somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জননী

৩০ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৌষ মাসের দুপুরে মেঘের থাবায় আহত রোদে উঠোনে মোড়া পেতে বসে আরামে চোখ বুজে আছেন অখিল; খালি গা, লুঙ্গি পরা, গামছাখানা ঊরুর ওপর। তার মাথায়-পিঠে খাঁটি সরিষার তেল মালিশ করে দিচ্ছে চৌদ্দ বছরের মেয়ে অর্পিতা। চল্লিশ পেরোনো অখিল গ্রামের বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। আজ শুক্রবার, ছুটির দিন। ছুটির দিনগুলোতে তিনি সাধারণত বাড়িতেই থাকেন। আর দুপুরবেলা অর্পিতা বাবার মাথায়-পিঠে তেল মালিশ করে দেয়। শরীরের বাকি অংশে অখিল নিজেই তেল মালিশ করে নেন।

হোক শীত কিংবা গ্রীষ্ম, বারো মাসই গায়ে তেল মালিশ করা অভ্যাস অখিলের। আগে অখিলের মা শৈলবালা ছেলের মাথায় ও পিঠে তেল মালিশ করে দিতেন। শৈলবালার বয়স হয়েছে। হাতের জোরও কমেছে। তাই শৈলবালার জায়গায় এখন অর্পিতা। অবশ্য অর্পিতা মামাবাড়ি বা পিসি বাড়িতে বেড়াতে গেলে শৈলবালা এখনও তেলের বোতল নিয়ে ছেলের কাছে এসে দাঁড়ান। অখিল বলেন, ‘মা তুমি পারবে না। তোমার কষ্ট হবে। তুমি যাও।’

শৈলবালা চোখ বড় বড় করে অখিলের দিকে তাকান। অখিলের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে মুখে অ অ শব্দ করে নিজের ঠোঁটে আঙুল দেন। তারপর দু-হাত নেড়ে আরো কিছু অঙ্গভঙ্গি করেন। অখিল চুপ করে মাকে বোঝার চেষ্টা করেন। মায়ের অঙ্গভঙ্গির অর্থ অখিলের কাছে পরিষ্কার হয়, ‘তুই চুপ কর। সেই ছোট্টবেলা থেকে এই সেদিন অব্দি আমি তোর গায়ে তেল মালিশ করেছি। আর এখন মেয়েকে পেয়ে আমায় অথর্ব ভাবতে শুরু করেছিস!’

অখিল হাসেন। মায়ের শীর্ণ হাত নিয়ে নিজের মাথায় বোলান। শৈলবালাও তখন মুচকি হাসেন। তারপর ছেলের মাথায়-পিঠে তেল মালিশ করেন।

শৈলবালা জন্ম থেকে বোবা। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ছোট এবং বোবা, দুইয়ে মিলে তিনি ছিলেন তাঁর বাবার সবচেয়ে আদরের সন্তান। বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। লোকে তাঁকে মাস্টার মশাই বলে ডাকতো। পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল। কিন্তু ছোট মেয়েটিকে নিয়ে মাস্টার মশাই ছিলেন খুবই চিন্তিত। মেয়ে বোবা হলেও দেখতে সুন্দরী। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। প্রায় কোমর সমান চুল। মায়ায় ভরা মুখখানা। এই মেয়েকে প্রথম দেখায় পাত্র তো বটেই পাত্রদের বাবাও চোখ ফেরাতে পারতো না। কিন্তু যখনই শুনতো মেয়ে বোবা, তখনই একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাত্র ভেগে পড়তো। আর পাত্রদের বাবা পালাতো ধুতির কোঁচা উঁচিয়ে। শেষে মাস্টার মশাই অবস্থাপন্ন ঘরে মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা বাদ দেন। তিনি খুঁজতে থাকেন গরিব ঘরের শিক্ষিত ভদ্র পাত্র। কিন্তু তখনকার দিনে গরিব ঘরে ভদ্র ছেলের সন্ধান যথেষ্ট পাওয়া গেলেও, শিক্ষিত ছেলে সহজে মিলতো না। অনেক খুঁজে খুঁজে এক সময় সন্ধান পান গরিব ঘরের এক বিধবার সদ্য বি এ পাস ছেলে। নাম অভিলাষ। মা ছেলেতে এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করে খুব কষ্ট করে বি এ পাস করে যখন চাকরি খুঁজছে অভিলাষ, তখনই মাস্টার মশাই ছেলেটির সন্ধান পান। কিন্তু সমস্যা হলো ছেলের চেহারার গড়ন বর্তমানের থিতু হওয়া খাঁটি বাঙালির হলেও গায়ের রঙ আদি আফ্রিকান নেগ্রয়েড ড্রাভিডিয়ান!

