বেণ মুগ্ধ হয়ে সুরোত্তমার নৃত্যশৈলী আর শারীরিক সৌন্ধর্য অবলোকন করতে করতে ভাবেন- আহা, অপ্সরা সুরোত্তমাই এত সুন্দর, তাহলে স্বর্গের উর্বশীর পদ অলংকৃত করে আছেন যে অপ্সরা, না জানি তিনি কত সুন্দর! তাঁর মনে হয়- স্বর্গ যেন জগতের আশ্চর্য এক পুষ্পদানী, ত্রিভুনের সবচেয়ে সুন্দরী নারীগণকে সেখানে পুষ্পরূপ সাজিয়ে রাখা হয়েছে, দেবগণ চাইলে যখন-তখন যে-কোনো পুষ্পের সুবাস নিতে পারেন! এইতো কিছুকাল পূর্বেও স্বর্গের দেবদেবীদের সঙ্গে ব্রহ্মাবর্তের মানবদের বিবাহসম্পর্ক হতো প্রায়শঃই, কিন্তু কিছুকাল যাবৎ স্বর্গের দেবীদের মধ্যে ব্রহ্মাবর্তের পুরুষদের বিবাহের ক্ষেত্রে অনীহা দেখা যাচ্ছে। এখন বিবাহ হয় না তা নয়, তবে বিবাহের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। দিন যাচ্ছে আর স্বর্গবাসীদের নাক উঁচু হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, ব্রহ্মাবর্তের মানবদেরকে তারা নিচু স্তরের মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, এমনটা আগে ছিল না।
নৃপতি বেণের ভাবনার জাল ছিন্ন হয় নৃত্য করতে করতে অপ্সরা সুরোত্তমা হঠাৎ তাঁর কাছে এসে হাত ধরে তাঁকে নৃত্য করার আহ্বান জানালে, সুরোত্তমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসেন বেণ, আহ্বানে সাড়া দিয়ে সিংহাসন ছেড়ে মঞ্চে গিয়ে নৃত্য করতে শুরু করেন সুরোত্তমার সঙ্গে। নৃত্যে খুব একটা পটু নন বেণ, তবে সব আর্য নারী-পুরুষই কমবেশি নৃত্য করতে পারে, যুদ্ধ আর নৃত্য আর্যদের রক্তে মিশে আছে, সেই হিসেবে নিপুণ না হলেও নৃত্যে একেবারে আনাড়ী নন বেণ।
যে-সব তরুণ দর্শক সারিতে বসে এতক্ষণ ছটফট করছিল নৃত্য করার জন্য, তাদের অনেকেই এখন যার যার সঙ্গীনিকে নিয়ে মঞ্চে এসে নৃত্য করতে শুরু করে। এমনটাই রীতি, যখন অনুষ্ঠানের শেষ নৃত্যশিল্পীর নৃত্য শেষের পথে তখন আগ্রহী অনেক পুরুষ তার স্ত্রী কিংবা সঙ্গীনিকে নিয়ে নৃত্য করতে শুরু করে, আর যতক্ষণ না একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ততক্ষণ তাদের নৃত্য চলতেই থাকে।
নেশায় চুর টলটলায়মান পায়ে যুগলেরা বেণ এবং সুরোত্তমাকে ঘিরে নৃত্যরত; নানা বয়সের নারী-পুরুষ নৃত্যে যোগ দেয়, কেউ নৃত্য উপভোগ করে, কেউবা তার সঙ্গীনিকে নিয়ে যৌনক্রীড়া করার জন্য এদিকে-ওদিকে বৃক্ষ নয়ত পাথরের আড়ালে অথবা পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠে যায়। একটু দূরে যে-সব আর্য গোত্রের বসতি, সে-সব গোত্রের নারী-পুরুষেরা এখন আর ঘরে ফিরবে না, তারা আরো নৃত্য করবে, আরো মদ্যপান করবে, তারপর ক্লান্ত হয়ে দর্শকদের বসবার জন্য পশমী চামড়ার বড় বড় আসনের ওপরেই ঘুমিয়ে রাত পার করে সকালে বসতিতে ফিরবে।
কোনো কোনো যুগল নৃত্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে এদিকে-ওদিকে চলে যায়, বয়স্ক এবং বালক-বালিকারা গৃহে ফিরতে শুরু করে। বেণের স্ত্রী হংসপাদাসহ পরিবারের সকলেই গৃহের দিকে পা বাড়ায়। বেণ বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাছাড়া তার নেশাও ধরে বেশ, তবে সুরোত্তমার কোনো ক্লান্তি নেই, তিনি যেন সারারাত্রি নৃত্য করতে সক্ষম! বেণ সুরোত্তমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, ‘আমি আর পারছি না অপ্সরা, নৃত্যে আমি তোমার নখের যোগ্যও নই, হার মানছি। চলো, আমার গৃহে ফিরে গিয়ে অবশিষ্ট রাত্রি উদযাপন করি।’
সুরোত্তমা বেণের গলা জড়িয়ে ধরে কপালে কপাল ছুঁইয়ে বাদ্যের তালে তালে মৃদু লয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলেন, ‘তুমি যে এতক্ষণ নৃত্য করতে পেরেছ আমার সঙ্গে, তাতেই তুমি প্রশংসা পাবার যোগ্য। দেবপতি ইন্দ্র তো তার অমন বেঢপ বপু নিয়ে তোমার অর্ধেক সময়ও নৃত্য করতে পারেন না।’
‘বলো কী! তিনি কি সত্যিই খুব বেশি স্থুলকায়?’
