somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- বারো)

১৪ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সন্ধ্যায় নৃপতি বেণের বাটীর সভাগৃহে সোম পানের বৈঠক বসে বেণ, কুথান, দেবগণ, অপ্সরাগণ এবং বেণ ও কুথানের কয়েকজন বাল্যসখা মিলে। মাঝখানে জলন্ত প্রদীপ, চারিদিকে গোল হয়ে উপবিষ্ট সকলে। দেবগণ এবং অপ্সরাদের সঙ্গে কুথানের পরিচয় করিয়ে দেন বেণ। ভৃত্য মারীচ পদ্মপাতায় ধোঁয়া ওঠা বাছুরের মাংস পরিবেশন করে সকলকে, তারপর বেণ ও কুথানের সখা চক্রধর মৃৎপাত্র থেকে কাঠের চষকে সোমরস ঢেলে দিলে মারীচ সোমপূর্ণ চষকগুলো সবাইকে পরিবেশন করে।

‘আপনার কথা কতবার যে শুনেছি নৃপতির মুখে! দেখা করবার খুব আগ্রহ ছিল, পরিচয় হয়ে ভালো লাগছে।’ সুরোত্তমার কণ্ঠ থেকে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে।

‘ধন্যবাদ। আমারও মন্দ লাগছে না এমন অনিন্দ্য সুন্দরী অপ্সরাদের সাক্ষাৎ পেয়ে, আশা করি সময়টা উপভোগ্য হবে।’ বলে মৃদু হাসেন কুথান।

বেণ বলেন, ‘সুরোত্তমার খুব আগ্রহ তোমার সঙ্গে পাতাল ভ্রমণে যাবার। পাতালের অনার্যদের জীবনযাত্রা দেখবার খুব ইচ্ছে ওর!’
‘কী সৌভাগ্য আমার, এমন সুন্দরী অপ্সরার সঙ্গ পেলে পাতালও স্বর্গ হয়ে উঠবে আমার কাছে! পাতালের গ্রীষ্মকালের গরমকেও মনে হবে স্বর্গের শৈত্য!’

বেণ আবার বলেন, ‘সুন্দরী অপ্সরার সঙ্গ পাও বা না পাও, একজন দেবতার সঙ্গ নিশ্চয় পাবে! দেবপতি ইন্দ্র দেবতা কল্পককে পাতালের সংবাদ সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে বলেছেন। তুমি সবে এলে, কয়েকদিন বিশ্রাম করো, তারপর দেবতা কল্পককে নিয়ে বেরিয়ে পোড়ো পাতালের উদ্দেশ্যে।’

কুথান কল্পকের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তাই নাকি! খুব ভালো হবে আপনি সঙ্গে থাকলে, হাতে যথেষ্ঠ সময় আছে তো, না কি ফিরবার তাড়া আছে আপনার?’

কল্পক ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘না না আমার কোনো তাড়া নেই, যতদিন খুশি থাকতে পারব।’
‘বেশ, তাহলে আমরা শীঘ্রই বেরিয়ে পড়ব।’
বায়ু বলেন, ‘আমারও ইচ্ছে ছিল পাতালে যাবার, কিন্তু এ যাত্রায় আর হচ্ছে না, শীঘ্রই স্বর্গে ফিরতে হবে, তবে আবার কখনো এলে নিশ্চয় যাব।’

‘কোনো যাত্রায়-ই আপনার পাতালে যাওয়া হবে না ভ্রাতা! আপনার স্বপ্নের কথা অন্তরেই রেখে দিন।’ বলেই হাসেন কল্পক, অন্যরাও তাতে যোগ দেন।
বায়ু আবার বলেন, ‘কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হওনি তো এখনো, হলে বুঝতে!’
কল্পক বলেন, ‘কে আপনায় বন্ধনে আবদ্ধ হতে দিব্যি দিয়েছিল বলুন!’

সুরোত্তমা বলেন, ‘এই তোমরা এখন থামো তো! আমরা বরং ভ্রাতা কুথানের মুখে পাতালের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে শুনি। বলুন না ভ্রাতা।’
‘নিশ্চয় শোনাব।’ বলেন কুথান। তারপর চক্রধরের উদ্দেশে বলেন, ‘সখা চক্রধর, পাত্র তো শূন্য, শুকনো গলায় কী গল্প জমে! দাও আরেক পাত্র করে।’

মারীচ দূরে গিয়ে পাথরের ওপর উপবেশন করে ছিল, বেণের নির্দেশ পেয়ে উঠে এসে সবার হাতের শূন্য চষক সংগ্রহ করে চক্রধরের সামনে রাখে, চক্রধর শূন্য চষক সোমরসে পূর্ণ করে দিলে সে সবার মাঝে পরিবেশন করে পুনরায় পাথরের ওপর উপবেশন করে।
কুথান বলেন, ‘এবারের যাত্রায় আমি বহু অনার্য জন্মন এবং নগর পরিভ্রমণ করেছি; সরস্বতী, গঙ্গা, যমুনার তীর চষে বেরিয়েছি!’
‘আপনি দেবী গঙ্গাকে দর্শন করেছেন!’ অপ্সরা কমলা বিস্ময় প্রকাশ করে।