ছেলে এমন কালো বলে শুরুতে মাস্টার মশাইয়ের মন একটু খুঁত খুঁত করছিল। হোক বোবা, তবু তো মা দূর্গার মতো দেখতে তার শৈল! এমন মা দূর্গাকে অমন নিকষ কালো কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন! কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনের খুঁত খুঁত নিজেই উড়িয়ে দিলেন। হোক কালো ছেলে। মানুষের ভেতরটাই তো আসল। ভেতরটা ময়লা না হলেই হলো। ছেলে নম্র-ভদ্র স্বভাবের। শৈল-মা তার সুখেই থাকবে ঐ ছেলের ঘরে। অভিলাষের বিধবা মায়ের কাছে মাস্টার মশাই প্রস্তাব নিয়ে যান। শুনে বিধবা আনন্দে কেঁদে-কেটে অস্থির। রাজি না হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। মায়ের আনন্দ দেখে অভিলাষও বিয়েতে সম্মতি জানায়।

মাস্টার মশাইয়ের সবচেয়ে আদরের সন্তান শৈলবালা অভিলাষের ঘরে বউ হয়ে আসে। বিয়েতে অভিলাষের বাড়ির সমস্ত খরচ দেন মাস্টার মশাই। বাড়িতে টিনের ঘর তুলে দেন, বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই উপর মহলে ধরাধরি করে পোস্ট অফিসের চাকরিও জুটিয়ে দেন। মাস্টার মশাইয়ের আদরের সন্তান আদরেই থাকে বিয়ের পর।

অর্পিতা অখিলের চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে মালিশ তেল করছে। ঘন, কোঁচের শলার মতো চুল অখিলের। চুলের ছাঁটটা পেয়েছে বাবার মতোই। বারান্দায় বসে ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসেন শৈলবালা। তাঁর বালিকাবেলার কথা মনে পড়ে যায়। তিনিও তাঁর বাবার মাথায় এমনিভাবে তেল মালিশ করে দিতেন মাঝে মাঝে। অখিলের স্বভাবটা হয়েছে শৈলবালার বাবার মতোই! গায়ের রঙটাও তাই, ফর্সা। তিন সন্তানের কেউ-ই তার স্বামীর গায়ের রঙ পায়নি। তিন সন্তানের মধ্যে অখিলই সবার বড়। এরপর দুটো মেয়ে। বড় মেয়ে শ্যামা একটু কালো, বাবার মতো নয়। ছোট মেয়ে দোলা উজ্জ্বল শ্যামলা। আর অখিল তো বলতে গেলে টকটকে ফর্সা।

অর্পিতা এখন অখিলের পিঠে তেল মালিশ করছে। লালচে রঙ ধারণ করেছে পিঠ। শৈলবালা অখিলের ফর্সা লালচে পিঠের দিকে তাকিয়ে হাসেন। ফিরে যান অনেক বছর আগে। বিয়ের অল্প কিছুদিন পরের কথা। জোছনা রাত। গরমের দিন বলে দক্ষিণ আর পুবের জানালা খোলা। দক্ষিণের জানালা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে হালকা বাতাসের ঢেউ ভাঙছে তার শরীরে। শৈলবালা শুয়েছেন জানালার দিকে। জানালা দিয়ে জোছনার আলো এসে পড়েছে তার শরীরে-বিছানায়। এমনকি পাশে ঘুমানো অভিলাষের গালেও। শুয়ে শুয়েই জানালা দিয়ে চাঁদটাকে দেখা যায়। তাদের শোবার সময় চাঁদটা মাথার কাছে পুবের জানালায় উঁকি দিচ্ছিল। হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙে গেল শৈলবালার। পাশ ফিরে জানালার দিকে মুখ করে শুতেই নজরে পড়ে চাঁদটা দক্ষিণের জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর তাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে আলোর বন্যায়। সে চাঁদের আলোয় একবার নিজের ডানহাতটা দ্যাখেন, আবার চাঁদের দিকে তাকান। টিনের চালে একটি জামগাছের পাতা পড়ে, গড়িয়ে নিচের দিকে নামার সর সর শব্দ হয়। আবার সব সুনসান। চাঁদের সাথে খেলায় মেতে ওঠেন তিনি। ভেঙচি কাঁটেন, জিভ ভ্যাঙান চাঁদকে। আঁচল দিয়ে নিজের মুখ ঢাকেন। বুকও ঢাকেন। আবার আঁচলের বাইরে মুখ এনে মুচকি হাসেন। হঠাৎ-ই একটি হাত। হাতটি শৈলবালার গলায় সুরসুরি দেয়। একটুও চমকান না শৈলবালা। চেনা রোমশ কালো হাতের চেনা গন্ধ! এ অভিলাষের মৌন আহব্বান। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে চাঁদকে আড়াল করে অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার। মাখানো অন্ধকার থেকে মুহূর্তের জন্য মুখ বাড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে প্রার্থনা করেন চাঁদের কাছে, ‘আমার সন্তানের গায়ের রঙ যেন তোমার মতো ফুটফুটে হয়।’
শৈলবালার চাওয়া পূরণ হয়েছে। তার প্রথম সন্তান অখিল চাঁদের মতো ফুটফুটে না হোক টকটকে ফর্সাই হয়েছে।

