তেরো
‘দেবপতি, আপনি একজন যথার্থ এবং সুযোগ্য মানুষের হাতেই ব্রহ্মাবর্তের শাসনভার অর্পণ করেছেন, যোগ্য মানুষ সঠিক দায়িত্ব পেলে জাতির কল্যাণ হয়, ব্রহ্মাবর্তের মানবদেরও তাই হবে। নৃপতি বেণ একজন যথার্থ ধার্মিক, শাস্ত্র ও যজ্ঞের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আপনার অনুগত, অন্যান্য দেবগণের প্রতি সশ্রদ্ধ, ব্রাহ্মণ ও ঋষিগণের একনিষ্ঠ সেবক এবং একজন বীর্যবান সারস্বত। তিনিই পারবেন পবিত্র সরস্বতী নদীর পার থেকে কুৎসিত অনার্যদেরকে উৎখাত করে আর্যজাতির সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে। নিজ গোত্র ব্যতিত অন্যান্য আর্য গোত্রের ওপরও তাঁর যথেষ্ঠ প্রভাব রয়েছে, গোত্রপতিগণ তাঁকে নৃপতি হিসেবে মান্য করেন, সম্মান করেন। ব্রহ্মাবর্তের সমগ্র আর্যগোত্রকে একই রজ্জুতে বেঁধে রেখে আর্য শাসনের বিস্তার ঘটানো তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আমরা সকলেই জানি যে অতীতে বেণ কয়েকটি অনার্য জাতিকে উৎখাতে যথেষ্ঠ পারদর্শীতা দেখিয়েছেন, আগামীতে তিনি এরকম পারদর্শীতা আরো দেখাবেন বলেই আমি জেনেছি। কিছুকাল পূর্বে তিনি আপনার নির্দেশে একটি বানরগোষ্ঠীকে ব্রহ্মাবর্ত থেকে উৎখাত করে সেখানে আর্য বসতি স্থাপন করেছেন, অচিরেই ব্রহ্মাবর্তের মানব এবং আমরা এর সুফল ভোগ করতে পারব। দুঃসবাদ এই যে এই বানরগোষ্ঠীকে উৎখাত করতে গিয়ে তিনি আহত হয়েছিলেন, তাঁর বাম কাঁধে তীর বিদ্ধ হয়েছিল। বৈদ্য’র সুচিকিৎসায় তাঁর ক্ষত প্রায় সেরে উঠেছে।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি নৃপতি বেণকে জানিয়েছি যে দেবপতি চান না ব্রহ্মাবর্তে পবিত্র সরস্বতীর তীরে কোনো অনার্য বসতি থাকুক, উপরন্তু দেবপতির ইচ্ছা যে ব্রহ্মাবর্ত আরো নিচের দিকে বিস্তৃত হোক। তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে কাঁধের ক্ষত সেরে গেলে সবকিছু একটু গুছিয়ে উঠার পর পুনরায় তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে অনার্য জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন, অনার্য জাতিকে উৎখাত করে ব্রহ্মাবর্তের পরিধি বাড়াবেন। অনেকগুলো আর্য গোত্রের তরুণদের একত্রিত করে প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলছেন, যুদ্ধের জন্য সৈন্যদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত করছেন। তাঁর অন্তরে অনার্যদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা রয়েছে, তাঁর অক্ষিযুগলে অনার্যদের দগ্ধ করবার অগ্নি দেখতে পেয়েছি আমি! একদিকে তিনি যেমন বীর যোদ্ধা, অন্যদিকে শাস্ত্রের প্রতি তাঁর রয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা; এ দুয়ের মেলবন্ধনে অনাগতকালে তিনি আরো উত্তম শাসকরূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। পুরোহিতদের পরামর্শে তিনি যজ্ঞ করেন অগ্নিদেব এবং আপনাকে উৎসর্গ করে, ব্রাহ্মণ ও ঋষিদেরকে যথেষ্ঠ দান করেন। তাঁর সাম্রাজ্যে কেউ অভুক্ত থেকে শয্যায় যায় না। এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে তিনি নৃপতি হয়েছিলেন, আর্য গোত্রগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস বাড়ছিল, ক্ষুদ্র কারণে রক্ত ঝরছিল, এমনকি গোত্রগুলির অভ্যন্তরেও অন্তর্কোন্দল বাড়ছিল। নৃপতি হবার দেড় বৎসরের মধ্যে বেণ সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনে শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- পবিত্র সরস্বতী নদীর পারে তিনি একদিন মহান কীর্তি স্থাপন করবেন, চারণ কবিগণ তাঁর স্তুতিগাঁথা রচনা করবেন, গায়কবৃন্ধ তাঁকে নিয়ে গীত গাইবেন, আর যতদিন ধরণীতে মানুষ থাকবে ততদিন মানুষের মুখে মুখে তাঁর নাম উচ্চারিত হবে ধরণীর প্রথম নৃপতি হিসেবে।’
এই পর্যন্ত বলে থামেন কল্পক, তার কথা শুনে দেবপতি ইন্দ্রের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সভায় উপস্থিত অন্যান্য দেবগণের মুখেও ফুটে ওঠে সন্তুষ্টির আভা।
দীর্ঘদিন ব্রহ্মাবর্ত, অতল, বিতল ও পাতাল পরিভ্রমণ শেষে গতকাল স্বর্গে ফেরেন কল্পক, ভ্রমণ-ক্লান্তির কারণে গতকাল রাত্রি এবং আজ মধ্যাহ্ন অবধি বিশ্রাম নেবার পর স্নানাহার শেষে অপরাহ্ণে আসেন দেবপতি ইন্দ্রের সভায়। অলকানন্দা নদীর অদূরে ইন্দ্র যে গুহায় বাস করেন তার সামনের উন্মুক্ত স্থানই তার সভাস্থল, নাম- সুধর্ম। দেবপতি ইন্দ্র তার উপদেষ্টা এবং পদস্থ দেবগণকে নিয়ে সুধর্মে সভা এবং বিচারকার্য পরিচালনা করেন। তিনি উত্তরদিকে বসেন কাঠ ক্ষোদন করে তৈরি করা নীল গাইয়ের চামড়া বিছানো কেদারায়। আর তার সামনে ডানে এবং বামে দু-দিকে সারিবদ্ধভাবে বসেন উপদেষ্টা এবং পদস্থ দেবগণ।
কল্পকের দিকে তাকিয়ে হাস্যমুখে ইন্দ্র বলেন, ‘উত্তম, অতি উত্তম সংবাদ শুনালে হে কল্পক, আমি শুনে ভীষণ উচ্ছ্বসিত, আহ্লাদিত এবং আনন্দিত। আমি তো এমন নৃপতি-ই চেয়েছিলাম- যিনি আমার অনুগত থাকবেন, শাস্ত্রের কথা মান্য করবেন, ঋষি ও ব্রাহ্মণদের সেবা করবেন। আমি নৃপতি বেণের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি, আমার আশির্বাদ তাঁর ওপর বর্ষিত হোক।’
দেবপতি ইন্দ্রের অঙ্গে ভেড়ার লোমের কুঞ্চক, পরনে চামড়ার বাস, মাথায় নীলগাইয়ের চামড়ার উষ্ণীব, পায়ে চামড়ার পাদুকা। তিনি দীর্ঘকায়, স্থুলাঙ্গ, স্ফীত উদরের অধিকারী। মাথা ভরা লম্বা সোনালি কেশ। বাম গালে একটা ছোট্ট কাটা দাগ, দানবদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় অস্ত্রের আঘাত লেগেছিল। তার উপদেষ্টা এবং অন্যান্য দেবগণের কারো গায়ে মোটা চামড়ার নিবি, কারো গায়ে চামড়ার চাদর, অনেকের মাথায় উষ্ণীব, আবার অনেকেই উষ্ণীববিহীন। শরৎকাল হলেও স্বর্গে এখনো অনেক শীত, বারোমাসই স্বর্গের আবহাওয়া শীতল থাকে, আর শরৎকালের শেষ থেকে তুষার পড়তে শুরু করে, বসন্তকালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তুষারে ছেয়ে থাকে স্বর্গের ভূমি। তখন দেবতা এবং তাদের পালিত পশুদের খুব কষ্ট হয়, তবু দেবতারা স্বর্গ ত্যাগ করে ব্রহ্মাবর্তের দিকের অপেক্ষাকৃত কম শীতল কিংবা আরো নিচের দিকের উষ্ণ অঞ্চলে বসতি গড়েন না। অনেককাল আগে থেকেই বংশ পরম্পরায় তারা শীতল