালাম। এখান থেকে আরও কিছুটা খাড়া নামতে হবে তবে এতটা কষ্টকর মনে হলো না। এতটুকু পথ নেমে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাগগুলো এখানে ঝর্নার কাছে রেখে নিচের দিকে যাবো। কেননা বলা যায় না আর কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আবারও নিচে নামতে লাগলাম। আরও কিছুটা খাড়া নেমে পাশের ঝোপঝাড় কেটে বড় একটা ক্যাসকেডের দেখা পেলাম। বেশ বড়। আমি বললাম এটাই কি সেটা। মাথা নেড়ে নতুন মুরং সঙ্গীটি না উত্তর দিল। ক্যাসকেডটির পাশ দিয়ে নেমে আরও কিছুটা পথ যাবার পর আবার হড়কা বানের ডালপালার বাঁধা শুরু হল । এসব পার হয়ে আবার একটা ক্যাসকেড। না, এটাও না। এটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে ছোট একটা খুমের মতো তার নিচেই সেই আরাধ্য। ক্যাসকেড আর খুমটা পার হয়ে দাঁড়ালাম সেই তীর্থের মুখে।


এই সেই শিকড় বেয়ে নামার যায়গা। ছবির চেয়ে বাস্তবতাটা বেশি রূঢ় ছিল।
আমার দেখা সবচেয়ে দীর্ঘতম ও প্রসস্থতম ক্যাসকেড। সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্যাসকেড এটি। একটাই পাথরের চাই, মানে বিশাল একটা পাথরের স্লপ (slope) প্রায় ৪৫ ডিগ্রী হেলে সোজা নিচে নেমে গেছে। উপর থেকে নিচটা কোন ভাবে নজরে আসে। আমি নামার চেষ্টা করে দেখলাম সোজা ঢাল ধরে নামা অসম্ভব। বেশ পিচ্ছিল আর ভুল করে পা পিছলে গেলে প্রায় ৫০০ ফিট নিচে গড়িয়ে পড়তে হবে। ক্যাসকেডটির দু পাশে বেশ ঝোপঝাড় আর কাঁটাগাছ। একবার ভাবলাম এখান থেকেই বিদাই নেই। পানি কিছুটা কম। কিন্তু আমার নতুন মুরং সঙ্গীটি বলল এর নিচে যেখানে এটা পড়েছে সেখানে একটা ছোট ঝর্না আর তার পাশ দিয়ে আর একটা সরু ক্যাসকেড নেমে গেছে তারপর দু জনের সঙ্গম এবং একসাথে এগিয়ে চলা। তার মানে দুটো ক্যাসকেডের মিলন স্থল। মাথার উপর তখন সূর্যের আনাগোনা। বাম পাশ দিয়ে কাঁটা ঝোপ আর লতাগাছ কেটে নামতে শুরু করি। কিছুটা নেমেই বুঝতে পারলাম এটাও ঐ ক্যাসকেডের বর্ধিত অংশ। পায়ের নিচে মাটি নয়, পাথরের সেই স্লেটটাই। আধা ঘন্টার উপর ঝোপঝাড় কেটে নিচে নেমে আসলাম। তারপর ক্যাসকেডের দিকে সরে গিয়ে কোন ভাবে দাঁড়াবার একটা যায়গা করে উপরে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম। উপর থেকে যা ভেবে ছিলাম এটা তার চেয়েও বিশাল। ভাগ্য এতক্ষণ সহায় থাকলেও এবার বিপরীত আচরণ করল। হঠাৎ করেই বজ্রসহ বৃষ্টি। মুহূর্তের মাঝেই পরিবেশটা বদলে গেল। যেখানটায় কোনভাবে দাড়িয়ে ছিলাম সেখানটাতে আর দাড়াবার উপায় নেই। হুড়মুড় করে জলের ধারা উপর থেকে আমাদের দিকে আসতে লাগল। পাশের সরু ক্যাসকেডটিও রুদ্র রূপে ধরা দিল। এমন একটা যায়গায় আটকে গেলাম যেখান দাঁড়িয়ে থাকা আত্মহত্যার