somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লৌকিক লোকলীলা (উপন্যাস: পর্ব-ষোলো)

০৭ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তেরো

‘তুই এট্টু বসে জিরে, আমি মাটি খুঁড়ি।’ বিলাসের উদ্দেশে বলে উঠে দাঁড়ায় অমল।

বিলাস কোমরের গামছা খুলে মুখ এবং শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে ঘাসের ওপর বসে পড়ে, অমল কোদাল হাতে নিয়ে বিলাসের খোঁড়া গর্তে একের পর এক কোপ বসায় আর মাটি ছুড়ে ফেলে গর্তের পাশে।

পরিমল অমলের উদ্দেশে বলে, ‘পশ্চিমদিক আর হাতখানেক জায়গা নিয়ে খুঁড়লি মনে হয় ভালো হতো রে, আমাগের অনুমান তো ভুলও হবার পারে!’
বিলাস বলে, ‘আগের তে কবি নে!’

অমল পশ্চিমদিকে আরো হাত খানেক জায়গা নিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করে, মাটি খোঁড়ে ঠিকই কিন্তু ওর হৃদমঞ্চে অবিরাম গান গেয়ে চলে কিশোরী আশালতা! অমলের চার বছরের দাম্পত্য-জীবন, দুই বছরের একটা ছেলে আছে, তবুও আশালতাকে ভুলতে পারে না। ও যখন আশালতার কথা ভাবে, তখন আশালতার পাশে প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে আরেকজনের মুখ, সে-মুখ গায়ত্রীর। গায়ত্রী অমলের ক্লাসমেট, হোমিওপ্যাথিক কলেজে একসঙ্গে পড়ত, প্রথমদিকে গায়ত্রী আর দশজন সহপাঠীর মতো থাকলেও কিছুদিন পর ওর সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওদের দুজনের কাছেই ঢাকা ছিল অচেনা, ও গিয়েছিল ফরিদপুর থেকে আর গায়ত্রী বরিশাল থেকে। ছুটির দিনগুলোতে দুজনে সারা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ চষে বেড়াত; মিরপুর বেড়িবাঁধ থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের পানাম নগরে ওদের কত দিন গড়িয়ে সন্ধে নেমেছে! অমল তখনো বরিশালে যায় নি, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটের ছোট লঞ্চের বাইরে বড় কোনো লঞ্চে চড়ার অভিজ্ঞতা নেই, ওর এই আফসোসের কথা প্রায়ই বলত গায়ত্রীকে। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় দূর্গাপূজা উপলক্ষে বাড়িতে যাবার আগে গায়ত্রী ওকে বলে, ‘তুই বরিশাল যাবি?’

‘তোদের বাড়ি?’

‘পাগল তুই! তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গেলে মা আমাকে আস্ত রাখবে! আর ঝড়ের বেগে এলাকায় আমার নামে কলঙ্ক রটে যাবে!’
‘তাহলে থাকবো কোথায়?’

‘হোটেলে। তুই পূজার পর ফরিদপুর থেকে বরিশাল চলে যাবি। সারাদিন আমরা ঘুরে বেড়াব, রাতে তুই হোটেলে গিয়ে থাকবি। লক্ষ্মীপূজার পরের রাতে আমরা একসঙ্গে লঞ্চে ঢাকায় চলে আসবো।’

‘ভালো আইডিয়া!’

অদেখা মেঘনা-কীর্তনখোলা যেন ঢেউয়ের আঁচল বাড়িয়ে তীব্রভাবে টানে অমলকে, ও রাজি হয়ে যায়।

