somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- বত্রিশ)

১৯ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পঁচিশ

দুজন নতুন মানুষের আগমনে বাটী পূর্বের চেয়ে অধিক কোলাহলপূর্ণ হবার পরিবর্তে আরো অধিক শান্ত হয়ে ওঠে অঙ্গ নিরুদ্দেশ হওয়ায়। অঙ্গ কোথায় আছেন তা কেউ জানে না, বাটীর কাউকে কিছু বলেও যাননি। এক রাত্রে তিনি বাটীতে না ফেরায় পরদিন প্রভাতে যখন খোঁজাখুঁজি শুরু হয় তখন মনু অঙ্গকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘তোমার পিতাশ্রী তোমার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে চিরদিনের জন্য গৃহ ত্যাগ করে নির্বাসনে চলে গেছেন। তুমি ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করায় তিনি মনোপীড়ায় ভুগছিলেন, আর অনার্য দাসীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে গৃহে তোলার পর তিনি তোমার আর তোমার ওই অনার্য স্ত্রীর সঙ্গে একই বাটীতে বাস করতে চাননি। তিনি আমায় অনুরোধ করেছেন তোমাকে জানাতে যে বৃথা যেন তার সন্ধান করা না হয়, কেননা অধর্মের সাম্রাজ্যে তিনি কিছুতেই ফিরবেন না। বাকি জীবন সন্ন্যাস-ধর্ম পালন করে কোনো আশ্রমে অতিবাহিত করবেন। আমার বয়স একটু কম হলে আর মনের জোর থাকলে আমিও তোমার পিতাশ্রীর মতোই এই পাপসংকুল ব্রহ্মাবর্ত থেকে দূরে চলে যেতাম!’

এই সংবাদ শোনার পর থেকে যেন এক আশ্চর্য নৈঃশব্দের মেঘ আচ্ছন্ন করে নৃপতি বেণের গৃহ, সে-মেঘ কাটেনা কিছুতেই। কেশিনী আর মতঙ্গকে গৃহে এনে পরিচয় উন্মোচন করার পর থেকে হংসপাদার আচার-ব্যবহারেও যেন তুষারের শীতলতা বিরাজ করছে! হংসপাদা রন্ধন করেন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করেন, সংসারের কাজকর্ম আগের মতোই করেন; কিন্তু বেণের সঙ্গে কথা বলেন না খুব প্রয়োজন ছাড়া। পৃথু আর অর্চিকে নিয়ে রাত্রে শয়ন করেন শাশুড়ির সঙ্গে। তার অহমে বড্ড আঘাত লেগেছে। তিনি সমগ্র ব্রহ্মাবর্তের নৃপতির মহিষী, ব্রহ্মাবর্তের সবচেয়ে সম্মানিত নারী। এতদিন নিজেকে তিনি যেমনি সৌভাগ্যবতী মনে করতেন, তেমনি স্বামী-সংসার নিয়ে গর্বও করতেন এজন্য যে তার কোনো সতীন ছিল না। তার সেই গর্ব পাহাড়চূড়ায় জমা তুষারের মতো ভেঙে পড়েছে! আজ তার গৃহে সতীন, তাও কোনো আর্য নারী নয়, যে কিনা একদিন তারই গৃহে দাসী ছিল, তারই আদেশ পালন করত, সেই দাসী আজ তার সতীন, একদা দাসী আজ তার সমতুল্য! এই ঘটনাকে মাঝে মাঝে তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়, রাত্রে শুয়ে শুয়ে মনে হয় যেন তিনি দীর্ঘ সময় যাবৎ দুঃস্বপ্নের ঘোরে আছেন! কিন্তু প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গের পর আঙিনায় বের হয়ে কেশিনীর মুখ দেখলেই তিনি বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন, এই বাস্তবতা তার কাছে তীব্র অভিঘাতের মতো, ভীষণ অপমানের, কান্নার, ক্ষোভেরও!

হংসপাদার আরো বড় বেদনার কারণ- পৃথু তার একমাত্র পুত্র, এতদিন সে ছিল ব্রহ্মাবর্তের ভবিষ্যৎ নৃপতি হবার একমাত্র উত্তরাধিকারী, অথচ আজ সে তার স্থান হারিয়েছে এক অনার্য নারীর গর্ভজাত সন্তানের কাছে, নৃপতির জ্যেষ্ঠ্যপুত্র হিসেবে ভবিষ্যতে ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি হবে ওই শ্যামবর্ণ মতঙ্গ! মাতা হিসেবে এ যে কী বেদনার বিষয়, তা কেবল তিনিই বোঝেন।