ভুমিতে বসবাস করে অভ্যস্ত। তাদের পিতৃভূমি ছিল আরো উত্তরে, আরো অধিক শীতলভূমিতে, সেই অঞ্চলে ক্রমশ জলের সংকট দেখা দেওয়ায় এবং তুষার ঝড় ও ভূমিকম্পে তুষার ধ্বসের ফলে বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়ায় তাদের পূর্ব-পুরুষগণ পিতৃভূমি ত্যাগ করে দক্ষিণ-পূর্বদিকে চলে আসেন। ক্রমশ গোত্র বড় হতে থাকে আর বড় গোত্র ভেঙে ছোট ছোট গোত্রে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পিতৃভূমি থেকে যাত্রা করা সেই আদি গোত্র ভাঙতে ভাঙতে এবং নানা জায়গায় বসতি গড়তে গড়তে শেষ অবধি দেবতাদের পূর্বপুরুষদের গোত্রটি প্রকৃতিক সৌন্ধর্যের লীলাভূমি বর্তমানের এই উপত্যকায় এসে থিতু হন এবং নাম রাখেন- স্বর্গ। কালের নিয়মে ক্রমশ এই গোত্রটিও অনেক বড় হয়ে যায়, গোত্র বড় হলেও অরণ্য কিংবা পশুচারণের তৃণভূমি তো আর বাড়ে না, ফলে প্রয়োজন হয় গোত্র ভেঙে কাউকে কাউকে অন্য কোথাও চলে যাবার। তাছাড়া গোত্র বড় হলে দ্বন্দ্ব-সংঘাতও বেড়ে যায়, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, সম্পদ ও নারী নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ে। ফলে দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারণে অনেকে অনিচ্ছা থাকলেও ছোট ছোট গোত্রে ভাগ হয়ে অন্যত্র চলে যায়, কেউবা যায় স্বেচ্ছায় ভাগ্যান্বেষণে। আজকের ব্রহ্মাবর্তের মানবরাও যেমনি দেবতাদের স্বজন, তেমনি ঘোর শত্রুতে পরিণত হওয়া অতল-বিতল-সুতলের দৈত্য-দানবরাও দেবতাদের স্বজন। সকলেরই পিতৃভূমি একই ছিল, একদা সকলেরই পূর্বপুরুষ আজকের এই স্বর্গভূমিতে বাস করত।
এই যে দেবতারা স্বর্গ অধিকার করে আছে, এটাই কিন্তু শেষ কথা নয়। দৈত্য-দানবরাও দেবতাদের ওপর আক্রমণ করে স্বর্গ দখল করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় আছে, সুযোগ পেলেই তারা আক্রমণ করবে। এই যুদ্ধের শেষ কোথায় কে জানে! কেননা দু-পক্ষই স্বর্গভূমি নিজেদের অধিকারে রাখতে চায় অপর পক্ষকে বিতাড়িত করে। ফলে দু-পক্ষই দূর-দূরান্তে থাকা তাদের অনুসারী আর্যদের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে, যাতে যুদ্ধ বাঁধলে জনবল এবং অস্ত্রের সাহায্য পাওয়া যায়।
আজকের দেবতারা কখনো তাদের আদি পিতৃভূমিতে যায়নি, কেবল বংশ পরম্পরায় গল্প শুনেছে। তবু পিতৃভূমিকে তারা পবিত্র স্থান মনে করে, পিতৃভূমির নাম শুনলে ভালোবাসায়-শ্রদ্ধায় তাদের মাথা নত হয়ে আসে।
ব্রহ্মাবর্তের আর্যরাও দেবতাদেরকে তাদের পূর্ব-পুরুষ এবং স্বর্গকে তাদের পবিত্র পিতৃভূমি মনে করে শ্রদ্ধা করে, স্বর্গের নৃপতি ইন্দ্রকে তারা মান্য করে। কেবল বৃহ্মাবর্তই নয়, পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়া আরো অনেক আর্য গোত্রই ইন্দ্রকে মান্য করে। অন্যদিকে পশ্চিমদিকে কিছু আর্য গোত্র আছে, যারা দৈত্য-দানবদের অনুসারী।
ইন্দ্র সভাসদদের উদ্দেশে বলেন, ‘তাহলে ব্রহ্মাবর্তে নৃপতির পদ সৃষ্টি এবং নৃপতি নির্বাচনের ব্যাপারে আমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, কী বলেন আপনারা?’