দূর্গাপূজার কয়েকদিন পর অমল সড়কপথে ফরিদপুর হয়ে বরিশাল চলে যায়, পূর্ব পরিকল্পনা মতো হোটেলে গিয়ে ওঠে, দিনভর দুজনে একসঙ্গে বরিশাল শহর ঘুরে সন্ধ্যায় ও ফিরে আসে হোটেলে আর গায়ত্রী বাড়ি চলে যায়। দুইদিন বরিশালে থাকার পর লক্ষ্মীপূজার পরদিন সন্ধ্যার পর ওরা ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চে ওঠে, লঞ্চ ছাড়লে রাতে খাওয়ার পর ওরা ছাদে যায়। কোজাগরি পূর্ণিমার পরের রাত হওয়ায় নদীর বুকে তখন ঝকঝকে চাঁদ হাসছে, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে জলপথ ও জনপদ। অমলের মনে হয় ও যেন পার্থিব জগত থেকে হঠাৎ অপার্থিব জগতে এসে পড়েছে! গায়ত্রীকে বলে, ‘ধন্যবাদ বন্ধু, এমন সুন্দর একটি রাত উপহার দেবার জন্য। এই রাতের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না!’

তখন অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধ, দিনে গরম হলেও রাতে নদীর বুকের চলমান লঞ্চের ছাদের শীতল বাতাসে শরীর যেন হিম হয়ে আসে! অমলের এই পথের লঞ্চ-যাত্রার অভিজ্ঞতা না থাকায় সঙ্গে কোনো গরম কাপড় ছিল না, শার্ট গায়ে দিয়েই ছাদে ওঠে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই শীতের দাপটে ধরাশায়ী হয়। অভিজ্ঞ গায়ত্রী ওর হাতে থাকা ভাঁজ করা চাদর অমলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নে।’

‘তোর শীত লাগছে না? তুই গায়ে দে।’
‘তুই সরে আয়, বড় চাদর, দুজনেই গায়ে দিতে পারব।’

চাঁদের ধার করা আলোয় দুজনে এক চাদর গায়ে-মাথায় দিয়ে পাশাপাশি বসে থাকে, চাদরের উষ্ণতায় আর দুজন দুজনের শরীরের ওম অনুভব করে গল্পে-গল্পে পার করে রাতের প্রহরের পর প্রহর। একসময় গায়ত্রী বলে, ‘আমি খুব বিপদে পড়েছি রে!’

অমল গায়ত্রীর মুখের দিকে তাকায়, ‘কেন?’

‘পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে এসেছিল। আগে থেকে বাড়ির কেউ আমাকে কিছু জানায় নি, হঠাৎ করেই বিজয়া দশমীর দিন মা আমাকে জানালো- “একটা ভালো পাত্রের খোঁজ পেয়েছি, পাত্রপক্ষ কাল তোকে দেখতে আসবে।” শুনে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! মাকে বললাম যে আমি লেখাপড়া শেষ করে নিজে কিছু না করা পর্যন্ত বিয়ে করব না। মা বললো- “দেখে যাক, দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।” পাত্রপক্ষ এল, দেখার পর তারা নাকি বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখন মায়ের কথা যে ছেলে ভালো, বিয়েটা সেরে ফেল, বিয়ের পর অনেক মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে, তুইও তাই করবি।’

‘ছেলে কী করে?’
‘সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক। ছেলে যত ভালোই হোক, আমি নিজে কিছু না করে বিয়ে করতে চাই না। আমি স্বাধীনচেতা মেয়ে, অন্যের কাছে হাত পাততে পারব না।’
‘মাসিমাকে বুঝিয়ে বল।’
‘মাকে বোঝায় সাধ্য কার! আমার মাকে তো চিনিস না, উকিলের মেয়ে, একবার যা বলে তা করেই ছাড়ে।’
‘তাইলে মেশোমশাইকে বোঝা।’

‘বাবা যদি মা’র কথার ওপর কথা বলতে পারত, তাহলে তো বেঁচেই যেতাম, বাবার সাধ্য কী মা’র মতের বিরুদ্ধে কথা বলে! আমাদের পরিবারে মা’র কথাই শেষ কথা। বাবার জন্য আমার খারাপ লাগে জানিস, নিরীহ মানুষ, আমার মায়ের দাপটে বেচারা সারাজীবন বাঘিনীর সামনে পড়া ভীত খরগোশের মতো জীবন কাটিয়ে দিল!’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে দুজনই, তারপর গায়ত্রী বলে, ‘সামনের মাঘ মাসেই আমার বিয়ে দিতে চায় মা। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না রে!’

