somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- একত্রিশ)

১৮ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চব্বিশ

মানবদের কয়েকটি গোত্রের গোত্রপতি এবং তাদের অনুসারী কিছু মানুষ আগে থেকেই বেণের বিরুদ্ধে ছিল, গোপনে নানারকম চক্রান্ত করত, এখন তারা প্রকাশ্যে ব্রাহ্মণদের পক্ষে যোগ দিয়েছে। এমনকি বেণের নিজের গোত্রের কিছু মানুষও ব্রাহ্মণদের পক্ষ নিয়েছে, তারা মনে করছে- বেণ বাড়াবাড়ি করছেন, বেদ এবং মনুর বিধান অমান্য করলে ঈশ্বরের অভিশাপ লাগবে, দেবতাদের অভিশাপ লাগবে, রোগ-বালাই বেড়ে যাবে, মহামারী শুরু হবে,পঙ্গপাল ফসল ভক্ষণ করবে, ব্রহ্মাবর্তের মানবরা ধ্বংস হবে বেণের জন্য। আর তাদের এই ভাবনায় আরো উস্কানি দিচ্ছেন ঋষি এবং ব্রাহ্মণরা, তারা মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বেণবিরোধীরা প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারছেন না বা বেণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারছেন না। কেননা বেণের অনুসারীও কম নয়, মানবদের একটি অংশ তো বেণের পক্ষে আছেই, এছাড়াও রয়েছে সমস্ত নিষাদ-পণি-রাক্ষসরা, যারা বেণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত।

নৃপতি বেণের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা স্বর্গের দেবপতি ইন্দ্রের কানে পৌঁছতেই তিনি দেবর্ষি নারদকে পাঠান বেণের নিকট, একদিন অপরাহ্ণে নারদ বেণের বাটীতে পা রেখে মুখে হাস্যপুষ্প ফুটিয়ে বলেন, ‘নারায়ণ, নারায়ণ, ব্রহ্মাবর্তের মহামান্য নৃপতির কল্যাণ হোক।’

বেণ তখন বুনো লতা দিয়ে গরুর রজ্জু তৈরি করছিলেন, নারদের কথা শুনে মুখ তুলে তাকান। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আসুন আসুন দেবর্ষি।’

নারদের সঙ্গে পূর্বে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল তিনি যখন স্বর্গে গিয়েছিলেন দেবপতি ইন্দ্রের পুত্রের বিবাহ উৎসবে। সুস্বাস্থের অধিকারী নারদ দেখতে ভারী সুন্দর, শ্মশ্রু মুণ্ডিত চন্দনসজ্জিত মুখমণ্ডল, মাথার কেশ চূড়ো করে বেঁধে খোঁপায় শুভ্র পুষ্পমাল্য জড়ানো। পরনে বাসন্তী রঙের বাস, শরীর একই রঙের চাদরাবৃত, পায়ে খড়ম। দুই হাতের কব্জিতে রুদ্রাক্ষের মাল্য, কাঁধে বীণা। নারদ বলেন, ‘সকলকে নিয়ে কুশলে আছেন তো মহামান্য নৃপতি?’

বেণের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দূর্গম পার্বত্য পথ পাড়ি দিয়ে স্বর্গ থেকে নারদ কেন তাঁর কাছে এসেছেন। তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা কুশলেই আছি, আপনি ভালো আছেন তো?’

‘নারায়ণের কৃপায় আমি সর্বদাই ভালো থাকি, অন্যদেরও ভালো থাকার সুপরামর্শ দান করি।’
‘ব্রহ্মাবর্তে আপনাকে স্বাগত জানাই।’ বলেই বেণ উঠে গৃহের অভ্যন্তরে গিয়ে একখানা কৃষ্ণাজিন এনে পাথরের উপর রেখে বলেন, ‘উপবেশন করুন দেবর্ষি।’
‘ধন্যবাদ। সত্যিই আপনি মহৎ, নিরহংকার, নৃপতি হয়েও আপনি নিজহাতে আমাকে উপবেশনের আসন দান করলেন!’

বেণও বিনয়ে কম যান না, ‘আপনার মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমার আঙিনায় পা রেখেছেন, এ তো আমার পরম সৌভাগ্য! বলুন কী দিয়ে আপনাকে আপ্যায়ন করবো?’