শৈলবালা মৃদু হাসলেন। অর্পিতা এখন অখিলের মাথার চুল টেনে দিচ্ছে। হঠাৎ অর্পিতা অখিলের চুলে তীক্ষ্ণ নজর রেখে প্রায় চিৎকার করে বলে, ‘বাবা তোমার চুল পেকে গেছে, তুমি বুড়ো হয়ে গেছো বাবা! মা দেখ বাবার চুল পেকে গেছে।’
তারপর শৈলবালার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ঠাকুমা দেখ বাবার চুল পেকে গেছে।’
একটা পাকা চুল টেনে উঠিয়ে অখিলের সামনে ধরে অর্পিতা, ‘এই দেখ।’
অখিল মেয়ের হাত থেকে পাকা চুলটা হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বলেন, ‘চুল তো পাকবেই, আমার যে শ্বশুর হবার সময় হয়ে এলো!’
‘যাও!’
বলে আবার অখিলের মাথায় পাকা চুল খুঁজতে থাকে অর্পিতা।

শৈলবালা আগুন চোখে তাকিয়ে আছেন অর্পিতার দিকে। রেগে গেলে শৈলবালা এমন দৃষ্টিতে তাকান। বারান্দার খুঁটি খামচে ধরে উঠে দাঁড়ান তিনি। আরেকবার অর্পিতার দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুড়ে নিজের ঘরে চলে যান।

বিকেলে উঠোনের মরা রোদের মুখোমুখি বসে চা খাচ্ছেন অখিল। অখিলের স্ত্রী কল্পনা একটা ব্লাউজ আর সুই-সুতো হাতে ঘর থেকে বারান্দায় এসে বসেন। সবুজ ব্লাউজটার বগলের কাছটায় সেলাই খুলে গেছে। সেটাই সেলাই করতে বসেন তিনি।

শৈলবালা ঘর থেকে বের হয়ে অখিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। দুপুরের পর থেকে তিনি কারো সাথে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করেননি। নিরিবিলি নিজের ঘরেই বসে ছিলেন। এখন ছেলের পিছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেখতে থাকেন। যেন কিছু খোঁজেন!
‘কিরে মা?’ অখিল মাকে তুই বলতেই অভ্যস্ত।

শৈলবালা একই ভাবে অখিলের মাথার চুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। কয়েকটা পাকা চুল তার চোখে পড়ে। কল্পনা ব্লাউজ সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে শাশুড়ি-স্বামীর দিকে তাকান আর মৃদু হাসেন।

শৈলবালার নজরে পড়ে উঠোনের তারে মেলে দেওয়া শুকনো কাপড় অর্পিতা তুলে নিচ্ছে। অর্পিতা শৈলবালার সাদা থানে হাত দিতেই যেন বদলে যান শৈলবালা। ক্ষিপ্র গতিতে মুহূর্তের মধ্যে অর্পিতার কাছে গিয়ে তার হাত থেকে নিজের কাপড়টা কেড়ে নেন। রেগে অ আ করতে করতে দু-হাত নেড়ে অর্পিতাকে বোঝান, ‘তুই আর আমার কোনো কাজ করবি না।’ অখিল আর কল্পনা অবাক হয়ে শৈলবালার দিকে তাকান। হতভম্ব অর্পিতা বলে, ‘আমি আবার কী করলাম!’