‘তবে আর বলছি কী, এমন স্ফীত তার উদর যে ভূমিতে উপবেশন করলে একা উঠতে কষ্ট হয়!’
‘তুমি দেবপতির সঙ্গে নৃত্য করেছ?’
‘না গো, সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি। হলে কী আর এত এত রুক্ষ পাহাড় আর পাথুরে পথ ডিঙিয়ে আমাকে এখানে আসতে হয়!’
‘শুনেছি সকল অপ্সরারা দেবপতির মনোরঞ্জন করেন?’
‘তোমাদের ব্রহ্মাবর্তের মানুষ দেখছি স্বর্গ সম্পর্কে যা জানে তার বেশিরভাগই ভুল। সবাই শুধু স্বর্গ সম্পর্কে বোকা বাকা প্রশ্ন করে। দেবপতি যদি সকল অপ্সরাকে দখল করেন তাহলে স্বর্গের অন্য সব পুরুষরা কী আঙুল চুষবেন! তারা বিদ্রোহ করে দেবপতির মুকুট ছিনিয়ে নেবেন না? আমাদের ওপর সকল দেবতার অধিকার। তবে একথা সত্য যে স্বর্গের সবচেয়ে রুপবতী-গুণবতী অপ্সরারাই দেবপতির মনোরঞ্জন করেন। যেমন ধরো উর্বশী, মেনকা, রম্ভার মতো শ্রেষ্ঠ অপ্সরারা দেবপতির সেবা করেন। এখন চলো, তোমার গৃহে যাই।’
‘তাই চলো।’
বেণ সুরোত্তমার কাঁধে হাত রেখে পা বাড়ান মঞ্চের বাইরের দিকে; তাদেরকে চলে যেতে দেখে সঙ্গীনিকে নিয়ে নৃত্যরত এক তরুণ হেমাঙ্গ বলে, ‘নৃপতি, চললে যে?’
বেণ পিছন ফিরে বলেন, ‘তোমরা আনন্দ করো। আমি বিশ্রামে যাচ্ছি।’
‘তুমি না থাকলে কী আর আনন্দ হয়?’
বেণ মৃদু হাসেন। আরেক তরুণ অষ্টক বলে, ‘তুমি বড় বেরসিক হেমাঙ্গ, দেখছ না নৃপতির হাত আজ কার কোমর বেষ্টন করে আছে! কথা বাড়িয়ে কালক্ষেপণ করাচ্ছ কেন?’
‘তাই তো, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে! অপরাধ ক্ষমা করো নৃপতি।’ হেমাঙ্গ হাসে।
অষ্টক আবার বলে, ‘দেখো, নৃপতি আজ সূর্যদেবের নিকট প্রার্থনা করবে, যেন তিনি বিলম্বে উদিত হন।’
সবাই হেসে ওঠে। হেমাঙ্গ বলে, ‘তুমি যাও গো নৃপতি, আমরা আজ আর গৃহে ফিরছি না!’
বেণ হাস্যমুখে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুরোত্তমার কাঁধে হাত রেখে হেঁটে মশালের আলো থেকে দূরে চলে যান, পিছনে বাজতে থাকে কাড়া-নাকাড়ার বাদ্য, চলতে থাকে জোড়া জোড়া পায়ের নৃত্য। জ্যোৎস্নায় হাঁটতে হাঁটতে পথের পাশের কতকগুলো মাঝারি আকৃতির জ্যোৎস্নালোকিত ধবধবে সাদা পাথর দেখিয়ে সুরোত্তমা বলেন, ‘নৃপতি, এখানে কিছুক্ষণ উপবেশন করবে? এমন সুন্দর চন্দ্রকিরণ অঙ্গে মাখতে ইচ্ছে করছে!’
‘বেশ তোমার যেমন ইচ্ছে। তুমি চন্দ্রকিরণ অঙ্গে মাখো আর আমি তোমার চন্দ্রমুখ অবলোকন করি!’
মৃদু হেসে আদুরে হাতে বেণের নাক টিপে দেন সুরোত্তমা, দুজনেই অঙ্গে অঙ্গ ঘেঁষে উপবেশন করেন পাথরের ওপর। সামনে পাহাড়ের ঢাল, তারপর নিচু একটি টিলা, তারপরেই সরস্বতী নদী। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় সরস্বতী নদীকে বড় মোহময় লাগে এখন থেকে!
সুরোত্তমা বলেন, ‘চারিদিকটা আশ্চর্য সুন্দর! তোমাদের এখানকার সঘন অরণ্য, সবুজ প্রকৃতি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি নৃপতি। দেখ, জ্যোৎস্নায় চারিদিকটা কী আশ্চর্য লাগছে!’
