somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- বাইশ)

২৭ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উনিশ


‘এই খেদ মোর মনে,
ভালোবেসে মিটল না আশ কুলাল না এ জীবনে।
হায়! জীবন এত ছোট কেনে,
এ ভুবনে?’

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসে ঝুমুর দলের শিল্পী বসনকে ভালোবেসে এই গান বেঁধেছিল কবিয়াল নিতাইচরণ। পৃথিবীতে জন্ম নেবার এত বছর পরে, জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমারও একইরকম উপলব্ধি হলো।

সে-রাতের জ্যোৎস্না উৎসবে আমি যখন আলপনাকে বললাম, ‘আমাদের জীবনে কি আবার হলুদ রাঙা বসন্তদিন আসতে পারে না?’ তখন আলপনা কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থাকার পর আমার প্রস্তাব ভেবে দেখার জন্য কিছুদিন সময় চাইলেন। এর তিনদিন পরই আমরা গোধূলিবাড়িবাসীরা ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে গেলাম। আমাদের মন যাতে ভালো থাকে, সে-জন্য বছরে অন্তত দু-বার ভ্রমণের ব্যবস্থা করে বাঁধন। ভ্রমণের খরচের জন্য ওর বন্ধু-বান্ধব এবং পরিচিত কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেয়।

১২,৪০৯ একর আয়তনের বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান। ২২১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। আমরা দলবেঁধে উদ্যানের নানা জায়গায় ঘুরতে লাগলাম। উদ্ভিদ দেখার চোখের আরাম, চিত্তের শান্তি এখানে পাওয়া যায়। আমি প্রাণভরে নানা প্রকার বৃক্ষ এবং লতাগুল্মে চোখ বুলাতে থাকলাম, হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম। ক্লান্ত হয়ে কেউ কেউ বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ছিল বসে বিশ্রাম নেবার জন্য। তবে সবাইকেই বলা ছিল- যে যেখানেই থাকুক দুপুর দুইটায় সবাই বাসের কাছে চলে আসবে মধ্যাহ্নভোজের জন্য। বাঁধন আর ইয়াসিন ভাই দুটো ক্যামেরায় আমাদের এই ভ্রমণ ভিডিও করছিল ইউটিউবে দেবার জন্য।
চলতে চলতে একসময় আমি আর আলপনা অনেকটা পিছিয়ে পড়লাম। লেকের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় আলপনা বললেন, ‘চলুন, একটু বসি, পায়ে আর কুলোচ্ছে না।’

বললাম, ‘আমারও পা টনটন করছে, বসলে মন্দ হয় না।’

লেকের ওপর তৈরি একটা ছাউনির নিচের বেঞ্চে পাশাপাশি বসলাম আমরা। বিচিত্র সব পাখির ডাক আমাদের কানে বাজতে লাগল। বাতাসে ভেসে আসতে থাকল লতাগুল্মের গন্ধ। আমরা নানা বিষয়ে গল্প করতে লাগলাম। আমাদের দল থেকে তখন আমরা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। এরই মধ্যে উড়ে আসা কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। খানিক পর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও শুরু হলো। দলের সবার কথা ভাবছিলাম আমরা, ওরা আবার ভিজে না যায়! আলপনা বললেন, ‘নিশ্চয় ওদিকে কোথাও আশ্রয় নেবে।’

এক সময় আমি আলপনাকে বললাম, ‘আমার প্রস্তাবটি ভেবে কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন?’

আলপনা আমার মুখের দিকে তাকালেন। তাকিয়েই রইলেন, আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করলাম তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি তার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললাম, ‘কী ভাবছেন?’
‘ভাবছি, মানুষের বয়স বাড়ে, দেহের কাঠামোর পরিবর্তন হয়, চুল পেকে যায়, কিন্তু মনটা তরুণই থেকে যায়, বাসনার বয়স বাড়ে না।’
‘এটাই তো প্রাণিজগতের স্বাভাবিক নিয়ম।’ আমি বললাম।
‘প্রাণিজগতের মধ্যে কেবল মানুষই হয়ত এই স্বাভাবিক নিয়মের পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছে, বিশেষত আমাদের এই উপমহাদেশের মানুষ! এই করা যাবে না, সেই করা যাবে না, ওটা করলে বদনাম হবে, লোকলজ্জায় মুখ দেখানো যাবে না, নানা অনুশাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ আমাদের এই প্রাচ্য সমাজ।’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’

আলপনা আবার বললেন, ‘এই যে আমাদের দেশে আমাদেরই মতো লক্ষ লক্ষ বয়স্ক মানুষ আছেন, অনেকের স্বামী নেই, অনেকের স্ত্রী নেই, এরা অবশিষ্ট জীবন একাই কাটিয়ে দিচ্ছেন। এদের কি আবার সঙ্গী কিংবা সঙ্গীনির সঙ্গ পাবার ইচ্ছে করে না? অনেকেরই নিশ্চয় করে। কিন্তু এরা সমাজের কথা ভেবে, সন্তানদের কথা ভেবে, নিজের বাসনাকে নিজের ভেতরেই গুম করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয় ভালো থাকার অভিনয় করে।’

‘আমরাও কি ভালো থাকার অভিনয় করে বাকি জীবন পার করে দেব?’