‘হ্যাঁ, তবে কেবল দর্শন করিনি, নিরন্তর প্রবহমান দেবী গঙ্গার পবিত্র অঙ্গ স্পর্শ করেছি, প্রণাম করেছি, তার জ্বলে স্নান করেছি। বর্ষার প্রমত্ত গঙ্গার রূপ কী ভয়ংকর, কী বিশাল তার ঢেউ! অথচ সেই প্রমত্ত গঙ্গাকেই যেন ময়নাপাখির ন্যায় পোষ মানিয়ে ফেলেছে অনার্যরা! তারা ছোট-বড় নানারকম তরণীতে আরোহণ করে গঙ্গাবক্ষ পাড়ি দেয়, দলবদ্ধ হয়ে মৎস্য শিকার করে, দূর-দূরান্তে যায় বাণিজ্য করতে। গঙ্গাকে কেন্দ্র করে যেনবা এক মহাযজ্ঞ চলে তাদের!’

অনভিজ্ঞ কমলা বলেন, ‘জলে সাঁতার কাটতে পারে তরণী? দেখতে কেমন সেই প্রাণি?’

কুথান হাসেন, ‘প্রাণি নয় দেবী, প্রাণি নয়; তরণী এক প্রকার জলবাহন, যা কাঠের সঙ্গে কাঠ জুড়ে তৈরি করে অনার্য কারিগররা। কাঠের বৈঠা দিয়ে নদীর বুকে বাইতে হয় সেই তরণী, যারা তরণী বায় তাদেরকে বলে মল্লার। নদীর উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যেও অবিরাম ভেসে চলে তরণী, সে এক আশ্চর্য জলবাহন!’

‘পাতালের অনার্যরা কি দেব-মানবদের চেয়েও শক্তিশালী?’ ভ্রূ কুঁচকে জানতে চান বায়ু।

‘যুদ্ধবিদ্যায় তারা আমাদের চেয়ে শক্তিশালী বা কৌশলী নয়, বরং অনেক পিছিয়ে, তাদের গড়ন বেঁটে, তবে অনেকেরই শরীর বেশ সুগঠিত। অনার্য জনপদে অশ্ব খুব কম দেখা যায়, তারা অশ্বের ব্যবহার জানে না বললেই চলে, যুদ্ধের প্রতি তাদের আগ্রহও কম; কিন্তু নির্মাণবিদ্যায় তারা আমাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে, যা তাদের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে, জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।’
‘কেমন তাদের জীবনযাত্রা?’ জানতে চান দেবতা লেখ।

‘আমরা কেবল পশুপালন, পশু শিকার, যব এবং কয়েকটি ফসল চাষ, জীবনযাপনের জন্য অল্পকিছু সামগ্রী নির্মাণ আর যুদ্ধবিদ্যার মতো সনাতন জীবনযাত্রার মধ্যেই আবদ্ধ আছি। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রা আমাদের মতো একইরকম সনাতন পদ্ধতিতে আবদ্ধ নেই, সনাতন জীবনযাত্রার ছকের বাইরে গিয়ে তারা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের নির্মাণকলা দিয়ে। এইসব নির্মাণ তাদের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে, জীবিকার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। গৃহনির্মাণবিদ্যায় তারা খুবই দক্ষ, পোড়া ইটের একতলা তো বটেই, তারা সুদৃশ্য দ্বিতল গৃহও নির্মাণ করতে পারে। সারি সারি গৃহ দ্বারা তারা নতুন নতুন পুর বা নগর নির্মাণ করছে, কী যে বাহারি সেইসব নগর, দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়! নগরের লোকেদের জীবনযাত্রা আর জন্মনের লোকেদের জীবনযাত্রায় রয়েছে ভিন্নতা। নগরের বেশিরভাগ লোক বাণিজ্য করে; আর জন্মনের লোকেরা কৃষিকাজ, পশুশিকার, মৎস্যশিকার ও নানারকম দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করে। জন্মনের লোকেরা তাদের দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করতে যায় নগরে। তবে সকল অনার্য জাতি-ই যে একইরকম চৌকস তা কিন্তু নয়, কোনো কোনো জাতি আছে যারা খুবই অলস, কর্মবিমুখ এবং উন্নাসিক, পাত্রে রাখা জলের ন্যায় অতিশয় স্থির তাদের চিন্তা। এরা সাধারণত নগর থেকে দূরের অরণ্যে বা অরণ্যের কাছাকাছি অঞ্চলে বাস করে, পশু এবং মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে।’

‘তাদের খাদ্যাখাদ্য সম্পর্কে বলুন।’ বায়ু বলেন।
‘পাতালের কিছু অনার্য জাতি এক অদ্ভুত খাদ্য আবিষ্কার করেছে, যার নাম অন্ন।’
সকলে বিস্ময়ে তাকান কুথানের দিকে, বায়ু বলেন, ‘কেমন সেই খাদ্য?’