সামিল। পানির জোগান বাড়তেই লাগল, সেই সাথে ঝুম বৃষ্টি। একটা মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হল যায়গাটা। আমার দুই মুরং সঙ্গীও ভরকে গেল। কারণ এখানেই অনেক বছর আগে ব্যাঙ ধরতে এসে দু’জন মুরং যুবক এভাবেই প্রাণ হারিয়ে ছিল। তারপর থেকেই ওরা আর এখানটায় আসে না। আমার সঙ্গীরা বলল পাশের ঝোপঝার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম ঝোপঝার গুলো এতক্ষণ আমাদের ভর নিতে পারলেও এখন আর পারছে না। কারণ বৃষ্টির পানি ঝোপগুলোর উপর দিয়ে আসা শুরু করেছে আর এগুলো যেহেতু পাথরের চাইয়ের (স্লেটের) উপর জন্মেছে তাই পানিতে গুড়ি নরম হয়ে ভর ধরে রাখতে পারছে না। আমি কাল বিলম্ব না করে বললাম, চল ভাগ্যে যাই থাক আমাদের উপরের দিকে যাওয়াই উত্তম হবে। তার উপর আরও একটা চিন্তা মাথায় ঢুকে গেল- ব্যাগ গুলো যে যায়গায় রেখে এসেছি সেখানে যদি পানি বাড়ে তবে হড়কা বানে(flash flood) সব নিয়ে যেতে পারে। তাই একজন মুরং কে বললাম তুমি যদি দ্রুত যেতে পার তবে যাও। ব্যাগ গুলো রক্ষা করা দরকার। হামাগুড়ি আর খামচে ধরে ঝোপঝার কাঁটাগাছ ধরে কখনও বুক লাগিয়ে গিরগিটির মতোই উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। নতুন সমস্যা পায়ের নিচের মাটি অসম্ভব পিচ্ছিল হয়ে গেছে তাই হাত পা কোনটাই কোথায় ভরসা পাচ্ছে না। বারবার পিছলে হাত পা কেটে অবশেষে ভয়কর যায়গাটা উঠে আসলাম কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই। প্রকৃতি বেশ একটা কঠিন পরীক্ষা নিয়ে নিল। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে উঠে এসেছি যায়গাটা। আমার নতুন মুরং সঙ্গীর চেহারায় ভয়ের ছাপ তখনও বর্তমান। আমাকে হাসতে দেখে হাপাতে হাপাতে যা বলল তার মানে বিরাট বাঁচা বেচে গেছি। বৃষ্টি তখনও হচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। কারণ এটাই মোটামোটি নিরাপদ দাঁড়াবার জন্য। বৃষ্টি থামার পর আবার উঠা শুরু করি।



বৃষ্টির আগে ও পরে মাকাং ক্যাসকেড। বৃষ্টির শুরু মুহূর্তের ছবি ।
সেই ঝর্নার কাছে এসে দেখি সব ঠিক আছে। ব্যাগগুলো বোল্ডারে খাঁজে উপরের দিকে রেখে যাওয়াতে রক্ষা। এবার আবার ঐ গাছের শিকড় ধরে উঠতে হবে।…তারপরের গল্পটা বাড়ি ফেরার, সেটাও অসাধারণ মজার অভিজ্ঞতায় ভরপুর। তবে সেই বৃষ্টি সহজে আমাদের পিছু ছাড়ল না।
মাকাং ক্যাসকেডের সাক্ষাৎ পাওয়া আর এর বিশালতার কাছে নিজেকে দাঁড় করাতে চাইলে এতটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হবে।
থাকুক সে অরণ্য গহিনে নিভৃতে বন্য রুদ্র রূপে আপন খেয়ালে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫০
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×