somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- ঊনিশ )

২৬ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঊনিশ

নিত্যদিনের মতোই শুকতারা ডুবে গেছে, ভোরের আলোয় উবে যাচ্ছে অন্ধকার, বকুলবৃক্ষে কয়েকটি পাখি কলকাকলি করছে, শবরী গৃহের ছাদে মাদুরের ওপর শুয়ে আছে অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে। সারারাত্রি একটুও ঘুমোয় নি সে, ঋষ্যশৃঙ্গ’র বিরহে নীরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে, যতোবার তার মনে হয়েছে যে তারই নিয়ে আসা কাদার পুতুল নিয়ে এখন খেলছে রাজকুমারী, ততোবার তার বক্ষ তোলপাড় করে উথলে উঠেছে কান্না।

চারিদিক এখন নির্জন, পথে পথে নৃত্য-গীতে মত্ত মানুষেরা আশাহত হয়ে গৃহে ফিরে গেছে। গণিকালয়ও এখন মানুষের কোলাহল মুক্ত, এমনিতেও ভোরবেলায় কোলাহল মুক্তই থাকে, তবে কোনো কোনো গণিকার কক্ষে নাগর থাকে, কিন্তু আজ আর কারো কক্ষে নাগর নেই, সকলেই ঘুমোচ্ছে। রাতে সকলেই ছাদে উঠে এসেছিল, আনন্দে নৃত্য-গীত আর হই-হুল্লোর করছিল এজন্য যে দীর্ঘদিন পর অঙ্গরাজ্যে বৃষ্টি নামবে, রাজ্যের দুর্দশা দূর হবে, তাদের জীবনেও সুদিন ফিরে আসবে। কিন্তু রাত যতো বাড়তে থাকে, আকাশে মেঘের অনুপস্থিতি দেখে তাদের হতাশাও ততো বাড়তে থাকে। মধ্যরাত পর্যন্ত বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একেকজনের চোখে ঘুম নেমে আসে, ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে একজন দু-জন করে নিচে নেমে যায়, থাকে কেবল শবরী।

সারারাত্রি জাগরণের পর এই ঊষাকালেও শবরীর চোখে ঘুম নেই, চোখের কোনা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামছে। শুরুতে দ্বিধাদন্দ্বে থাকলেও পরে সেও সকলের মতোই বিশ্বাস করেছিল রাজকুমারীর সঙ্গে মুনিকুমারের বিবাহ হলেই রাজ্যে বৃষ্টি নামবে, তাইতো সে বিভাণ্ডকের অভিশাপের ভয় উপেক্ষা করে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে, ছলনা করে চম্পানগরীতে নিয়ে এসেছে মুনিকুমারকে। একজন মুনিবর নাকি দেবতাদের কাছ থেকে সংবাদ নিয়ে এসেছিলেন যে দেবরাজ ইন্দ্রের উদ্দেশে যজ্ঞ করলে আর রাজকুমারীর সঙ্গে মুনিকুমারের বিবাহ দিলেই অঙ্গরাজ্যে বৃষ্টি নামবে। যজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে, রাজকুমারীর সঙ্গে মুনিকুমারের বিবাহও মঙ্গল মতোই সম্পন্ন হয়েছে। বিবাহের তিনরাত্রি পর আজ পুষ্পশয্যার রাত্রি পেরিয়ে এখন প্রায় সকাল, তবু বৃষ্টি হলো না কেন? মুনিবরের আনা সংবাদ কি তবে মিথ্যে? একে তো ঋষ্যশৃঙ্গকে হারানোর বিরহ, তার ওপর রাজ্যে বৃষ্টি না হওয়ায় শবরী এখন নিরানন্দে নিমজ্জিত হয়েছে, তার বাঁচার ইচ্ছে মরে গেছে, ইচ্ছে করছে প্রাণত্যাগ করে এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে।