কুথান বলেন, ‘ভূমিতে জল দিয়ে কর্ষণ করে সেই কাদাজলে ধান্য নামক একপ্রকার গাছের চারা রোপন করা হয়, ধান্যগাছ খুব বেশি বড় হয় না, দেড়-দুই হাত লম্বা হয়, সেই গাছে যবের মতো ছোট দানার ফল হয়, ফল পাকলে গাছসহ কেটে বাটীতে এনে গাছ থেকে ধান্যফল পৃথক করে রোদ্রে শুকিয়ে গৃহে সংরক্ষণ করে রাখে। তারপর সেই ধান্যফলের খোসা ছড়ালে ভেতর থেকে যে বীজ বের হয় তার নাম চাল। এই চাল পাত্রের মধ্যে ঢেলে জলের সঙ্গে সিদ্ধ করতে হয়, সিদ্ধ করার ফলে চাল নরম হয়ে দ্বিগুণ আকার ধারণ করে শ্বেত রঙের অন্ন তৈরি হয়।’

‘অন্ন খেতে কি খুব সুস্বাদু?’ সুরোত্তমা জানতে চান।
‘মৎস্য, মাংস, শাখ-সবজীর ঝোল রন্ধন করে ঝোল দিয়ে মেখে অন্ন আহার করতে হয়; খেতে বেশ সুস্বাদু আর পেটেও থাকে অনেকক্ষণ। আমি পাতালে গেলে দিনে অন্তত দু-বার অন্ন আহার করি।’

বেণ বলেন, ‘সখা, আমি তোমার সঙ্গে যখন পাতালে গিয়েছিলাম, তখন তো ধান্য দেখিনি!’
‘আমরা তো তখন পাতালের খুব বেশি নিচের দিকে যাইনি। যেখানে গিয়েছিলাম সেখানকার অনার্যরা আমাদের মতোই রুটি আহার করে।’
‘আমরা কি ওদের মতো ধান্য চাষ করতে পারি না?’
‘ধান্য চাষ করার জন্য সমতল ভূমি হলে সুবিধা হয়, আর প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়, ফলে পাতালে ধান্য চাষ করা সহজ। তবে আমরাও চাষ করতে পারি, সরস্বতী নদী এবং বিভিন্ন ছড়ার পাশে যে-সব সমতল জায়গা রয়েছে, সে-সব জায়গা ধান্যচাষের উপযোগী করে গড়ে তোলা যেতে পারে।’
‘ধান্য চাষের পদ্ধতি তুমি জানো?’
‘জানবো না কেন, এতবার পাতালে গিয়েছি যে পাতালবাসীরা পাতাল সম্পর্কে যা জানে, বলা যায় আমিও তাই জানি।’
‘তাহলে তুমি এবার পাতালে গেলে আসবার সময় ধান্যবীজ নিয়ে আসবে, তোমার তত্ত্বাবধানে আমরাও ধান্য চাষ করব।’
‘বেশ, আমি বীজ নিয়ে আসব। ব্রহ্মাবর্তে ধান্য চাষ করতে পারলে মানুষের সুবিধাই হবে, খাদ্যাভাসেও বৈচিত্র্য আসবে।’

কুথানের মুখে অনার্যদের সম্পর্কে বিচিত্র সব গল্প শুনতে শুনতে বিস্ময়বনে যান সকলে, তাদের মনোজগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়, বিশেষত দেবতা ও অপ্সরাগণের, তারা অনভিজ্ঞ বালক-বালিকার ন্যায় একের পর এক প্রশ্ন করলেও কুথান আন্তরিকতার সঙ্গে উত্তর দিতে থাকেন।