প্রথমে ডানদিকে, তারপর বামদিকের সারির সভাসদদের দিকে তাকান ইন্দ্র। বায়ু বলেন, ‘নিশ্চয়, আপনার সিদ্ধান্ত যথার্থ দেবপতি।’
বরুণদেব বলেন, ‘দেবপতি, ব্রহ্মাবর্তের মানবদের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, আপনি তখন এই সিদ্ধান্ত না নিলে আমাদের বিরুদ্ধাচারী দৈত্য আর দানবরা ব্রহ্মাবর্তের মানবদের একটা বড় অংশকে নিজেদের পক্ষে টেনে নিতে পারত। তাহলে হয়ত তারা আজ আপনার নামে যজ্ঞ উৎসর্গ না করে দৈত্য কিংবা দানবপতির নামে উৎসর্গ করত। এমনিতেই ব্রহ্মাবর্তের কিছু কিছু মানব শাস্ত্র ও যজ্ঞবিরোধী।’
দেবপতি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘আপনার ধারনার সঙ্গে আমি একমত। উত্তর-পশ্চিমের কিছু কিছু আর্য গোত্রের ওপর দৈত্য আর দানবদের প্রভাব রয়েছে, ব্রহ্মাবর্তেও যে তাদের দু-চারজন অনুসারী নেই তা বলা যায় না। ব্রহ্মাবর্তে এমন কিছু মানবও আছে যারা আমাদের এবং দৈত্য-দানব উভয়েরই প্রভাবমুক্ত, কিন্তু তারা দৈত্য-দানবদের মতোই শাস্ত্র ও যজ্ঞবিরোধী; এরা দৈত্য-দানবদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওদের পক্ষে চলে গেলে তা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর হোত না, ব্রহ্মাবর্ত শাসন করা কঠিন হয়ে পড়ত, এমনকি ব্রহ্মাবর্ত হাতছাড়া হয়ে যাবার সম্ভাবনাও ছিল। আমাদের বিরুদ্ধাচারী গোষ্ঠীর অভাব নেই; অতল, বিতল, সুতল, পাতাল সর্বত্রই আর্য এবং অনার্য উভয় জাতির মধ্যেই আমাদের বিরুদ্ধাচারী রয়েছে। ফলে একদিকে আমাদেরকে যেমনি সতর্ক থাকতে হবে, আরো শক্তি অর্জন করতে হবে, অন্যদিকে কূটনৈতিকভাবেও তৎপর থাকতে হবে, দূর-দূরান্তের আর্য গোত্রগুলোকে প্রভাবিত করতে হবে। আমাদের বিরুদ্ধাচারী অনার্য এবং দৈত্য-দানবদের শক্তি সম্বন্ধেও জ্ঞাত হতে হবে। দৈত্য-দানবরা আমাদেরকে স্বর্গচ্যূত করতে সর্বদা সুযোগের অপেক্ষায় আছে।’
কল্পক সামনে-পিছনে ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘আপনি একদম সঠিক বলেছেন দেবপতি। দৈত্য-দানবরা মুখিয়ে আছে আমাদেরকে উৎখাত করে স্বর্গভূমি দখল করবার জন্য, ফলে ওদের শক্তির উৎসসমূহ সম্পর্কে আমাদেরকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।’
ইন্দ্র বলেন, ‘কল্পক, তুমি ব্রহ্মাবর্তের অন্যান্য মানব গোত্রগুলো সম্পর্কে নতুন কী তথ্য জানতে পেরেছ বলো। ঋষি এবং ব্রাহ্মণগণ যাগ-যজ্ঞের প্রচারণা ঠিক মতো করছেন তো?’