শৈলবালা মুখে শব্দ করে, হাত নেড়ে মনের ভাব প্রকাশ করেন। তিনি বুকে ডান হাত ঠুকে অতঃপর দু-হাত দিয়ে বাচ্চা কোলে নেওয়ার মতো ভঙ্গি করেন। অখিলের জন্মের পর থেকেই অখিলকে বোঝাতে তিনি এমন অঙ্গভঙ্গি করেন। অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ করেন আরো অনেক কিছু যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে- ‘তুই আমার কোনো কাজ করবি না। আমার সাথে কথাও বলবি না। তখন তুই আমার ছেলেকে বুড়ো বলেছিস!’

কল্পনার ব্লাউজ সেলাই শেষ। দাঁতে সুতো কেটে মৃদু হাসেন তিনি। অখিলও মায়ের পাগলামী দেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। শৈলবালা নিজের ঘরে চলে যান। কাপড়খানা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় বসে পড়েন।

কিছুক্ষণ পর মায়ের ঘরে আসেন অখিল। মায়ের পাশে বসে মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলেন, ‘আমাকে বুড়ো বলায় তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস, নারে মা? অর্পিতা তো মজা করে আমাকে বুড়ো বলেছে। ও বললেই হলো নাকি! বয়সের নিয়মে না হয় দুটো-চারটে চুল পেকে গেছে। কিন্তু আমি এখনও তোর সেই ছোট্ট অখিলই আছি। তোর কাছে আমি ছোট-ই থাকতে চাই।’

অখিল মায়ের কোলে মাথা রাখেন। শৈলবালা অখিলের গায়ে, মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে আদর করেন। অখিলও ছোট্ট শিশুর মতো মায়ের কোলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকেন। শৈলবালা ফিরে যান অনেক বছর আগে। পুরনো স্মৃতিতে মনের চোখ বোলান। ছোট্টবেলার অখিল ফিরে আসে মায়ের কাছে-শিশুকালের হাঁটি হাঁটি পা পা অখিল, কৈশোরের দুরন্ত অখিল, যৌবনের পিতৃহীন দিশেহারা গম্ভীর অখিল! বিভিন্ন বয়সের অখিল শৈলবালার স্মৃতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে থাকে। অখিলের সঙ্গে শৈলবালার এই লুকোচুরি খেলা নতুন নয়, তিনি প্রায়ই খেলেন একা একা। কেউ জানতেও পারে না। এমনকি অখিলও না। শৈলবালার সত্ত্বার সবটা জুড়ে আছে অখিল। অখিলের বাবা চলে গেছেন। মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়েছে অল্প বয়সেই। তখন এই অখিল-ই ছিল তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। অখিলকে আঁকড়ে ধরেই তিনি জীবনের ভাটিতে ভেসে এসেছেন। তাই অখিলকে না দেখে তিনি একটি রাতও শান্তিতে ঘুমুতে যেতে পারেন না। আগে অখিল দু-একদিনের জন্য শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেলে, তিনি যাবার সময় কাঁদতেন। কল্পনা এসব দেখে প্রথম প্রথম শাশুড়ির প্রতি খুব বিরক্ত হতেন। পরে যখন তিনি শাশুড়িকে বুঝতে শিখেছেন, শাশুড়ির ভেতরটা পড়তে পেরেছেন, তখন তিনিও শাশুড়িকে ভালবাসতে শুরু করেছেন নিজের মায়ের মতো করে। মায়ের জন্য অখিল কোথাও গিয়ে একটি রাতও থাকেন না। দরকারি কাজে কোথাও গেলে যতো রাতই হোক বাড়ি ফিরে আসেন। পাড়ার লোকে বলে আদিখ্যেতা। গায়ে মাখেন না শৈলবালা, অখিলও না। এই আদিখ্যেতাটুকু নিয়েই মা-ছেলে নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকতে চান আরো অনেকগুলো বছর।

স্মৃতির লুকোচুরি খেলা থেকে বেড়িয়ে এসে শৈলবালা মৃদু হাসেন। অখিলের কপালে চুমু খান। অখিল মায়ের হাতখানা নিয়ে নিজের ডান গালে রাখেন। তার চোখে চিক চিক করে ওঠে জল।