এরপর কুথান বহু যোজন দূরের এক বসতির একজন আশ্চর্য মানুষ আর তার মুখে শোনা আরো অধিক দূরের আরেক বসতির একজন নৃপতিপুত্রের আখ্যান শোনান। কুথান শতলজ নদীর পারের এক আর্য বসতিতে কিছুকাল অবস্থান করার পর পূর্বদিকের পথে বের হন অন্য এক বসতির উদ্দেশ্যে। তিনি তখন শতলজ নদীকে কয়েক যোজন পিছনে ফেলে হাঁটতে থাকেন পর্বত থেকে নিচের দিকে, লক্ষ্য করেন পথের ধারেই একটি বৃক্ষের তলায় একজন লোক উপবিষ্ট; তার অঙ্গে পা পর্যন্ত লম্বা শ্বেতবর্ণের অদ্ভুত রকমের ঢিলা পরিচ্ছদ, মাথায় মহিষের শিংয়ের মতো লম্বা ও চোখা উষ্ণীব, পায়ে পাদুকা। এই ধরনের পরিচ্ছদ সাধারণত ব্রহ্মাবর্ত থেকে দুইশত-আড়াইশত যোজন পশ্চিমদিকের বসতির লোকেরা পরিধান করে, যাদেরকে কুথান দেখেছেন পাতালের বিভিন্ন অনার্য নগরে, যারা তরণীতে আরোহণ করে জলপথ কিংবা উটের পিঠে আরোহণ করে শত শত যোজন দূর্গম পথ অতিক্রম করে বাণিজ্য করতে আসে। লোকটা প্রথমে কুথানকে লক্ষ্য না করলেও আরো কাছাকাছি যেতেই পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে কুথানকে দেখেই প্রায় দৌড়ে এসে তার হাত ধরেন, কুথান প্রথমে ঘাবড়ে যান। লোকটা কুথানের বয়সীই হবে, তিনি তার ভাষা আর দু-চারটি আর্য শব্দ মিলিয়ে কুথানের উদ্দেশে কথা বলতে থাকেন, তার ভাষা আর আর্য ভাষায় অমিল থাকলেও কিছু শব্দের উচ্চারণ আর্য ভাষার কাছাকাছি। পাতাল, সুতল, বিতলের নানা বসতিতে ভ্রমণের কারণে ওই দুইশত-আড়াইশত যোজন দূরের বসতি থেকে আসা বণিক আর তাদের তরণীতে কাজ করা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হওয়ায় কুথান ওই অঞ্চলের কিছু কিছু শব্দের অর্থ বুঝতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন যে লোকটা পথ হারিয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর ক্লান্ত আর হতাশ হয়ে ওই বৃক্ষের নিচে উপবিষ্ট ছিল। তিনি কিছুটা মুখে বলে এবং কিছুটা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে লোকটির নিবাস সম্পর্কে জানতে চান।

লোকটি কুথানের কথা বুঝতে পেরে বলেন, ‘অরট্ট।’

আগে-পিছে আরো কিছু শব্দ প্রয়োগ করেন লোকটি। অরট্ট শুনেই কুথান বুঝতে পারেন যে তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পশ্চিমদিকে দুইশত-সোয়া দুইশত যোজন দূরের এক বসতির নাম অরট্ট। পাতালে অনল ও ইল্বল নামে তার দুইজন বণিক সখা আছেন, তারা বাণিজ্য করতে অরট্ট গিয়েছিলেন। শুধু অরট্ট নয়; পশ্চিম অঞ্চলের এলাম, নিশ্য, সসা, মরহষি প্রভৃতি নগরেও তারা বাণিজ্য করতে গিয়েছিলেন। কুথান তার সখা অনল ও ইল্বলের মুখ থেকেই অরট্টের কথা শোনেন।

কুথান লোকটির গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘হারখাওয়াতি।’

কুথান বুঝতে না পেরে আবারো জিজ্ঞেস করলে লোকটি একই উত্তর দেন, তিনি বুঝতে পারেন যে লোকটি হারখাওয়াতি দেখতে চান, কিন্তু হারখাওয়াতি বলে কোনো বসতি আছে বলে তার জানা নেই। লোকটি অনেক কথা বলে কুথানকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাত দিয়ে ঢেউ খেলানো এবং সাঁতার কাটার ভঙ্গী করলে তিনি অনেকটা অনুমানের ওপর নির্ভর করে বলেন, ‘সরস্বতী নদী?’

লোকটি এবার শিশুর মতো খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, ‘হারখাওয়াতি, হারখাওয়াতি!’

কুথান বুঝতে পারেন লোকটি সরস্বতী নদী দেখতে যাবার কথা বলছেন, কিন্তু সরস্বতী নদী তখনো অনেক যোজন দূরে, হেঁটে তেরো দিনের আগে পৌঁছনো সম্ভব নয়, আর বৃষ্টি হলে আরো বেশি সময় লাগবে। লোকটিকে সে-কথা জানাতেই তাকে হতাশ দেখায়। কুথান তাকে জানান যে আগামী তিন দিনের পথ তিনি কুথানের সঙ্গে যেতে পারেন, তারপর বাকি পথ তাকে একাই যেতে হবে অথবা অন্য কোনো সঙ্গী খুঁজে তার সঙ্গে যেতে হবে। লোকটি সম্মত হন কুথানের সঙ্গে যেতে। আসবার পথে কুথান তার অশ্বটি এক সখার আশ্রয়ে রেখে এসেছেন, সেই পর্যন্তই লোকটির সঙ্গে যাবেন তিনি, তারপর যাবেন অন্যত্র। পথ চলতে চলতে কুথান লোকটির নাম জানতে পারেন- তৌরু। কিছুটা শব্দের ভাষায় এবং কিছুটা আকারে ইঙ্গিতে কথা চলে তাদের মধ্যে। দু-দিনের পথ অতিক্রম করার পর প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়, কুথান লোকটিকে নিয়ে এক পণি বসতির অতিথিশালায় ওঠেন। বৃষ্টি থেমে পথ কিছুটা না শুকোনো পর্যন্ত থাকতে হবে অতিথিশালাতেই, কিন্তু বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণই নেই।