এদিকে সারা চম্পানগরীর মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বৃষ্টি না হওয়ায়, রাতভর যে নগরী ছিল উৎসবে মুখর, সকাল হতেই সেই নগরী মৃতবাড়ির ন্যায় শোকস্তব্ধ! মানুষ হায় হায় করছে, তাদের জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু হয়েছে। এই নিষ্ফল রাজ্যে আগামী দিনগুলোতে কিভাবে বেঁচে থাকবে সেই চিন্তায় তারা দিশেহারা।

সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান-আ‎হ্নিক-প্রাতঃরাশ সেরে অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক আগেই রাজজ্যোতিষীকে তার গৃহ থেকে ডেকে নিয়ে রাজবাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন রাজপুরোহিত। পথে যেতে যেতে রাজজ্যোতিষী বললেন, ‘নির্বোধ রাজাকে কৌশলে আচ্ছা শিক্ষা দেওয়া গেল!’

রাজপুরোহিত বললেন, ‘শেষ ঘুঁটিটা ঠিক মতো চাল দিও ‍তুমি।’
‘সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত থাকো।’
‘কূটবুদ্ধিতে আমাদের বাল্যসখা বলদেব অদ্বিতীয়, কি বলো?’
‘নিঃসন্দেহে। তবে সে এবার যা করছে তাতে তার পাপের চেয়ে পূণ্যই বেশি হবে। এই দুর্ভিক্ষের কালে রাজ্যের অনেক ব্রাহ্মণ তিনবেলা পেটপুরে আহার করতে পারছিল না, অনেকের অনাহারে দিন কাটছিল। যজ্ঞের ফলে তারা অনেক কিছু পেয়েছে, যা দিয়ে তারা বেশ কিছুদিন দিব্যি চলতে পারেবে। আর বলদেবের দোসর হিসেবে এই পূণ্যের ভাগ কিছুটা তুমি আর আমিও পাবো।’
রাজপুরোহিত হাসলেন, ‘নিশ্চয়।’

দিন পনের আগে এক রাত্রে রাজপুরোহিতের আঙিনায় দাঁড়িয়ে একজন মানুষ উচ্চস্বরে তার নাম ধরে ডাকতে থাকেন, ‘সত্যানন্দ…সত্যানন্দ….সত্যানন্দ গৃহে আছো?’

কণ্ঠে অধৈর্য, মুহূর্ত কয়েক বিরতি দিয়ে আবার ডাকেন, ‘সত্যানন্দ, গৃহে থাকলে শীঘ্র বাইরে এসো।’

রাজপুরোহিত বহুদিন পর কারো অধৈর্য কণ্ঠে নিজের নাম শুনে যেন চমকে ওঠেন! একে তো তিনি বয়োঃজ্যেষ্ঠ ব্রা‏‏‏‏‏হ্মণ, তার ওপর রাজপুরোহিত, সকলে তাকে রাজপুরোহিত মহাশয় বলে সম্বোধন করে। চম্পানগরীতে তার চেয়ে প্রবীণ যে-সব ব্রা‏হ্মণ আছেন তারাও তাকে সম্মান করে রাজপুরোহিত মহাশয় বলেই সম্বোধন করেন। রাজজ্যোতিষী চন্দ্রানন তার বাল্যবন্ধু, বাল্য-কৈশোর-যৌবনে উভয়ে একই গুরুর কাছে বেদ অধ্যায়ন এবং তপশ্চর্যা করেছেন, রাজসভায় তারা একে-অপরকে আপনি সম্বোধন করলেও বাইরে তুমি সম্বোধন করেন। কিন্তু এ কণ্ঠস্বর তো রাজজ্যোতিষীর নয়, তবে কার এতো স্পর্ধা যে রাজপুরোহিতের নাম ধরে ডেকে তুমি সম্বোধন করছে? কিছুটা রাগ এবং কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তৈল-প্রদীপ হাতে বাইরে বের হতে হতে বলেন, ‘কে হে অস্থিরমতি, শৈশবে পিতা-মাতা কি ধৈর্য্য নামক শব্দটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নি?’