‘হ্যাঁ দেবপতি, ঋষি এবং ব্রাহ্মণগণ যাগ-যজ্ঞের প্রচারণা যথাসম্ভব করছেন। গোত্রগুলোর অধিকাংশ মানুষই ধর্মের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, তারা যথানিয়মে যাগ-যজ্ঞ করে। তবে….।’
‘তবে কী কল্পক?’ ইন্দ্রের কপালে ভাঁজ পড়ে।
সবাই কৌতুহলী চোখে কল্পকের দিকে তাকান, কল্পক বলেন, ‘আপনি অবগত আছেন যে মানবদের প্রত্যেক গোত্রেই কিছু কিছু মানুষ আছে যারা অগ্নি পূজারী নয়, শাস্ত্র এবং যজ্ঞবিরোধী। কিন্তু এরা বিশ্বাস করে আদি পিতা ব্রহ্মা আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন। ঋষি এবং ব্রাহ্মণগণ সর্বদাই চেষ্টা করেন এদেরকে ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনতে, মাঝে মাঝে সফলও হন। তবে এদের বাইরেও একটা শ্রেণির খুব দ্রুত উত্থান ঘটছে, যারা নাস্তিক, পরমপুরুষ ব্রহ্মায় বিশ্বাসী নয় এবং ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তো নয়-ই। তারা মনে করে যাগ-যজ্ঞ করলে কোনো ফল পাওয়া যায় না, মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গলে আপনার কিংবা অন্য দেবগণের কোনো ভূমিকা নেই! তারা পুরোহিত এবং ব্রাহ্মণদের দান করে না, তারা বিশ্বাস করে ব্রাহ্মণদের দান করলে কোনো পূণ্য হয় না, কেবল অসহায় ব্যক্তিদেরকেই দান করা উচিত আর প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির কর্ম করে খাওয়া উচিত। তারা মনে করে পরমপিতা ব্রহ্মা এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেননি, ব্রহ্মাণ্ড আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়েছে, প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে চলছে! দিন-রাতের পরিবর্তন, ঝড়-বৃষ্টি, হড়পা বান, তুষারপাত, ভূমিকম্প প্রভৃতিতে নাকি কারো কোনো হাত নেই!’
‘কী ভয়ংকর কথা, নাস্তিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে!’ বিস্ময় প্রকাশ করেন ইন্দ্র, অন্য দেবতারাও অবাক হন।
কল্পক আবার বলেন, ‘তার চেয়েও ভয়ংকর হলো এই নাস্তিকেরা তাদের দর্শন মানুষের মাঝে প্রচার করে বেড়ায়, কিছু কিছু মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করে। কিছু মানুষ যজ্ঞের তাৎক্ষনিক ফল চায়, তারা হয়ত কারীরী ইষ্টি যজ্ঞ করে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি চায়। বৃষ্টি না হলে এই নাস্তিকেরা মানুষের মনে যজ্ঞ সম্বন্ধে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়। তখন কিছু মানুষ নাস্তিক দর্শন বিশ্বাস করতে শুরু করে।’
ক্রোধে রক্তিমবর্ণ ধারণ করে ইন্দ্রের মুখমণ্ডল, ‘এই মূর্খ নাস্তিকেরা জানে না যে যজ্ঞে অনেক সময় ত্রুটি হয়, যিনি বা যারা যজ্ঞ উৎসর্গ করেন তাদের কোনো পাপ বা ত্রুটির ফলে অনেক সময় যজ্ঞের ফল পাওয়া যায় না, আবার কখনো কখনো পুরোহিত বা ঋত্ত্বিকদের ভুলেও যজ্ঞের ফল প্রাপ্তি থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়।’