অন্যদিকে কেশিনী পড়েছেন এক মহা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে, সতীন তার সঙ্গে কথা বলতে চান না, শাশুড়ি তার মুখও দর্শন করেন না। একদিন তিনি এই গৃহে দাসী ছিলেন, আজ নৃপতির মহিষী, কিন্তু কোনো দম্ভ নেই তার, একদিন দাসী হিসেবে এই গৃহে যেভাবে ছিলেন এখনও সেভাবে থাকতে পারলেই তিনি খুশি। বেণের পাশের কক্ষে পুত্র মতঙ্গকে নিয়ে শয়ন করেন তিনি, গভীর রাত্রি অব্দি তার চোখে ঘুম আসে না। মাঝে মাঝে নীরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দেন আনন্দে, আবার কষ্টেও। আনন্দ এজন্য যে তিনি একজন নিগৃহীত-অবহেলিত অনার্য কৃষ্ণবর্ণ নারী, নানা অপ্রাপ্তি আর আঘাতে পরিপূর্ণ তার জীবন, অথচ ভাগ্যের খেলায় আজ তিনি ব্রহ্মাবর্তের নৃপতির মহিষী, যা এখনো তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়! আর কষ্ট হয় এজন্য যে তার এমন সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত হবার কারণেই শ্বশুর নিরুদ্দেশ হয়েছেন, শাশুড়ি-সতীনের স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। যদিও শাশুড়ি-সতীনের মন পেতে তিনি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেন না। খুব প্রভাতে শয্যা ত্যাগ করে সারা আঙিনা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেন, ভৃত্য মারীচ আর স্বামী বেণের সঙ্গে তিনিও গাভীর দুগ্ধ দোহন করেন, গবাদীপশুর যত্নও করেন। নিজেই দুগ্ধ উনুনে চড়িয়ে জ্বাল দেন। একদিন এই গৃহে দাসী ছিলেন বলেই তিনি এই সংসারের কাজের ধরন জানেন, কখন কী করতে হবে বোঝেন, কোনটা হংসপাদার পছন্দ আর কোনটা অপছন্দ তা তার নখদর্পণে। তারপরও তিনি হংসপাদাকে জিজ্ঞেস করেন কখন কী করতে হবে, তিনি দশটা প্রশ্ন করলে হংসপাদা হয়ত একটা প্রশ্নের উত্তর দেন। আবার কখনো বলেন, ‘তোমায় কিছু করতে হবে না, তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো।’

কেশিনী বোঝেন যে এটা হংসপাদার অভিমানের কথা। তাই হংসপাদা তাকে কোনো আদেশ না দিলেও তিনি পূর্বের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সংসারের কাজকর্ম করেন। কেশিনী পৃথু আর অর্চিকেও স্নেহ করেন। পৃথুর সঙ্গে তার বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, পিতা বেণের নির্দেশে পৃথু তাকে ছোটমাতা বলে ডাকে। কিন্তু অর্চি তাকে মাতা বলে ডাকে না। একদিন মধ্যাহ্নে কেশিনী অর্চিকে নিজের হাতে আহার করিয়ে দিতে চাইলে অর্চি বলে, ‘আমি তোমার হাতে আহার করব না, তুমি কালো, তুমি কুৎসিত, তোমার হাতে আহার করলে পাপ হয়।’
সাত বৎসরের বালিকার মুখে এমন কথা শুনে কষ্ট পান কেশিনী, আড়ালে কাঁদেনও। কিন্তু অর্চির ওপরে তার কোনো রাগ বা অভিমান হয় না, কেননা তিনি জানেন যে অর্চি অবুঝ বালিকা, বড়দের মুখে সে যা শুনেছে তাই বলেছে, তার কোনো দোষ নেই।

কেশিনীও মনে মনে পণ করেছেন, সুব্যবহার আর কর্মদক্ষতার মাধ্যমে তিনি এই বাটীর সকলের মন জয় করেই ছাড়বেন।

মতঙ্গ প্রথম প্রথম নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে আপন মহিমায় বেরিয়ে আসে। সদা প্রাণোচ্ছল এক কিশোর সে, নিষাদপল্লীতে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় বেড়ে উঠেছে। সমবয়সীদের মধ্যে সে ছিল মধ্যমণি, সারাদিন সখাদের সঙ্গে খেলাধুলা করত, নদী থেকে মৎস্য আর অরণ্য থেকে খরগোশ শিকার করত, শাখামৃগের ন্যায় বৃক্ষ থেকে ফল সংগ্রহ করত, আর করত সীমাহীন দুষ্টুমী, এজন্য সে মাতার হাতে মাঝে মাঝে প্রহারও খেত। প্রহার থেকে তাকে রক্ষা করতেন দাদু ধনদ। ধনদ তাকে খুব স্নেহ করতেন, তার দুষ্টুমী উপভোগ করতেন, প্রশ্রয় দিতেন।