গায়ত্রী অমলের কাঁধে মাথা রাখে, জ্যোৎস্না ফুঁড়ে ধাবিত লঞ্চের ছাদে কেবল ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যায়। মৌনতায় সময় ভেসে যায় জোলো-বাতাস আর জ্যোৎস্নায়, বিপরীত দিক থেকে আসা একটা লঞ্চ সার্চলাইটের তীব্র আলো ফেললে সাদা ঢেউ, কস্তুরীর ঝোঁপ আর একটা ট্রলার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঁপু বাজিয়ে পেরিয়ে যায় লঞ্চটি। গায়ত্রী কোমল স্বরে বলে, ‘অমল…।’
অমল সাড়া দেয়, ‘হুম।’

আর কিছু বলে না গায়ত্রী, চাদরের অভ্যন্তরে দুই হাতের ভেতর অমলের বামহাত নিয়ে আলতভাবে নাড়াচাড়া করতে থাকে, যেন নিজের দুই হাতের উষ্ণতায় শীত থেকে সুরক্ষা দিতে চায় অমলের হাতটিকে। কিছুক্ষণ পর আবার একইভাবে বলে, ‘অমল…।’

‘বল।’
‘এখন আমার খুব ভালো লাগছে। বাড়িতে শেষ কয়েকটা দিন খুব তিক্ততায় কেটেছে, কিন্তু এখন সেই তিক্ততার মেঘ কেটে গেছে!’
‘এই পরিবেশে আমারও খুব ভালো লাগছে রে!’

গায়ত্রী অমলের কাঁধে মাথা রেখেই বলে, ‘আই লাভ ইউ অমল।’
অমল বলে, ‘যাঃ, ফাজলামি করিস না!’

গায়ত্রী অমলের কাঁধ থেকে মাথা তুলে মুখের দিকে তাকায়, দুজনের মাথার চাদর পড়ে যায় ঘাড়ের কাছে, অমলের হাতে জোরে চাপ দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, ‘আই অ্যাম সিরিয়াস অমল, আমি তোকে ভালোবাসি।’

বলেই অমলের ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাত দিয়ে মাথাটা কাছে টেনে আলতভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায় বাম গালে, তারপর বলে, ‘এবার বিশ্বাস হলো তো!’

অমল হতভম্ব হয়ে যায়, কোনো কথা খুঁজে পায় না, মেরুদণ্ড টান করে সোজা হয়ে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার গায়ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নেয় দূরের জ্যোৎস্নামাখা ঢেউয়ের দিকে। গায়ত্রী অমলের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলে, ‘ভেবেছিলাম তুই-ই আগে কথাটা বলবি, তাই আমি এতদিন অপেক্ষা করছিলাম। এখন দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে, তাই আমাকেই বলতে হলো!’

গায়ত্রী অমলের বাহুতে নাক গুঁজে ঘ্রাণ নেয়, কাঁধে মাথা ঘষে, কয়েক মুহূর্তের নীরবতা শেষে বলে, ‘কী রে তুই কিছু বলছিস না কেন? শোন, আমরা কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলব, তারপর আমি বাড়িতে বলব যে বিয়ে করে ফেলেছি। নইলে আমি কিছুতেই ওই ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে আটকাতে পারব না।’

অমলের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে কাঁধ থেকে মাথা তোলে গায়ত্রী, হাত দিয়ে অমলের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, ‘এই তুই এমন কাঠ হয়ে আছিস কেন রে? ভয় পাচ্ছিস? এমন সুন্দর জ্যোৎস্না রাতে একটা মেয়ে যেচে প্রেম নিবেদন করছে, বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে, কোথায় একটু জড়িয়ে ধরে আদর করবি, তা না কেমন সিঁটিয়ে আছিস! অনেক ছেলেই বিয়ে করতে ভয় পায়, তোর কোনো ভয় নেই, পাস করে আমিও রোজগার করব, সংসারের দায়িত্ব দুজনেই কাঁধে তুলে নেব।’

তবুও চুপ করে থাকে অমল, গায়ত্রী ওর বাহু ধরে ঝাঁকি দেয়, ‘কিরে তুই এখনো চুপ করে থাকবি? কিছু একটা বল।’
অমল শূন্যে দৃষ্টি রেখে বলে, ‘কী বলব?’