অর্পিতা রাতে শৈলবালার কাছে শোয়। রাতে শুয়ে কপট অভিমানে শৈলবালা অর্পিতার দিকে পিছন ফিরে থাকেন। অর্পিতা পিছন থেকে শৈলবালার গলার ওপর হাত দিয়ে বলে, ‘ও ঠাকুমা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি বাবাকে আর কখনও বুড়ো বলবো না। বাবা এখনও তোমার ছোট্ট খোকা। ঘুরে শোও ঠাকুমা। আর রাগ করে থেকো না।’

শৈলবালা পাশ ফেরেন। জানালা দিয়ে আসা উঠোনের বাতির আলোয় অর্পিতার দিকে তাকিয়ে দুহাত নেড়ে অর্পিতাকে বোঝান, ‘তুই আমার ছেলেকে আর বুড়ো বলবি না তো?’
অর্পিতা ঘাড় নেড়ে বলে, ‘বলবো না। আর কক্ষনো তোমার ছেলেকে বুড়ো বলবো না।’
শৈলবালা হাসেন, অর্পিতার গলা জড়িয়ে ধরেন।

কবে শৈলবালার নিজের চুলে পাক ধরেছে, খেয়াল নেই তার। একটা দুইটা করে পাকতে পাকতে মাথার আশি ভাগ চুল সাদা হয়ে গেছে। তাও কখনো মন খারাপ হয়নি তার। বরাবরের মতোই চুলে তেল মেখে পুকুর ঘাটে গেছেন, চুল খুলে স্নান করেছেন, খোঁপায় গামছা বেঁধে ঘরে এসে খোঁপা খুলে চুল আঁচড়েছেন। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ার জন্য, সাদা চুলের জন্য কখনও তার বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়নি। মন খারাপ হয়নি। অথচ আজ সন্তানের মাথার পাকা চুলের জন্য তার চোখের জল পর্যন্ত ঝরলো। এই বুঝি মায়ের মন, মা।

কিছুদিন বাদে বেসরকারি শিক্ষকবৃৃন্দ শতভাগ বেতন-ভাতার দাবীতে অনশন কর্মসূচী পালন শুরু করলে অখিলও যোগ দেন সেই অনশনে। অনশনের দ্বিতীয় দিনেই সরকারি দলের ছাত্রনামধারী গুণ্ডাবাহিনী শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ অনশন কর্মসূচীতে হামলা চালায়। নিরীহ-নিরস্ত্র শিক্ষকেরা এলোপাথারি মার খান। কারো মাথা ফাটে, কারো হাত ভাঙে, কারো বা ভাঙে পা। কয়েকজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তাদের মধ্যে একজন অখিল। অখিল মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। অচেতন অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে।

বাড়িতে খবর আসে কল্পনার কাছে। কল্পনা ছুটে যান হাসপাতালে। শৈলবালাকে মিথ্যে বলেন, ‘আমার দাদার খুব অসুখ। আমি দাদাকে দেখতে যাচ্ছি। আপনার ছেলেও স্কুল থেকে যাবে। আমরা আজ নাও ফিরতে পারি।’

পরদিন সকালে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ায় বাড়ির উঠোনে। তুলসী তলায় নামানো হয় অখিলকে। শৈলবালা সারারাত ছটফট করেছেন ছেলের জন্য। ছেলের চিন্তায় ঘুম আসেনি চোখে। সূর্য ওঠার পর থেকে তিনি অপেক্ষায় ছিলেন কখন সাইকেলের বেল বাজবে। কখন এসে ‘মা’ বলে ডাকবে তার অখিল আর তিনি ছুটে যাবেন অখিলের কাছে!

শৈলবালার অপেক্ষার প্রহর শেষ। অখিল এলেও তিনি অখিলের কাছে ছুটে যাননি। চারিদিকে কান্নার রোল-কল্পনার, অর্পিতার, পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজনদের। অথচ বারান্দায় বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শৈলবালা। ঐ তো অখিল আসছে। টাল খাওয়া পায়ে দু-হাত বাড়িয়ে ছোট্ট অখিল তার দিকে ছুটে আসছে, পড়ে যাচ্ছে, উঠে আবার দৌড়চ্ছে! তার পিছনে আরো অখিল। বাল্যকালের অখিল, কৈশোরের অখিল, যৌবনের অখিল। কতো অখিল!


পাইকপাড়া, মিরপুর।
ডিসেম্বর, ২০১২
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২১
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×