এই সময় তৌরুর এক অসাধারণ গুণের সঙ্গে পরিচয় হয় কুথানের। বৃষ্টিতে কিছু করবার নেই দেখে তৌরু বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পাথর কুড়িয়ে এনে ধুয়ে-মুছে রেখে দেন, পাথর ভালোভাবে শুকোনোর পর তিনি পাথরে চিত্র অঙ্কন করেন; মানুষ, পশুপাখি এবং লতা-পাতার চিত্র। ছোট ছোট পাত্রে নানা বর্ণের রঙ ছিল তার ঝুলিতে, বৃক্ষের পাতা আর বাঁকল থেকে তিনি নিজেই তৈরি করেছেন ওই রঙ। তৌরু কুথানকে জানান যে, তিনি আসবার পথে যেখানে বিশ্রাম করেছেন, সেখানকার পথের ধারের বড় বড় পাথরের গায়ে চিত্র অঙ্কন করতে করতে এসেছেন। আবার ছোট ছোট পাথরে চিত্র অঙ্কন করে মানুষকে উপহার দিয়েছেন। তৌরুর মুখে এসব শুনে অবাক হয়ে যান কুথান। পাথরে অঙ্কিত একটি চিত্র তাকেও উপহার দেন তৌরু।

একটানা চারদিন কিছুটা থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। পথ শুষ্ক হবার জন্য আরো একটি দিন অতিথিশালায় থেকে তারপর কুথান আর তৌরু আবার যখন যাত্রা শুরু করেন তখন দুজনের যোগাযোগের দূরত্ব কিছুটা ঘুচেছে, দুজন দুজনের সম্পর্কে অনেক কথা জেনেছেন, দুজনের মাঝে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, আর কুথান এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে তিনি তার এই নতুন সখা তৌরুর সঙ্গে কেবল সরস্বতী নদী পর্যন্তই যাবেন না, তৌরুকে বহির্ষ্মতীতে নিজের গৃহেও নিয়ে যাবেন! কুথান জানতে পারেন যে তৌরু এক মহৎ উদ্দেশ্যে সেই দুইশত-আড়াইশত যোজন দূরের বসতি অরট্ট থেকে এই ভারতবর্ষে পা রেখেছেন। তৌরুর পাঁচ প্রজন্ম পূর্বের পূর্বপুরুষ ছিলেন এই ভারতবর্ষের ব্রহ্মাবর্তের মানব, অর্থাৎ তৌরু আর কুথানের বংশের শিকড় একই ভূমিতে প্রোথিত। তৌরুর যে পূর্বপুরুষ ব্রহ্মাবর্ত ত্যাগ করেছিলেন তিনি ছিলেন ঋষি ভৃগুর সম্প্রদায়ের একজন ঋষি। ঋষি ভৃগু ছিলেন প্রসিদ্ধ ঋষি অথর্বার শিষ্য, অর্থাৎ অথর্বান সম্প্রদায়ের একজন ঋষি। ঋষি অথর্বা গত হয়েছেন দীর্ঘকাল পূর্বে, কিন্তু আজও দেবগণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ঋষি এবং নানা গোত্রের আর্যরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তার নামটি উচ্চারণ করে তার অভূতপুর্ব এক আবিষ্কারের কারণে। আর্যরা পূর্বে অগ্নি ব্যবহার করত দুটো প্রস্তরখণ্ড ঘর্ষণ করে, সেটি ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। ঋষি অথর্বা অরণি কাঠ ঘর্ষণ করে অগ্নি প্রজ্জ্বলনের অপেক্ষাকৃত সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, এই আবিষ্কারের ফলে আর্য সমাজে তার নামে জয়জয়কার পড়ে যায় এবং তিনি অধিষ্ঠিত হন এক উচ্চ আসনে। সেই থেকে তিনি অগ্নিকে আরাধনা করার রীতি প্রচলন করেন। তার দুজন প্রধান শিষ্য ছিলেন ভৃগু ও অঙ্গিরা, কালক্রমে ভৃগু ও অঙ্গিরার মধ্যে অগ্নি আরাধনার রীতি নিয়ে মতবিরোধ দেখা যায় এবং দুজন দুজনের মতাদর্শীদের নিয়ে পৃথক হয়ে যান। ভৃগু মতাদর্শীগণ ভৃগু সম্প্রদায় ও অঙ্গিরার মতাদর্শীরা অঙ্গিরা সম্প্রদায় নামে পরিচিতি লাভ করেন। পৃথক হলেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ দিন দিন প্রকট হতে থাকে, এক পর্যায়ে ভৃগু সম্প্রদায় অঙ্গিরা সম্প্রদায়ের ওপর বিরক্ত হয়ে ব্রহ্মাবর্ত ত্যাগ করে পশ্চিমের দিকে চলে যান। ব্রহ্মাবর্ত ত্যাগ করা সেই ভৃগু সম্প্রদায়ের একজন ঋষি ছিলেন তৌরুর পূর্বপুরুষ। কালক্রমে ভৃগু সম্প্রদায় বিস্তৃত হয় এবং পশ্চিমের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তৌরুর পূর্বপুরুষ স্থিত হন অরট্ট নগরে।