অলিন্দে এসে দ্যাখেন আঙিনায় একজন ঋষি দাঁড়িয়ে; পরনে গেরুয়া বসন, মাথার জটা চুড়োখোঁপা বাঁধা, মুখে লম্বা দাড়ি-গোঁফ, চোখ দুটি যেন অগ্নিকুণ্ড, কাঁধে কাপড়ে গিঁট দিয়ে বানানো একটি ঝোলা!

ঋষির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে পা থমকে যায় রাজপুরোহিতের, চিনতে না পেরে ঋষির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন! ঋষি কয়েক কদম এগিয়ে এসে হেসে বলেন, ‘তুমি যথার্থই বলেছো সখা, আবাল্য আমি অস্থিরমতি। তবে একদা তুমি আমার চেয়েও বেশি অস্থিরমতি ছিলে। ফলে আমরা কেউই তপশ্চর্যায় সিদ্ধিলাভ বলো আর খ্যাতিলাভ-ই বলো, তা করতে পারি নি। তুমি নগরীতে ফিরে এসে তোমার পৈত্রিক পৌরোহিত্যের জীবিকা বেছে নিয়েছো, আর আমি এখনো ব্যর্থ জীবনের গ্লানি বয়ে কখনো অরণ্যে-পর্বতে, আবার কখনো নগরে-জন্মনের তীর্থস্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হা হা হা….।’

এবার কণ্ঠস্বর শুনে আর প্রদীপের আলোয় ঋষিকে ভালো মতো দেখে রাজপুরোহিত চিনতে পারেন তার বাল্যসখাকে, ‘সখা! বলদেব!’
‘চিনতে পেরেছো তাহলে!’

রাজপুরোহিত হাতের প্রদীপটা অলিন্দে রেখে আঙিনায় নেমে তার বাল্যসখাকে আলিঙ্গন করেন। তারপর বলদেবের হাত ধরে বলেন, ‘প্রথমে আমি তোমাকে চিনতে পারি নি সত্য, কেননা আমি শুনেছিলাম তুমি মন্দার পর্বতে দেহত্যাগ করেছো।’

‘ভুল শুনেছো তুমি, দেহ আমাকে ত্যাগ না করলে আমি কখনোই দেহকে ত্যাগকে করবো না!’

হেসে ওঠেন দুজনই। তারপর রাজপুরোহিত অলিন্দের কোনে রাখা জলের ঘড়া থেকে এক ঘটি জল নিয়ে এসে বলদেবের পা ধুয়ে দিয়ে বলেন, ‘আজ আমি ভীষণ আনন্দিত সখা, অপ্রত্যাশিতভাবে এতোকাল পর তোমার দেখা পেয়েছি। এসো, আমার গৃহে তোমাকে স্বাগত।’

বামহাতে অলিন্দ থেকে প্রদীপ নিয়ে আর ডানহাতের মুঠোয় বলদেবের হাত ধরে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করেন রাজপুরোহিত। বলদেবকে বসার আসন দেন, নিজেও আসন পেতে বসেন বলদেবের মুখোমুখি, দুজনের মাঝখানে নিচু জলচৌকি। বলদেব কক্ষের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলেন, ‘তাহলে বেশ আছো দেখছি।’

রাজপুরোহিত বলেন, ‘ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় মন্দ নেই বলতে পারো।’

রাজপুরোহিত ভৃত্যকে ডেকে পত্নীর কাছে খবর পাঠান বাল্যবন্ধুর জন্য জলখাবার পাঠাতে এবং রাত্রে উত্তম আহারের ব্যবস্থা করতে। অন্তঃপুরে তাঁর স্ত্রী এবং পুত্রবধূদের হাতের চুড়ির আওয়াজ শোনা যায়।

বলদেব বলেন, ‘আমি তোমার গৃহে ঘৃতপক্ক অষ্টব্যঞ্জনে আহার এবং আরামদায়ক শয্যায় নিদ্রাযাপন করতে আসি নি সখা। আমি এসেছি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, এসেছি দীর্ঘদিন ধরে অন্তরে প্রজ্জ্বলিত ক্ষোভের আগুন নির্বাপিত করতে।’

‘তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না সখা, একটু খোলাসা করে বলবে?’