‘আপনি ব্যস্ত হবেন না নৃপতি, আমাকে আপ্যায়ন করতে হবে না। পড়ন্ত বেলায় আমি কিছু আহার করি না, আমার অম্বলের অসুখ আছে কিনা! দয়া করে আপনি উপবেশন করুন নৃপতি, আপনার সঙ্গে আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে।’

বেণ আরেকটি পাথরের ওপর উপবেশন করে বলেন, ‘বলুন কী কথা?’
‘লোকমুখে এসব কী শুনছি নৃপতি, আপনি নাকি ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন? যজ্ঞ-পার্বণ সব নিষিদ্ধ করেছেন?’
‘আপনি যথার্থই শুনেছেন মহামান্য।’

নারদ ভ্রূ উঁচিয়ে জিভ কেটে হাত নেড়ে বলেন, ‘না, না, না, আপনি সজ্ঞানে এসব কথা বলতে পারেন তা আমার বিশ্বাস হয় না, নিশ্চয় কোনো অসৎ চরিত্রের মানুষ আপনাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে এসব কথা বলিয়েছে!’
‘আমি নাবালক নই দেবর্ষি, আমি যা বলেছি, তা নিজের বিশ্বাস থেকে, সজ্ঞানে বলেছি।’
‘তবু আমার সন্দেহ থেকেই যায় যে এসব আপনার কথা নয়।’
‘আপনার সন্দেহ করবার কোনো কারণ নেই।’

‘উদ্বেগের কারণ আছে বৈকি। আপনি জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ নৃপতি, সৎ বংশের সন্তান, আপনার পক্ষে দেবতাদের বিরুদ্ধতা এবং যজ্ঞ নিষিদ্ধ করা উচিত কার্য নয়। আর বেদ বিরোধীতা করা মানে স্বয়ং এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টাকে অস্বীকার করা।’
‘বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোনো স্রষ্টা আছেন বলেও আমি বিশ্বাস করি না।’
‘নারায়ণ, নারায়ণ, ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করুন। এমন কথা আর বলবেন না নৃপতি, এ যে মহাপাপ! আদি পিতা ব্রহ্মা স্বয়ং ঈশ্বর; তিনি আপনার, আমার, আমাদের সকলের পূর্বপুরুষ, তিনি ঊর্ধ্বলোকে আছেন, সব দেখছেন।’

‘আদি পিতা ব্রহ্মা দেব, মানব, দৈত্য ও দানবদের পূর্ব পুরুষ একথা সত্য; আমাদের পূর্বপুরুষ হিসেবে আমি তাঁকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু তিনিই ঈশ্বর বা তিনিই এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন একথা আমি বিশ্বাস করি না। বিভিন্ন কালের শাস্ত্রকারগণ তাঁকেই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা আখ্যা দিয়ে তাঁর নামে শাস্ত্র এবং লোকগাঁথা সৃষ্টি করেছেন, এসব শাস্ত্র ও লোকগাঁথা সর্বাংশে সত্য নয়।’

নারদ তাঁর দুই কানে হাত দিয়ে জিভ কেটে বলেন, ‘তিনি সর্বজ্ঞ, সব দেখছেন, সব শুনছেন, এমন পাপের কথা বলবেন না দয়া করে।’

‘এত বৃহৎ এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা ঊর্ধ্বলোকে উপবেশন করে আমার মতো ক্ষুদ্র দেহের সামান্য একজন মানুষকে দেখতে পান, আমার কথা শুনতে পান, অথচ যখন অরণ্যে দাবানল শুরু হয়, তখন তিনি সেই বিশাল অগ্নি দেখতে পান না, নিরীহ পশুপাখিদের আর্তনাদ শুনতে পান না! বিষয়টি আশ্চর্যজনক বৈকি!’
‘আপনার ধারণা ভুল নৃপতি, তিনি দাবানল দেখতে পান, পশুপাখিদের আর্তনাদও শুনতে পান।’
‘তাহলে তিনি দ্রুত অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা করেন না কেন? তাহলেই তো পশুপাখিদের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয় না, আশ্রয়হীন হতে হয় না। তাছাড়া তিনি যদি সবই জানবেন, তাহলে অরণ্যে অগ্নি শুরু হবার আগেই তো তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।’
‘ঈশ্বর জীবকে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ফেলে পরীক্ষা নেন, এ তার এক ধরনের ক্রীড়া।’

