somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লৌকিক লোকলীলা (উপন্যাস: পর্ব-আঠারো)

১০ ই মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পনেরো

অমলের পর কোদাল হাতে নেয় পরিমল, প্রায় কোমর সমান গর্তে নেমে বিলাসের ধরে রাখা টর্চের আলোয় অবিরাম কুপিয়ে কুপিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে, গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ে মাটিতে, কোপ দেবার এবং কোদালের মাটি উপরে ফেলার সময় মাঝে মাঝে গর্তের দেয়ালে ঘষা লেগে শরীরে জড়ানো ধুলো ঘামে ভিজে কাদাকাদা হয়ে ওঠে। গর্ত অনেকটা গভীর হওয়ায় সাবধানে আস্তে আস্তে অগভীর কোপ বসিয়ে মাটি তুলতে থাকে পরিমল, তবু বিলাস ওকে সতর্ক করে, ‘এই পরি, এহন সাবধানে কোপ দে, আরো আস্তে।’

পরিমল আস্তে আস্তে কোপ দিয়ে মাটি তুলে উপরে ফেলে, অল্প কিছুক্ষণ পর কোদালের কোপে ভিন্নরকম শব্দ হলে আলগোছে মাটি সরিয়ে একখানা ধূসর হাড়ের অংশবিশেষ দেখতে পায়। হাড় দেখে বিলাস বলে, ‘ওই তো পাওয়া গেছে।’

সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে গর্তের কাছে বসে নিচের দিকে ঝুঁকে গর্তের ভেতরে তাকায় অমল।

পরিমল বলে, ‘কুদাল দিয়ে আর মাটি খুঁড়া যাবি নে, রামদা দে।’

পরিমল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের কোদাল গর্তের বাইরে মাটিতে রেখে দেয়। অমল মাটি থেকে রামদা তুলে পরিমলের হাতে দিয়ে পুনরায় গর্তের ভেতরে দৃষ্টি রাখে, টর্চের আলোয় ঝুরোমাটির ভেতরে হাড়ের আবৃত অংশটুকুর দিকে তাকিয়ে থাকে, ওর বুকের ভেতর দিয়ে যেন হু হু করে শীতল বাতাস বয়ে যায়, গা শির শির করে, লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। হঠাৎ-ই যেন শরীরটা ভীষণ ভারী হয়ে যায়!
পরিমল গর্তের মধ্যে বসে রামদার মাথা দিয়ে আস্তে আস্তে মাটি কোপায় আর একটু পর পর দুই হাতের আঁজলায় সেই মাটি নিয়ে গর্তের বাইরে ছুড়ে ফেলে। পরিমল যত মাটি সরায় তত বেশি হাড়ের অংশ উন্মোচিত হয়, বিলাস বলে, ‘উডা কোন জাগার হাড়?’
পরিমল আঙুল দিয়ে আরেকটু মাটি সরিয়ে বলে, ‘পাঁজরের হাড়।’

পরিমলের গলা কিছুটা কাঁপে, অমল হাড় থেকে চোখ সরায় না। বিলাস বলে, ‘তালি আরেট্টু দক্ষিণ দিকের মাটি সরা, মাথা আরো দক্ষিণে।’

অমল বলে, ‘বুকের কাছের মাটি আরেট্টু সরা না পরি, এট্টু দেহি।’

অমলের কণ্ঠ কেমন যেন শোনায়, খানিকটা বুঝি হাহাকার ফুটে ওঠে, গর্তের ভেতরে বসেই ক্ষণিকের জন্য পরিমল আকাশ দেখার মতো অমলের মুখের দিকে তাকায়, অন্ধকারে অমলের মুখের ভাষা পড়তে পারে না, তবু তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত; বিলাসও তাকায় অমলের দিকে। ওরা দুজন একসঙ্গে তাকানোয় অমল কিছুটা বিব্রতবোধ করে, মনে মনে ভাবে যে আমি কী অসৌজন্যমুলক কিছু বলে ফেললাম? ছয় বছর আগে সমাধি দেওয়া একজন মৃত মানুষের বুকে হাড় ছাড়া আর কী-ই বা আছে! তাহলে ওরা দুজন অমনভাবে তাকালো কেন?