সবার সঙ্গে খুব সহজেই মিশতে পারে মতঙ্গ, পিতৃগৃহে আসার দু-দিন পরই সে হংসপাদাকে মাতা বলে ডাকতে শুরু করে, হংসপাদা সেই ডাকে সাড়া দিলেও দূরত্ব রাখতে একটা অদৃশ্য আগল দিয়ে রাখেন, কিন্তু পাগলাটে মতঙ্গ সেই আগল ভেঙে তার বড় মাতার হৃদয়ে স্থান পেতে চায়, সে হংসপাদার কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে বসে, এটা-সেটা আবদার করে, এমনকি কোলে মাথা রেখে শয়নও করে। তার এইসব পাগলামী দেখে হংসপাদা বাধ্য হন আগল সরাতে।

অঙ্গ গৃহত্যাগ করার পর থেকে সুনীথা পারতপক্ষে কারো সঙ্গে কথা বলেন না, আর কেশিনীর সঙ্গে তো নয়ই। বেশিরভাগ সময় নিজের শয্যায় বসে কিংবা শুয়ে থাকেন। হংসপাদা আহার সামগ্রী নিয়ে তার কক্ষে গিয়ে জোর করে খাওয়ান। স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ায় তিনি ব্যথিত, শোকাচ্ছন্ন; কিন্তু এজন্য তিনি পুত্র বেণকে দোষারোপ করেননি। স্বামীকে তিনি ভালোবসেন, কিন্তু পুত্রও যে তার অপত্য স্নেহের পুত্তলি। অনেক সাধনার ধন পুত্র তার। বিবাহের পর অনেক বৎসর নিঃসন্তান ছিলেন তিনি, অনেক চেষ্টা করেও সন্তান হচ্ছিল না। গোত্র-প্রধানের স্ত্রী, অথচ নিঃসন্তান! মানুষ আড়ালে নানা কথা বলত, সে-সব কথা কানে এলে আরো বেশি কষ্ট পেতেন তিনি। মনঃকষ্টে একবার স্বামীকে দ্বিতীয় বিবাহ করার কথাও বলেন, কিন্তু অঙ্গ আর বিবাহ করতে চাননি। সন্তান না হওয়ায় অঙ্গ’র মনেও কষ্ট ছিল। গোত্রের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই প্রশ্ন উঠেছিল যে- একজন নিঃসন্তান মানুষ কেন গোত্র-প্রধান থাকবেন? ঋষিদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনোভাবের কথা দেবতাদের কানেও পৌঁছেছিল। হয়তবা সেই সময় দেবতারাও অঙ্গকে গোত্র-প্রধান রাখার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন, কেননা এই সময়েই অঙ্গ একবার অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞের দিন সকাল থেকেই ঋত্ত্বিকগণের মন্ত্রে মুখরিত হয়ে ওঠে অঙ্গ’র আঙিনা, নানা দিক থেকে আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ-ঋষি এবং অন্যান্য গোত্রের অতিথিগণ আসেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। কিন্তু এত ঘটা করে যজ্ঞ করলেও সেই যজ্ঞে অনুপস্থিত থাকেন দেবগণ। যথাসময়ে দেবগণকে নিমন্ত্রণ জানানো হয় এবং যথানিয়মে ইন্দ্র ও অগ্নিকে যজ্ঞ উৎসর্গ করা হলেও তারা কিংবা তাদের কোনো প্রনিনিধি এসে যজ্ঞভাগ গ্রহণ না করায় অঙ্গ চিন্তিত হয়ে পড়েন। যজ্ঞের কারণে তিনি মৌনাবলম্বন করছিলেন, মৌনতা ভেঙে ঋত্ত্বিকদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বিপ্র, দেবগণ যজ্ঞভাগ গ্রহণ করলেন না, যজ্ঞের আয়োজনে কোনো ত্রুটি আছে কি?’

