একুশ
পৌষের শীতের সকালে প্রতিদিনের মতোই যখন আমার ঘুম ভাঙলো, তখন টিনের চালায় গাছের পাতা থেকে টপ টপ করে শিশিরের ফোঁটা পড়ার শব্দ হচ্ছে আর বেণুদির ভৈরবী রাগের সুর ভেসে আসছে কানে। শরীরের ওপর থেকে লেপ সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে সোয়েটার গায়ে দিলাম, ট্রাউজার পরলাম, কেডস পায়ে দিলাম। বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম অনেকেই উঠে পড়েছেন, কেউ দাঁত ব্রাশ করছেন, কেউ বেঞ্চে বসে আছেন। বাইরে বেশ কুয়াশা আর হালকা উত্তরে হাওয়া। প্রথমে পুকুরপাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ প্রাতঃভ্রমণ করলাম, তারপর মাঠে হারুন ভাইয়ের নেতৃত্বে শরীরচর্চা শেষে ঘরে এসে দেখি পরান বাউল তখনও ঘুমিয়ে আছে। সে সাধারণত আমার চেয়ে পরে ঘুম থেকে ওঠে, রাত জাগতে ভালোবাসে, তাই দেরিতে ঘুমায়, ওঠেও পরে। তাই বলে এতটা বেলা পর্যন্ত তো ঘুমায় না। আমাদের শরীরচর্চা যখন শেষের পথে, তখন সে পুকুরপাড়ে গিয়ে হাঁটে আর গুনগুন করে গান গায়। আমাদের মতো সে শরীরচর্চা করে না। বললাম, ‘বাউল, ওঠোনি যে, শরীর খারাপ করেছে?’
উত্তর দিল না। শরীর খারাপ করলো কিনা তা দেখার জন্য ওর মুখের ওপর থেকে লেপটা সরিয়ে কপালে হাত রাখতেই আমি চমকে গেলাম, বরফের মতো ঠান্ডা শরীর! গায়ের লেপ সরিয়ে হাত ধরলাম, শক্ত হাত, পালসের ওঠা-নামা নেই, বুঝলাম পরানে পরান নেই! শীতের সকাল, তবু আমি ঘামতে শুরু করলাম যেন! কখন চলে গেল পরান? সারারাত পাশাপাশি দুটো বিছানায় দু’জন মানুষ ঘুমালাম। একজন মানুষ এই পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে গেল, অথচ আমি কিছু টেরই পেলাম না! আহারে সাধের জীবন, যত্নে গড়া শরীরটাকে খড়-কুটোর মতো ফেলে কেমন করে ফাঁকি দিয়ে পালায়!
আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল, ঘোরগ্রস্তের মতো বারান্দায় গিয়ে দুঃসংবাদটা জানাতেই সবাই ছুটে এলো। কেউ কেউ কাঁদতে লাগল। আমি নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। পরান বাউলের মৃত্যুর কথা শোনামাত্র বাঁধন ঢাকা থেকে রওনা হয়ে গেল। আর এদিকে চলতে লাগল দাফনের আয়োজন। বাঁধন এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদল, পরানকে ও খুব ভালোবাসতো।
পরান বাউলকে হারিয়ে আমি সত্যি সত্যিই ভাই হারানোর শোক পেলাম, পরম বন্ধু হারানোর শোক পেলাম। আমার নিজের আপন ভাইদের সঙ্গেও আমার এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না, যেটা ছিল পরান বাউলের সঙ্গে।
পরান বাউল আমার সামনে বাউল দর্শনের মতো এক বিস্ময় জগত উন্মোচন করেছে, এ জগতের গভীরে ঢোকার সাধ্য বা ক্ষমতা আমার নেই, আমি যতটুকু দেখেছি আর জেনেছি তা হয়ত অনেকটা দূর থেকে ধুমকেতু ও নক্ষত্ররাজি দেখার মতোই! তবু দেখেছি, জেনেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। এমন অহিংস দর্শনই তো আমাদের চাই, যা অহিংস মানুষ-সমাজ তৈরি করবে। দর্শন বা মতবাদ শত-সহস্র হোক তাতে অসুবিধা নেই, সব দর্শন বা মতবাদ যদি বাউল দর্শনের মতো অহিংস হয়, তবে মানব সমাজে হানাহানি-সহিংসতা হ্রাস পাবে। মানুষের দুঃখও অনেকটা লাঘব হবে। পরান বাউলকে দেখেই আমার প্রথম উপলব্ধি হয় যে সারাজীবন আমি লোভ-লালসা, রাগ-ক্ষোভে ভরা সংসারে কী এক জীবন কাটালাম, এর চেয়ে বাউল হলেই বুঝি জীবনটা আরও বেশি সমৃদ্ধ হতো।
পরান বাউলের মৃত্যুতে গোধূলিবাড়ির সবাই শোকগ্রস্ত। স্তম্ভিত। আমরা কেউ নীরবে অশ্রু বিসর্জন করলাম, কেউ কেউ হাউমাউ করে কাঁদলেন। এই প্রথম এখানে কারো চিরবিদায় ঘটলো। আমরা সবাই বুড়ো-বুড়ি। এভাবেই একজন একজন করে চলে যাব। তাই যাওয়ার শুরুটা চিরবৈরাগ্য পরান বাউলই করে দিয়ে গেল! পরান বাউলের দাফন সম্পন্ন হলো পাশের একটি কবরস্থানে। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে রয়ে গেল পরান বাউল, আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে রয়ে গেল পরান বাউলের গাওয়া বেশ কিছু গান।
পরান বাউলের বিছানাটা শূন্য পড়ে থাকে। দেয়ালে ঝুলে থাকে নিঃসঙ্গ দোতারাটা। মাঝে মাঝে দোতারাটা হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করি। তারে আঙুল বুলাই, বেতালে বেজে ওঠে দোতারা। আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কানে কেবলই বাজে পরান বাউলের কণ্ঠের সুর। যে রাতে চোখে ঘুম আসত না, বিছানায় শুয়ে পরান বাউলকে বলতাম, ‘বাউল, গাইবা নাকি একটা গান?’
অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়েই পরান গান গাইত। কোনোদিন দুজনে উঠে চলে যেতাম পুকুরপাড়ের চাঙায়, গান-গল্পে অতিবাহিত করতাম সময়। বিছানায় শুয়ে শুয়েও কত গল্প করতাম দুজনে, গল্প করতে করতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার সেই প্রাণসখা পরান বাউল আর নেই, তার জন্য প্রাণ বড় কাঁদে।
(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