তৌরু অরট্টের মানুষ এবং তাদের জীবনযাপন ও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে নানা গল্প বলেন কুথানকে। অরট্টে অগ্নি উপাসক এবং মূর্তি পূজারী উভয় ধরনের মানুষই আছে। অগ্নি উপাসকরা বেদি স্থাপন করে অগ্নিকে উপাসনা করে। আর মূর্তি পূজারীরা দেবী ইনান্নার মূর্তি গড়ে পূজা করে।

অরট্ট পল্লীদশা থেকে কিছুকাল হলো নগররূপ ধারণ করেছে এবং ক্রমশ তা বর্ধিত হচ্ছে কেননা এখানে রয়েছে বৈদূর্যমণি ও তাম্র খনি। নানা অঞ্চরের বণিকেরা সেখানে যায় বৈদূর্যমণি ও তাম্র সংগ্রহ করার জন্য।

তৌরু যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সুদূর অরট্ট নগরী থেকে সরস্বতী নদীর সন্ধানে ভারতবর্ষের ভূমিতে পা রাখেন তা হলো- তিনি তার পূর্বপুরুষদের দেহভস্ম পবিত্র সরস্বতী নদীতে বিসর্জন দিতে চান। তার যে পূর্বপুরুষ ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন পশ্চিমে, শেষ বয়সে তিনি নাকি জন্মভূমি আর জন্মভূমির ভেতর দিয়ে বয়ে চলা সরস্বতী নদীর প্রতি টান অনুভব করেন, তাই মৃত্যুর পূর্বে পুত্রের কাছে তিনি এই ইচ্ছার কথা জানান যে তার দেহভস্ম ভারতবর্ষের পবিত্র সরস্বতী নদীতে বিসর্জন দিলে তার আত্মা শান্তি পাবে। তার পুত্র পিতার দেহভস্ম রেখে দেন এই আশায় যে ভবিষ্যতে ভারতবর্ষে গিয়ে তা সরস্বতী নদীতে বিসর্জন দেবেন। কিন্তু পুত্রের পক্ষে কোনোদিন ভারতবর্ষে আসা সম্ভব হয়নি। পুত্র আবার তার পুত্রের হাতে পিতার দেহভস্ম তুলে দিয়ে দেন, সঙ্গে তার নিজের দেহভস্মও সরস্বতী নদীতে বিসর্জন দিতে বলেন। এমনিভাবে পাঁচ প্রজন্মের দেহভস্ম সংরক্ষিত হয়ে থাকে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে কেউ-ই আর দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে আসতে পারেননি। তৌরুর পিতাশ্রীও মৃত্যুর পূর্বে পুত্রদের হাতে পূর্বপুরুষের দেহভস্ম তুলে দিয়ে একই কথা বলেন। তৌরুর ভ্রাতারা সবাই বিবাহিত এবং নানা কর্মে ব্যস্ত। তৌরু অবিবাহিত এবং সন্ন্যাসী স্বভাবের একজন চিত্রশিল্পী। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পূর্বপুরুষের দেহভস্ম যেভাবেই হোক সরস্বতী নদীতে বিসর্জন তাকে দিতেই হবে, আর সেই উদ্দেশ্যেই একদিন পা বাড়ান ভারতবর্ষের সরস্বতী নদীর সন্ধানে।

সরস্বতী আর্যদের কাছে পবিত্র এক নদী, হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে যার উৎপত্তি, বহু আর্য-অনার্য বসতির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে সমুদ্রের সঙ্গে। সরম্বতীকে কেন্দ্র করেই ব্রহ্মাবর্তে আর্যদের বসতি শুরু হয়েছিল, তারপর আর্যরা ক্রমান্বয়ে সরস্বতীর আরো ভাটির দিকে এবং ক্রমান্বয়ে পশ্চিমের নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্তের সকল আর্যরাই এখনো সরস্বতীকে পবিত্র নদী আর সরস্বতীর পারের আর্যদেরকে শ্রেষ্ঠ আর্য মনে করে। কেউ সারস্বত অর্থাৎ সরস্বতী পারের অধিবাসী, দূর-দূরান্তের আর্যদের নিকট এই পরিচয় উন্মোচিত হলেই সকলে তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। তাই বহু যোজন দূর থেকে আর্যরা সরস্বতী নদীতে তীর্থ করতে আসে, মনে করে সরস্বতী নদীতে স্নান করলে পাপ মোচন হয়!