পরিমল পুনরায় কঙ্কালের বুক আবৃত করা মাটি রামদার মাথা দিয়ে আলগা করে আর হাত দিয়ে সরিয়ে রাখে যেদিকে ও নিজে বসে আছে, অর্থাৎ কঙ্কালের কোমরের দিকে। ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকে কঙ্কালের বুকের হাড়গুলো, বিলাসের হাতের টর্চের আলো বিরামহীন এবং স্থির; প্রায় একইরকমভাবে স্থির বিলাসের দৃষ্টি, কদাচিৎ ওর চোখের পলক পড়ে। অমলও গর্তের পশ্চিম পাড়ে হাঁটু মুড়ে বসে ঝুঁকে তাকিয়ে থাকে ক্রমশ উন্মোচিত হতে থাকা কঙ্কালের বুকের হাড়ের দিকে, কয়েকটি হাড় ভেঙে বসে গেছে, কোটরে মাটি, পরিমল সে-জায়গার মাটিও সরায় এমন আলগোছে যেন দ্রুত সরাতে গেলে আঙুলের স্পর্শে কঙ্কাল ব্যথা পাবে!

অমল ভাবে- হাড়ের কাঠামোর ভেতরে ওখানে একদিন হৃদয় ছিল, হৃদয়ে ভালোবাসা ছিল, ওখানে কান পাতলে ভালোবাসার স্লোগানের মতো হৃদস্পন্দনের ধ্বনি শোনা যেত, অথচ সেই হৃদয় আজ কেবলই ঝুরো মাটি! আহারে জীবন!

অমল যে হঠাৎ গর্তের কাছেই বসে পড়েছে তা খেয়াল না করায় পরিমল গর্তের ভেতর থেকে দুই হাতের আঁজলা ভরে মাটি ছুড়ে ফেলে ওপরে না তাকিয়েই, সেই মাটি কখনো অমলের পাশে পড়ে, কখনো-বা গায়েও। হঠাৎ এক আজঁলা মাটি অমলের বুকে এসে লাগে, শরীর থেকে গড়িয়ে ঊরু আবৃত করে রাখা ধুতির ভাঁজে ভাঁজে আটকে যায়, এরপর আরো দুই আঁজলা মাটি এসে পড়ে ওর কোলের মধ্যে। অমল ধুতির ওপর থেকে কিছু মাটি ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরে, অন্ধকারে মাটির রঙ বোঝা যায় না। ওর মনে হয় এই এক মুঠো মাটি নিছকই মাটি নয়, এই মাটি হৃদয়, সমাধির অভ্যন্তরে হৃদয় গলে সৃষ্টি হয়েছে এই মাটি! হাত নাকের কাছে নিয়ে চোখ বুজে মাটির ঘ্রাণ নেয়, একবার-দুইবার নয়, বারবার। হয়ত চন্দনার পশ্চিম পারের কোনো গৃহস্থবাড়ির পুকুর খোঁড়া মাটি কিংবা রঘু পালের কুমারশালার মাটির মতোই একই রকম স্বাভাবিক ঘ্রাণ এই একমুঠো মাটিতেও, তবু ওর ঘ্রাণেন্দ্রিয় যেন অনুভব করে একজন মানুষের শরীরের ঘ্রাণ! হঠাৎ এক অদ্ভুত খেয়াল চাপে অমলের মাথায়, পরিমল আর বিলাসের অলক্ষে সন্তর্পণে কোমরের গামছা খুলে প্রথমে হাতের আঁজলার মাটিটুকু রাখে গামছায়, তারপর ওর হাঁটুর সামনে থেকে আরো তিন-চার মুঠো মাটি গামছায় রেখে বেশ কায়দা করে কোমরে বেঁধে রাখে গামছাখানা, এই মাটির সঙ্গে আরো মাটি টবে রেখে সেখানে একটা নীল অপরাজিতা ফুলের চারা রোপন করার খেয়াল চাপে ওর মাথায়!