‘বলবো, আগে সেই ভাঁড় জ্যোতিষীটাকে সংবাদ দিয়ে এখানে আনাও, তারপর সকল বৃত্তান্ত বলবো।’

রাজজ্যোতিষীর গৃহ নিকটেই, রাজপুরোহিত ভৃত্যকে পাঠান তাকে ডেকে আনবার জন্য। রাজপুরোহিতের পত্নী অভয়াদেবী জলের পাত্র এনে নামিয়ে রাখেন দুজনের মাঝখানের জলচৌকিতে, তারপর কিছুটা দূরত্ব রেখে বলদেবকে প্রণাম করে বলেন, ‘দাদা ঠাকুর, ভগবানের কৃপায় আপনি বেঁচে আছেন, অথচ আমরা শুনেছিলাম…। যাক, দীর্ঘায়ু লাভ করুন। এতোদিন আসেন নি কেন? এতোকাল পর মনে পড়লো আমাদের কথা!’

বলদেব মৃদু হেসে বলেন, ‘তীর্থস্থানে ঘুরতে ঘুরতে সময় হয়ে ওঠে নি বৌঠান। আপনারা কুশলে আছেন তো?’

‘আজ্ঞে, ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় ভালো আছি। দাদা ঠাকুর, আপনি কতো তীর্থস্থান দর্শন করে বেড়ান, সে-সব বৃত্তান্ত শুনবো আপনার মুখে।’
‘নিশ্চয় শুনবেন বৌঠান।’

অভয়াদেবী উঠে চলে যান, অল্পক্ষণের মধ্যেই ফল এবং মিষ্টসহ নানা প্রকার খাবার পাথরের পাত্রে সাজিয়ে এনে জলচৌকিতে রেখে বলেন, ‘নিন আহার করুন।’

আহার করতে করতে বলদেব বলেন, ‘বুঝলে সখা, বহু দেশ ঘুরেছি, বহু তীর্থ দর্শন করেছি, তপশ্চর্যা করেছি, ঈশ্বরকে খুঁজেছি; কিন্তু কোথাও ঈশ্বরকে খুঁজে পাই নি, সর্বত্রই ক্ষুধার্ত মানুষ। জগত ঘুরে আমি এই উপলব্ধি করেছি যে ঈশ্বরের চাইতে ক্ষুধা অধিক সত্য। যজ্ঞের ঘিয়ের চেয়ে অন্নের অধিক প্রয়োজন।’

‘তাহলে তুমি বলছো যে গুরুগৃহ থেকে ফিরে আমি গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করে কোনো ভুল করি নি!’

‘ভুল কী নির্ভুল সেই আলোচনায় আমি যাব না। আমি শুধু এটাই বলবো যে যার যা ভালো লাগে, যে যাতে আনন্দ পায় তার সেটাই করা উচিত। নইলে অন্তিমকালে অনুশোচনা করতে হয়।’

‘তোমার কথা অতি মূল্যবান।’

বলদেবের আহার শেষ হলে এঁটো থালা নিয়ে চলে যান অভয়াদেবী। বলদেব বলেন, ‘দ্যাখো, আমি স্বীকার করি আমি অস্থিরমতি এক ঋষি, আমার তপশ্চর্যায় ত্রুটি থাকতে পারে, তাই হয়তো আমি ঈশ্বর দর্শন পাই নি। কিন্তু আমি অনেক ঋষিকে দেখেছি যারা গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে তপশ্চর্যা করেছেন, কিন্তু শেষ জীবনে তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণা-রোগে অনেক ক্লেশ পেয়েছেন। শেষ জীবনে তারা কারো শুশ্রূষা পান নি বলে অনুতাপ করেছেন। আবার অনেক ঋষিকে আমি দেখেছি দীর্ঘ তপশ্চর্যার পর তারা গার্হস্থ্য জীবনে ফিরেছেন, নারীসঙ্গ করেছেন, সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিসে যে মোক্ষলাভ সখা, আজও বুঝলাম না।’

‘তোমার এখন কী অভিলাষ?’