‘স্বপ্নের কথা বল, আমাদের সুন্দর আগামীর কথা বল, আমরা কিভাবে সংসার করব, আমাদের বাসাটা কেমন হবে, আমাদের সন্তান কয়টা হবে….।’

অমল গায়ত্রীর চোখের দিকে তাকায়, গায়ত্রীর কথা শেষ হবার আগেই অনেক কষ্টে ভেতরের কথাগুলো উগড়ে দেয়, ‘আমি আমার ছেলেবেলার বান্ধবী আশালতাকে ভালোবাসি গায়ত্রী, ওকে বিয়ে করব বলে কথা দিয়েছি।’

অমলের বাহু আঁকড়ে থাকা গায়ত্রীর হাতটা হঠাৎ আলগা হয়ে যায়, সামনের আলোকিত চাঁদটাকে তার মায়ের ভাত রান্না করা হাঁড়ির কালিমাখা তলা আর জ্যোৎস্নাকে অরণ্যের প্রাণ-প্রকৃতি জ্বালানো ভয়ংকর দাবানলের রাশি রাশি কালো ধোঁয়ার মতো মনে হয়, নদীর বুকের শীতল বাতাসকে মনে হয় আগুনের শিখার তপ্ত ছোবল! ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে গায়ত্রী, চোখের জলে কপোল ভেসে যায়, তারপর তার ফোঁপানোর শব্দ শোনা যায় না, কিন্তু নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে অনেকক্ষণ, পরে আর চোখের জলও ঝরে না, জ্যোৎস্নারাতের মেঘনার চরের মতো শূন্যতায় ভরা ধূ ধূ চোখ।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অমল মূক হয়ে বসে থাকে গায়ত্রীকে সান্ত্বনা দেবার মতো শব্দ সাজিয়ে বাক্য তৈরি করার বিফলতায়, বেশ কিছুক্ষণ পর কেবল গায়ত্রীর ডান হাতটি টেনে নেয় নিজের দুই হাতের মধ্যে, গায়ত্রী তখনো প্রাচীন সভ্যতা ওয়ারী-বটেশ্বরের মতো নৈঃশব্দের নিগড়ে বন্দী! অমল বড় আশা নিয়ে লঞ্চে পা রেখেছিল, জীবনের প্রথম এতবড় লঞ্চে আরোহণ, ভেবেছিল রাতটা হবে আনন্দের, অবাধ জ্যোৎস্নায় লঞ্চের ছাদে বসে দুই বন্ধু গল্প করতে করতে ঢাকায় পৌঁছে যাবে, দারুণ অভিজ্ঞতায় পূর্ণ রাতটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্মরণীয় হলো ঠিকই, কিন্তু তা বিষাদের বন্যায় প্লাবিত! লঞ্চের ছাদে উঠে যে অমলের মনে হচ্ছিল- আহা, রাতটা কী সুন্দর, জীবন কত আনন্দময়! গায়ত্রীর প্রেমের প্রস্তাব এবং আশালতার কথা শুনে ওর কান্নার পর অমলের মনে হয় রাত্রিটা বড় বেশি দীর্ঘ, যেন মহাকালের বিষাদময় অনন্ত কালরাত্রি, যেন বহুকাল ধরে সে এভাবেই বসে আছে! তাড়াতাড়ি ভোর হয় না কেন!

প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরের মাঘ মাসেই মায়ের পছন্দ করা সেই পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় গায়ত্রীর।

