somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- চব্বিশ)

৩০ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একুশ

পৌষের শীতের সকালে প্রতিদিনের মতোই যখন আমার ঘুম ভাঙলো, তখন টিনের চালায় গাছের পাতা থেকে টপ টপ করে শিশিরের ফোঁটা পড়ার শব্দ হচ্ছে আর বেণুদির ভৈরবী রাগের সুর ভেসে আসছে কানে। শরীরের ওপর থেকে লেপ সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে সোয়েটার গায়ে দিলাম, ট্রাউজার পরলাম, কেডস পায়ে দিলাম। বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম অনেকেই উঠে পড়েছেন, কেউ দাঁত ব্রাশ করছেন, কেউ বেঞ্চে বসে আছেন। বাইরে বেশ কুয়াশা আর হালকা উত্তরে হাওয়া। প্রথমে পুকুরপাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ প্রাতঃভ্রমণ করলাম, তারপর মাঠে হারুন ভাইয়ের নেতৃত্বে শরীরচর্চা শেষে ঘরে এসে দেখি পরান বাউল তখনও ঘুমিয়ে আছে। সে সাধারণত আমার চেয়ে পরে ঘুম থেকে ওঠে, রাত জাগতে ভালোবাসে, তাই দেরিতে ঘুমায়, ওঠেও পরে। তাই বলে এতটা বেলা পর্যন্ত তো ঘুমায় না। আমাদের শরীরচর্চা যখন শেষের পথে, তখন সে পুকুরপাড়ে গিয়ে হাঁটে আর গুনগুন করে গান গায়। আমাদের মতো সে শরীরচর্চা করে না। বললাম, ‘বাউল, ওঠোনি যে, শরীর খারাপ করেছে?’

উত্তর দিল না। শরীর খারাপ করলো কিনা তা দেখার জন্য ওর মুখের ওপর থেকে লেপটা সরিয়ে কপালে হাত রাখতেই আমি চমকে গেলাম, বরফের মতো ঠান্ডা শরীর! গায়ের লেপ সরিয়ে হাত ধরলাম, শক্ত হাত, পালসের ওঠা-নামা নেই, বুঝলাম পরানে পরান নেই! শীতের সকাল, তবু আমি ঘামতে শুরু করলাম যেন! কখন চলে গেল পরান? সারারাত পাশাপাশি দুটো বিছানায় দু’জন মানুষ ঘুমালাম। একজন মানুষ এই পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে গেল, অথচ আমি কিছু টেরই পেলাম না! আহারে সাধের জীবন, যত্নে গড়া শরীরটাকে খড়-কুটোর মতো ফেলে কেমন করে ফাঁকি দিয়ে পালায়!

আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল, ঘোরগ্রস্তের মতো বারান্দায় গিয়ে দুঃসংবাদটা জানাতেই সবাই ছুটে এলো। কেউ কেউ কাঁদতে লাগল। আমি নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। পরান বাউলের মৃত্যুর কথা শোনামাত্র বাঁধন ঢাকা থেকে রওনা হয়ে গেল। আর এদিকে চলতে লাগল দাফনের আয়োজন। বাঁধন এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদল, পরানকে ও খুব ভালোবাসতো।

পরান বাউলকে হারিয়ে আমি সত্যি সত্যিই ভাই হারানোর শোক পেলাম, পরম বন্ধু হারানোর শোক পেলাম। আমার নিজের আপন ভাইদের সঙ্গেও আমার এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না, যেটা ছিল পরান বাউলের সঙ্গে।

পরান বাউল আমার সামনে বাউল দর্শনের মতো এক বিস্ময় জগত উন্মোচন করেছে, এ জগতের গভীরে ঢোকার সাধ্য বা ক্ষমতা আমার নেই, আমি যতটুকু দেখেছি আর জেনেছি তা হয়ত অনেকটা দূর থেকে ধুমকেতু ও নক্ষত্ররাজি দেখার মতোই! তবু দেখেছি, জেনেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। এমন অহিংস দর্শনই তো আমাদের চাই, যা অহিংস মানুষ-সমাজ তৈরি করবে। দর্শন বা মতবাদ শত-সহস্র হোক তাতে অসুবিধা নেই, সব দর্শন বা মতবাদ যদি বাউল দর্শনের মতো অহিংস হয়, তবে মানব সমাজে হানাহানি-সহিংসতা হ্রাস পাবে। মানুষের দুঃখও অনেকটা লাঘব হবে। পরান বাউলকে দেখেই আমার প্রথম উপলব্ধি হয় যে সারাজীবন আমি লোভ-লালসা, রাগ-ক্ষোভে ভরা সংসারে কী এক জীবন কাটালাম, এর চেয়ে বাউল হলেই বুঝি জীবনটা আরও বেশি সমৃদ্ধ হতো।

পরান বাউলের মৃত্যুতে গোধূলিবাড়ির সবাই শোকগ্রস্ত। স্তম্ভিত। আমরা কেউ নীরবে অশ্রু বিসর্জন করলাম, কেউ কেউ হাউমাউ করে কাঁদলেন। এই প্রথম এখানে কারো চিরবিদায় ঘটলো। আমরা সবাই বুড়ো-বুড়ি। এভাবেই একজন একজন করে চলে যাব। তাই যাওয়ার শুরুটা চিরবৈরাগ্য পরান বাউলই করে দিয়ে গেল! পরান বাউলের দাফন সম্পন্ন হলো পাশের একটি কবরস্থানে। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে রয়ে গেল পরান বাউল, আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে রয়ে গেল পরান বাউলের গাওয়া বেশ কিছু গান।

পরান বাউলের বিছানাটা শূন্য পড়ে থাকে। দেয়ালে ঝুলে থাকে নিঃসঙ্গ দোতারাটা। মাঝে মাঝে দোতারাটা হাতে নিয়ে নাড়া-চাড়া করি। তারে আঙুল বুলাই, বেতালে বেজে ওঠে দোতারা। আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কানে কেবলই বাজে পরান বাউলের কণ্ঠের সুর। যে রাতে চোখে ঘুম আসত না, বিছানায় শুয়ে পরান বাউলকে বলতাম, ‘বাউল, গাইবা নাকি একটা গান?’

অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়েই পরান গান গাইত। কোনোদিন দুজনে উঠে চলে যেতাম পুকুরপাড়ের চাঙায়, গান-গল্পে অতিবাহিত করতাম সময়। বিছানায় শুয়ে শুয়েও কত গল্প করতাম দুজনে, গল্প করতে করতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার সেই প্রাণসখা পরান বাউল আর নেই, তার জন্য প্রাণ বড় কাঁদে।



(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:০০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×