‘এ কেমন নিষ্ঠুর ক্রীড়া ঈশ্বরের! জীবের কাছে যা জীবন-মৃত্যুর লড়াই, ঈশ্বরের কাছে তা ক্রীড়া মাত্র! জীবের দুঃখ-কষ্ট, মৃত্যু নিয়ে তিনি যদি ক্রীড়াই করে থাকেন তবে আপনারা কেন তাকে পরম দয়ালু বলেন? তিনি তো নিষ্ঠুর, ভয়ানক পাষণ্ড!’
‘নৃপতি, আপনি ঈশ্বরের নামে যে-সব শব্দ প্রয়োগ করছেন তা নিন্দ্যনীয়, নিজেকে অপরাধী করবেন না।’

‘আমি তো মিথ্যে কিছু বলছি না দেবর্ষি। ঈশ্বর যদি দয়ালু হবেন তাহলে জীবকে রোগ-ব্যধিতে কেন কষ্ট দেন তিনি? কেন মহামারীতে অকালমৃত্যু হয় অসংখ্য মানুষের? তিনিই যদি জীবকে সৃষ্টি করবেন, তাহলে তারই সৃষ্ট জীবকে তিনি কেন কষ্ট দেবেন? মহামান্য নারদ, আপনি কি পারবেন আপনার সন্তানকে স্বেচ্ছায় কষ্ট দিতে, স্বেচ্ছায় তার প্রাণ হরণ করতে? আদি পিতা ব্রহ্মা ছিলেন, তার মৃত্যু হয়েছে, তার নশ্বর দেহ ভস্ম হয়ে লীন হয়ে গেছে অলকানন্দার জলে। এখন আর তিনি কোনো ঊর্ধ্বলোকে উপবেশন করে স্বর্গ, ব্রহ্মাবর্ত বা সপ্তপাতালের জীবদের নিয়ে ক্রীড়া করছেন না। ওসব তার নামে প্রচলিত লোকগাঁথা। বস্তুত, ঈশ্বর বলে কেউ নেই, আদিপিতা ব্রহ্মাও এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেননি, এই ব্রহ্মাণ্ড আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়েছে, আপন নিয়মেই চলছে।’

‘আপনি ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি, আপনি যদি ধর্ম থেকে দূরে সরে যান, তাহলে আপনার কারণে ঈশ্বরের অভিশাপে ব্রহ্মাবর্তের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে।’

‘ধর্মের আশ্রয়ে থেকেও অতীতে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, এখনো কম-বেশি পোহাতে হয়। ধর্ম পালন করে, শত শত যজ্ঞ করেও মহাপ্লাবনের মতো দুর্ভোগ মানুষকে পোহাতে হয়েছে। ঈশ্বর মহাপ্লাবন থেকে মানুষ এবং নিরীহ পশুপাখিকে কেন রক্ষা করলেন না? আমার মতে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই, তাই অভিশাপের ভয় আমি পাই না। আর নৃপতির ধর্ম হওয়া উচিত বহিঃশত্রুর হাত থেকে তার প্রজাদেরকে রক্ষা করা, সবল যেন দূর্বলকে আঘাত করতে না পারে সে-দিকে দৃষ্টি রাখা, অন্যায়কারীকে দণ্ড দিয়ে সুশাসন বজায় রাখা। স্বাধীনতা ঘোষণার আগের দিন পর্যন্ত আমি সেই ধর্ম যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি, বারবার ব্রাহ্মণদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছি, কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকে আমি সেই ধর্ম যথাযথভাবে পালন করছি মহামান্য নারদ।’

‘স্বাধীনতা ঘোষণার দিনই আপনি প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে কতিপয় ব্রাহ্মণ যুবককে অযথাই দণ্ড দিয়েছেন।’