বেণ বলেন, ‘তুমি দেখি আমাদের কুথানের মতো কথা বলছ!’
‘কুথান কে?’
‘কুথান আমার বাল্যসখা, আমাদেরই গোত্রের, ভালো গল্পকথক। সেও তোমারই মতো এইসব বৃক্ষরাজি, নদী, ঝরনার রূপ দেখে মুগ্ধ হয়। সহস্রবার দেখার পরও তার মুগ্ধতা শেষ হয় না, আবার যখন দ্যাখে মনে হয় প্রথম দেখছে! সে বৃক্ষরাজি আর পশু-পাখির সঙ্গে কথাও বলে, অদ্ভুত পাগল! নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, আর্যভূমি তো বটেই, সরস্বতী ছাড়াও বহু দূরের গঙ্গা-যমুনা পারের পাতালের অনার্য জনপদেও সে যায়, কোনো ভয়-ডর নেই। ফিরে আসে গল্পের ঝুলি নিয়ে, সন্ধেবেলা তার গৃহের আঙিনায় গল্পের আসর বসে। নানা রকম গল্প বলে সে মানুষকে আনন্দ দেয়।’
‘বাহ, ভারী আশ্চর্য মানুষ তো তিনি!’
‘হ্যাঁ, আশ্চর্য মানুষই বটে।’
‘আমি একদিন তার গল্প শুনতে চাই নৃপতি।’
‘সে কী আর এখন এখানে আছে? অতল-বিতল-পাতালের কোনো বসতিতে গিয়ে হয়ত মানুষকে গল্প শুনিয়ে আনন্দ দিচ্ছে।’
দুজনই চুপ হয়ে যায়, কেবল ঝিঝির ডাক শোনা যায়। অদূরের নাকাড়ার বাদ্যের তালে ভূমিতে পা ঠোকেন বেণ, তারপর গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন সামগীত। সুরোত্তমা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন, বেশ কিছুক্ষণ পর গীত থামিয়ে সুরোত্তমার কাঁধে হাত রেখে বেণ বলেন, ‘আকাশের দিকে তাকিয়ে অমন করে কী দেখছ প্রিয়তমা অপ্সরা?’
‘চন্দ্রদেবকে দেখছি।’
বেণও তাকান পরিচ্ছন্ন আকাশের গোলাকার চন্দ্রের দিকে। সুরোত্তমা বলেন, ‘ব্রহ্মাবর্ত থেকেও চন্দ্রদেবকে দেখতে স্বর্গের মতোই একই রকম উজ্জ্বল দেখায়। তবে স্বর্গের আকাশে চন্দ্রদেব ক্ষণে ক্ষণে মেঘের আবরণ টেনে নেন, ফলে দীর্ঘক্ষণ দর্শন করা যায় না।’
বেণ আবার আকাশের দিকে তাকান। সুরোত্তমাও আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘চন্দ্রদেবকে দেখতে দেখতে স্বর্গের জন্য মনটা কেমন করছে। মনে হচ্ছে যেন কতদিন আমি স্বর্গ থেকে নিপতিত।’
‘স্বর্গে তোমার কোনো প্রিয় মানুষ আছে বুঝি?’
‘সকল দেবগণই অপ্সরাদের প্রিয়, তবে তারই মধ্যে কেউ কেউ অধিক প্রিয় হয়ে ওঠেন। তাছাড়া আমার পিতা-মাতা আর ভ্রাতা-ভগিনীগণ তো আছেন।’
বেণ সুরোত্তমার চিবুক ধরে ওর মুখমণ্ডল নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলেন, ‘আরো কিছুদিন ব্রহ্মাবর্তে থাকো প্রিয়তমা অপ্সরা, আনন্দ করো, আহার-বিহার করো, তারপর স্বর্গে ফিরে যেও।’
সুরোত্তমা মুখে কিছু বলেন না, বেণের চোখে দৃষ্টি রেখে মৃদু হেসে কাঁধে মাথা রাখেন। সুরোত্তমার কেশ আর শরীরের সুগন্ধ বেণের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে পৌঁছলে সারা শরীরে কামের মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে, তিনি সুরোত্তমাকে বাহুলগ্ন করেন, নিজের বাম কাঁধে থাকা সুরোত্তমার মাথার কেশে নাক গুঁজে ঘ্রাণ নেন, তারপর কপালে চুম্বন করেন। সুরোত্তমা বেণের কাঁধ থেকে মাথা তুলে প্রতিচুম্বন করেন। এবার বেণ দু-হাতে সুরোত্তমার মুখমণ্ডল ধরে ওষ্ঠে চুম্বন করেন আর সুরোত্তমা বেণের গ্রীবা আঁকড়ে ধরেন। বেশ কিছুক্ষণ পর বেণ বলেন, ‘অপ্সরা, চন্দ্রদেব নিদ্রা যাবার সময় হয়ে এল, এবার আমরা গৃহে যেতে পারি, কী বলো?’
‘বেশ, তাই চলো প্রিয়তম।’
(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২২ রাত ৯:২৮