‘তীর্থে তীর্থে অনেক ভ্রমণ করেছি, এবার আমি কোথাও স্থির হতে চাই।’

দুজনের আলোচনা চলতে থাকে, কিছুক্ষণ পরই রাজজ্যোতিষী গৃহে প্রবেশ করেন, রাজপুরোহিতের মতো তিনিও বিস্ময় বনে যান বাল্যসখাকে দেখে, ‘সখা, তুমি বেঁচে আছো! অথচ আমরা শুনেছিলাম…।’

রাজজ্যোতিষী দু-হাত প্রসারিত করে বলদেবের দিকে এগিয়ে এলে বলদেব উঠে দাঁড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করেন। রাজজ্যোতিষী বলেন, ‘শেষবার তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল মিথিলার এক শিবমন্দিরে, সে-ও বছর দশেক আগে।’

বলদেব মৃদু হেসে বলেন, ‘হ্যাঁ, তোমার দেখছি ঠিক স্মরণ আছে।’

রাজজ্যোতিষী এবং বলদেব আসনে উপবেশন করেন। বলদেব রাজপুরোহিতের উদ্দেশে বলেন, ‘সখা, দ্বার রুদ্ধ করে দাও, আলোচনা শুরু করা যাক।’

রাজপুরোহিত দ্বার রুদ্ধ করে পূর্বের আসনে উপবেশন করেন। রাজজ্যোতিষী বলেন, ‘ব্যাপার কী হে বলো দেখি!’

বলদেব গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘তোমাদের মহারাজ লোমপাদ ব্রা‏হ্মণদের সঙ্গে অসদাচরণ করার পর সেই যে চম্পানগরী ছেড়েছিলাম আর এই নগরীতে পা রাখি নি আমি।’

রাজজ্যোতিষী বলেন, ‘সে-কথা তুমি এখনো মনে রেখেছো! হ্যাঁ, সে-বার মহারাজ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে খুব অন্যায় করেছিলেন। এখনো নগরীর অনেক ব্রা‏হ্মণ মহারাজের প্রতি অসস্তুষ্ট, আর অনেকেই তখন নগরী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।’

রাজপুরোহিত বলেন, ‘তখন মহারাজের বয়স কম ছিল, ব্রাহ্মণদেরকে লোভী এবং অকর্মণ্য বলেছিলেন। ব্রাহ্মণদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেছিলেন একথাও ঠিক। কিন্তু আজ এতোদিন পর সে-কথা তুলে কী হবে বলো! এখন তো তিনি ব্রাহ্মণদের যথেষ্ট সম্মান করেন।’

বলদেব বেশ রাগত স্বরে বলেন, ‘তোমরা দুজন লোমপাদের উচ্ছিষ্টভোজী, তাই তোমরা লোমপাদের সেই অপরাধ ক্ষমা করলেও, আমি করি নি। আজও আমার অন্তরে সেই ক্ষোভের অগ্নি দাবানলের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে।’

রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষী মাথা নত করে মৌন থাকেন। একথা তো ঠিক যে তারা দুজনই রাজপদে অধিষ্ঠিত হবার পর সেই পুরনো অপমান মনের ভেতরে চাপা দিয়েছেন। এতোদিন পর বলদেব সেই চাপা আগুনে খোঁচা দেন, ‘তোমাদের নিশ্চয় মনে আছে, গুরুগৃহে থাকার সময় গুরুদেব আমায় মন্দমতি বালক বলতেন; মন্দবুদ্ধির কারণেই ঋষি হিসেবে আমি খ্যাতিলাভ করতে পারি নি। গুরুভ্রাতাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে নিজে সাধনা করার চেয়ে অন্যদের সাধনা পণ্ড করতেই আমি বেশি মনোযোগী ছিলাম। মন্দবুদ্ধি আমাকে আজও তাড়িত করে। বোধকরি দেবরাজ ইন্দ্র ভিন্ন মন্দবুদ্ধিতে কেউ আমাকে পরাজিত করতে পারবে না! তাই লোমপাদের এই দুঃসময়ে আমাদের সময় এসেছে ব্রা‏হ্মণদের সঙ্গে অসদাচরণের প্রতিশোধ নেবার। ব্রা‏হ্মণদের অন্তরে দীর্ঘদিন ধরে প্রজ্জ্বলিত ক্ষোভের অগ্নি নির্বাপিত করবার! রাজ্যে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে। তোমরা দুজন তো রাজার খেয়ে-পরে দিব্যি পুষ্ট হচ্ছো, কিন্তু রাজ্যের অন্য ব্রাহ্মণদের খোঁজ রাখো? রাখো না। রাজ্যের অনেক ব্রাহ্মণ অভাব-অনটনে দিনাতিপাত করছেন, তিনবেলার আহার তাদের জুটছে না। তাই এখনই সময় রাজকোষ ভাঙিয়ে ব্রাহ্মণদের জন্য কিছু করার।’

রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষী একে অন্যের মুখের দিকে তাকান। রাজপুরোহিত ভীরু ভীরু চোখে বলেন, ‘এতোকাল পরে…. কিন্তু তা কী করে সম্ভব?’

বলদেব রাজপুরোহিতের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলেন, ‘সম্ভব। ব্রা‏হ্মণের অসম্ভব বলে কিছু নেই ভূ-মণ্ডলে! নির্বোধ ক্ষত্রিয় অস্ত্রের নিপুণ প্রয়োগ জানে কিন্তু ব্রা‏হ্মণকৃত তালবৃন্তে ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসার ন্যায় জটিল শাস্ত্রের সুক্ষ্ম প্যাঁচ বোঝে না। ক্ষত্রিয় মারে অস্ত্রে, আর ব্রা‏হ্মণ মারে শাস্ত্রে! ক্ষত্রিয় অস্ত্র প্রয়োগে কেবল শত্রু নিধন করতে পারে, আর ব্রা‏হ্মণ শাস্ত্র প্রয়োগে অধঃস্থন ত্রিবর্ণকে নির্বোধ ভৃত্য করে রাখতে পারে! শাস্ত্রই ব্রাহ্মণের অস্ত্র!’

রাজজ্যোতিষী বলেন, ‘তোমার মাথার জটার মতো না পেঁচিয়ে এবার সরাসরি আসল কথাটা বলো দেখি, শুনি।’

বলদেব কখনো শান্ত স্বরে, কখনো রাগত স্বরে রাজা লোমপাদকে কিভাবে চরম শিক্ষা দেওয়া যায় সেই কৌশল বলেন। রাজা লোমপাদকে শিক্ষা দেবার জন্য তাকে দিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের উদ্দেশে যজ্ঞ করিয়ে ব্রাহ্মণদের প্রচুর দান করার ব্যাপারে বলদেবের সঙ্গে একমত হন রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষী। কিন্তু সেই সঙ্গে তাদের তিনজনেরই বাল্যসখা মহর্ষি বিভাণ্ডককে শিক্ষা দেবার জন্য তার পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ’র সঙ্গে লোমপাদের একমাত্র কন্যা শান্তার বিবাহ প্রসঙ্গে রাজজ্যোতিষী বলেন, ‘এর মধ্যে আবার আমাদের বাল্যসখা বিভাণ্ডককে টানছো কেন?’

‘বাল্যসখা! বাল্যসখা! বাল্যসখা! হা হা হা…।’