কিন্তু যার জন্য গায়ত্রীকে হারায় অমল, সেই আশালতার বাবা জগদীশ দাসের কাছে যখন ওদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান অমলের জ্যাঠতুতো দাদা অশোক, প্রস্তাবটি বিবেচনা করার জন্য একটুও কালক্ষেপণ না করে শোনামাত্রই প্রত্যাখান করেন জগদীশ। অমল আর আশালতা যে দুজন দুজনকে ভালোবাসে আর ওদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, অশোক সে-সব কথা খুলে বলার পরও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন জগদীশ এবং তার প্রত্যাখানের ধরন এমন রূঢ় ছিল যে অশোক ব্যথিত হন আর অপমানিত বোধ করেন। এই সময়েই কী করে যেন অমল আর আশালতার সম্পর্কের কথা এবং বিয়ের প্রস্তাব ও প্রত্যাখানের কথা এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। হেঁশেল থেকে চায়ের দোকানে ওদের দুজনকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, নানা ধরনের কথা ছড়ায় মানুষের মুখে মুখে। এই সময়ে অমলের কানে আসে যে জগদীশ নাকি বলেছে, ‘মিয়া কাটে জলে ভাসায়ে দেব, তাও বাইর অওয়া জাতের ছাওয়ালের সাথে বিয়ে দেব না!’

জগদীশের এই কথা অমলকে ভীষণ আহত করে; শুধু অমলকেই নয়, ওদের গোটা পরিবারের শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত খুঁচিয়ে পুনরায় জাগিয়ে তোলেন জগদীশ। সেই কবেকার কথা, মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল; তখন যারা ছোট বা পরে যাদের জন্ম হয়েছে, কিংবা সেই ঘটনার পরে গ্রামে যারা বউ হয়ে এসেছে, তারা অনেকেই জানত সেই কথা। কিন্তু জগদীশের ওই একটি বাক্য সেই পুরোনো ঘটনাকে আবার নতুন করে সামনে নিয়ে আসে, অনেকেই কৌতুহলী হয়ে বড়দের কাছে জানতে চায় সেই ঘটনার কথা। যারা জানত তারা রসিয়ে রসিয়ে জাবড় কাটে না জানাদের কাছে, অনেকেই জেনে আমোদিত হয় এই ভেবে যে ডাক্তার বাড়ির এমন কলঙ্ক আছে!

কলঙ্ক তাই যা অন্যায়; চুরি করা, ডাকাতি করা, ঘুষ খাওয়া, চাঁদাবাজি করা, লোক ঠকানো ইত্যাদি ধরনের কর্মকাণ্ড যদি কেউ করে থাকে সেটাকে কলঙ্ক বলা যায়। এইসব কর্মকাণ্ড করেও সমাজে অনেকে যথেষ্ট সম্মান নিয়ে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকে সর্বকালেই, অমলদের গ্রামেও আছে! অথচ সেই কবে অমলের পিসি ভালোবেসে বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রেমিককে বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন বলে এতকাল পরেও সেই ভালোবাসাকে কলঙ্ক আখ্যা দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে সমাজে হেঁয় করা হয়!

অমলের ছোট পিসি, ওর দাদুর দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো হওয়ায় ওর দাদু মেয়ের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণা। একে তো দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তান, তার ওপর কালো এবং অল্প শিক্ষিত বলে কৃষ্ণার বিয়ে হচ্ছিল না। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে এসে কৃষ্ণার গায়ের রঙ দেখে হতাশা গোপন করে ভদ্রতার খাতিরে বলত- ‘ফিরে গিয়ে বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা করে জানাব।’ আর জানাত না তারা, অথবা ঘটকের মাধ্যমে জানাত তাদের পাত্রী পছন্দ হয় নি। বয়স বেড়ে যাচ্ছিল কৃষ্ণার, তার চেয়ে ছোট বয়সের মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তাদের সন্তানেরা বড় হচ্ছিল, অথচ কৃষ্ণার বিয়েই হচ্ছিল না।