একজন প্রবীণ ঋত্ত্বিক বলেন, ‘না গোত্রপতি, যজ্ঞের হবিঃসকলে কোনো ত্রুটি নেই, আপনি শ্রদ্ধাপূর্বক সকল দ্রব্যসামগ্রীই আহরণ করেছেন। দেবতাদের প্রতি কোনো প্রকার অবহেলা করা হয়নি, তবু কেন তারা স্বয়ং যজ্ঞস্থলে এসে কিংবা তাদের কোনো প্রতিনিধি পাঠিয়ে যজ্ঞের ভাগ গ্রহণ করলেন না, তা বুঝতে পারছি না।’

অঙ্গ আবার বলেন, ‘যথাবিধি নিমন্ত্রিত, পূজিত এবং আহূত হয়েও দেবগণ এই যজ্ঞে এলেন না, জানি না অজান্তে আমি কোনো অপরাধ করেছি কি না!’

একজন মধ্যবয়সী ঋষি বলেন, ‘গোত্রপতি, আমি যতটুকু জানি আপনি দেবগণের পছন্দের মানুষ। কিন্তু আমি শুনেছি যে, একটা ব্যাপারে আপনাকে নিয়ে দেবগণের মধ্যে অস্বস্তি আছে, যেটা নিয়ে মানবরাও কানাঘুষা করে।’
অঙ্গ কৌতুহলী চোখে তাকান ঋষির দিকে, ‘কোন ব্যাপারে মুনিবর?’

‘হয়ত নিজের অজ্ঞাতে আপনি এমন কোনো পাপ করেছেন, যে কারণে আপনি নিঃসন্তান। এই ব্যাপারেই দেবগণ এবং মানবদের মধ্যে অস্বস্তি আছে। হতে পারে যে একারণেই দেবপতি এবং অগ্নিদেব আপনার উৎসর্গিত যজ্ঞের আহুতি গ্রহণ করলেন না।’

অঙ্গ ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকেন ঋষির দিকে, মানবদের মধ্যে যে তার সন্তান না হওয়া নিয়ে কানাঘুষা হয় তা তিনি জানেন। এবার দেবগণও তা নিয়ে ভাবছেন? তবে কি দেবগণ তাকে গোত্রপতির পদ থেকে সরিয়ে দেবেন?

ঋষি আবার বলেন, ‘যাতে আপনার পুত্র লাভ হয় সেই চেষ্টা করুন গোত্রপতি, তাতে আপনার এবং আপনার পরিবারের কল্যাণ হবে।’
‘সন্তান লাভের জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি মুনিবর, কিন্তু ঈশ্বর আমার দিকে মুখ তুলে চাইছেন না।’

‘আপনি হয়ত অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু পুত্রেষ্টী যজ্ঞ করেননি। আপনি বিষ্ণুকে উৎসর্গ করে পুত্রেষ্টী যজ্ঞ করুন। আমার ধারণা বিষ্ণুর আশির্বাদে আপনি সন্তান লাভ করবেন।’
‘বেশ, আমি দেবতা বিষ্ণুর উদ্দেশে পুত্রেষ্টী যজ্ঞ করব।’

অঙ্গ একদিকে ঋত্ত্বিকগণকে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন করতে বলেন আর অন্যদিকে দুজন ঋষিকে স্বর্গে পাঠান যজ্ঞে বিষ্ণুকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য, যাতে বিষ্ণু সশরীরে এসে তাকে উৎসর্গিত যজ্ঞের আহুতি গ্রহণ করেন। তিন সপ্তাহ পর ঋষি দুজন বিষ্ণুকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলে যজ্ঞানুষ্ঠান করা হয়। অঙ্গ প্রভাতে সরস্বতী নদীতে স্নান করে এসে নতুন বস্ত্র পরিধান করে যজ্ঞস্থলে গিয়ে তার জন্য নির্ধারিত আসনে উপবেশন করেন হোমকুণ্ড সামনে রেখে। হোমকুণ্ডের একদিকে অঙ্গ আর অন্যদিকে উচ্চ আসনে উপবেশন করেন দীর্ঘদেহী সুদর্শন বিষ্ণু। বিষ্ণুর উর্ধাঙ্গ অনাবৃত, পরনে বাস, গলায় রক্তিম পদ্মপুষ্পের মাল্য, চন্দনসজ্জিত কপাল। ঋত্ত্বিকগণ যজ্ঞ শুরু করেন, ঘৃতস্নাত বিল্বপত্র হোমকুণ্ডে নিক্ষেপ করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকেন। বিষ্ণুর উদ্দেশে যজ্ঞের পুরোডাশ আহুতি দেওয়া হয়। যজ্ঞ শেষে বিষ্ণু একটি পায়েসপূর্ণ মৃৎপাত্র অঙ্গ’র হাতে তুলে দেন। অঙ্গ সেই পায়েসের পাত্র হাতে নিয়ে পা বাড়ান গৃহের উদ্দেশ্যে।