অমল আবার গর্তের ভেতরে তাকায়, এরই মধ্যে পরিমল মাটি সরিয়ে মাথার খুলিটাও উন্মোচন করায় আবক্ষ কঙ্কাল দেখতে পায়। চোখের কোটর, মুখ আর নাকের গহ্বর ভরাট হয়ে আছে মাটিতে। কেবল অমল নয়, পরিমল আর বিলাসও অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে আবক্ষ কঙ্কালের দিকে। তিনজনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই, কোনো নড়াচড়া নেই, যেন তিন জায়গায় স্থির ত্রিমূর্তি! ওরা সময় ভুলে যায়, ওদের সময় যেন স্থির হয়ে থাকে!

অমলের মনে হয়- ছয় বছর, মাত্র ছয়টি বছর আগেও একজন মানুষ পৃথিবীর এই জনপদে জীবন্ত ছিল, হাঁটাচলা করত, আহার-বিহার করত, কথা বলত, হাসত, গাইত, কাঁদত। স্বামী ছিল তার, সন্তান ছিল, শত্রু-মিত্রও নিশ্চয় ছিল। ছয় বছর আগে রক্ত-মাংসের সেই মানুষটি চিরঘুমের অতলে ডুব দেয়, তারপর ঠাঁই হয় এই মাটির ঘরে, ছয় বছর পরে রক্ত-মাংসের সেই মানুষটি আজ কেবলই জড় কঙ্কাল! আজ কোথায় সেই চোখ-মুখ-নাকসহ সুন্দর-মায়াবী মুখশ্রী, আকর্ষণীয় দেহবল্লরী!

পরিমলের হাতের তলায় কঙ্কালের বুকের পাঁজর, ওর মাথায়ও কত কী ভাবনা আসে, ওর অভিযোগের তীর ঈশ্বরের দিকে- ভগবান তুমি এমন নিষ্ঠুর কেন? মানুষকে দুঃখ দিয়ে কী সুখ পাও তুমি?

বিলাস তাড়া দেয় পরিমলকে, ‘নে তাড়াতাড়ি কর। এমনিতেই মেলা দেরি অয়ে গেচে, আর দেরি করিসনে।’

বিলাসের তাড়ায় গর্তের মধ্যে খাঁড়া করে রাখা রামদা হাতে নেয় পরিমল আর আশ্চর্যভাবে অনুভব করে যে ওর হাত মৃদু কাঁপছে, বুক ধুকপুক করছে, তৃষ্ণা অনুভব করছে! রামদা’র হাতল শক্ত করে চেপে ধরে পরিমল নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে এবং অনেকটা সফলও হয়।

বিলাসের পিঠে মশা কামড়ালে বামহাত দিয়ে পিঠ চুলকানোর সময় ওর ডান হাত কিছুটা নড়ে যায় এবং টর্চের আলোর ফোকাসটা কঙ্কালের ওপর থেকে সরে গর্তের দেয়ালে পড়ে, তাতে পরিমল কিছুটা বিরক্ত হয় অথবা মানসিক চাপ কিছুটা কাটাতে কথা বলার ফুসরত পেয়ে কিছুটা বিরক্তির স্বরে বলে, ‘লাইটটা ধর ঠিক মতো!’