‘দেবপতি, কিছু ঋষিও বিপথে চলে যাচ্ছেন। তারা শাস্ত্রের কিছু কিছু বিধিবিধান এবং প্রচলিত রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। শাস্ত্রের বিধান ত্যাগ করে তারা তাদের নিজস্ব দর্শন মেনে জীবনযাপন করছেন। তাদের এই নিজস্ব বিধান তারা মানুষের মধ্যে ছড়িয়েও দিচ্ছেন।’
‘না, না, যা শুনছি, তা মোটেও শ্রুতি সুখকর কিছু নয়। ব্রহ্মাবর্তের মানবদের নিজেদের মধ্যেই যদি বিভেদ সৃষ্টি হয়, তারা নিজেদের শাস্ত্রকেই যদি অমান্য করে, তাহলে তারা অনার্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে কিভাবে! আমি বার্তা পাঠাব নৃপতিকে, যাতে গোত্রপতিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি এইসব বিপথগামী ধর্ম ও শাস্ত্রের বিরুদ্ধাচারী নাস্তিকদের কঠোর হাতে দমন করেন। এদেরকে দমন করতে না পারলে সমাজে শৃঙ্খলা থাকবে না, আমাদের এবং ব্রাহ্মণদেরকে কেউ মান্য করবে না। পাপ বেড়ে যাবে। আর পবিত্র সরস্বতীর তীরে আর্য শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন কেবল অন্তরেই থেকে যাবে, বাস্তব রূপ পাবে না কোনোদিন। কল্পক, আপনি অনার্যদের কথা বলুন।’
ইন্দ্র বিচলিত বোধ করেন, যা কেবল তার মুখমণ্ডলে নয়, কণ্ঠেও ধরা পড়ে। একফালি শুভ্র মেঘ পূর্বদিক থেকে ভেসে এসে দেবতাদের ছুঁয়ে পশ্চিমের দিকে চলে যায় বাতাসে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে হতে।
কল্পক বলেন, ‘দেবপতি, ব্রহ্মাবর্তে এখনো যেসব অনার্য জাতি আছে, নৃপতি বেণ তাদের নিকট থেকে কর সংগ্রহ করেন, যার ভাগ আমরাও পাই। ব্রহ্মাবর্তের সীমান্তের বাইরে যে-সব অনার্য জাতি আছে, তাদেরকে উৎখাত না করে তাদের নিকট থেকে কর সংগ্রহ করা যায় কি না, সে ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চেয়েছেন নৃপতি বেণ। তিনি জানিয়েছেন যে- সকল অনার্য জাতিকে উৎখাত না করে কিছু জাতিকে রেখে দিয়ে তাদের নিকট থেকে কর সংগ্রহ করলে দেব এবং মানব উভয়েই লাভবান হবে।’
ইন্দ্র ভ্রু কুঁচকে বলেন, ‘প্রস্তাবটির ভালো-মন্দ উভয় দিক আমি ভেবে দেখবো। তুমি পাতাল সম্পর্কে বলো।’
‘পাতালে বলতে গেলে সবাই অনার্য, খুব নগন্য সংখ্যক আর্য আছে সেখানে। অনার্যদের মধ্যে অনেক জাতি আছে, যেমন- পণি, অজ, শিগ্রু, বানর, যক্ষ, দস্যু, রাক্ষস ইত্যাদি। এরা সকলেই কালো-কুৎসিত দর্শন। সব জাতিই দেখতে একই রকম নয়, কোনো কোনো জাতির মুখমণ্ডলের গড়ন এবং আকৃতি-প্রকৃতিতে প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। কোনো জাতির আকৃতি অতিশয় খর্ব, আবার কোনো জাতির আকৃতি মাঝারি। কোনো জাতির প্রকৃতি হয়ত লড়াকু, আবার কোনো জাতি অত্যন্ত উদাসীন। কোনো জাতি পরিশ্রমী, আবার কোনো জাতি ভীষণ অলস।’
‘তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কী-রূপ? যুদ্ধবিদ্যায় তারা কতটা দক্ষ?’