এদিকে যজ্ঞ চলাকালীন সময়ে সুনীথা গৃহে উপবেশন করে করজোড়ে মনে মনে বিষ্ণুর কাছে প্রার্থণা করেন, ‘হে বিষ্ণু, আমি আপনাতেই আমায় সমর্পণ করেছি, নিজের অজ্ঞাতে কোনো পাপ করে থাকলে আমায় ক্ষমা করে দিন, আমায় একটি পুত্র সন্তান দিন। বংশ রক্ষা করুন। আমি আজীবন আপনাতেই আমার অন্তর সমর্পণ করে রাখব।’

পায়েসপূর্ণ পাত্র হাতে স্বামীকে গৃহে প্রবেশ করতে দেখে উঠে দাঁড়ান সুনীথা। প্রথমে স্বামীকে প্রণাম করেন, তারপর স্বামীর হাত থেকে পায়েসের পাত্র নিয়ে আসনে উপবেশন করে পরম শ্রদ্ধাভরে পায়েস আহার করেন।

যজ্ঞাগ্নি নিভে যায়, হোমের সমাপ্তি হলেও পুত্রেষ্টি যজ্ঞের অন্তিমকার্য তখনো বাকি, যা শুরু হয় সূর্য ডুবে যাবার পর চরাচরে অন্ধকার নেমে এলে, তখন গৃহাভ্যন্তরে শয্যায় একা উপবিষ্ট সুনীথা, মুখে তার তখনো যেন পায়েসের স্বাদ লেগে। কারো পায়ের শব্দ পেয়ে গৃহের দ্বারের দিকে তাকান তিনি, অন্ধকারে একটি অবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসে, তিনি চোখ বন্ধ করেন, পরক্ষণেই দুটি শক্ত হাত তার দুই কাঁধ স্পর্শ করে, একটু কেঁপে ওঠেন তিনি, শরীর শিরশির করে, নাকে ভেসে আসে পদ্মপুষ্পের সুগন্ধ। একটি হাত স্পর্শ করে তার চিবুক, নতমুখ তুলে ধরে। তপ্ত নিশ্বাসের ঝাপটা লাগে তার চোখে-মুখে, জিহ্বায় নোনা স্বাদ অনুভূত হয়। হাত দুটি তার শরীর থেকে পরিচ্ছদ খুলে ফেলে তাকে শুইয়ে দেয় শয্যায়। পুত্র কামনায় তিনি নিজেকে শপে দেন পুত্রেষ্টি যজ্ঞের অন্তিমকার্য সাধনে, পুত্রেষ্টি যজ্ঞের অগ্নি জ্বলে দেহকুণ্ডে, নিভে যায় অগ্নি, আবার জ্বলে, আবার নেভে! পদ্মপুষ্পের পাপড়ি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে থাকে তার কেশরাশিতে, অঙ্গে আর শয্যায়। পুত্রেষ্টী যজ্ঞের অন্তিমকার্য তাকে ক্লান্ত করে, অবসন্ন করে, তবু তিনি সঙ্গ দিয়ে যান যজ্ঞকার্যে পুত্রের জননী হবার তীব্র বাসনায়। গভীর রাত্রে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের অন্তিমকার্য শেষে অবয়ব শয্যা থেকে নেমে ভূমিতে দাঁড়িয়ে তার কপালে চুম্বন করে মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করেন, ‘আশির্বাদ করি, তুমি পুত্রবতী হও।’

তারপর অবয়বটি যেমনি এসেছিল, তেমনি চলে যায় গৃহ ত্যাগ করে। সুনীথা পুত্রের স্বপ্নে বিভোর হয়ে শয্যায় শয়ন করে এপাশ-ওপাশ করতে থাকেন, ভালোলাগার আবেশে তার দু-চোখে নিদ্রা আসতে চায় না, তারপর ভোরের দিকে কখন যেন নিদ্রায় নিমজ্জিত হন তা নিজেও বুঝতে পারেন না, নিদ্রা ভঙ্গ হয় প্রভাতে পাখ-পাখালির কলতানে। শয্যা থেকে উঠে সরস্বতী নদীতে গিয়ে স্নান করেন। নয় মাস আঠারো দিন পর তিনি পুত্রের জন্ম দেন, নাম রাখেন- বেণ।

সেই সাধনার ধন বেণের কারণেই তার স্বামী অঙ্গ নিরুদ্দেশ হয়েছে, তবু তিনি সেই স্নেহের পুত্তলি বেণকে ভালোবাসেন, বেণ তার নয়নের মণি, তাকে তিনি কী করে অভিসম্পাত করবেন!


(চলবে.....)

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:০৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×