‘আরে বাল, মশায় এমন ঠাপ দিচে!’ বলেই পুনরায় কঙ্কালের খুলির ওপর আলো ফেলে বিলাস।

পরিমল যখন রামদা দিয়ে কঙ্কালের সার্ভাইকাল ভার্টিব্রা বা গ্রীবাদেশীয় কশেরুকায় প্রথম কোপটা দেয় তখন আচমকা চোখ বোজে অমল আর ওর মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে সুন্দর গলা এবং গ্রীবা, যেখানে শোভা পেত একটি সরু সোনার চেইন, আর চেইনের নিচের প্রান্তে ঝুলত নীল রঙের পাথর বসানো সুন্দর লকেট। পরিমল পর পর আরো দুটো কোপ দিয়ে গ্রীবাদেশীয় কশেরুকার শীর্ষস্থান অর্থাৎ অ্যাটলাস থেকে খুলিটা বিযুক্ত করে, তারপর রামদা গর্তের দেয়ালে খাঁড়া করে রেখে খুলিটা হাতে নেয়, আলতোভাবে হাত বুলিয়ে খুলিতে লেগে থাকা আলগা মাটি ঝেড়ে ফেলে, চোখ আর নাকের গর্তে জমে থাকা মাটি আঙুলের মাথা দিয়ে খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করে। বিলাস টর্চলাইট বন্ধ করলে পরিমল খুলিটা ডানহাতে নিয়ে বামহাতে গর্তের দেয়ালে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়েই দুইহাতে খুলিটা ধরে তাকিয়ে থাকে।

বিলাস বলে, ‘উপরে ওঠ তাড়াতাড়ি, গর্তে মাটি ফেলি।’

পরিমল ওঠে না, খুলির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে। বিলাস আবার বলে, ‘কী রে? ওঠ।’

পরিমল বলে, ‘জানিস অমল, অন্য মেয়েরা তাগের স্বামীরে যেভাবে ভালোবাসে, ও আমারে সেভাবে কোনোদিনও ভালোবাসে নাই!’
পরিমলের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে অবাক হয় অমল আর বিলাস। পরিমল আবার বলে, ‘কেউ না জানলেও আমি জানি, ও সংসার করত আমার সাথে, কিন্তু মরার আগ মুহূর্ত পর্যন্তও ভালোবাসত তোরে!’

স্মৃতি আর আবেগের কুয়াশা গ্রাস করে অমলকে, মুখে কোনো কথা বলতে পারে না, কেবল বাম হাতটি রাখে পরিমলের ডান কাঁধে। পরিমল বলে চলে, ‘আশার বাবা তোর আর ওর বিয়েতে রাজি না হওয়ায় ও নিরুপায় হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমারে বিয়ে করে।’

পরিমলের কথায় একবিন্দু মিথ্যে নেই, পরিমলের বাবা যখন আশালতার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং কয়েকদিনের মধ্যে দুই পরিবারই বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা এগিয়ে নেয়, তখন একদিন পরিমলের সাথে দেখা করে আশালতা বলেছিল, ‘পরি, তুই আমার ভালো বন্ধু। কয়দিন পর আমরা স্বামী-স্ত্রী হব। তুই তো জানিস অমলরে আমি কতটা ভালোবাসি। আমি হয়ত অমলরে কোনোদিন ভুলবার পারব না। বন্ধু হিসেবে তোর প্রতি আমার এক ধরনের ভালোবাসা আছে, স্বামী হিসেবেও নিশ্চয় তোরে ভালোবাসব। কিন্তু আমার হৃদয়ে অমলের জন্য যে জায়গা আছে, সে-জায়গায় আমি তোরে কোনোদিনও বসাবার পারব না। তুই কি মানে নিবার পারবি? যদি পারিস তাইলে আমরা বিয়ে করি, আর না পারলি আমাগের বিয়ে না করাই ভালো।’

একদা প্রত্যাখ্যাত হবার পর অকস্যাৎ সেই প্রিয় মানুষকে কাছে পাবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ায় পরিমলের তখন আনন্দে হতবিহ্বল দশা! তখন যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে আশালতাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়াটাই ওর কাছে মূখ্য ছিল। সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণের দিন আদ্যনাথ বালা ব্রত অনুষ্ঠানে বলেছিলেন- ‘সন্ন্যাসীর জীবন বড় কষ্টের, তুমি বাড়ি ফিরে যাও’, ‘তোমার মা তোমার জন্য কাঁদতেচে, তুমি মায়ের ছাওয়াল মায়ের কাছে ফিরে যাও’, ‘তোমার ঠাকুমা দুধমাখা ভাত নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করতেচে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গিয়ে খাইতে বসো’, ‘তোমার বাবা তোমার জন্য লাল টুকটুকে একটা মেয়ে দেখিচে, তুমি বাড়ি ফিরে বিয়ে করে ঘর-সংসার কর’; আদ্যনাথ বালার সকল কথার উত্তরে পরিমল বা ব্রত গ্রহণে ইচ্ছুক অন্যরা যেমনি কেবল ‘গুরুই সত্য’ বলেছিল, তেমনি আশালতার সকল শর্ত মেনে নিয়ে পরিমল কেবল বলেছিল-‘পারব।’