অমল তখন নয় বছরের বালক, এক চৈত্রের রৌদ্রজ্জ্বল খাঁ খাঁ দুপুরে বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ায় টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর সময় দ্যাখে ওর পিসি নির্জন বারোয়ারি কালী-মন্দিরের সিঁড়িতে বসে গল্প করছেন এক অচেনা লোকের সঙ্গে। শ্যামবর্ণ লোকটার কপালে লম্বা একফালি সিঁদূর, পরনে লাল ধুতি, গায়ে লাল গেঞ্জি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে তাগা, মাথায় উস্কো-খুস্কো কোঁকড়া চুল, নগ্ন পা। লোকটা যে চৈত্রপূজার সন্ন্যাসী এবং ওদের গ্রামের নয় তা বুঝেছিল অমল। পিসি যে দেখতে খুব কালো বলে তার বিয়ে হয় না, বাড়ির লোকজনও পিসিকে অবহেলা করে, এমনকি ওর মাও পিসিকে কেবল খাটায়, ঠাকুরমা উঠতে-বসতে মুখ ঝামটা দেয়, পিসি মন খারাপ করে থাকে আর কাঁদে, এসব তখন সে বুঝত। পিসির প্রতি তার দরদ ছিল, পিসিও তাকে আদর করতেন। পিসিকে লোকটার সঙ্গে গল্প করতে দেখে ওর কচি মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পিসি লোকটার কাছে বসে আছে কেন? অমল বাড়িতে ফেরার পর দ্যাখে ওর মা পিসির ওপর রাগ ঝাড়ছেন! ওকে দেখেই বলেন, ‘দ্যাখ তো তোর পিসি কোন চুলোয় গেচে! কাপড়গুলো ক্ষারে পচতেচে, আর উনি কোন সগ্গে গেছে ধান বানবার!’

পিসির সন্ধান জেনেও অমল মাকে কিছু বলে না পিসিকে আরো বকবে বলে, পিসিকে খোঁজার অছিলায় সে আবারও বাড়ি থেকে বের হয়, দূর থেকে দ্যাখে যে পিসি তখনো সেই লোকটার সঙ্গে কথা বলছে, লোকটা পিসির ডান হাত ধরে আছে। বাড়ির পরিবেশই বোধহয় ওকে অভিজ্ঞ করে তুলেছিল, ওর তখন মনে হয়েছিল ওই লোকটার সঙ্গে পিসির বিয়ে হলে বেশ হয়, তাহলে আর পিসিকে বাড়ির মানুষের কাছে বকা খেতে হবে না!

এর মাস খানেক পর একদিন সকালবেলা কৃষ্ণা পিসিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, বাড়িতে শোরগোল পড়ে যায়, শুরু হয় পিসির সন্ধান। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চোখ রগড়াতে রগড়াতে পিসির নিখোঁজ হবার খবর শুনেই অমলের চোখে ভেসে ওঠে মন্দিরের সিঁড়িতে পিসির হাত ধরে ওই লোকটার বসে থাকার দৃশ্য।

সেদিন বিকেলেই খবর পাওয়া যায় যে কৃষ্ণা বাড়ি থেকে পালিয়ে সিধলাঝুরি গ্রামের এক নমশূদ্র ছেলেকে বিয়ে করেছে, এখন ছেলের বাড়িতেই আছে। এই খবর শোনার পর অমলের মনে হয় পিসি নিশ্চয় মন্দিরের সিঁড়িতে বসে থাকা ওই লোকটাকেই বিয়ে করেছে, বেশ করেছে পিসি। ওর কাছে পিসি বেশ করেছে মনে হলেও বাড়ির মানুষের কথা শুনে ও ধন্দে পড়ে যায়। বড়দের কথায় কান পেতে ও জানতে পারে যে পিসি পালিয়ে গিয়ে একটা নমশূদ্দুর ছেলেকে বিয়ে করে অন্যায় করেছে, সমাজে তাদের মান-সম্মান নষ্ট করেছে! ওর ঠাকুরমা ঘরে হত্যে দিয়ে কান্না শুরু করে, পথে-ঘাটে কিংবা পড়শীদের বাড়িতেও তখন পিসিকে নিয়ে আলোচনা হয়, সবাই পিসিকে মন্দ বলে। সবার মুখেই ওই এক কথা- ‘নমশূদ্দুরির সাথে বিয়ে বসে কিশনা বংশের মুহি চুনকালি দিচে!’

স্কুলে যাবার পথে অমলকেও কেউ কেউ হাসতে হাসতে বলেছে- ‘কী রে তোর পিসি কনে?’, কেউ বলেছে, ‘তোর পিসি নাকি নমশূদ্দুরির সাথে ভাগিচে!’