আলপনা আবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, মুখ টিপে মৃদু হাসলেন, তারপর আমার ডান হাতখানি নিজের দু-হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে গাইলেন অতুলসংগীত-
‘কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে?
হৃদি মোর উঠল কাঁপি চরণের সেই রণনে।।’

আমার হাতখানি নিজের কপালে-গালে ছোঁয়ালেন। তার অশ্রুতে সিক্ত হলো আমার হাত। সত্যি বলতে কী কিশোরের বুকের অনুরণন হলো আমার বুকের মধ্যে, পাবার আনন্দে আমারও চোখ ভিজে উঠল। আর নিতাইয়ের কথাগুলোই তখন বেজে উঠল মনের মধ্যে, ‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবনে?’

জাহানারাকে হারানোর পর আমার মনে হয়েছিল- হায়, জীবন এত বড় কেন? একটা মানুষ জীবনে যদি সুখকর কোনো কিছুই না পায়, কেবলই নিরানন্দ জীবন যাপন করে, তাহলে তার জীবন এত বড় হয়ে লাভ কী! বঞ্চিত জীবনে দুঃখের পলি জমে জমে হৃদয় যে কেবলই পাথর হয়ে ওঠে, আর সেই পাথর মাড়িয়ে পথ চলে অনেকে! বেঁচে থাকতে ভীষণ কষ্ট হয়।

তারপর কেটে গেছে জীবনের বহু বছর, নিজের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করে গেছি। মৃত্যু নিয়ে কখনও দুশ্চিন্তা করিনি, ভয়ও পাইনি, ভেবেছি মৃত্যু যখন হবার হবে। কিন্তু জীবনের এই গোধূলিবেলায় এসে আলপনার ভালোবাসা পেয়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেল আমার। তিহাত্তরে বুড়ো আমি, মৃত্যু যে-কোনো সময়ই হতে পারে। কিন্তু আমি বাঁচতে চাই, আরও অনেক বছর বাঁচতে চাই। আলপনার হাত ধরে পাহাড়-সমুদ্রে ঘুরতে যেতে চাই, আলপনার কোলে মাথা রেখে অজস্র পূর্ণিমার জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে চাই। আবার পান করতে চাই জীবনের যত অমৃতসুধা, পূর্ণ করতে চাই অপ্রাপ্ত যত বাসনা। মনে হলো জরা-ব্যাধি-মৃত্যুকে বলি- দূর হও হতচ্ছাড়ার দল, আগামী এক হাজার বছর আমাকে স্পর্শ করতে এসো না!

বেশ জোরেই বৃষ্টি শুরু হলো। লেকের জলে বৃষ্টির ফোঁটা সশব্দে ফুটতে লাগল খইয়ের মতো! আলপনা আমার বাহু ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘আসুক আরো জোরে বৃষ্টি। আমরা এভাবেই বসে থাকি সারাটা দুপুর।’

আমি আলপনার কাঁধে হাত রেখে, মাথায় মাথা ঠেকিয়ে আবৃত্তি করলাম-
‘চলো, এই বাদলের দিনে
ভুলে থাকি দুঃখ-ব্যথা সব
এই বাদলের দিনে হোক
তোমার-আমার ভালোবাসার উৎসব!’

আলপনা আমার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘তুমি ওই কবিতাটা আবৃত্তি করো।’
‘কোন কবিতাটা?’
‘ওই যে- চলো প্রিয়, আজ আমরা একটা কিছু হই।’

আমি আবৃত্তি শুরু করলাম-
‘এই সরলরেখার মতো জীবন
আর ভালো লাগে না আমার,
চলো প্রিয়, আজ আমরা বক্ররেখা হই!

চলো, বসন্তের বাউরি বাতাস হয়ে
রবিশস্যের ক্ষেতে বিলি কাটি,
বনে বনে পাতায় পাতায় তুলি মূর্ছনা
কিশোরের ঘুড়ি শূন্যে ভাসিয়ে রাখি।

আর না হয় বাউকুড়ানি হই
ধুলো আর ঝরাপাতা উড়াই
উড়াই কাগজের টুকরো, পলিথিন
পাখির পালক, আরও কত কী।
যা দেখে মানুষেরা জন্ম দেবে অলৌকিক সব আখ্যান!
যদি ঝড় হতে চাও, তাতেও আপত্তি নেই আমার
শীতের একঘেয়ে শান্ত বৃষ্টির মতো জীবনে
ঝড়ের বৈচিত্র্য নিশ্চয় মন্দ লাগবে না।

চলো প্রিয়, এবেলায় রোদ্দু হই, অবেলায় বৃষ্টি
আপনা-আপনি সুখের রঙধনু উঠবে আকাশে!

চলো প্রিয়, আজ আমরা একটা কিছু হই।’



(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:৩৫
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজামী, মুজাহিদ, বেগম জিয়াও বিজয় দিবস পালন করেছিলো!!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২০



মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম জিয়ার মুরগী মগজে এই যুদ্ধ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না; বেগম জিয়া বিশ্বাস করতো না যে, বাংগালীরা পাকীদের মতো শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার থেকে

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×