কুথান তৌরুকে নিয়ে তার সখার গৃহে পৌঁছান যেখানে তিনি তার প্রিয় অশ্ব রেখে গেছেন। এক রাত্রি বিশ্রাম নিয়ে আবার তারা যাত্রা শুরু করেন, কখনো তৌরুকে অশ্বে আরোহণ করিয়ে নিজে হাঁটেন, আবার কখনো তিনি অশ্বে আরোহণ করেন আর তৌরু হাঁটেন। সখার গৃহ থেকে অশ্ব নিয়ে যাত্রা শুরু পর তাদের দিন পেরোতে থাকে পথে আর রাত্রি যাপন করেন কখনো কুথানের কোনো সখার গৃহে, আবার কখনো কোনো অতিথিশালায়। অতিথিশালার শয্যায় শুয়ে শুয়ে পশ্চিমের নানা বসতির নানা গল্পগাঁথা কুথানকে শোনান তৌরু। একটি গল্প কুথানের মনে বেশ দাগ কাটে, তিনি সেই গল্পটিই শোনান দেবতা, অপ্সরা আর তার সখাদেরকে।

অরট্ট নগরী থেকে আরো উত্তর-পশ্চিমে, অনেক দূরের হরা-বরাজাইতি নামক পর্বতে এক বসতির নৃপতি ছিলেন কাব্য বংশের কাবুস। কাবুসের এক রূপবান পুত্র ছিল, যার নাম সিয়াবস; সিয়াবসের রূপ দেখে লোকেরা তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত, অনেক নারী তাকে কামনা করত। সিয়াবসের রূপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়েন তারই পিতার একজন স্ত্রী- সুদবা, অর্থাৎ তার সৎ মা। সুদবা তার কামনার কথা জানান সিয়াবসকে। কিন্তু সিয়াবস সাধু প্রকৃতির যুবক, তিনি করজোড়ে সুদবার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। প্রেমান্ধ সুদবা তবু সিয়াবসকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন, কিন্তু সিয়াবস নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন সুদবা, তিনি নৃপতি কাবুসের কাছে মিথ্যা অভিযোগ করেন যে সিয়াবস তার সম্ভ্রম নাশের চেষ্টা করেছে। এই অভিযোগ সিয়াবসের স্বভাবের বিরুদ্ধ, তাই কাবুস নানাভাবে পুত্রের পরীক্ষা নেন, তাতে উত্তীর্ণ হয়ে সুদবার অভিযোগ থেকে মুক্তি পান সিয়াবস। কিন্তু মুক্তি পেলেও শান্তি মেলে না সিয়াবসের, ক্রমাগত তিনি লোকের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় এবং সুদবার কুমন্ত্রণায় কাবুস তাকে ঈর্ষা করতে শুরু করেন, এক পর্যায়ে প্রাণাশঙ্কায় তিনি পালিয়ে চলে যান তর নামক বসতিতে। তরের নৃপতি ফ্রানরাসিয়ান সিয়াবসকে গ্রহণ করেন এবং নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেন। সিয়াবসের জীবনে তখন শান্তির সুবাতাস বইতে থাকে, তার স্ত্রী গর্ভবতী হন। এরই মধ্যে জ্যোতিষী ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে নাতির হাতে ফ্রানরাসিয়ানের মৃত্যু হবে। চিন্তিত ফ্রানরাসিয়ান জামাতা সিয়াবসকে এবং ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে নাতিকেও হত্যার নির্দেশ দেন। সিয়াবসকে হত্যার কিছুকাল পরে তার স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন এবং ফ্রানরাসিয়ান নাতিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন। সিয়াবসের পুত্রের নাম রাখা হয় হাওস্রব, দেবী অনাহিতার পূজারী হাওস্রব বড় হয়ে একজন বীর যোদ্ধা হন এবং পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে মাতামহ ফ্রানরাসিয়াকে হত্যা করেন।

তৌরুর মুখে অদেখা বসতির এই আখ্যান শুনে কুথান যেমনি পুলকিত হন; তেমনি কুথানের মুখে শুনেও পুলকিত হন দেবগণ, অপ্সরাগণ, বেণ এবং অন্যরা। সেই অদেখা বসতির কল্পিত চিত্র ভেসে ওঠে সকলের মনে, আখ্যানের চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে!

বেণ চষকে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘তারপর তুমি আর তৌরু হারখাওয়াতি নদীতে কবে পৌঁছলে?’