এইসব কথা বলে তারা এমনভাবে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হাসত যে অপমানটা ছোট্ট অমলকে ভীষণ আহত করত, ওর খুব রাগ হতো, কান্নাও পেত। কিন্তু ও বুঝে উঠতে পারত না যে নমশূদ্দুর বিষয়টা কী! ওই লোকটা তো দেখতে তাদের গ্রামের আর দশজনেরই মতোই; চোখ আছে, মুখ আছে, হাত-পা আছে। তাহলে লোকটা নমশূদ্দুর হবে কেন? নমশূদ্দুর মানে কী? নমশূদ্দুর মানে কি চোর-ডাকাতের মতো খারাপ কিছু? নাকি ছেলে ধরা? এই প্রশ্নটি তাকে তাড়ায়, কিন্তু ভয়ে বাড়ির কাউকে জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না, আর অপমানের আশঙ্কায় পাড়ার কাউকেও নয়।

আরো বড় হয়ে ও যখন ‘নমশূদ্দুর’ শব্দের অর্থ জানতে পারে, তখন ওর মনে হয় বেশ করেছে পিসি বাড়ি থেকে পালিয়ে নমশূদ্দুর ছেলেকে বিয়ে করে। কই পিসি কালো বলে তাদের মাহিষ্য সমাজের কোনো ছেলে তো পিসিকে বিয়ে করল না! এমনকি কোনো কালো ছেলেও না!

বিয়ের প্রায় দুই বছর পর অমলের বাবা প্রথম কৃষ্ণার শ্বশুরবাড়িতে যান অমলকে সঙ্গে নিয়ে, অমলের বাবা এবং অমলকে জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণার সে কী কান্না! এরপর অমলের বাবা আরো কয়েকবার গিয়েছেন কৃষ্ণার শ্বশুরবাড়িতে, দূর্গাপূজার আগে উপহার নিয়ে গেছেন বোন এবং তার শ্বশুরবাড়ির মানুষের জন্য। পরিবারের অন্যরা চান নি বলে অমলের বাবা কখনোই বোন-ভগ্নীপতিকে বাড়িতে আনেন নি, আসার কথা বলেনও নি। এর কয়েক বছর পরই কৃষ্ণার শ্বশুরবাড়ির পরিবার জায়গা-জমি বেচে চলে যায় ভারতে, ভারতে যাবার আগে এক রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে শেষবারের মতো বাবার ভিটে দেখতে এসেছিলেন কৃষ্ণা, ঘণ্টা দেড়েক থেকেই চলে গিয়েছিলেন, বাইরের মানুষ জানতেও পারে নি। ভারতে যাবার পর আর কখনো কৃষ্ণা বাংলাদেশে আসেন নি। বহু বছর বাদে আশালতার বাবা জগদীশ দাস পুনরায় খুঁচিয়ে প্রায় ভুলে যাওয়া কৃষ্ণার নামটি আবার সামনে নিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, অমলের পেশা নিয়েও কটাক্ষ করে মানুষের কাছে জগদীশ বলেন, ‘যার নাই কোনো গতি, সে করে হোমেপতি!’ অর্থাৎ যার অন্য কোনো উপায় নেই, সে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করে।
আশালতার বাবার এইসব কথায় অমলের জ্যাঠতুতো দাদারা রেগে যান, তারা জানান যে অমল যদি আশালতাকে বিয়ে করে তাহলে তারা সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না। অমলের মাও বেঁকে বসেন, তারপরও অমল আশালতাকেই বিয়ে করতে চায়। আশালতার সঙ্গে দেখা করে বলে, ‘চলো, আমরা নিজেরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করি।’

আশালতা জানায়, ‘বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে আমি বিয়ে করবার পারব না।’
‘তাইলে আমরা এখন কী করব?’
‘আমরা আরো কিছুদিন অপেক্ষা করি, দেখি বাবা রাজি হয় কি না।’

অমলের মনে হয় আশালতাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে, যেখানে গ্রামের কুটিল রাজনীতি নেই। কিন্তু ও জানে আশালতা তাতে রাজি হবে না, তাই মনের কথা মনে রেখেই অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে আশালতার মুখের দিকে!



(চলবে....)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০২২ রাত ৯:১২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×