‘যুদ্ধবিদ্যায় তারা আমাদের ধারে-কাছেও নেই! অশ্বই নেই তাদের! কদাচিৎ কোথাও কোথাও দু-চারটি অশ্ব দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু তা খর্বকায় এবং দূর্বল! অশ্ব পালনের চেয়ে তারা গরু, মহিষ, ছাগল, শূকর পালন করতে পছন্দ করে; যা থেকে তারা মাংস ও দুগ্ধ পায়। যুদ্ধের প্রতি তারা অনাগ্রহী, জীবিকার প্রতি তারা অধিক মনোযোগী।’
ইন্দ্র এবং অন্য দেবতাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইন্দ্র বলেন, ‘অনার্যদের বসতি ও জীবিকা সম্পর্কে বলুন।’
‘পাতালের অনার্যদের বসতি দু-ধরনের; পল্লী ও নগরে তারা বাস করে, অনেকে নগরকে পুরও বলে থাকে। পল্লীগুলো অরণ্য এবং কৃষিভূমির পাশে; গৃহ মাটি, বাঁশ, কাঠ, খড় ইত্যাদির তৈরি। তাদের জীবিকার মাধ্যম বহুমুখী, নানা প্রকার কর্ম করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ ভূমি কর্ষণ করে ফসলের চাষ করে, কেউ পশু-পাখি শিকার করে, কেউ মৎস শিকার করে, কেউ মৃৎপাত্র ও শিল্প নির্মাণ করে, কেউ গৃহ নির্মাণ করে, কেউ সুতা তৈরি করে, কেউ কাপড় বোনে, কেউ পোশাক তৈরি ইত্যাদি। অপরদিকে অনার্যদের এক আশ্চর্য সৃষ্টি- নগর! সুউচ্চ প্রাচীরঘেরা নগরের প্রশস্ত সড়কের দু-পাশে একতলা, দো-তলা বাটী। নানারকম পণ্যের বিপণি। নগরের মানুষও কিছু কিছু সামগ্রী তৈরি করে; যেমন- কেউ তাম্র দিয়ে নানা প্রকার তৈজসপত্র, শিল্পকর্ম, অস্ত্র তৈরি করে; স্বর্ণ ও রৌপ্য দিয়ে গহনা তৈরি করে। কেউ পাথরের তৈজসপত্র ও শিল্পকর্ম নির্মাণ করে। স্বর্ণ-রৌপ্য’র গহনা এবং তাম্র ও পাথরের সামগ্রী সাধারণত নগরের অভিজাত লোকেরা ব্যবহার করে থাকে। পল্লীর লোকেরা ব্যবহার করে মৃত্তিকার সামগ্রী। নগরের লোকেরাও সুতা ও পোশাক তৈরি করতে পারে। পল্লীর লোকেরা তাদের প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত সামগ্রী নগরের হাটে বিক্রয় করে, আর তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করে। নগরগুলি বাণিজ্যকেন্দ্রিক, নগরের লোক নানা রকম পণ্যের বাণিজ্য করে, জলপথে তরণী নামক এক প্রকার বাহনে আরোহণ করে তারা দূর-দূরান্তের অন্যান্য নগরে যায় বাণিজ্য করতে। পল্লীর লোকদের চেয়ে নগরের লোক অধিক বুদ্ধিমান, অভিজাত, তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ অধিক পরিপাটী। পল্লীর লোকের চেয়ে নগরের লোক কম পরিশ্রমী।’
ইন্দ্র সময় নিয়ে বড় করে শ্বাস ছাড়েন, তারপর বলেন, ‘অনার্যদের এই আশ্চর্য নগরের কথা আমি আগেও শুনেছি। তবে তারা দ্বিতল বাটী নির্মাণ করতে পারে তা আমার অজ্ঞাত ছিল। আমি শুনেছিলাম তারা একতলা সুদৃশ্য বাড়ি নির্মাণ করতে পারে।’
‘সেটা হয়ত পূর্বের কথা, কিন্তু এখন ওরা গৃহনির্মাণ কলায় আরো উন্নতি লাভ করেছে। তবে সব নগরে দ্বিতল বাটী নেই। আমি অনেকগুলি নগরে গিয়েছি, সব নগরেই একতলা বাটী। কেবল একটি নগরেই দ্বিতল বাটী দেখেছি। এই নগরটি দেখতে আমাকে বহু পথ অতিক্রম করতে হয়েছে।’