‘প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে নয়, আমি তাদেরকে তাদের অপরাধের জন্য দণ্ড দিয়েছি। ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি হয়ে আমি ঘোষককে পাঠিয়েছিলাম স্বাধীনতার ঘোষণার কথা মানুষকে জানাতে, ব্রাহ্মণ যুবকেরা ঘোষকের কাজে বাধার সৃষ্টি করে তাকে প্রহার করেছে। সে-জন্যই আমি তাদেরকে দণ্ড দিয়েছি।’

‘ব্রাহ্মণ যুবকদের দণ্ড দিয়ে মহা অন্যায় করেছেন আপনি।’

‘অন্যায় নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে আমি নৃপতির ধর্ম পালন করেছি মাত্র। আর এখন থেকে এই ধর্মই পালন করব। অন্যায়কারী ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় কিংবা আর্য-অনার্য যে-ই হোক না কেন; তাকে দণ্ড ভোগ করতেই হবে।’

নারদ হঠাৎ হাততালি দিয়ে বলেন, ‘সাধু, সাধু! সত্যিই আপনি মহান, অসাধারণ, অনন্য নৃপতি! আমি ধন্য আপনার মতো দৃঢ় চিত্ত, প্রজাবৎসল এবং ন্যায় পরায়ণ নৃপতির সঙ্গলাভ করে। আমি আপনাকে এতক্ষণ পরীক্ষা করছিলাম মাত্র। আপনি যে ধর্মের কথা বলছেন তা নিসন্দেহে প্রশংসনীয়, অত্যন্ত মানবিক আপনার ধর্ম। তবে আমার একটি অনুরোধ আপনি রাখবেন আশা করি, দয়া করে স্বর্গের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবেন না, তাহলে দেবগণ ভীষণ কষ্ট পাবেন। আপনার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের আশঙ্কায় দেবপতি ইন্দ্র ভীষণ কেঁদেছেন আমার হাত ধরে! আমি তাকে বলেছি- “আপনি ভেঙে পড়বেন না দেবপতি, আমি নৃপতি বেণকে ভালো মতোই চিনি, তিনি আপনার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করবেন না।” তিনি আমার কথায় আস্বস্ত হয়ে বলেন- “নৃপতি বেণ যেভাবে খুশি সেভাবেই ব্রহ্মাবর্ত শাসন করবেন, শুধু স্বর্গের সঙ্গে সম্পর্কটি যেন ছিন্ন না করেন। আপনি ব্রহ্মাবর্তে যান নারদ, একটিবার তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে স্বর্গে নিয়ে আসুন, আমরা আলোচনা করি, আলোচনার মাধ্যমেই সবকিছুর সমাধান করব আমরা।” আমি দেবপতিকে কথা দিয়েছি যে আপনাকে সঙ্গে করে তবেই স্বর্গে ফিরব। আপনি আমার সঙ্গে স্বর্গে চলুন নৃপতি, দু-চারটা দিন স্বর্গের মনোরম আবহাওয়ায় সুন্দরী অপ্সরাদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেবপতির সঙ্গে আপনার চমৎকার অনুশাসননীতি নিয়ে আলোচনা করে তারপর ব্রহ্মাবর্তে ফিরবেন। তাছাড়া বায়ুবদলে মন হালকা হয়, স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। আমরা তাহলে আগামীকাল প্রত্যুষেই স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি, কেমন?’

বেণ মৃদু হাসেন নারদের চোখের দিকে তাকিয়ে, অকস্যাৎ নারদের কথার ধরণ পরিবর্তন করে তাঁর প্রশংসা এবং তাঁকে স্বর্গে আমন্ত্রণের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবেন। তিনি বুঝতে পারেন যে নারদ দেবপতি ইন্দ্রের সঙ্গে ছক কষেই ব্রহ্মাবর্তে এসেছেন, অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা এবং নিজের স্বতন্ত্র অনুশাসনের পথ থেকে টলাতে ব্যর্থ হয়েই নারদ দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করছেন। অর্থাৎ তাঁর অনুশাসনের প্রশংসা করে, তাঁকে পরীক্ষা করার কথা বলে স্বর্গে যাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি ভীষণ ব্যস্ত দেবর্ষি। সঙ্গত কারণেই আমি স্বর্গে যেতে অপারগ। দেবপতির যদি আমার সঙ্গে কোনো আলোচনা করার ইচ্ছা থাকে, তবে তাঁকে ব্রহ্মাবর্তে আসার আমন্ত্রণ রইলো।’