রাত বেড়ে চলে, বাজারের ভেতরে কয়েকটা কুকুর ডেকে ওঠে, দূর থেকে শোনা যায় পাহাড়াদারদের বাঁশির আওয়াজ। পরিমল ওর সংসার জীবনের অতৃপ্তি উগড়ে দেয়, ‘ভাবছিলাম বিয়ের পর আমি আশার মন জয় করে নিবার পারব, আস্তে আস্তে ওর মন থেকে তোর নাম মুছে দেব। কিন্তু আশা অন্য ধাতুতে গড়া ছিল, ও নিজে থেকে না মুছলি ওর মন থেকে কারো নাম মোছা অসাধ্য ছিল, ও নিজে থেকে মন না দিলি কারো পক্ষে ওর মন জয় করাও অসম্ভব ছিল। তোরে না পায়ে আশা মানসিকভাবে সুখী ছিল না, আশার অসুখী জীবন আমার জীবন অস্থির আর অতৃপ্ত করে তুলছিল।’

আশালতার হৃদয়ের অসুখ আর যাপিত জীবনের অসুখী ভাবটি অন্যদের চোখে ধরা না পড়লেও পরিমলের চোখে ঠিকই ধরা পড়ত, প্রথম প্রথম পরিমল আশালতার সকল ত্রুটি উপেক্ষা করত, ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে চাইত আশালতার হৃদয়। কিন্তু বিয়ের বছর খানেক পর থেকেই পরিমল কিছুটা বিরক্ত আর কখনো কখনো অসহিষ্ণুও হয়ে ওঠে, তখন প্রায়ই দুজনের কথা কাটাকাটি হতো, ঝগড়া হতো। রাগে-অভিমানে দুজন দুজনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রাখত কিছুদিন, তারপর আবার সব স্বাভাবিক মনে হতো। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই আবার দুজনের ঝগড়া হতো, আর নিশ্চিতভাবেই অমলের প্রসঙ্গ উঠত। পরিমল একদিন রেগে গিয়ে আশালতাকে বলেছিল, ‘ভাতারের সঙ্গ তোর আর ভালো লাগতেচে না, তুই তোর নাঙ অমলের কাছে যা!’

সেদিনের পর আশালতা বেশ কিছুদিন বাবার বাড়িতে গিয়ে ছিল, তারপর পরিমল গিয়ে অনেক বুঝিয়ে আর ক্ষমা চেয়ে ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল।

এতদিন নিজেকে ব্যর্থ-বঞ্চিত ভাবা বিলাস আজ পরিমলের কথা শুনে কিছুটা যেন সান্ত্বনা খুঁজে পায়, এতদিন সে আশালতাকে অহংকারী আর অর্থলোভী ভাবত এজন্য যে তার ধারণা ছিল দরিদ্র পিতার সন্তান হওয়ার কারণেই আশালতা তার প্রেম প্রত্যাখান করেছে। অথচ আজ জানতে পারছে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও, তিন বছর সংসার করেও পরিমল আশালতার ভালোবাসা পায় নি, আশালতা ভালোবাসত পরিমলের পরিবারের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে থাকা পরিবারের সন্তান অমলকে! মৃত্যুর ছয় বছর পর আশালতাকে নতুন করে চিনে, আশালতাকে অহংকারী-অর্থলোভী ভাবার জন্য অপরাধবোধ হয়, নিজের কাছেই লজ্জিত হয়, আত্মগ্লানিতে বিদীর্ণ হয় বিলাসের বুক!