‘গৃহ নির্মাণের প্রতি আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ কখনোই মনোযোগী ছিলেন না, ফলে আমরা গৃহনির্মাণ কলায় দক্ষতা অর্জন করতে পারিনি। সে-জন্যই তোমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে-কোনো প্রকারে হোক এক বা একাধিক সুদক্ষ গৃহ নির্মাতাকে স্বর্গে নিয়ে আসতে।’
‘দেবপতি, পাতালের নগরের ওইসব সুদৃশ্য গৃহ আমাদের এখানে নির্মাণ করা সম্ভব নয়। আমাদের এখানে গৃহ নির্মাণ করার জন্য বিতল-সুতলের কারিগর প্রয়োজন। কিন্তু আমি অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। ব্রহ্মাবর্ত, বিতল, সুতল কিংবা পাতাল সর্বস্থলের বানরজাতি গৃহনির্মাণ কলায় সবচেয়ে বেশি দক্ষ; তাদের নির্মিত নগর এবং গৃহ সবচেয়ে উন্নত। তাদের তরুণ-মধ্যবয়সীরা তো বটেই, এমনকি কিশোররাও চমৎকার গৃহ নির্মাণ করতে পারে। আমি বিতল এবং সুতলের অনেক তরুণ এবং মধ্যবয়সীকে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়েছি তাদেরকে স্বর্গে নিয়ে আসার জন্য; কিন্তু কেউ-ই সম্মত হয়নি। ওরা ওদের নিজের জাতি, ধর্ম এবং আচার-সংস্কৃতিকে খুব ভালোবাসে, সে-সব ত্যাগ করে আসতে চায় না।’
‘কী তাদের ধর্ম বিশ্বাস, কেমন তাদের আচার-সংস্কৃতি?’
‘বড় অদ্ভুত আর পাপাচারে ভরা অনার্যদের ধর্ম বিশ্বাস ও আচার-সংস্কৃতি। ওরা অনার্য শিবের মূর্তি বানিয়ে পূজা করে; যোগাসনে উপবিষ্ট শিবমূর্তির চারপাশে হস্তী, বাঘ, গণ্ডার, মহিষ আর অধোদেশে মৃগ। শিবমূর্তি ছাড়াও ওরা নানা প্রকার মাতৃকা মূর্তির পূজা করে। এর চেয়েও বড় লজ্জার কথা ওরা মৃত্তিকা অথবা পাথর দ্বারা পুরুষের শিশ্ন তৈরি করে পূজা করে!’
কল্পকের কথা শুনে বিস্ময়ে-ঘৃণায় সকল দেবতার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায়, অনেকে এমনভাবে নাক-মুখ কুঁচকায় যেন এখনই বমি করে দেবেন! তারা নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারে না, এ-ও কী সম্ভব? সকলেই ভাবেন- এত কুৎসিত, এত ঘৃণ্য অনার্যদের আচার-সংস্কৃতি!
একজন প্রবীণ দেব বলেন, ‘কী অনাসৃষ্টি, কী অনাচার!’
একজন যুবক বলেন, ‘দেবপতি, পবিত্র সরস্বতীর তীরে এই অনাচার সহ্য করা যায় না। দয়া করে আপনি ওদেরকে সংহারের ব্যবস্থা করুন।’
‘অধৈর্য হোয়ো না যুবক, আমার ওপর আস্থা রাখো। পবিত্র সরস্বতীর তীরে আমি কোনো অনাচার সহ্য করব না। কিন্তু এখন আমি ভাবছি, একজন বানর গৃহ নির্মাতাকে কী উপায়ে স্বর্গে আনা যায়!’
পড়ন্ত বিকেলের শেষ আলোটুকু ম্লান করে ঘন মেঘের বিশাল এক চাঙর এসে সভাস্থল মুড়ে ফেলে! দেবতারা এক-অন্যের মুখ ঝাঁপসা দেখতে পান, শীতও হঠাৎ বেড়ে যায়, দেবপতি ইন্দ্রের শরীরে চাগাড় দিয়ে ওঠে সোমের নেশা, তিনি সভার সমাপ্তি ঘোষণা করে গুহায় প্রবেশ করেন।
(চলবে.......)