‘স্বর্গ আপনার পূর্ব-পুরুষের বসতি, আর সেখানকার অধিশ্বর ইন্দ্র, তার প্রতি সম্মান জানিয়ে তার আমন্ত্রণ আপনার অগ্রাহ্য করা অনুচিত।’
‘সে-জন্য আমি দুঃখিত।’
‘দেবপতি অত্যন্ত অতিথি বৎসল, তিনি অতিথি আপ্যায়ন করতে ভীষণ ভালোবাসেন।’
‘সে আমি জানি। দেবপতিকে বলবেন- ব্রহ্মাবর্তের মানবদের পক্ষ থেকে আমি তাকে এখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এও বলবেন- তিনি আমাকে যেভাবে আমন্ত্রণ জানাতেন আমি তাকে সে-ভাবে আমন্ত্রণ জানাতে হয়ত পারব না, তবে তার আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি হবে না।’

নারদ সুচতুর দেবর্ষি, তিনি বুঝতে পারেন যে নৃপতি বেণ কোনোভাবেই দেবপতি ইন্দ্রের আমন্ত্রণে স্বর্গে যাবেন না। তাকে ব্যর্থ হয়েই স্বর্গে ফিরতে হবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই তিনি বলেন, ‘আপনি দেবপতির আমন্ত্রণ রক্ষা না করলে তিনি মনোক্ষুন্ন হবেন।’

বেণ মৃদু হেসে বলেন, ‘দেবপতি মনোক্ষুন্ন হলেও ব্রহ্মাবর্তে সূর্য উঠতে বিলম্ব হবে না, যথাকালে বৃষ্টি হবে, শস্যক্ষেত্রেও সময় মতো ফসল ফলবে!’

‘আপনি দেবপতিকে নিয়ে কৌতুক করছেন, ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন!’
‘অন্তরালে দেবপতিকে নিয়ে এর চেয়ে ঢের কৌতুক স্বয়ং দেবগণই করে থাকেন, বোধকরি আপনিও!’

নারদ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে বেণ আবার বলেন, ‘সে কী, আপনি উঠে পড়লেন যে! আমার উপর যতই রাগ করুন এই গোধুলিবেলায় আপনি স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারবেন না। পথে বিপদ হতে পারে।’

নারদ বলেন, ‘আপনি হয়ত ভাবছেন স্বর্গের আনুগত্য প্রত্যাখান করে বেদ, যজ্ঞ, মনুর বিধান নিষিদ্ধ করে আপনার ভবিষ্যৎ সুখের হবে; কিন্তু তেমনটা নাও হতে পারে। এখনো সময় আছে, আপনি ভেবে দেখুন।’

‘আমি যা করি ভেবেচিন্তেই করি দেবর্ষি। আপনি এই অবেলায় যাবেন না, দয়া করে উপবেশন করুন।’

‘উপবেশনের আর কোনো প্রয়োজন নেই। রাত্রিটা আমি মান্যবর মনুর গৃহে কাটিয়ে কাল প্রত্যুষেই স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব। রাত্রের মধ্যে যদি আপনার মত পরিবর্তন হয় মান্যবর মনুর গৃহে চলে আসবেন।’

‘আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমার মতের আর কোনো পরিবর্তন হবে না। অহেতুক প্রত্যাশা করবেন না। আপনার কল্যাণ হোক।’

আর কোনো কথা না বলে বাটীর বাহিরের দিকে পা বাড়ান নারদ, তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন বেণ। বেণ বুঝতে পারেন যে নারদের এই ছক আর কিছু নয়, তাকে হত্যার ছক। একবার তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যেতে পারলেই নারদের কাজ শেষ, তখন দেবপতি ইন্দ্র তাঁকে হত্যা করে অলকানন্দার জলে ভাসিয়ে দেবেন! অথচ তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় নারদের চোখ দুটি কী শান্ত, মুখে কী প্রশান্তির আভা খেলা করছিল, দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে ওই শান্ত-কোমল চোখ-মুখের অন্তরালে আছে তাঁর মৃত্যুর নিমন্ত্রণ!


(চলবে......)

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:২৬
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×