উদ্ভট শব্দে হেসে ওঠেন বলদেব! তার হাসির শেষোক্ত রেশ আচমকা রূপান্তরিত হয় ক্রোধে, চোখ-মুখের ভাষা বদলে যায়! রক্তাভ চোখে হুঙ্কার ছাড়েন তিনি, ‘এই বিভাণ্ডকের জন্যই আমি সিদ্ধিলাভ করতে পারি নি, তোমরা সিদ্ধিলাভ করতে পারো নি। বিভাণ্ডক গুরুদেবের সবচেয়ে নিষ্ঠাবান এবং প্রিয় শিষ্য ছিলেন, গুরুদেব আমাদের চেয়ে ওকে বেশি প্রশ্রয় দিতেন, স্নেহ করতেন। এটা আমি সহ্য করতে পারতাম না, ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেক ভুল করে বসতাম। একসময় এইসব ভুলই আমাকে বিপথে চালিত করেছে। আর গুরুদেবের অত্যাধিক স্নেহভাজন হওয়ায় ওই হতচ্ছাড়া বিভাণ্ডক সর্বদা আমাদেরকে অগ্রাহ্য করতো, দর্পে ওর পা যেন মাটিতে পড়তো না। ও সিদ্ধিলাভ করেছে, এখন সে ঋষিকুলে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠান করছে। শুনেছি দেবতারাও তাকে সমীহ করেন। এসব কথা ভাবলেই আমার গাত্রদাহ হয়, হৃদ অরণ্যে অমর্ষঅগ্নি জ্বলে! চেষ্টা করেও ওকে তপশ্চর্যার পথ থেকে টলাতে পারি নি। তাই এখন ওর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে বিপথগামী করে ওর অন্তরে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করতে চাই।’

তারপর বলদেব বিভিন্ন তীর্থে এবং আশ্রমে গিয়ে ঋষিদের মুখে শোনা বিভাণ্ডক এবং ঋষ্যশৃঙ্গ’র সাধনার কথা, মৃগ’র গর্ভে ঋষ্যশৃঙ্গ’র জন্মবৃত্তান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ শুনিয়ে তার দুই বাল্যসখা রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যাতিষীকে প্ররোচিত এবং উত্তেজিত করে বলেন, ‘তোমাদের ঈর্ষা হয় না? আমার হয়, আমি প্রতিশোধ নিতে চাই।’

বলদেবের চোখ-মুখ থেকে যেন আগুনের হলকা বের হতে থাকে। বলদেবের ঈর্ষা সংক্রামিত হয় রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যাতিষীর মধ্যে। তারা দুজন বাল্যসখা বলদেবের কূটবুদ্ধির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং রাজা লোমপাদ ও বিভাণ্ডককে হেনস্থা করার ব্যাপারে একমত হন।

তারপর বলদেব কখন কিভাবে রাজসভায় প্রবেশ করবেন, রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষীর ভূমিকা কী হবে, তাদের কী বলতে হবে সব বুঝিয়ে বলেন।

নগরীর ভৃত্যশ্রেণির শুদ্ররা কাজে যাচ্ছে। রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষীকে দেখে তারা প্রণাম জানিয়ে রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে। পথ চলতে চলতে রাজজ্যোতিষী বললেন, ‘বলদেব কোথায় গেল এবার, তোমায় বলেছে কিছু?’

রাজপুরোহিত বললেন, ‘হ্যাঁ, বলেছে।’

যজ্ঞের পরদিন প্রত্যুষেই চম্পানগরী ছেড়ে চলে গেছেন ঋষি বলদেব। তার যাবার সময় বিদায়ী আলিঙ্গনের পর অশ্রুসিক্ত চোখে রাজপুরোহিত বলেন, ‘আর কী কখনো আমাদের দেখা হবে সখা?’

বলদেব বলেন, ‘সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।’

‘কোথায় গিয়ে স্থির হবে ভাবছো?’

‘শুনেছি বঙ্গদেশের ভূমি এবং নারী দুই-ই খুব উর্বর, সেদিকেই যাবো। গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করে ফসল ফলাবো।’

রাজপুরোহিত বিস্মিত হন নি বলদেবের কথা শুনে, কেননা তিনি জানেন বলদেবের পক্ষে সবই সম্ভব।

রাজবাড়ীতে প্রবেশ করে রাজসভায় না গিয়ে রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষী গেলেন অন্দরে, গিয়ে জানলেন যে সারারাত্রি জাগরণের পর রাজা লোমপাদ সবে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছেন। তবু রাজমহিষী বর্ষিণী বললেন, ‘আপনারা বসুন, আমি তাকে আপনাদের আসার সংবাদ জানাচ্ছি।’

রাজপুরোহিত এবং রাজজ্যোতিষী বৈঠককক্ষে রাজা লোমপাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।


(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৮
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×