পরিমল বলতেই থাকে, ‘বিয়ের পর আমি নিজেরে বিজয়ী মনে করতাম, ভাবতাম আশারে বিয়ে করে আমি জিতে গেচি, আর তুই এক পরাজিত প্রেমিক! কী যে বুনো আনন্দ পাতাম সে-সময়! কিন্তু কিছুদিন সংসার করার পর আমার এই উপলব্ধি হয় যে আমি আশার শরীর পাইচি আর মন পাইচিস তুই; আশার হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে কেবল তুই, ওর হৃদয়ে অষ্টপ্রহর কেবল তোর কীর্তর চলে, সে-জায়গায় আমি নেহাতই উচ্ছিষ্টভোগী কাঙাল স্বামী! শেষ পর্যন্ত আসলে তুই-ই বিজয়ী, আমি পরাজিত।’

অমল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে পরিমলের মুখের দিকে, সে ঠিক শুনছে তো! ন্যাংটাকাল থেকে চেনা বন্ধু পরিমল হঠাৎ বদলে গিয়েছিল আশালতার সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে, তখন ওকে একেবারেই অচেনা লাগত, আজ এতদিন পর আবার সেই বিয়ের আগের অকপট সত্যভাষী পরিমলকে যেন চিনছে অমল! পরিমল আর আশালতার বিয়ের কথা যখন পাকা হয়, তখন থেকেই অমলের সঙ্গে পরিমলের দূরত্ব বেড়ে যায়, এমনকি পথে-ঘাটে কিংবা বাজারে দেখা হলেও দুজন দুজনের সঙ্গে কথা বলত না, একে অন্যকে এড়িয়ে যতটা সম্ভব দূর দিয়ে যেত! অমলের মনে হতো বাল্যকালের বন্ধু তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আশালতাকে বিয়ে করে, ওদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক দূষিত করেছে, তীব্র দুঃখবোধ আর অভিমান থেকেই সে পরিমলকে এড়িয়ে চলত। আর পরিমল মোহের বশবর্তী হয়ে আশালতাকে বিয়ে করে নিজেকে গর্বিত অথবা ভাগ্যবান কিংবা বিজয়ী মনে করলেও এবং কোনো ধরনের অপরাধবোধে না ভুগলেও অমলের মুখোমুখি হতে বিব্রতবোধ করত, তাই পারতপক্ষে সে কখনো অমলের মুখোমুখি হত না। এমনকি দুজনে একই দলে শিবপূজা করলেও ওরা কেউ কারো সাথে কথা না বলে এমনভাবে থাকত যেন দুজন দুজনের অচেনা! টানা তিনবছর এমনিভাবে থাকার পর ওদের দূরত্ব ঘুচিয়েছিল আশালতার অকাল মৃত্যু!

সেদিন অমল চেম্বার থেকে বাড়িতে ফিরেছিল রাত সাড়ে আটটার দিকে, পৌষমাসের শীতের রাতে কুয়াশা পড়েছিল খুব, সেই সঙ্গে ছিল তীব্র শীত। বাড়িতে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে, ভাত খেয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে শরীরটা একটু গরম করছে, স্ত্রী তখনো মায়ের ঘরে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে, তখনই বেজে ওঠে ওর মোবাইলের রিংটোন, কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনতে পায় বিলাসের কান্না জড়ানো কণ্ঠস্বর, ‘অমল, আশা আর নাই!’

অমলের কণ্ঠ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ে, ‘মানে!’

‘আশা সহালে ফরিদপুর গিছিল অফিসের কাজে, বাড়ি আসার পথে বিকেলে বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়, ফরিদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করছিল। কিন্তু আশারে আর বাঁচানে যায় নাই।’

যেন আচমকা চেলা কাঠ দিয়ে কেউ মাথায় আঘাত করেছে, এমন অনুভূতি হয় অমলের, কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে, বিলাস আরো কী কী বলে তা ঠিকঠাক কানে ঢোকে না! বিলাস বলে যায়, ‘অ্যাকসিডেন্টের খবর শুনে পরি সাথে সাথে ফরিদপুর গেচে, আশার লাশ নিয়ে ফরিদপুরির তে রওনা দিচে।’


(চলবে.....)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০২২ রাত ৯:২৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×