বেণের মুখে সরস্বতী নদীর নাম হারখাওয়াতি শুনে কুথান ব্যতিত সকলেই হেসে ওঠেন।

কুথান কয়েক নিমেষ নীরব থাকেন, তারপর বলেন, ‘সরস্বতী নদী যখন আর মাত্র চার দিনের দূরত্বে তখন তৌরুর শরীর খারাপ হয়, আমরা এক অতিথিশালায় আশ্রয় নিই। রাত্রিবেলা তৌরুর শরীরের উত্তাপ বেড়ে যায়, দু-বার বমিও হয়। অতিথিশালার ভৃত্যকে দিয়ে বৈদ্য ডেকে আনি, বৈদ্য তৌরুকে দেখে কয়েক প্রকার পাচন দেন পান করতে। আরো একটি রাত্রি পেরিয়ে যায়, কিন্তু তৌরুর অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। ওর অবস্থা দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই, বৈদ্যও চিন্তিত হয়ে পরেন। এরপরের রাত্রে বৈদ্য, আমি আর অতিথিশালার ভৃত্য সারারাত্রি জেগে বসে থাকি তৌরুর পাশে। তৌরু আর তার আরাধ্য হারখাওয়াতি নদীতে পৌঁছতে পারেনি, ভোররাত্রে তার প্রাণবায়ু লীন হয় অনন্ত আকাশে।’

তৌরুর মৃত্যুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান সকলে, ক্ছিুক্ষণের জন্য কারো মুখ থেকে কথা বের হয় না। তৌরুর মৃত্যুর পর শোক জানানোর মতো কোনো নিকটাত্মীয় তার কাছে না থাকলেও শোকে কাতর হয়েছিলেন কুথান, শোকাচ্ছন্ন হৃদয়ে নিজহাতে তার নতুন সখার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। কুথানের হৃদয়ের শোক ক্ষণিকের জন্য বেণ এবং অন্যদেরকে আচ্ছন্ন করে, সকলেরই চোখ সিক্ত হয়ে ওঠে।
বেণ বলেন, ‘আহা, হতভাগ্য মানুষটির সরস্বতী নদী দেখা হলো না, পূর্বপুরুষের দেহভস্মও সরস্বতীর জলে বিসর্জন দেওয়া হলো না।’

কয়েক নিমেষ পর কুথান বলেন, ‘আমি তৌরুর ঝোলার মধ্যে পরিচ্ছদের সঙ্গে পাঁচটি ছোট্ট তাম্রপাত্রে তার পাঁচ পূর্বপুরুষের দেহভস্ম আর একটি আশ্চর্য পুতুল খুঁজে পাই।’
সুরোত্তমা ছলছল চোখে বলেন, ‘পুতুল কেন?’

সে-কথা তৌরু আমাকে বলেননি, হয়ত পরে বলতেন। তবে পুতুলটি দেখেই বোঝা যায় যে সেটি আমাদের ভারতবর্ষে তৈরি নয়, এমন আদলের পুতুল আমাদের ভারতবর্ষে নেই। হয়ত অরট্ট থেকেই সে বয়ে এনেছিল পুতুলটি।

এরপর কুথান তার পাশে রাখা ঝোলা হাতে নিয়ে ভেতর থেকে সেই পুতুলটি বের করে সকলের সামনে তুলে ধরে। সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে পুতুলটির দিকে। বিস্ময়কর পুতুল! উপবেশিত পুতুলটির পরনে কণ্ঠ থেকে পা পর্যন্ত লম্বা এক অদ্ভুত ধরনের পরিচ্ছদ, কেশ আবৃত করে রাখা গোলাকার উষ্ণীব মাথায়, পরিচ্ছদের হাতায় আবৃত বাহু দুটো দুই ঊরুর ওপর রাখা, শুধু কব্জি দুটো অনাবৃত। অনাবৃত মুখমণ্ডল, কণ্ঠ এবং হাত শুভ্র। কুথানের হাত থেকে সুরোত্তমা পুতুলটি হাতে নিয়ে দেখেন, তারপর একে একে সকলেই হাতে নেন। এরপর কুথান ঝোলা থেকে তৌরুর উপহার দেওয়া পাথরের ওপর অঙ্কন করা চিত্রটি বের করে দেখান সকলকে। নৃত্যের ভঙ্গিমায় এক নারীর চিত্র, এক পা শূন্যে তোলা, বেণি করা কেশ। চিত্রটি দেখে সকলেই প্রশংসা করেন। সুরোত্তমা বলেন, ‘চমৎকার চিত্র, আশ্চর্য এক মানুষ তৌরু!’

বেণ বলেন, ‘সত্যি, আশ্চর্য মানুষই বটে, তৌরুর পাঁচ পূর্বপুরুষের দেহভস্ম কী করেছ সখা?’
‘তৌরুর পাঁচ পূর্বপুরুষের দেহভস্ম আর তৌরুর দেহভস্ম আমি বয়ে এনে সরস্বতী নদীতে বিসর্জন দিয়েছি।’
‘বাহ, খুব সাধুকর্ম করেছে সখা!’ বলেন বেণ।

বায়ু বলেন, ‘মহা পূণ্যের কাজ করেছেন আপনি!’

অন্যরাও কুথানের এই কাজের প্রশংসা করেন। তৌরুর মৃত্যুর কথা শুনে সকলের মনের মধ্যে যে আক্ষেপ আর ব্যথা জমে, তাতে যেন কিছুটা শান্তির জল বর্ষিত হয়।


(চলবে.......)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:০৭
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×